কুয়াশায় নিমীলিত
নিজের ঘরের দেয়ালের কানে চাপা কণ্ঠস্বরে
প্রার্থী হই অতিশয় দীন কোনো ব্যক্তির মতন।
কী-যে চাই তার কাছে নতজানু যখন তখন
ব্যর্থতার খোয়ারি-ঠেকানো যত কাঙাল প্রহরে
জানি না, কেবল হৃদয়ের চোখ থেকে রক্ত ঝরে।
দুবাহু এগিয়ে যায় দেয়ালের দিকে, মায়াবন
ইট-বালি ফুড়ে জেগে ওঠে, তোমার যুগল স্তন
স্বপ্নিল চোখের মতো উন্মীলিত সিমেন্টের স্তরে।
তোমার স্তনাভা দেয়ালের কাছে নিয়ত আমাকে
নিয়ে যায়, বিশেষত মধ্যরাতে। কখনো কখনো,
মনে হয়, দেয়াল তোমার শরীরের দীপ্ত ত্বক।
অন্ধতার চেয়েও অধিক তমসায় স্বপ্ন থাকে
পড়ে ঘরময়, যেন ভাঙা বাবুইয়ের বাসা, ঘন
কুয়াশায় নিমীলিত আকাঙ্ক্ষার সমাধি-ফলক।
কোথায় মনের মুক্তি
কোথায় মনের মুক্তি? বহুদূর জনহীন দ্বীপে
অথবা পর্বতশৃঙ্গে, বিশাল অরণ্যে নাকি ধুধু
প্রান্তরের মধ্যপথে? নিসর্গের খুব কাছাকাছি
গেছি বার-বার, মনে লেগেছে উদার হাওয়া আর
আমার সমগ্র সত্তা হয়েছে সবুজ, লাল নীল
ফিরোজা বেগনি, হলদে ঋতুতে ঋতুতে। কখনোবা
গ্রন্থের অক্ষরদ্বীপে ক্রূশোর মতন হেঁটে হেঁটে
পেয়ে গেছি কী উম্মুক্ত অনাক্রমণীয় বাসভূমি।
কখনো আবার কোন নান্দনিক চেতনায় ভাবি
শিল্পেই মনের মুক্তি। বুঝি তাই যেখানে তুলির
সখ্য আর মোহন যুগলবন্দী বাটালি ছেনীর
যেখানে সংগীত হয় অন্দ্রধনু বিস্তারে বিস্তারে
সেখানেই স্বস্তি খুঁজি। আবার কখনো মনে হয়
প্রকৃত মনের মুক্তি দয়িতার সান্নিধ্যে বিস্তৃত।
কোথায় শিউলিতলা
কোথায় শিউলিতলা, সেই কবেকার ভোরবেলা-
যখন কুড়িয়ে ফুল, পেরিয়ে শিশিরভেজা পথ
বসতে পুকুর ঘাটে, দৃষ্টি মেলে দিতে তুমি দূর
বহুদূর বনানীর দিকে অথবা সাঁতার কেটে
কাটতো তোমার বেলা কারো কথা ভেবে নিরালায়?
কোথায় সে তন্বী যার বুকে গোলাপের অব্যর্থ উন্মেষ?
কোথায় সে প্রতিবাদী তরুণ যে ছিলো সর্বক্ষণ
তোমার হৃদয় জুড়ে অনিন্দ্য স্বপ্নিল অশ্বারোহী?
যেও না অতীতে ফিরে, এখন ফেলো না দীর্ঘশ্বাস
অতিশয় কালদগ্ধ শিউলিতলার কথা ভেবে।
এখন তোমার কানে একজন প্রৌঢ়ের আড়ালে
যে যুবা আবৃত্তি করে হৃদয়ের নতুন সংহিতা,
ফিরিয়ে দিও না তাকে, কেননা সে শিলীভূত বুকে
সহজে জাগাতে পারে পাথরগলানো প্রস্রবণ।
ক্ষেত
কী আমার দখলে রয়েছে? কোন্ জমি আজ
ফসলসজ্জিতু বলা যায়, আমারই এলাকা? কোন্
নদীতীর, সাঁকো কিংবা বালুচর, তমালের বন
আমার নিজের? সেই কবে দূরে সাধের জাহাজ
ভাসিয়েছিলাম, মনে পড়ে। মাঝিমাল্লাদের গান
যেখানে শোনেনি কেউ-লোনা ঢেউ, জলচর প্রাণী,
দ্বীপস্থিত বৃক্ষ, শ্যামা, কেউ- সেখানে সন্ধানী
দৃষ্টি মেলে, মনে হয়, ফলিয়েছি অলৌকিক ধান।
অথচ এখন, যতদূর চোখ যায়, দেখি শুধু
ফসলবিহীন মাঠ বুভূক্ষুর মতো করে ধু ধু।
তবে কি যথেষ্ট শ্রম করিনি কখনো? ফসলের
স্বপ্নই দেখেছি শুধু প্রতিদিন মোহন বিলাসে?
