আবহ-মোরগ ঘোরে
কেমন অবাক লাগে ভেবে মন্দ ভালোয় অর্ধেক
শতাব্দী কেটেছে প্রায়। পুঁথি পড়ে, তর্ক করে, নানা
দৃশ্যাবলি দেখে কখনো বা ঘোর কর্দমাক্ত খানা-
খন্দে পড়ে, খুব স্বপ্নাশ্রয়ী হয়ে এবং হরেক
সুউচ্চ মিনারে পৌঁছে দেখেছি বর্ণাঢ্য অভিষেক
নিঃসঙ্গ কবির আর মাঝে-মাঝে পেয়েছি নিশানা
সেই সুন্দরীর, ভঙ্গি যার বড় নিষ্ঠুর, বেগানা,
ভালোবেসে বার বার দুঃখ আমি পেয়েছি অনেক।
তবুও লড়ছি নিত্য নিয়তির সঙ্গে অবিরত,
কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে নিশিদিন গোলাপের গান
গাই আর শান্ত মহিমায় একা ভীষণ আহত
গরুড়ের মতো ভাবি আজ-কবে হবে অবসান
এ ট্রাজিক সংগ্রামের? স্বপ্নাকুল দেখি ক্রমাগত
আবহ-মোরগ ঘোরে, রৌদ্রে পোড়ে, বৃষ্টি করে পান।
আবার এসেছো তুমি
আবার এসেছো তুমি বৃক্ষতলে খর পুর্ণিমায়
নিঃশব্দে পেরিয়ে ডোরাকাটা পথ, শাড়ির হিল্লোল
তুলে নিরিবিলি, দেখলাম। মোহন ছন্দের দোল
তোমার সত্তায়, তুমি জোৎস্নাময় হেসে নিরালায়
চলো যাই বলে উঠে গেলে যানে, আস্তে পুনরায়
বসেছি তোমার পাশে আগেকার মতো, ডামাডোল
চতুর্দিকে, পুলিশের হুইসিল, কারো রাগী বোল
ভেসে আসে, কখনোবা রবীন্দ্রসংগীত বয়ে যায়।
জ্যোৎস্নায় তোমার চোখ খৃষ্টপূর্ব শতকের হীরকের
মতো জ্বলে, আবার তোমার হাত মাছ হয়ে খেলা
করে একাকিনী আমার এ হাতে, আমরা পরস্পর
মুখোমুখি চেয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের দুজনের
এই রাত্রি সত্য নয়। এতো কুহকের ভুল বেলা-
নিমেষেই অস্তমিত; তারপর কী শূন্য প্রহর!
আমার আস্তিনে
আমার আস্তিনে আমি লুকিয়ে রাখিনি কোনো ছুরি,
কোমরে রিভলবার নেই অথবা শিশিতে বিষ
নেই এক ফোঁটা, নেই হাতে বাঘ্নখ কিংবা শিস
দিতে দিতে কাউকেও আস্তে সুস্থে কাস্তে কি হাতুড়ি
দিয়ে ফৌত করিনি কখনো কিংবা ছলনা চাতুরী
মূলধন ক’রে কোনো শক্রূকেও বলির মহিষ
বানাইনি, কস্মিনকালেও আমি করিনি কুর্নিশ
স্বৈরাচারী লৌহ মানবকে অন্তরালে। লুকোচুরি
খেলেছি বরংমরণের সঙ্গে ভীষণ একাকী।
আমার আড়ালে আমি নিজেই কী নগ্ন, অসহায়
এক খয়া খর্বুটে মানুষ, কিন্তু সর্বদাই কাঁধে
নিঃসঙ্গ বেড়াই বয়ে কায়ক্লেশে সুপ্রাচীন দায়।
পেশী শ্লথ হয়, চোখ বুজে আসে কালো অবসাদে,
ঘুমের ভেতরে ক্রূর গান গায় স্বপ্নচর পাখি।
আমার কন্ঠস্বর
আমার চোখের আলো এখনো তো নয় খুব ক্ষীণ-
ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদী, খোলা পথ, বন্ধ দ্বার,
নানা জীবজন্তু দেখি, পাথরের নিচে লোকটার
গেরস্থালি, তা-ও দেখি, দৃশ্যাবলী দেখি প্রতিদিন।
যদিও বয়স ত্বকে ধুলোরাশি ছড়াচ্ছে মলিন,
তবু ও শ্রবণশক্তি অতিশয় প্রখর আমার,
এখনো জিভের কাজ চলে নিয়মিত, এই ঘাড়
পাহাড়ের মতো, আজো কণ্ঠস্বর তেজী, ক্ষমাহীন।
তবে কেন বারংবার দেখেও অনেককিছু আজ
না দেখার করি ভান? কেন সাজি বিহ্বল বধির?
