ঝুলন্ত রেস্তেতারাঁ
কেউ কেউ দ্যাখে দূর নীলিমায় ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ।
কেউ কেউ সিঁড়িহীন সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় আর
প্রবাল-চেয়ারে বসে। এঞ্জেলের উজ্জ্বল পাখার
মতন টেবিলে আছে এটা সেটা আর মেঝে-জোড়া
অভ্রের কার্পেট। একদিন অপরাহ্নে আনকোরা
স্বপ্ন নিয়ে সেখানে ছিলাম আমরা, তুমি আর আমি-
আমার অধীর ওষ্ঠে চুম্বনে ছড়ালে অস্তগামী
সূর্যের সৌন্দর্য তুমি। ছিলো চাদ্দিকে নৈঃশব্দ্যে মোড়া।
নীলিমায়বৃত সে রেস্তোরাঁয় কিছুক্ষণ পরে, শোনো,
হে দয়িতা, তুমি ছাড়া আর কিছুই পড়েনি চোখে;
সর্বব্যাপী শূন্যতায় তোমার গহন চক্ষুদ্বয়
যেন বা যমজ দ্বীপ-আমার নিবাস দুঃখ-শোকে
এবং আনন্দে চিরদিন। অকস্মাৎ কী-যে হয়
কাক-তাড়ুয়ার তীক্ষ্ম হাসি বুকে বাজে ঘন ঘন।
টেলিফোন
প্রত্যহ সকাল সন্ধ্যা বসে থাকি তীব্র প্রতীক্ষায়,
বস্তুত অপেক্ষমাণ আমার নিজস্ব গৃহকোণ
সারা দিনমান, কান পেতে থাকি, হয়তো টেলিফোন
এখুনি উঠবে বেজে ঘরময় কালো স্তব্ধাতায়।
নিবদ্ধ আমার দৃষ্টি শাদা ধূসর খরগোশ-প্রায়
যন্ত্রটির গায়ে, ওর এই অন্ধ নীরবতা মন
মেনে নিতে চায় না কিছুতে। বুঝি তাই সারাক্ষণ
বলো কিছু বলো, বলে চেঁচাই শব্দের সাহারায়।
টেলিফোন হার্দ্য বেজে উঠলেই হয়তো কোন্ দূর
দেশ থেকে (নাবিকের গান-ঝলসিত দ্বীপ?) ভেসে
আসবে, ঝরবে হৃদয়ের কানে তোমার মধুর
কণ্ঠস্বর, নিরন্তর মনে হয় স্তব্ধ মধ্যরাতে
এইতো উঠেছে বেজে, টেলিফোন আমার উদ্দেশে,
কিন্তু ভুল শুনি আর কষ্ট পাই নিঃশব্দ সংঘাতে।
তখনই হঠাৎ
তোমার সান্নিধ্যে কিছুকাল অলৌকিক সরোবরে
কেটেছি সাঁতার, অকস্মাৎ শেষ হলো জলকেলি,
যেমন কেবল আলাপেই সাঙ্গ করেন সঙ্গীত
কোনো গুণী কী খেয়ালে। জানতাম, বিদায়ের পালা
আসবেই একদিন হৃদয়ে ছড়িয়ে রাশি রাশি
তেজস্ক্রিয় ছাই, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ঘটে যাবে
ভয়ংকর অবসান, কখনো ভাবিনি আগে। তুমি
কিংবা আমি কেউ নয় দায়ভাগী এমন সংকটে।
যা ঘটেছে কে জানে প্রকৃতপক্ষে তার বিষবীজ
আমাদের অগোচরে আমরা দুজনই পরস্পর
করেছি রোপণ কিনা অসতর্কভাবে? চতুর্দিকে
দৃষ্টি-অন্ধ-করা ঝড়, বেনো জলে লুপ্ত সাঁকো আর
নিরাশ্রয় মৃত পাখি ভাসমান। যখন তোমাকে
আমার সবচে বেশি প্রয়োজন, তখনই হঠাৎ চলে গেলে।
তরুণ কবির প্রতি
সবুরে ফসবে মেওয়া, না ফসলেও নেই ক্ষতি।
তুমি শুধু মাথা নীচু করে রোজ তোমার টেবিলে
উপবাসী সিদ্ধার্থের মতো স্থির হও; দূর নীলে
তোমার দখন থাক চিরকাল, কলমের গতি,
মনে রেখো, যেন রুদ্ধ না হয় কখনো। যদি নতি
সহজে স্বীকার করো ক্ষমাহীন শব্দের নিখিলে,
যদি না বন্ধন ছিঁড়ে আনো নব্য মায়া ছন্দে মিলে,
তাহলে বলবে লোকে এ-কবির কাব্যে নেই মতি!
