ম্যাজিক লন্ঠন
কোথায় তোমার উৎস কবিতা হে কবিতা আমার?
কোন্ নেই-দেশ থেকে অকস্মাৎ তুমি, পৃথিবীর
কোন্ প্রান্ত থেকে আসো? স্যীন্ কিংবা রাইনের তীর
অথবা টেমস্ ভল্গা, মিসিসিপি নীল নদ-কার
তরঙ্গে নেচেছো তুমি? সত্য তুমি কেটেছো সাঁতার
সেসব নদীতে আর নীল চঞ্চু রেখেছো নিবিড়
ঢেউয়ে ঢেউয়ে, তবু মেঘনা নদীর তীরে নীড়
তোমার সর্বদা নক্ষত্রের মতো জ্বলে দুর্নিবার।
যখন তোমার উৎস খুঁজি, কোরবানীর ম্রিয়মাণ
পশুর ভড়কে-যাওয়া চোখ, ডালিমের ফেটে-পড়া
বুক, কবেকার শান্ত প্রান্তরের খোড়ো ঘর, ঝরা
শৈশব, খঞ্জের যানে মেঘে মেঘে ভ্রমণ, নিঝুম বন
মনে পড়ে বারংবার। নও তুমি দীপ্র বাতিঘর, এ বিরান
উদাস আঁধারে তুমি কম্পমান ম্যাজিক লন্ঠন।
যখন আমার কাছ থেকে
যখন আমার কাছ থেকে চলে যাও তুমি হায়,
আমার হৃদয়ে ক্রূদ্ধ বাজ পাখি সুতীক্ষ্ম চিৎকারে
দীর্ণ করে দশদিক, নখের আঁচড়ে বারে বারে
কুটি কুটি ছেঁড়ে শিরাপুঞ্জ, কী ব্যাপক তমসায়
অন্তর্গত পুষ্পাকুল উদ্যান ভীষণ ডুবে যায়।
যখন আমার কাছ থেকে সরে যাও, বন্ধ দ্বারে
মাথা কোটে একজন অন্ধলোক, খাদের কিনারে
অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে হাঁটে একা, অসহায়।
তবু তুমি চলে যাও দূরে তোমাকে যেতেই হয়,
যেমন আকাশ ছেড়ে পাখি প্রত্যাবর্তনের সুর
উন্মুক্ত ডানায় নিয়ে। আমার তো সর্বক্ষণ ভয়-
কখন হারিয়ে ফেলি অকস্মাৎ তোমার মধুর
স্পর্শ, কণ্ঠস্বর, তুমি আসবে না, তবু এ হৃদয়
তোমাকেই ডেকে যায়, ডেকে যাবে বিষণ্ণ দুপুর।
যখন প্রকৃত কবি
যখন প্রকৃত কবি কবিতার চোখে চোখ রাখে
কোজাগরী পূর্ণিমায় কিংবা ব্যাপক অমাবস্যায়
দারুণ অনলবর্ষী গ্রীষ্মে, শীতে অথবা বর্ষায়,
কদম ফুলের মতো খুব শিহরিত হতে থাকে
কবিতার স্তন আর যখন সে তন্বী কবিতাকে
বুকে টেনে নিয়ে ওর গালের মাংসের স্বর্ণাভায়
ঠোঁট ঘষে, যখন হৃদয় তার তীব্র চুমো খায়
কবিতার গোপনে, তখন সে স্বপ্নের নগ্ন বাঁকে।
এমনও তো হয়, মাঝে মাঝে সেই নিষ্ঠুরাতমার
কিছুতে মেলে না দেখা। দিন যায়, মাস যায় কত,
তবু তার পদধ্বনি বাজে না কোথাও, কী অসুখে
জ্ব’লে পুড়ে একা কবি আদিগন্ত উজ্জ্বল আমার
দিকে হাঁটে, খোঁজে পানশালা, হয়ে সে সতত
মাতাল দর্পণে ঢোকে, কবিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে।
যদি কাসান্দ্রার মতো কেউ
ধরো যদি কাসান্দ্রার মতো কেউ বলতো আমাকে
দারুণ অমোঘ তার কণ্ঠস্বরে, দেয়ালের লেখা
করো পাঠ; হেলেনের মতো রূপ যার, তার দেখা
যদি পাও অকস্মাৎ অবেলায় দৈব দুর্বিপাকে,
কখনো দিও না সাড়া কুহক ছড়ানো তার ডাকে,
তবে কি তোমার অথৈ চোখ, ঠোঁট, স্তনের শিখর
দেখে আমি চোখ বুজে সর্বক্ষণ থাকবো নিথর?
তীব্র স্পর্শে স্পর্শে করবো না ঋদ্ধ আপন সত্তাকে?