কেন কণ্ঠস্বর রাখি চেপে সর্বক্ষণ? আর আমি
বোবা-কালা সেজে থাকবো না-এ স্বরের কারুকাজ
পৌঁছে দেবো মেঘনা নদীর নিচে ব্যাকুল অধীর
পাহাড়ে পাহাড়ে-কন্ঠস্বর হবেই সর্বত্রগামী।
আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়
এখন বাইরে রাত্রি তপোক্লিষ্ট বিমর্ষ নানের
পোশাকের মতো আর সুদূর কোথাও সন্ন্যাসীর
অস্থায়ী ধুমল আস্তানায় আস্তে ঝরছে শিশির,
প’ড়ে থাকে কতিপয় চিহ্ন উদাস অন্তর্ধানের।
নিশীথ রপ্তানি করে প্রসিদ্ধ সুরভি বাগানের
দূর-দূরান্তরে, ক্লান্ত মগজের ভেতরে রাত্তির
ডোরাকাটা বাঘ, জেব্রা, ঝিলঘেঁষা হরিণের ভিড়
নিয়ে গাঢ়, শিহরিত ঘাস পুরানো গোরস্তানের।
ঘুমন্ত পৃথিবী মধ্যরাতে, আমি ধুধু অনিদ্রায়
কাটাই প্রহর একা ঘরে আর তুমি দেশান্তরে
সুখান্বেষী তোমার শরীরে মিলনের চন্দ্রোদয়;
না, আমি মানিনা এই দূরত্বের ক্রুর অন্তরায়।
যদিও দুস্তর ব্যবধান, তবু প্রতিটি প্রহরে
তোমারই শিয়রে জ্বলে আমার ক্ষুধার্ত চক্ষুদ্বয়।
আমার তৃষ্ণার জল
তুমিও ফিরিয়ে নিলে মুখ কম্পিত দ্বিধায়, নাকি
ঘৃণায় গিয়েছো সরে। কতকাল, বলো কতকাল
এমন সুদূরে তুমি সীমাহীন ঔদাস্যের জাল
ছড়িয়ে থাকবে সর্বক্ষণ? আমি কী ব্যাকুল ডাকি
তোমাকেই, আজ আর এমন প্রান্তর নেই বাকি,
নেই কোন নদীতীর কিংবা পথ, অথবা পাতাল
যেখানে যাইনি আমি তোমার সন্ধানে। অন্তরাল
নিজেই করেছো সৃষ্টি, আজ আমি ভীষণ একাকী।
তোমার কার্পণ্য কেন মেনে নেবো? কেন যাবো ফিরে
ধূমল তৃষ্ণায় প্রস্রবণ থেকে জলপান বিনা?
এখনতো অন্য কেউ নগ্ন তোমার সত্তার তীরে
তুলছে ফেনিল ঢেউ নিরন্তর, তুমি সে উচ্ছল
আদিমতা বুনো অন্ধকারে উপভোগ করো কিনা
জানতে চাই না, শুধু চাই আমার তৃষ্ণার জল।
আমার নির্মাণ
আমার নির্মাণ আজ আমাকেই বড়ো ব্যঙ্গ করে।
যা-কিছু গড়েছি এতদিন বেলা অবেলায় প্রায়
প্রত্যহ নির্মম শ্রমে, সেসবই কি তবে, হায়,
খড়ের কুটোর মতো পরিণামহীন জলে-ঝড়ে?
আমিতো দিয়েছি ডুব বারংবার, পাতালের ঘরে
দানবের মুখোমুখি নিয়ত থেকেছি বসে আর
পর্বতচূড়ায় অনাহারে কাটিয়েছি দিন হাড়
কালি ক’রে; জঙ্গলের জটাজালে আছি হেলাভরে
এখনো প্রত্যাশাময়। রক্ত দিয়ে লিখি রাত্রিদিন
শূন্যের দেয়ালে কত পংক্তিমালা, সবই কি অসার?
এই যে স্বপ্নের মতো অনুপম ঘরগেরস্থালি,
অথবা নিঝুম বনস্থলী, হ্রদ, চকচকে মীন
জেগে ওঠে শূন্যতায় অকস্মাৎ-এ-ও কি নচ্ছার
কারুর জঠরে যাবে? আমার নির্মাণ ধুলো-বালি?