একটি অনুপস্থিতি
পৃথিবী এখনো খুব সজীব সুন্দর ভোরবেলা
নতুন মাছের মতো কেলিপরায়ণ, নীলাকাশে
সারস প্রফুল্ল ওড়ে, ঝিলে নামে নিভৃত আশ্বাসে
তৃষ্ণার্ত কোমল প্রাণী বনপ্রান্তে পথিক একেলা
হেঁটে যায়, গেরস্থের উঠোনে শিশুর রাঙা খেলা
জমে অপরাহ্নে রোজ। নিশুত নিশীথে স্বপ্ন আসে
পরাবাস্তবের হরিণের মতো স্মৃতির আভাসে,
ছাদের কার্নিশে একা পাখি ডাকে গভীর সুরেলা।
পৃথিবী আনন্দময় বস্তুত এখনো। সুর কাটে
মাঝে মধ্যে, তবু এক দীপ্তিমান উল্লসিত সুর
বয়ে যায় সবখানে। শুধু আমি মানুষের হাটে
একাকী বিষণ্ণ ঘুরি এবং যখন যেখানেই
যাই, সত্তা জুড়ে বাজে সর্বক্ষণ আর্ত অশ্বক্ষুর,
কেননা আমার বিশ্বে আজ আর সে নেই, সে নেই।
একটি আশ্চর্য মুখ
একটি আশ্চর্য মুখ দেখি আমি স্বপ্নের প্রহরে
মাঝে-মাঝে; সেই একই মুখ নীল সমুদ্রের পানি
থেকে জেগে ওঠে, সিক্ত ওষ্ঠে তার গূঢ় ঝলকানি
হাসির, কখনো দেখি সে রয়েছে ঘুমের ভেতরে
পথপার্শ্বে একাকিনী কোনো এক প্রাচীন শহরে।
অজ্ঞাত শিল্পীর ক্ষিপ্র ছেনী তাকে রহস্যের রানী
রূপে কবে করেছে নির্মাণ; চোখে কী গভীর বাণী
নিয়ে চেয়ে থাকে শুধু নিষ্পলক নিস্পন্দ পাথরে!
আশ্চর্য সে-মুখ বুঝি কেউ খৃষ্টপূর্ব জগতের।
ঘুম ভেঙে গেলে ভাবি তারই কথা, ছন্দিত পাথুরে
তার অবয়ব বারবার ভেসে ওঠে দৃষ্টিপথে।
পুনরায় নীল সমুদ্রের ঢেউ তাকে দেবে ছুঁড়ে
আমায় সত্তার তটে? মনে হয়, স্বপ্নের জগতে
দেখা সেই মুখ যেন প্রতিচ্ছায়া তোমারই মুখের।
একটি বাগান
নিশ্চয় তোমার মনে আছে একটি বাগান তুমি
আর আমি খুব গোপনীয়তায় সাজিয়েছিলাম
রঙ বেরঙের ফুলে। ইচ্ছে করে বাগানের নাম
রাখিনি আমরা, শুধু গড়েছি সুন্দর পুষ্পভূমি
পানি ঢেলে চারার শিকড়ে তুলে ফেলে পরগাছা
অগণিত। সে বাগানে নানা পাখি দ্বিধাহীন এসে
শুনিয়েছে গান আমাদের, কী মধুর সুর ভেসে
গেছে দূরে কোথাও, শিখেছি কাকে বলে তীব্র বাঁচা।
অথচ বসন্তদিনে চলে গেলে তুমি অকস্মাৎ
কাটিয়ে সকল মায়া বাগানের। ঝরে যাচ্ছে ফুল
যত্নের অভাবে, ক্রমাগত বেড়ে ওঠে বুনো ঘাস,
আমি আর কত পারি একা একা? দিন যায়, রাত
আসে, তুমি আসো না এখানে ছিঁড়ে যায় মর্মমূল
এবং বাগানময় বয় শুধু প্রেতের নিশ্বাস।
একটি বাদামি ঘোড়া
একটি বাদামি ঘোড়া সঙ্গীহীন অপরাহ্নে এসে
পড়েছে চওড়া পথে শহরের। মাংসের ভিতর
তার জীবনের মর্মমূল যেন করে থরথর
অবিরত; ট্রাফিক দ্বীপের ঘাস গাঢ় স্বপ্নাবেশে
খাচ্ছে সে নিঝুম আস্তে সুস্থে, প্রায় তার ল্যাজ ঘেঁষে
একটি মোটরকার ছুটে যায় অকস্মাৎ খর
গতিতে এবং দূরে একজন বামন লজঝড়
