আমার প্রতিদ্বন্দ্বী
একজন খর্বকায় মানুষ নিস্তব্ধ সন্ধ্যেবেলা
পড়ছে নামাজ কী তন্ময়। মনে হয়, সে এখন
অনেক অনেক দূরে শাল তাল অর্জুনের বন
পেরিয়ে সমুদ্রে এক ভাসিয়েছে নিরঞ্জন ভেলা।
এখন সত্তায় তার শান্ত উঠোনে শিশুর খেলা,
দিগন্তের বংশীধ্বনি, বিশাল তরঙ্গ, পাটাতন,
কিশোরীর পাখি পোষা, শিকারীর হরিণ হনন,
ভগ্নস্তুপময় জ্যোৎস্না একাকার, নিজে সে একেলা।
যদিও জমিনে নতজানু তবু তার নক্ষত্রের
মতো মাথা পৌঁছে যায় পাঁচবার দূর নীলিমায়।
তার মতো আমিও একটি ধ্যানে সমর্পিত, তবু
আমার অভীষ্ট কেন ক্রমাগত অনেক দূরের
আবছা সরাই হয়ে থাকে? কেন আমি ব্যর্থতায়
কালো হই? কেন বিষ্করুণ বাক্ প্রতিমার প্রভু?
আমার যা বলার
যা কিছু দেখার দেখি আশপাশে যা কিছু দেখার
একা ঘরে খাটে শুয়ে কিংবা পথেঘাটে হেঁটে যেতে
যেতে দেখি, যা কিছু শোনার শুনি, সকালেও চা খেতে
খেতে, গ্রন্থাগারে ঠান্ডা এক কোণে সেই কবেকার
পুরোনো নইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, অস্থিসার
বস্তিটার অভ্যন্তরে, রেস্তোঁরায় খোশগল্পে মেতে
কত কী-যে শুনি এলেবেলে আর মগজের ক্ষেতে
সুনীল ফসল নিয়ে বলি এ জীবন ফক্কিকার।
অথচ আমার যা বলার তা বলি ঠিক? সব
কিছু বলতে কি পারি? আমার মনের কিনারায়
নানা কথা অকস্মাৎ ধর্মঘটী শ্রমিকের মতো
বেরিয়ে আসতে চায় একরোখা, ঐ যে জমি যায়
দেখা বলে নীলকুর্তা নাবিকের মতো কলরব
করে উঠতে চায় ওরা বেলা অবেলায় অবিরত।
আমি কি পারবো?
নেমেছে অসিত নম্র ডানা মেলে নিশীথ নিঝুম
চৌদিকে এবং বাতিজ্বলা ছোট আমার এ ঘরে
স্তব্ধতা ঘুমন্ত বেড়ালের মতো গাঢ় আছে প’ড়ে,
রয়েছি চেয়ারে বসে বহুক্ষণ, চোখে নেই ঘুম,
হাতে প্রস্ফুটিত বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম।
মনে পড়ে, নিঃসংগ অসুস্থ কবি প্রহরে প্রহরে
হেঁটেছেন কৃষ্ণ বেশে। তাঁরই মতো আমিও শহরে
একা-একা ঘুরি নিয়ে অস্তিত্বে ব্যাধির গুপ্ত ধুম।
যে-নারী দেয়নি শান্তি তাঁকে বরং কুটিল পাকে
করেছে অত্যন্ত ক্লান্ত তারই জন্যে কত দুঃখশোক
সয়েছেন, নিজেকে ক্ষইয়ে শুধু গড়েছেন তাকে।
আমি কি পারবো হতে দান্ত মহিমায় সমাসীন
তাঁর মতো? পারবো কি ক্ষিপ্র তুলে নিতে কোনোদিন
গরল আঁজলা ভরে অমৃতে ভাসিয়ে বিশ্বলোক?
আমিও বনের ধারে
আমিও বনের ধারে মধ্যে-মধ্যে একা চলে আসি
শহর পেছনে ফেলে। কোলাহলহীন বেলা কাটে
ঘাসে বসে ঝিলের ঝিলিক আর বীতশস্য মাঠে
পাখি দেখে, শিস বাজে ঘন ঘন; ক্লান্ত শীর্ণ চাষী,
সূর্যসেঁকা, বৃক্ষতলে স্বপ্ন শোঁকে, আশ্রয়-প্রত্যাশী
পান্থজল লম্বা পায়ে বসতির দিকে পথ হাঁটে
এবং সূর্যের চোখ বুজে আসে মেঘাচ্ছন্ন খাটে।
সহসা শুনবো আমি, আশা রাখি, উত্তেজক বাঁশি।
এখনো বনের ধারে আমি কার পথ চেয়ে থাকি?
