তোমাকে দিইনি আংটি
তোমাকে দিইনি আংটি, বাগদত্তা ছিলে না আমার
কোনোকালে, গোধূলিতে তুমি লাজরক্তিম যেদিন
বসবে উৎসব হয়ে বিবাহমন্ডপে, সঙ্গীহীন
থাকবো বিনিদ্র ঘরে চুপচাপ, যেমন খামার
পুড়ে গেলে নিঃস্ব চাষী বসে থাকে হা-হা শূন্যতায়।
ছিলো না আমার অধিকার কোনোদিন পুষ্পাকুল
উদ্যানে তোমার, শুধু স্বপ্নের ভিতরে কিছু ফুল
তুলেছি বাগান থেকে মাতাল আঙুলে, বলা যায়।
যখন রঙিন পথে হেঁটে যাবে তুমি যৌবনের
সৌরভ ছড়িয়ে, পদস্পর্শে হবে চূর্ণ ছন্নছাড়া
কবির নিটোল স্বপ্ন; ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত লেবাস
পড়বে তোমার চোখে। দাঁতে-ছেঁড়ে সে-বেশ বরের
নয়; ছিলো যার, তাকে পশুপাল করে তাড়া
রাত্রিদিন, সঙ্গী তার কংকাল-কর্কশ সর্বনাশ।
তোমাকে ভাবছি
তোমাকে ভাবছি আমি, যেমন আঁধার কুঠুরিতে
ফাঁসির কয়েদি ভাবে সকালের আরক্ত প্রতিমা
অত্যন্ত একাকী বসে উৎকন্ঠিত অন্তিম নিশীথে।
এখন কোথায় তুমি? এখন তুমি কি মধুরিমা
ছড়িয়ে তোমার আশপাশে আছো শবগন্ধময়
কোনো বন্ধ ঘরে কিংবা কান পেতে শুনছো কেবলই
কবর খোঁড়ার শব্দ? ভাবছি তোমার চক্ষুদ্বয়,
কেশপাশ, স্তনচূড়া, স্মৃতিজ্বলা সুগন্ধি ত্রিবলী।
তোমার হাতের দিকে আমার দুবাহু ছুটে যায়।
তোমার চোখের দিকে আমার দুচোখ উন্মীলিত,
তোমার ওষ্ঠের প্রতি আমার তৃষিত ওষ্ঠধায়
সারাক্ষণ, আমার হৃদয় শোনে প্রহরে প্রহরে
তোমারই নিভৃত পদধ্বনি। আর আমি সদা ভীত,
কেননা চৌদিকে হিংস্রজিহ্বা শিকারী কুকুর ঘোরে।
তোমার কি মনে পড়ে
তোমার কি মনে পড়ে দিবপ্রহরে নিরিবিলি ঘরে
কতদিন কাটিয়েছি ভালোবেসে কিছুটা সময়
পরস্পর, কী আমরা বলেছি তখন, ঘরময়
কেমন সৌরভ ছিলো মৃদু তোমার কি মনে পড়ে?
তোমার দু’চোখে দৃষ্টি মেলে দিয়ে কী স্নিগ্ধ নির্ঝরে
মিটিয়ে প্রখর তৃষ্ণা পুনরায় পেয়েছি অভয়
দুঃসময়ে; ভুলে গেছি কে অর্জুজ কেই বা সঞ্জয়
সর্বগত্রাসী দাবানলে, দিকচিহ্নলোপকারী ঝড়ে।
ঝড়ের পরেও দেখি আমরা দুজন মুখোমুখি
বসে আছি, জীবনের বন্দনায় স্পন্দিত এবং
নিজেরাই হয়ে গেছি গান, বিভ্রান্তির কালো রঙ
মুছে গেছে সত্তা থেকে, মনে হয়। এখন দাঁড়াবো
সুস্থির জমিনে তুমি আর আমি হবো দীপ্র সুখী।
ফের ভাবি-কেন বেঁচে আছি, কেনই বা মরে যাবো?
তোমার কিসের তাড়া ছিলো
(মনসুর আহমদ স্মরণে)
তোমার কিসের তাড়া ছিলো অত? কেন তুমি সাত
তাড়াতাড়ি এই গুলজার আড্ডা থেকে গুডবাই
বলে চলে গেলে, কেন? হায় করমর্দন বিনাই
নিয়েছো বিদায়, যেন গূঢ় অভিমানে অকস্মাৎ।
না, অমন করে যেতে নেই নিভিয়ে পূর্ণিমা-রাত,
চেয়ার নিঝুম করে টলটলে গ্লাস ফেলে, ছাই,
ঠান্ডা না হতেই ত্র্যাশাক্ট্রেতে। চাই, তোমাকেই চাই,
বলে যে ব্যাকুল ডাকে, তারও হাতে রাখলে না হাত।
এখন কোথায় তুমি ঝর্নাতলে নির্মোহ, একেলা
মুখ রাখো? কাদের আসরে খুব মেতে থাকো, বলো?