আমার শিরায় আজ ভাসছে সহস্র রণতরী,
মাংসের প্রাকারে হুহু আর্তনাদ, পুড়ছে মিনার
শতাব্দী শতাব্দী ধরে দুঃস্বপ্নের মতো, নিরুপায়।
তোমার নিকট থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেবে, হায়,
ত্রিলোকে এমন সাধ্য নেই কোনো রূঢ় কাসান্দ্রা।
স্বপ্নের স্মৃতির মতো চোখে তাই চোখ মেলে ধরি।
যদি তুমি মন থেকে
এখন এ মধ্যরাতে মনে রেখো ধ্বনি বেজে ওঠে
সারা চরাচরে; শাখাচ্যুত পাতা গাছের উদ্দেশে
বলে, মনে রেখো, সমুদ্রের ক্ষিপ্র ঢেউ তটে এসে
চুর্ণ হয়ে প্রতিবার আমাকে ভুলো না বলে ছোটে
আবার পিছনে। গোধূলির নিঃসঙ্গ আকাশ চোখে
অস্তরাগ মেখে করে উচ্চারণ আসন্ন রাত্রির কানে,-
মনে রেখো, মনে রেখো, জাগে ভোরের পাখির গানে,
বিদায়ী মুহূর্তে কম্পমান প্রেমিকের অন্তর্লোকে।
যতই বাজুক গাঢ় মনে রেখো ধ্বনি জলে-স্থলে,
তবু আমি কোনোদিন জানাবো না করুণ মিনতি
তরুণী তোমার কাছে, বলবো না আর্তস্বরে জলে
ভাসিয়ে দুচোখ, মনে রেখো। যদি তুমি মন থেকে
ক্ষ্যাপাটে শিল্পীর মতো মুছে ফেলো আমাকে, বিবেকে
বাধবে কি? অকস্মাৎ থেমে যাবে পৃথিবীর গতি?
যাত্রা
কোথায় লুকালে তুমি? বলো কোন্ সুদূর পাতালে
দিনান্তে পালঙ্কে শুয়ে কাটাও প্রহর প্রিয়তমা?
এখানে নেমেছে দশদিকে মৃত্যুর মতন অমা,
সেখানে কি কেলিপরায়ণ তুমি স্মিত জ্যোৎস্নাজালে
সোনালি মাছের মতো? নাকি তোমার নৌকোর পালে
লেগেছে উদ্দাম হাওয়া অজানা সমুদ্রে। কী উপমা
দেবো সে যাত্রার আজ? হয়তো মরুর বালি জমা
হয়েছে তোমার কালো চোখে রোজ সন্ধ্যা ও সকালে।
যেখানে তোমার পদচ্ছাপ প্রস্ফুটিত, বেজে ওঠে
কণ্ঠস্বর কিংবা তুমি দর্পণে প্রতিফলিত, গান
গাও গুনগুন সুরে, পারি না সেখানে যেতে, তবু
সেদিকেই মুখ রেখে পথ হাঁটি। হতাশাই প্রভু
সে-পথের জেনেও সর্বদা করি যাত্রা, কাঁটা ফোটে
পায়ে; তোমাকেই পাবো, আমি কি এমনই পুণ্যবান?
যে এলো তোমার কাছে
যে এলো তোমার কাছে অবশেষে উড়িয়ে আঁচল
বিরূপ হাওয়ায় তার সৌন্দর্য তুলনাহীন; তাকে
দেখে তুমি দূরবর্তী সন্ধ্যায় হঠাৎ অচেনাকে
বড় বেশী চেনা বলে অন্তরালে কেমন চঞ্চল
হ’য়ে উঠেছিলে, তার সুগভীর চোখের কাজল,
মনে হলো, যুগ-যুগান্তের স্মৃতি নিয়ে কাকে ডাকে
স্বপ্নের সংকেতে, তুমি ভেবেছিলে হয়তো তোমাকে
নিয়ে যাবে খৃষ্টপূর্ব কালে, শুষে নেবে অমঙ্গল।
এখন সে স্মিত হেসে দাঁড়ায় তোমার পাশে, ঠোঁটে
হৃদয় পুষ্পিত হয় ক্ষণে ক্ষণে, ঝরে যায় কত যে শতক
সুপ্রাচীন থরথর চুম্বনে চুম্বনে ভালোবাসা
মিসরীয় সম্রাজ্ঞীর চোখের মতন জ্বলে ওঠে-
মাঝে মাঝে স্বপ্নে দ্যাখো যমজ সোনালি ঘোড়া চক
চক করে জ্যোৎস্নারাতে, বুকে জাগে শোণিতের ভাষা।