কিছুই হলো না বলে করো না আক্ষেপ কোনোদিন
হে বন্ধু তুমিতো জানো জীবনানন্দের পায়ে পায়ে
ঘোরেনি ফ্যাশনদীপ্র লাস্যময়ী ললনার ঝাঁক
ভুলেও কখনো কিংবা নিজের ভবন দ্বিধাহীন
দেননি নির্জন্সে কবিকে ছেড়ে আলৌকিক দায়ে
ঐশ্বর্যশালিনী কেউ। তাই বলি, ক্ষোভ মুছে যাক।
তারও মন
নদীর উর্মিল বেগ পেশীতে পেশীতে; প্রতিদিন,
ছুটিছাটা বাদে, নিয়মমাফিক যায় কারখানায়
এবং কলের পাকে স্বেদসিক্ত ঘুরপাক খায়-
যেমন দেখেছি ফিল্ম-এ মজাদার চার্লি চ্যাপলিন
ঘুর্ণ্যমান, চক্রাকারে হয়ে যান নিজেই মেশিন।
বাজলে ছুটির বাঁশি ফ্যাক্টরি-গহ্বর ছেড়ে ছুড়ে
ক্লান্ত, ভারি পায়ে চলে আসে পথে, সে খিস্তি খেউড়ে
মাতে চা-খানায় দোস্তে-ইয়ারের সাথে শান্তিহীন।
মনের ভেতরে মন ডুব দেয় তারও স্মিত নীলে
মেশে সত্তা; কী উদার তৃণভূমি, ঘন বনস্থলী,
কী করে যে, বোঝে না সে, জেগে ওঠে শূন্য আশেপাশে।
দ্যাখে, অকস্মাৎ শাদা হাতি দলে দলে ধেয়ে আসে
তারই দিকে; কবন্ধের কালো হাটে চলে নরবলি।
রূপোলি পানের বাটা, শিরস্ত্রাণ হলুদ টেবিলে।
তিরিশ বছর
তোমার কথাই ভাবি রাত্রিদিন; পল, অনুপল
তোমার মুখের রেখা, চক্ষুদ্বয়, অধর, চিবুক
চুলের অসিত ঝর্না, স্বর্গের স্বপ্নের মতো বুক
মনে পড়ে। তোমাকেই ভাবি, যেমন কল্পানাজ্জ্বোল
কবি ভাবে কাব্যের শরীর তার লেখার টেবিলে,
কোনো গ্রন্থপাঠের মুহুর্তে, খেতে বসে, ফুটপাতে
হাঁটতে হাঁটতে, বিছানায় দারুণ বিনিদ্র রাতে-
সর্বদাই ব্যেপে আছো তুমি আমার হৃদয় নীলে।
ভাবিনি তোমাকে পাবো সাতচল্লিশের সীমানায়
অকস্মাৎ ভাবিনি যখন আমি রুক্ষ, ধূ-ধূ এই
পথে বড়ো দিশেহারা, তৃষ্ণায় কাতর, তুমি এসে
আমার আঁজলা ভরে দেবে ফোয়ারায় দিনশেষে।
তোমার আসার কথা ছিলো জানি অনেক আগেই,
তিরিশ বছর আমি ছিলাম তোমারই প্রতীক্ষায়।
তুমি তো এসেই বললে
তুমিতো এসেই বললে, এখন আমাকে যেতে হবে।
সরে না আমার মুখে কথা, শুধু আর্ত মনে ভাবি-
পুষ্পাকুল বসন্তের কাছে শ্রান্ত হেমন্তের দাবি
কতটুকু? তোমার উপস্থিতির সুস্মিত বিভবে
আমার যে একরত্তি অধিকার নেই, জেনেছি তা
অনেক আগেই, জানি নিশ্চিত তোমাকে অবশেষে
যেতে দিতে হবে, হবে ছেড়ে দিতে শীঘ্র ম্লান হেসে,
তবু জ্বেলে বসে আছি সত্তাময় লেলিহান চিতা।
বীতপুষ্প যে বাগান ছিলো পড়ে এক কোণে, যার
হৃতস্বাস্থ্য শুক্নো ডালে কোনো পাখি বহুকাল গান
গায়নি তন্ময়, তাকে পুনরায় বসন্ত-বিহ্বল
করেছো সে কোন্ খামখেয়ালে হে প্রতিমা আমার?
মিলন মুহূর্ত শুরু না হতেই দৃশ্যাবলি করে ছল ছল,
বিচ্ছেদ সকলই স্তদ্ধ, কেবল হৃদয় স্পন্দমান।