যে-কথা বলেনি কেউ
এখন বচসা থাক, ঢের কথা কাটাকাটি হলো-
নিরীহ চায়ের কাপে শান্ত হোক সব ক্ষ্যাপা ঝড়।
এই যে ড্রইংরুমে সোফার গহ্বরে বসে খর
তর্কে মেতে ওঠে উৎসবের মতো খুব ঝলোমলো
দ্বিপ্রহরে ইতিহাস, সমাজ শিবির সংঘ আর
ত্র্যাবসার্ড নাটকের রীতিনীতি নিয়ে অর্থহীন,
ভীষণ নিষ্ফল মনে হয়। এমন সুন্দর দিন
এভাবে কারো না ব্যর্থ; প্রাণের পুষ্পিত ঝোপঝাড়
এখন উঠুক দুলে, আমাকে দেখতে দাও চোখ
ভরে স্মৃতিজাগানিয়া চোখ, চোখের কাজললতা;
অসিত শিখার মতো চুল আর স্তনাভা তোমার,
দাও, দাও, আমাকে দেখতে দাও। সব দ্বিধা হোক
দূর, হও উন্মীলিত, আমাকে বলতে দাও কথা-
যে-কথা বলেনি কেউ কোনোদিন রমণীকে তার।
যে-তুমি আমার স্বপ্ন
পুনরায় জাগরণ, পুল্মঢাকা আমার গুহার
আঁধারে প্রবিষ্ট হলো রশ্মিঝর্না, জাগালো কম্পন
এমন নিঃসাড় ম্রিয়মান সত্তাতটে। যে-চুম্বন
মৃতের পান্ডুর ওষ্ঠে আনে উষ্ণ শিহরণ, তার
স্পর্শ যেন পেলাম সহসা এতকাল পরে, আর
তৃণহীন বীতবীজ মৃত্তিকায় মদির বর্ষণ
দেখালো শস্যের স্বপ্ন। শিরায় শিরায় সঞ্চরণ
গোলাপের, নতুন মুদ্রার মতো খর পুণিমার।
পাথুরে গুহার কাছে স্বপ্নজাত বনহংসী ওড়ে
অপ্সরার ভঙ্গিতে এবং তার পাখার ঝাপটে
মৃতপ্রায় সাপ নড়ে ওঠে ফের, মহাশ্চর্য দান
পেয়ে যায় কী সহজে, কারুকাজময় ত্বক ফোটে
শরীরে নতুন তার। তুমি এলে প্লাবনের পরে,
যে-তুমি আমার স্বপ্ন, অন্নজল, অস্তিত্বের গান।
যেসব কবিতা আমি
যেসব কবিতা আমি কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলি,
মেলার মাটির পাখি হয়ে ওরা শূন্যে ঝুলে থাকে,
শ্রাবণ ধারায় গলে যায়, পুনরায় যেন ডাকে
মাটির ভেতর থেকে বীজ-স্বরে। বকুল, চামেলি
কিংবা মল্লিকার মাংসে পুর্নজন্ম নিতে চায়, গূঢ় চেলি
হ’য়ে সূর্যাস্তের দিকে উড়ে যাবে ভেবে শূন্যতাকে
তুষ্ট করবার ব্যর্থতায় অন্ধকারে মুখ ঢাকে।
টেবিলে সাগর দস্যু আর জলকন্যাদের কেলি।
আহত কবিতাবলী ছিন্ন ভিন্ন আঙুলের মতো
তাহলে বিদায় বলে অন্তর্হিত প্রেতের বাসায়।
রক্তাক্ত পালক ওড়ে ইতস্তত উত্তরে দক্ষিণে,
পুবেও পশ্চিমে ঝরে বালির সারস অবিরত।
একটি ক্ষুর্ধাত কুকুরকে ঘোর বৃষ্টিময় দিনে
ছেঁড়া স্বপ্ন ছুঁড়ে দিই কবিতার জন্মের আশায়।
রক্ষাকবচ
এতদিনে জেনে গেছি সুসময় ভীষণ অস্থির।
এখন তো বারংবার শবযাত্রা, কবরখানায়
একা একা ব’সে থাকা মৃত্যুগন্ধময় নিরালায়;
এখন পাবো না আর একটিও মুহূর্ত স্বস্তির।
ক্রূর অন্ধকারে আছি তুমিহীন অত্যন্ত একেলা।
কর্কশ গজায় দাড়ি, নখ বড়ো বেশি বেড়ে যায়,
গেন্থেও অমনোযোগী, প্রিয় বন্ধুবর্গের ডেরায়
