ক-এর আঙুল থেকে
ক-এর আঙুল থেকে একটি কী পথ বহুদূরে
গ্যাছে বেঁকে চিত্রবৎ, বৃক্ষশ্রেণী যেন দেবদূত,
পৃথিবীর নিসর্গের বন্দনায় কেমন নিখুঁত
সৌন্দর্যে এসেছে নেমে আসমান থেকে নম্র উড়ে।
ক-এর ওষ্ঠের তটে তৃষ্ণার্ত হরিণ ঘুরে ঘুরে
ফিরে যায় বারংবার জলকষ্টে, হিংস্র পদচ্ছাপ
চোখের নিচের বালিয়াড়ি ধরে রাখে, হলদে সাপ,
কেবলি দলতে থাকে সাবলীল তার গলা জুড়ে।
সে পথের কাছে আজ ক-এর কী বলার আছে?
পথ বড় উদাসীন, নিশ্চুপ সর্বদা। তার ভাষা
বুঝলেও কখনো দেবো না সাড়া; ক-এর মুখের
ভেতরে আদিম জলপরী এবং কিন্নরী নাচে,
পাঁজর-প্রান্তরে বুকভাঙা ডাক ঘোড় সওয়ারের।
সে-পথ রাখে না মনে কারো চলে-যাওয়া,ফিরে-আসা।
কত পদচ্ছাপ
হয়তো হবে না দেখা আমাদের কোনোদিন আর,
কোনোদিন শুনবো না রাত্রিময় ঝর্নার মতন
কণ্ঠস্বর তার রাখবো না হাতে হাত, শুধু মন
প্রখর থাকবে চেয়ে তারই দিকে, যে আমার
উদ্যান বিরান করে চলে গ্যাছে; স্নিগ্ধ মল্লিকার
বাহার এখানে নেই, গাছের কংকাল সারাক্ষণ
ভীষণ কঠোর দৃষ্টি হানে, এ কেমন নির্বাসন
ব’লে পাখি হয়ে যায় এক রাশ মৃত শাদা হাড়।
এখনো দরজা খুলে প্রতিদিন ঘরে ঢুকি, রাখি
স্যুইচ আঙুল, আলো ফেটে পড়ে, শুই; বিছানায়
কারো ছায়া কাঁপে যেন। ক্লান্ত মনে কখনো আলাপ
জুড়ি দেয়ালের সঙ্গে, কখনো বা দান্তে কী একাকী
হেঁটে যান আমার নিবাস ছুঁয়ে শ্রাবণ ধারায়,
এবং বৃষ্টিতে ডোবে গলি, ঘর, কত পদচ্ছাপ।
কবি
শহরে হৈ হল্লা দৈনন্দিন, যানবাহনের ঢল
পথে পথে, দিকে দিকে ফুৎকার, চিৎকার, চলে স্মার্ট
নাটক শিল্পিত স্টেজে, হোটেলে স্বপ্নিল কনসার্ট;
মেলায় নাগরদোলা, ডুগডুগি, বানরের দল।
হঠাৎ এলেন ভিনদেশী মল্লবীর, দৃপ্তবল;
সমস্ত শহর ঘোরে তার পায়ে পায়ে সারাক্ষণ,
পুষ্পবৃষ্টি চতুর্দিকে; মন্ত্রমুগ্ধ জনসাধারণ।
নতুন সার্কাস পার্টি ফেলে তাঁবু, নগর চঞ্চল।
বস্তুত চৌদিকে লাফালাফি, লোফালুফি, ক্ষিপ্র
কেনাবেচা; ম্যাজিক ম্যাজিক বলে কেউ পোড়া ঘাসে
বেজায় লুটিয়ে পড়ে, কারো কণ্ঠে ফানুস ফানুস
ধ্বনি বাজে। চলেছেন একজন একলা মানুষ
সবার অলক্ষ্যে জনাকীর্ণ পথে আস্তে সুস্থে দীপ্র
শব্দের গুঞ্জনে পূর্ণ যেন বা হাঁটেন পরবাসে।
কবিতার মৃত্যুশোক
আমিতো অজস্র কবিতার মৃত্যুশোক পুষে রাখি,
মৃত্যুশোককালীন আঁধারে নির্বিকার ফেরেস্তারা
দ্যাখেন আমার মদ্যপান। মদিরার স্বচ্ছ ধারা
আমার ভেতরে বয়ে গেলে পর নিজেকে একাকী,
ব্যথিত একাকী লাগে আরো, চুপচাপ বসে থাকি,
কখনো চড়িয়ে গলা এলেবেলে কথা বলি, যারা
আশপাশে থাকে, তারা নিজেরাও নয় বাক্যহারা;