গাড়ি ঠেলে কোত্থেকে আওয়াজ আসে ভেসে সর্বনেশে।
এসব কিছুই তাকে, ঘোড়াটাকে, করে না বিব্রত।
পথের আক্রোশ, চোরা আঘাত অথবা পুলিশের
বাঁশি, যানবাহনের প্রতি সীমাহীন উদাসীন
সারাক্ষণ, মাঝে মাঝে চোখ তুলে এখানে কিসের
ডামাডোল দেখে নিতে চায় কিছু। বুঝি সে প্রাচীন
শাপভ্রষ্ট গ্রীক দেব, আগন্তুক ভ্রান্তিবশত।
এমন উল্লেখযোগ্যভাবে
যেন নিশীথের ওষ্ঠ থেকে ঝরে গূঢ় শব্দাবলি
সাবলীল, যেন খুব সুদূরের জ্যোৎস্নাছায়া মেখে
চকিতে এসেছে ওরা নিরিবিলি গাঢ় চুমো এঁকে
দিতে রুক্ষ একাকীত্বে আমার এবং স্বপ্ন-পলি
ক্রমশ গড়বে বেভে সত্তাতটে। এ কার অঞ্জলি
আমার সম্মুখে এলো রাত্রিময় নিরুদ্দেশ থেকে
এমন উল্লেখযোগ্যভাবে নিজেকে রহস্যে ঢেকে?
আমাকে ছুঁয়েছে কণ্ঠস্বর, আমি কী তন্ময় জ্বলি।
আমার নিকটে নেই সেই রুপময়ী অবয়ব,
নিষ্ঠুর পাখির মতো রাত্রি রূষ্টি চঞ্চুর আঘাতে
আমাকে করেছে ক্ষতবিক্ষত কেবলই; আমি তারই
মুখরেখা ভেবে ভেবে প্রহর কাটাই, শূন্য হাতে
পড়ে থাকি বড়ো একা, সেই মোহিনীর করি স্তব
এবং উঠোনে দেখি স্বপ্নপ্রায় চাঁপারঙ শাড়ি।
ওফেলিয়ার গান
শরীরে আমার সারদ জ্যোৎস্না বুনেছে কী মায়া
ভরা আঠারোয়া। শরীর আমার বসন্ত রাগ,
এখনো সজীব হৃদয়ের ফুলে কোনো কালো নাগ
দেয়নি ছড়িয়ে কৃষ্ণ জহর। তবে কিছু ছায়া,
অশুভই বটে, চেনা মানুষের ছন্দিত কায়া
ধ’রে ঘোরে এই আঁধার দুর্গে? রক্তের দাগ
দুর্গ প্রাকারে বেঁধেছে জমাট। তুমিও বেহাগ
গাইছো কুমার, আমি নিরুপায় অসিদ্ধ জায়া!
কোথায় উধাও মেঘ-টলোটলো স্নিগ্ধ শ্রাবণ?
উটের পিঠের মতন দূরের মেঘতরঙ্গে
বাজে না তো আর জলতরঙ্গ। বলো, এ কেমন
ব্যাভার তোমার? ভুল হত্যার দূর নিশিডাক
তোমাকে ঘোরায় পথে-প্রান্তরে; স্বপ্নভঙ্গে
দেখি উড়ে আসে জলজ কবরে দোয়েলের ঝাঁক।
ক এখন
ক এখন একা-একা প্রতিদিন ঘুরছে শহরে।
ফুটপাত ত্র্যাভেনিউ, বিপনী-বিতান, অলিগলি-
কিছুই পড়ে না বাদ। কোন অলৌকিক বনস্থলী
দিয়েছিলো গূঢ় ডাক মধ্যরাতে, তার মনে পড়ে
মাঝে-মধ্যে। ক এখন প্রায়শ আপনকার ঘরে
থাকে না, বসে না চুপচাপ। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছুড়ে
হাঁটে, শুধু একা, যেতে চায় দ্রুত বহুদূরে।
শহর থাকুক পড়ে, ক এখন বলে রুক্ষ স্বরে।
যতই এগিয়ে যায়, তত সে বিরূপ শহরেই
কী আশ্চর্য, ঘুরপাক খায় এবং নিজেকে তার
বড় অসহায় লাগে, বুকে ভয়ঙ্কর ধূলিঝড়,
জব্দ বীণা, মৃত সিংহ। কখনো হারিয়ে ফেলে খেই
চিন্তার, একাকী থাকে পড়ে রিক্ত ঢিবির ওপর-
যেন সে তুখোড় বিক্রেতার হাতে স্তিমিত শিকার।