সে তার নিজেরই বাসা
এই তার বাসগৃহ ছন্নছাড়া বাগানের ধারে
অনেক বছর ধরে রয়েছে দাঁড়িয়ে রৌদ্রজলে।
এখানে সুন্দর তার হস্তস্পর্শ যার করতলে
রেখে যায় আগোচরে, তাকে আজো তো বনবাদাড়ে
দেখা যায়, হাতে লাঠি, পিঠে বোঝাই সুদূর পাহাড়ে
জনহীন নদীতীরে হাঁটে সে একাকী, পুনরায়
ফিরে আসে একজন ব্যথিত কবির আস্তানায়,
মানে সে বাসায় যার সত্তা লগ্ন বেহালার তারে।
সে তার নিজেরই বাসা হঠাৎ পুড়িয়ে ফেলে কিছু
অপরূপ আলো দেখে নিলো। সে আলোয় মর্মমূল
আর্তনাদ করে, তবু সেই উদাসীন, দৃষ্টি নিচু
করে ভস্মারাশি তুলে নেয় মুঠো ভরে পুনর্বার
হাওয়ায় উড়িয়ে দ্যায়। বাসা নেই, দগ্ধ স্মৃতিভার
বেড়ে যায়, মাথার ভেতরে কাঁদে কিছু কালি, ঝুল।
সেই সুর
এখনো আমার মন আদিম ভোরের কুয়াশায়
প্রায়শ আচ্ছন্ন হয়। মনে হয় স্বচ্ছন্দ কৌশলে
অমার শহরটিকে প্রাচীন দেবতা করতলে
সর্বদা আছেন ধরে; পশু-পাখি কেমন ভাষায়
কথা বলে, খৃষ্টপূর্ব শতাব্দীর নারী কি আশায়
বসে থাকে নদীতীরে। ছিন্ন শির, বীণা খর জলে
সে-সুরের ক্ষীণ ছায়া, মনে হয়, আজো মাঝে মাঝে
আমার নিমগ্ন অবচেতনের প্রচ্ছন্ন প্রদোষে
খেলা করে, নইলে কেন অস্তিত্বের তন্ত্রীতে আমার
জাগে সূক্ষ্ম কম্পন এমন? মর্মমূলে কেন বাজে
সাহসা অদৃশ্য বাণী? খর স্রোতে চোখ রেখে ব’সে
আছি একা ঔদাস্যের তটে, নেই লোভ অমরার।
স্থগিত বাসনা
সঙ্গমে কী সুখ পাবে তুমি? ওটা থাক, শারীরিক
ব্যাপার স্যাপার ভারি স্থুল মনে হয়, ঘেন্না লাগে।
বরং চুম্বনা নাও, আলিঙ্গনে বাঁধো অনুরাগে,
আমার আঙুল নিয়ে খেলা করো, আমি অনিমিখ
চেয়ে থাকি তোমার চোখের দিকে। শোনো, বাস্তবিক
এটুকুই চাই আমি, তার বেশি নয়। যদি জাগে
কোনোদিন কামনার বন্য ঢেউ শরীরী ভূভাগে
তাহলে আমার আত্মা বলবে আমাকে ধিক, ধিক।
তোমার এ উচ্চারণ মেনে নিতে মনোকষ্ট হয়;
শরীর এবং আত্মা দুটি পাখি বসে একই ডালে
গান গায় প্রীতিবশে। নয়, ওরা তো পৃথক নয়
কেউ কারো থেকে; যত দূরে পারো ঠেলে দাও, তবু
তোমার ঘাটেই যাবো খেয়া বেয়ে লিবিডোর খালে,
মেটাবো অকুল তৃষ্ণা। এখনো তো নই জবুথবু।
স্মৃতির ভেতরে
স্মৃতির ভেতরে ঘুরে ঘুরে একটি মরাল কাঁদে,
পায়ে তার নুড়িগুলি অথবা কাঁকর চুমো খায়
অত্যন্ত নির্দয়ভাবে। রক্ত ঝরে আর কৃশকায়
অলবডো লোক কতিপয়, খুনখুনে বুড়ো, কাঁধে
ঢাক নিয়ে খুব ঢক্কা নিনাদে চাদ্দিক অবসাদে
ভরে তোলে ক্রমান্বয়ে। স্মৃতির ভেতরে গান গায়
শহুরে কোকিল, যার চক্ষুদ্বয় অন্ধ; অসহায়
আমি ভাবি-তার সঙ্গে দেখা হবে কতদিন বাদে?
ফের যদি তার সঙ্গে দেখা হয় দীর্ঘ দীর্ঘকাল
পরে বিরানায় কিংবা কোনো নৈশ তুখোড় পার্টিতে,
যদি সে আমার চোখে দুটি গাঢ় চোখ রাখে ভুলে
তবে কি সহসা যাবে কেটে তার সামাজিক তাল?
সে কি বন্দী শিবিরের কথা ভুলে প্রাক্তন নিশীথে
ফিরে যাবে নিমেষেই? উঠবে কি তার বুক দুলে?
হে আমার বাল্যকাল
হে আমার বাল্যকাল তুমি সে কেমন মাল্যদান
দেখেছিলে খুব বিস্ফারিত চোখে শহুরে সন্ধ্যায়?
সে মালার ফুলগুলি স্মৃতির মতন ভেসে যায়
মনোজ তীর্থের তীরে, যেন বা পাপড়িরা অফুরান-
শতাব্দী শতাব্দী ধরে ঝরে যাবে, বেদনার্ত গান
গাইবে জীবন জুড়ে। পথচারী যখন হারায়
দিকচিহ্ন, এবং স্মৃতির সঙ্গে বিষণ্ণ ছায়ায়
কথোপকথন করে, পথ হয়ে আরো সুনসান।
সে পথ পতিতা নাকি ভগ্নী নান, তার চুলচেরা
হিসের উভীষ্ট নয়, শুধু দেখি রুক্ষ, পোড়া মাটি
আশপাশে- সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটাময়, সুপ্রাচীন
রণক্ষেত্র, তরমুজের ফালি, ভাঁড়ের করোটি, ছেঁড়া
জুতো এক পাটি; বাল্যকাল, তুমি কেন প্রতিদিন
আনো রেলগাড়ি কাটা ঘুড়ি, বাতাসা ও জামবাটি?
হে পাখি, শহুরে পাখি
চেতনায় ঝরে ঝরে সুর থেমে গেলো অকস্মাৎ।
জানাজানি হবার মতন কিন্তু কিছুই ঘটেনি,
দূর থেকে আসা সে সুরের দাম ক’পেনি
করিনি যাচাই, শুধু এক জ্বলজ্বলে অভিঘাত
স্মৃতিস্রোতে নিয়ে ঘুরি মনুষ্য সমাজে। দিনরাত
কেটে যায় যথারীতি আহারে বিহারে কি নিদ্রায়,
মাঝে-মাঝে সেই সুর চেতনায় ডানা ঝাপটায়
এবং অব্যক্ত কবিতার মতো করে অশ্রুপাত।
হে পাখি শহুরে পাখি, তুমিও করেছো বড়ো ভুল-
এর কোনো ছিলো না দরকার, সাদামাটা শত কাজে
ছিলাম জড়িয়ে নিত্য; তুমিও পল্লবে, দূর নীলে
অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ছিলে। তোমার এ সুর কী ব্যাকুল
করেছে আমাকে আজ। যদি সুর থেমে যাবে সাঁঝে,
তবে কেন হৃদয়ে আমার তুমি ডেকে উঠেছিলে?