আমার চোখের ভুল দ্যুতিতে কেউবা পড়ে ফাঁকি।
কবিতার মৃত্যুশোক ফিকে হলে নিভৃত টেবিলে
কাগজ কলম নিয়ে বসি। অকস্মাৎ চোখে স্মৃতি
ভেসে ওঠে, যেন শান্ত জলের উপরিভাগে সদ্য
মৃত মাছ। কখনো আমার অস্তিত্বের গূঢ় নীলে
খৃষ্টপূর্ব সভ্যতার মতো কিছু প্রবল প্রতীতি
নিয়ে জেগে উঠতে চায়, বুঝি ওরা অলৌকিক পদ্ম।
কর্ণমূল থেকে খুলে
কর্ণমূল থেকে খুলে যে ফুল আমাকে দিয়েছিলে
একঘর অতিথির দৃষ্টি থেকে দূরে বারান্দায়,
এখনো সুগন্ধ তার জীবিত আমার চেতনায়।
যখন নিমগ্ন থাকি ফাইলের ধূসর নিখিলে,
অথবা কাজের ফাঁকে চোখ রাখি আকাশের নীলে,
উড়ন্ত পাখির প্রতি, অকস্মাৎ মনে পড়ে যায়
তোমার সে পুষ্পদান কোলাহলময় নিরালায়
এবং সুরভি মিলে থাকে মধ্যমিলে, অন্ত্যমিলে।
সে ফুলে শুকিয়ে গেছে, কে জানে কোথায় আগোচরে
এক ফোঁটা হাহাকার হয়ে আজ হয়েছে বিলীন।
মাঝে মাঝে মধ্যরাতে কোনো একজন চক্ষুহীন
মুখ নিয়ে এসে আস্তে দাঁড়ায় খাটের পাশে, বলে
প্রেতের মতন স্বরে, দারুণ বিরূপ ঝড়জলে
তোমাদের প্রেমদীপ্ত তৃষিত হৃদয়ও যাবে ঝরে।
কাল সারারাত
কাল সারারাত আমি কবিতার সঙ্গে অতিশয়
লুত্কা লত্কা করে কাটিয়ে দিয়েছি। বাতি জ্বেলে
দেখেছি উত্তুঙ্গ স্তন, নাভিমূল শ্রোণী; লজ্জা ফেলে
স্খলিত শাড়ির মতো কবিতা আমাকে, মনে হয়,
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছিলো কাল। মন জয়
করতে পেরে তার চতুর্দশপদী আর ভিলানেলে
আনন্দ পেয়েছি ঢের। হৃদয়ের তন্তুজাল ঠেলে
এখনো কবিতা এসে আমাকে করছে ছন্দোময়
একটি কি দুটি নয়, বহু কবিতায় আজ ভোরে
আমার পকেট ভর্তি, যেন নিয়ে উৎসবী আবেগ
ঘরের ভেতরে, বারান্দায় আমার হৃদয় নাচে।
এসব কবিতা আমি কণ্ঠস্বরে কিছু রাঙা মেঘ
ঢেলে দিয়ে তোমাকে শোনাতে চাই আজ প্রাণ ভরে
এক্ষুনি সবার আগে, অথচ তুমিই নেই কাছে।
কী কঠিন কাজ
একজন মহিলাকে বহুদিন থেকে ভালোবেসে
চলেছি, যেমন মাঝি নিয়মিত নৌকো বেয়ে যায়
অনুকূল আবহাওয়া কিংবা ঝড়জলে। সে কোথায়
কী রকমভাবে থাকে কেমন বিরূপ পরিবেশে,
সেকথা কী করে বলি? আমি কবিতার মতো ভেসে
বেড়াই শহরে একা। আমার এ হৃদয়ের জলে
মহিলাটা পা ধুলে আনন্দ পাই অতিশয়; ফলে
ক্ষণে ক্ষণে বারোয়ারী বিদ্রুপ তাচ্ছিল্য করি হেসে।
দেহ মন দিয়ে ভালোবাসি তাকে, যদিও শরীর
ছেড়ে ছেড়ে সে মহিলা মনের কথাই বলে বেশি
গোপনে আমার কাছে, নক্ষত্রের কাছে কী নিবিড়
অনুভবে। এ গহন বর্ষণের রাতে জানি আজ
সে ঘুমিয়ে আছে একাকিনী বিছানায় এলোকেশী-
বুঝেছি এরূপ ভালোবেসে যাওয়া কী কঠিন কাজ!