করিনি কর্ষণ অবিরত কিংবা নিজস্ব ক্ষেতের
পরাগাছা নিড়াইনি? তাই ক্ষেত ছেয়ে গ্যাছে ঘাসে?
খরার দুপুরে
একটি দোতলা ফ্ল্যাটে লকলকে খরার দুপুরে
কিঞ্চিৎ ছায়ার লোভে দেয় হানা। পয়লা বৈশাখে।
ছিলাম আমরা বসে মুখোমুখি নতুনের ডাকে
অনেকেই বহির্মুখী। বৈশাখী মেলায় যে রোদ্দুর
ছিলো, তারই আভা বুকে নিয়ে, বলো কতদূর
শৈশবের টলটলে পুকুর আমার বলে কাকে
তোমার দু’চোখে পাই, কী খেয়ালে তুমি স্তব্ধতাকে
হঠাৎ দুলিয়ে ফ্ল্যাটে হও পুরোনো গানের সুর।
যখন তোমার কণ্ঠে সাতটি সুরের উন্মীলন
চতুষ্পাশ্বে মায়া বোনে, আহত হরিণ শুশ্রূষায়
ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয় অরণ্যের তন্দ্রালু ঊষায়,
ভবঘুরে পুনরায় ফিরে পায় গার্হস্থ্য জীবন,
আমার অসুস্থ মন অমৃতের খর পিপাসায়
আতর্স্বরে করে উচ্চারণ-চাই ভিন্ন জাগরণ।
ঘুড়ি
ঘুড়ি বসবাস করে নিরিবিলি বিনীত দোকানে,
গৃহকোণে, খাটের নিভৃত নিচে, কিংবা খোলা ছাদে
চুপচাপ বালকের স্বপ্নের মতন নির্বিবাদে।
খয়েরী, সবুজ, হলদে, নীল ঘুড়ি সবখানে,
মানে শহরে ও গ্রামে মিশে রয় স্তব্ধতার গানে।
মাছ কিংবা পরীর মতন চোখ কী ফুল্ল আহ্লাদে
জেগে থাকে সর্বক্ষণ, নাকি অত্যন্ত নিঃশব্দ কাঁদে,
যখন মাটিতে থাকে। সর্বদা নীলিমা তাকে টানে।
বস্তুত মাটিতে নয় সে প্রকৃত ঘুড়ি; অতিদূরে
নীলিমায় হাওয়ায় হাওয়ায় যখন সে ওঠে দুলে,
আকাশের ঠোঁটে চুমো খায়, তখনই সৌন্দর্য তার
লীলায়িত খুব স্মরণীয়ভাবে, নকশা তার সুর
হয়, সুর নকশা, আর হোক যত দূরেই বিস্তার
স্পন্দিত বর্ণের, সুতো যেন থাকে সর্বদা আঙুলে।
জয়নূলী কাক
কখন মিটিঙ ভেঙে গ্যাছে, মিটে গ্যাছে বেচা-কেনা
সকল দোকানপাটে, ফলের বাজার শূন্য; ঘরে
ফিরি দীর্ঘ পথ হেঁটে একা-একা, বুকের ভেতরে
কী একটা কষ্টবোধ, ভিড়ে কাউকে যায় না চেনা।
পাঁশুটে জ্যোস্নায় দেখি মৃতের মিছিল। তাকাবে না
ফিরে ওরা, মনে হয়, কপ্সিমকালেও; চরাচরে
আর কোন টান নেই জেনেই বুঝি বা এ শহরে
নির্বিকার হেঁটে চলে, দেবে না চুকিয়ে কোনো দেনা।
পাঁশুটে জ্যোৎস্নায় অকস্মাৎ ডানা-ঝাপটানি, ডাক
শোনা যায়; এক দুই, তিন, সংখ্যাহীন পক্ষী এসে
ছাদের কার্নিশে, ফুটপাতে আর রিক্ত রেস্তোরাঁয়
বসে; ওরা তৃষাতুর, মানুষের মগজের নিভৃত প্রদেশে
প্রবেশ করতে চায়। যেন ওরা জয়নুলী কাক,
বিংশ শতাব্দীর কবিতার মতো গূঢ় ডেকে যায়।