ভীত ত্রস্ত হরিণ তাড়িয়ে এনে কোন্ সে শিকারী
আসবে বেরিয়ে খোলা ধুধু মাঠে অথবা বেনামি
দেবী বাকলের আবরণে এখানে আসবে, নাকি
সেই অর্ধছাগ আর অর্ধ মানবের দেহধারী
দেবতা আসবে যার বংশীধ্বনি শুনতে চাই আমি।
আশ্চর্য
আমার সত্তায় উদ্ভাসিত রৌদ্রী একটি সকাল,
অস্তিত্বের তটরেখা গুঞ্জরিত সানাইয়ের সুর
ক্ষণে ক্ষণে; দাঁত মাজি, চেয়ে দেখি এইতো অদূরে
উঠোনে কুড়োয় খুশি হল্দে পাখি, অসুখী বেড়াল
আমার লেপের নিচে খোঁজে উষ্ণ গুহা; নিম ডাল
নেচে ওঠে অকস্মাৎ। বহুদূর দেশ থেকে এসে
কখনো ফিরে না-যাওয়া বৃদ্ধলোক লাঠি হাতে, হেসে
কুশল শুধান পড়শির-গলিময় ইন্দ্রজাল।
আমার পায়ের নিচে পড়ে আছে খবর কাগজ
নীরব বিশ্বের মতো। কফি খাই, আশ্চর্যের ধূপে
সমাচ্ছন্ন কবিতার খাতা খুলি, বাস্তবের সীমা
ছিঁড়ে ফেলি ফালা ফালা, ছকস্থিত অশ্ব আর গজ
সুনীল প্রান্তরে ছোটে আশ্চর্যের তরঙ্গের রূপে-
সব চে আশ্চর্য তুমি হে আমার আপন প্রতিমা।
উদ্দাম আসবো ফিরে
চমৎকার পাখি পুষি, নিজে স্বপ্নপোষ্য হয়ে আছি
আজ অব্দি, মাঝে-মধ্যে গান ধরি, শব্দ গাঁথি কিছু
আমার ভেতরে যে নিমগ্ন কর্মচারী মাথা নিচু
ক’রে থাকে তার মেদমজ্জা চাটে পুপ্ত নীল মাছি।
অলপ্পেয়ে পদাবলী একটি মনের কাছাকাছি
পৌঁছুতে চেয়েও কায়ক্লেশে ঝরে যায় অন্তরালে,
একটি দীপ্তশ্রী মুখ সরে যায়, এ মুখ বাড়ালে
আমার সর্বস্ব গেছে তবু এই পৃথিবীতে বাঁচি।
সে কবে শ্রাবণঘন যূথীগন্ধী সায়াহ্নের কাছে
অকথিত কিছু কথা, কিছু নীরবতা সমর্পণ
ক’রে চলে গেছে বহুদূরে। এই জীর্ণ অন্ধকার
পিঞ্জরে একাকী আমি, শুধু তাকে মনে পড়ে, নাচে
স্বপ্নস্মৃতি, মৃত্যুর পরেও ছিঁড়ে বেবাক কাফন
উদ্দাম আসবো ফিরে যদি ডাকে সে আবার।
একজন মৃতদেহ
একজন মৃতদেহ পানপাত্রে তিনটি হীরক
হেলায় দিলেন ছেড়ে। পানপাত্র থেকে আস্ত পরী
তিনজন অকস্মাৎ উপচে পড়লো, কালো তরী
হলো সাড়া ঘর, জলদস্যুর দুচোখ খুব ধ্বক
করে জ্বলে ওঠে, মৃতদেহটির সবগুলি নখ
বেড়ে বেড়ে অতিকায় ঈগলের চঞ্চু, নীল ঘড়ি
সোনাটার মতো বাজে, কজন কংকাল চূর্ণ জরি
মুখোর গহ্বরে পরে গান গায়, এসো হে মড়ক।
একটি ঘাসের মূর্তি, তুর্কী টুপি-পরা, ঘূর্ণি নাচে
মত্ত, মৃতদেহটিকে ঘিরে তীব্র গাইছে কাসিদা,
আরক করছে পান খৃষ্টপূর্ব পিপের ভেতরে
ডুবিয়ে সবুজ মাথা, সাপ দীর্ঘ বাজে দগ্ধ গাছে
বোগাদাদী বণিকের তোরঙ্গ গচ্ছিত থরে থরে
কতিপয় মৃত সুন্দরীর চোখ, চোখে তীক্ষ্ম দ্বিধা।