প্রায়শ অনুপস্থিত আমি, দেখি মকরের খেলা।
এ-খেলায় ছিন্নভিন্ন হতে থাকি সকল সময়।
থামের আড়ালেও শক্রু চতুষ্পার্শ্বে জন্মান্ধ জল্লাদ,
কী করে বাঁচবো তবে? বেদনার্ত আমার হৃদয়।
জন্তুর বিষাক্ত দাঁতে বিদ্ধ, তবু হবো না উন্মাদ;
এখনো তো জীবনের প্রতি আমি কী দীপ্র উৎসুক,
সহায় তোমার স্মৃতি, ভোরস্মিত কবিতার মুখ।
রঙিন নিশ্বাসের জন্যে
খুব একা হাঁটি বোবা কালা অন্ধ বামনের ভিড়ে।
নোনা ঘামগন্ধ, মুখ-গহ্বরের কটু গন্ধ ঝাঁকে,
ভীষণ দুঃস্বপ্ন যাপি রুদ্ধশ্বাস এ বন্দীশিবিরে।
যেখানেই যাই কালো সন্ত্রাস আমাকে ধরে ঘিরে,
অনিদ্রার রক্তজবা জ্বলে চোখে, যদি কোনো ফাঁকে
দৃষ্টি থেকে মরুভূমি সরে যায়, চেতনাকে ঢাকে
বিষলতা, নিশ্বাসও বিকিয়ে যায় এমন তিমিরে।
তাহলে কী লাভ বলো, প্রিয়তমা, বিচ্ছিন্নতা পুষে
আমাদের দুজনের মধ্যে আর? এসো ভালোবাসি
দূরন্ত আবেগে, সব বাধার প্রাকার দ্বিধাহীন
ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এসো আমরা পরস্পর শুষে
নিই আমাদের অস্তিত্বের সারাৎসার, সুখে ভাসি
কিছুকাল, নিশ্বাসকে করে তুলি প্রবল রঙিন।
শহরে নেমেছে সন্ধ্যা
শহরে নেমেছে সন্ধ্যা, যেন নীরব ধর্মযাজিকা
প্রার্থনায় নতজানু। ফুটপাতে বেকার যুবক,
বিশীর্ণ কেরানী ঘোরে, লাস্যময়ী দৃষ্টির কুহক
হেনে হেঁটে যায়, কেউ কেউ দোকানকে মরীচিকা
ভেবে চিত্রবৎ স্থাণু কারো কারো চোখে স্বপ্নশিখা।
ক্লান্ত পাখিঅলা পঙ্গু পথিকের সঙ্গে মারাত্মক
বচসায় মাতে আর স্বপ্ননাদিষ্ট পুলিশও নিছক
অভ্যাসে বাজায় বাঁশি, কম্পমান কৃষ্ণ যবনিকা।
আমাকেও সন্ধ্যা তার কেশ-তমসায় ঘন ঢেকে
কেমন বিষণ্ন ঘণ্টা বার বার বাজায় আমার
অস্তিত্বের অণুপরমাণুময় ক্রূদ্ধ বনভূমি
লুকানো সৈনিক নিয়ে ধেয়ে আসে চতুর্দিক থেকে,
ক্লান্তিতে দুচোখ বুজে আসে, জীর্ণ আমার সত্তার
মরুতে জীবনতৃষ্ণা কী প্রবল জাগিয়েছো তুমি।
শিবির
প্রতিদিন ভিড় ঠেলে পথ চলি, দেখি সবখানে
দলাদলি, মরমুখো সব দল, খুন খারাবির
জন্যে তৈরী সর্বক্ষণ অনেকেই, শান্তির দাবির
যেন মূল্য নেই কোনো। মোহময় শ্লোগানে শ্লোগানে
মুখর চৌদিক, অতিকায় জন্তু বিধ্বস্ত উদ্যানে
ভীষণ চঞ্চল, অন্ধ ওরা আর জন্মেই বধির-
তাহলে কোন্ দলে ভিড়ে ঢেকে নেবো মাথা শিরস্ত্রাণে?
আমার শিবির নেই কোনো, আমি অত্যস্ত একাকী
পড়ে আছি এক কোণে নিরস্ত্র এবং বর্মহীন
কী জানি কিসের প্রতীক্ষায় দৃষ্টি জ্বেলে রাত্রিদিন।
মাঝে মধ্যে বিরানায় ডাকে একলা ভয়ার্ত পাখি,
আমি কবিতার রক্তোৎপল বুকে মুখ ঢেকে থাকি
কী অমোঘ ঘৃণা আর উপেক্ষার প্রতি উদাসীন।