শুধু দেখি
আমার কবিত্ব বুঝি গৃহত্যাগী সিদ্ধার্থের মতো
বড় অনশন-ক্লিষ্ট আজ, নইলে কেন হে নবীনা
তোমার রূপের শিখা অনায়াসে জ্বালতে পারি না
ছত্রে ছত্রে? এই চোখ, এই ওষ্ঠ আর সমুন্নত
নাকের উপমা খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হচ্ছি অবিরত।
নতুন উপমা পেলে অবশেষে হে তুলনাহীনা,
তা-ও বড়ো তুচ্ছ মনে হয় আর মগজে যে বীণা
বাজে মাঝে-মাঝে, তারও সুর কাটে, চেতনা বিব্রত।
আমার এ প্রয়াসের ব্যর্থতায় জানি উপহাস
জুটবে বিস্তর আর কবিত্বকে সুতীক্ষ্ম ধিক্কার
দেবে কেউ কেউ। তুমি যেন রূপবতী বাংলাদেশ
অনন্য সৌন্দর্যে খুঁতে, অন্তরঙ্গ একটি নিশ্বাস,
এবং বর্ণনাতীত। খুঁজিনাকো উপমা তোমার
শুধু দেখি, দেখি মুগ্ধাবেশে তোমাকেই অনিমেষ।
শুনি অপরাহ্নে
শুনি অপরাহ্নে অর্ফিয়ূস বাজায় মোহন বাঁশি-
ভাঙাচোরা পৌর পথ, মায় ঘরদোর, শীর্ণ গাছ
কেমন বদলে যায় নিমেষেই আর জোড়ে নাচ
বস্তুপুজ্ঞ দশদিকে। ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি
উচ্চারণ ক’রে যেন স্বপ্নময় মেঘলোকে ভাসি;
ভালোবাসি, ভালোবাসি। সে ভালোবাসুক আর না-ই
বাসুক আমাকে, পুরোপুরি না হোক আমার, গাই
তবু তারই গান, আপাতত নই কিছুরই প্রত্যাশী।
এই কি যথেষ্ট নয় এই ভালোবাসা, যা শিরায়
শিরায় ঝংকার তোলে, যার টানে আনন্দিত পথ
হাঁটি, কথা বলি পশু পাখি, বৃক্ষলতা পাথরের
সঙ্গে, না চাইতে শক্রূকেও করি ক্ষমা, পক্ষীবৎ
উড়ে যাই, গায়ে মাখি ঘ্রাণ স্মৃতির মরূদ্যানের
এবং নিজেই হই অর্ফিয়ূস দীপ্র নিরালায়?
শ্রাবণের বিদ্যুতের মতো
সযত্নে রাখবে পুষে তুমি সর্বদা আমার স্মৃতি,
করি না এমন অসম্ভব দাবি, বিস্মৃতিপ্রবণ,
কম বেশি, সকলেই। মাঝে-মধ্যে করলে স্মরণ
উদাস প্রহরে কোনো, খুব ফিকে-হয়ে-আসা প্রীতি
ধূলোর দবিজ পর্দা চকিতে সরিয়ে যথারীতি
তুললে স্মিত মুখ, আমি তোমার নিকট আমরণ
থাকবো কৃতজ্ঞ আর ঘটুক যতই অঘটন,
স্মৃতিতে জ্বলবে তবু তোমার স্বপ্নের মতো সিঁথি।
আমাকে রাখবে কিনা মনে, হে নবীনা, চিরদিন
তা ভেবে উদ্বিগ্ন নই আদপেই আমি আপাতত,
চাই না তোমার দীপ্র দরজায় অভ্যর্থনাহীন
দাঁড়িয়ে থাকতে আর। এসো কাছে এসো বলে ডাকে
তোমাকে আমার প্রতি অঙগ সময়ের প্রতি বাঁকে;
এসো কাছে এসো তুমি শ্রাবণের বিদ্যুতের মতো।
সপ্তাহ
গোলাপ পায়রা আর প্রজাপতিদের ভিড়ে ছিলে
তুমি সোমবার সুখী, এবং মঙ্গলবার ঘাসে
শুয়েছিলে একাকিনী পুরাতন কবরের পাশে,
বুধবার, কী আশ্চর্য, বহুদূরে আকাশের নীলে
তোমার দোলনা দুলছিলো; তুমি আর আমি মিলে
কটেজে খেয়েছি চুমো বারংবার বৃহস্পতিবার।
শুক্রবার দেখেছি তোমার চোখ, শ্রোণী, স্তনভার