আমরা কজন আজো, তুমিহীন, বসি এখানেই-
তক্কে-গপ্পে গানে-পানে জমে ওঠে কিছু সন্ধ্যেবেলা।
হঠাৎ তোমাকে দেখি! ভাবি, যদি যাই, ছলোছলো
দুটি চোখে বলবে কি কেউ, না, অমন করে যেতে নেই?
তোমার পুরোনো ছবি দেখে
কে তুমি কে তুমি বলে আমার হৃদয় হ’য়ে যায়
আরক্ত চিৎকার এক। সেই বেলফুল ফুটে আছে
চুলের চুড়ায় আজো কী প্রফুল্ল। রাগমালা নাচে
সতত অস্তিত্বময়, একটি নিমেষ স্তব্ধতায়
হয়ে গেছে চিরকাল। অনেক দুরের নিরালায়
যে ফাল্গুনে মধ্যরাতে দরবারী কানাড়ার কাছে
সমর্পিতা, তার চক্ষুদ্বয়ে স্মৃতির মন্তাজ বাঁচে,
না কি সে নিজেই স্মৃতি অনেক মনের নীলিমায়!
তোমার পুরোনো ছবি দেখে ভাবি, সত্যি এই তুমি
সে-তুমির কাছ থেকে কতদূরে এসে আজ একা
আঁধারে দাঁড়িয়ে আছো; পারাপার কোথায় বিলীন;
আশ্রয় আঁধিতে লুপ্ত, দারুণ বিরূপ এই ভূমি।
কখনো আবার, কথা ছিলো, আমাদের হবে দেখা-
এসেছি দুর্যোগে তাই তোমার কাছেই দ্বিধাহীন।
তোমার সান্নিধ্যে
তোমার সান্নিধ্যে আমি, হা কপাল, কখনো পারি না
ছুটে যেতে ইচ্ছেমতো। অথচ আমার মধ্যে রোজ
একটি ঈগল দূর তোমার আসমানের খোঁজ
নেয়ার তৃষ্ণায় ডানা ঝাপটায়। হায়, মনোলীনা
কী করে হৃদয় পাবো বলো তোমার শরীর বিনা?
প্রত্যহ সযত্নে তুমি চুল বাঁধো, কারো সাজগোজে,
এখন তা-নয় কিছুতেই আমার দৃষ্টির ভোজ।
পড়ে আছি রুক্ষ একা, সঙ্গী শুধু মর্চে-পড়া বাণী।
তুমি কি এখনো আসবে না? শিরাপুঞ্জে বাজাবে না
মত্ত মঞ্জীরের ধ্বনি? সে কোন্ দ্বিধার বেড়াজাল
ঘিরেছে তোমাকে আজ? কোন্ ভীতি কুন্ডলী পাকায়
পথে পথে? মনে কি পড়ে না একজন, চিরচেনা,
তিমির-শংকিল রাতে একাকিনী দূর শাল তাল
তমালের বনে গ্যাছে বারংবার প্রেমের ডেরায়?
দন্ডিত মানুষ
দন্ডিত মানুষ আমি, বসে আছি একা অন্ধকারে
গৃহকোণে মুখ ঢেকে। চৌদিকে কবন্ধদল নাচে
উন্মাতাল, কী আমার অপরাধ? কবিতার কাছে
মানুষ হয়েছি বলে সুন্দরের স্তবে বারে বারে
তন্ময় হয়েছি বলে আমি আজ বীভৎস ভাগাড়ে
কাটাবো প্রহর শুধু নরমুন্ডময় শীর্ণ গাছে
দৃষ্টি রেখে সর্বক্ষণ? প্রকৃতির আনাচে-কানাচে
ওড়ে শ্মশানের ছাই, বসে আছি দীপ্ত অহংকারে।
স্বেচ্ছায় নিয়েছি দন্ড, কাউকে দিই না তাই দোষ।
যে যা চাইবে আজ সবই দিতে পারি নির্দ্বিধায়
আমার উরুর মাংস তাল তাল কিংবা কর্ণমূল
এবং রাখতে পারি হাত তীব্র মোমের শিখায়।
সর্বদা উপেক্ষা করে ডাকিনীর প্রেতের আক্রোশ
শ্মশানেও কালেভদ্রে ঝরে যায় শেফালি, বকুল।