স্তব্ধ ব্যাঙ্ক-কারিডরে, শনিবার হাঁসময় ঝিলে।
রবিবার? তোমার সান্নিধ্য, হায় যায় বনবাসে
রবিবারে বারে বারে। তবে কি দেখি না প্রিয়তনা
তোমাকে তখন? রাজহাঁসের মতন স্পীডবোটে
তুমি, হল্দে-কালো শাড়ি-পরা; দেখি, চুল সুবাতাসে
ওড়ে কী উদ্দাম, মাছের ঝিলিক মনে হয় জমা;
সত্তাতটে নিয়ত তোমার দীপ্র উপস্থিতি ফোটে।
সহসা যীশুর হাত
সহসা যীশুর হাত আমার উন্মুক্ত জানালায়
বাজে রবাবের মতো। হাতের তালুতে পেরেকের
দাগগুলি সিংহচক্ষু; ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর পতনের
স্মৃতি নিয়ে এ আমার চক্ষুদ্বয় অতি কৃশকায়
সে-হাতে নিবদ্ধ হয়। আমি কেমন অস্থিরতায়
শয্যায় আহত মাছ, শুধু টগবগে আবেগের
খুরধ্বনি শিরাপঞ্জে; নিশীথের মদির মেঘের
ময়ূর মাথায়, স্রোতে যেশাসের গাধা ভেসে যায়।
কোনো কিশোরীর উন্নয়শীল স্তনের মতন
অথবা পাছার মতো আমার ভাবনা স্ফীত হতে
থাকে নিদ্রাহীন মধ্যরাতে। হায়, কোন্ মরুপথে
যাবতীয় জরুরি দলিল দস্তাবেজ তাড়াহুড়ো
করে আমি আঁধারে এসেছি ফেলে? মোহান্তের মন
নিয়ে তবু মাংসের স্বপ্নের শালীনতা করি গুঁড়ো।
সে কবে আমার ঘরে
সে কবে আমার ঘরে এসেছিলো তুমি হে প্রতিমা
শুন্যতায় তুলে ঢেউ? বসেছিলে মুখোমুখি; চোখে
বসন্ত-বিস্ময় ছিলো, শরীরে স্বপ্নের মধুরিমা।
টেবিলে তোমার হাত, যেন সে মাছ, রহস্যলোকে
সমর্পিত; দেখলাম নড়ে চড়ে বসলে আবার।
ইচ্ছে হলো তুলে নিই হাতে সেই মাছ অলৌকিক,
হয়নি সাহস; যেন আমি দীন কুষ্ঠরোগী, যার
সৌন্দর্যকে ছুতে ভয়। বলো, হবো কি করে অভীক?
হে বন্ধু তাহলে আসি, বলে চলে গেলে কী সহজে
আমাকে একাকী ফেলে আর আমি যেন স্বপ্ন থেকে
চক্ষুদ্বয় কচলাতে কচলাতে জেগে উঠলাম
অকস্মাৎ; সত্যি তুমি এসেছিলে? নাকি এ মগজে
মায়াবী একাটি হাত আগোচরে দিয়েছিলো এঁকে
জীবন-স্পন্দিত চিত্র? জাগুক সে চিত্র অবিরাম।
সে কবে সোনালি দিন
কায়ক্লেশে পথ চলি, অকস্মাৎ ঘোর সন্ধ্যা নামে;
সব দিকে লুপ্ত গাছপালা, নদীনালা, হল্দে ক্ষেত,
ত্রস্ত পাখি, গেরস্তের ঘর জনমনিষ্যি সমেত।
তবে কি এসেছি আমি পথ ভুলে নৈরাশের গ্রামে?
একটু পরেই ফের আকাশের ঘুরঘুট্রি খামে
তারার অক্ষরে লেখা নতুন ঠিকানা অনিকেত
আমাকে দেখায় পথ। কাক-তাড়ুয়ার মতো প্রেত
স’রে যায়, মধ্যে মধ্যে বৃক্ষতলে গা ঢালি বিশ্রামে।
কখনো ম্যুনিখে ঘুরি, কখনো বা ঢাকাই বস্তিতে,
কত স্বপ্ন জমা হয় অবচেতনের স্তরে স্তরে
চল্তি পথে, অকস্মাৎ দৃষ্টি জুড়ে কালো বধ্যভূমি
ভেসে ওঠে, কংকাল বাজায় বাঁশি, বিবর্ণ আর্শিতে
মুখ দ্যাখে শীর্ণ প্রৌঢ় কবি, বার-বার মনে পড়ে-
সে কবে সোনালি দিন কালো ক’রে চলে গেছো তুমি!