বয়স যতই হোক
বয়স যতই হোক, আজো অমিলের ভিড়ে মিল
খুঁজে ফিরি বন্ধ ঘরে, প্রত্যেকের থেকে অন্তরালে
একটু আলাদা ভাবে থাকি কিছুকাল। কী হারালে
বিনিময়ে কী লভ্য সে-কথা ভেবে কিছু ঢিল
ছোঁড়া যায় নক্ষত্রের আস্তানায়। আলৌকিক ঝিল
আমার ভেতরে উচ্ছ্বসিত, অস্তিত্বের তন্তুজালে
গভীর সরোদ বেজে ওঠে। সে কোন্ সুদূর কালে
ছিলেন আমারই মতো তপোক্লিষ্ট হোমার, ভার্জিল-
এ-কথা স্বরণে রেখে নিজেকেই উস্কে দেয়া যায়
মাঝে মধ্যে; তবে এ-ও জানি শূন্য ফাটা কলসের
মতো বেজে ওঠা শুধু আত্মপ্রবঞ্চককে মানায়।
তাই একা, বড়ো একা কাটাই প্রহর কলমের
স্পর্শে মূলহীন লাল-নীল কমলের জাগরণ
দেখে, দেখে মরুবেক্ষ হরিণ-কোমল ঘন বন।
ভিক্ষা নয়
তুমি তো জানোই আমি কোনোকালে নই বিত্তবান।
আমার বাড়ির দরোজায় দেয় না পাহারা কোনো
উর্দিপরা দারোয়ান যমমুখো, অথবা কখনো
হুঁকোবর্দারের দল আহ্লাদের ঝড়ে খানখান
করে না স্তব্ধতা আমার এ নিভৃত ডেরার, ধান
নেই অফুরান শত শত সম্পন্ন গোলায়। শোনো,
মেয়ে বলি, তবু নই বিশীর্ণ ভিক্ষুক, যত ঘন
কৃষ্ণ হোক দুর্দশার মেঘ, চাই না কৃপার দান।
তাই আমি আর্তস্বরে ভিক্ষা দাও, ভিক্ষা দাও বলে
কখনো হবো না নতজানু তোমার পুষ্পিত এই
দরবারে, বরং সর্বস্ব নেবো লুটে নিমেষেই
সাগর দস্যুর মতো হঠকারিতায়। জ্বলজ্বলে
চোখে শুধু থাকবে তাকিয়ে তুমি, কোন কূট ছলে
ফেরাবে দূর্বার অতিথিকে? তোমার সে শক্তি নেই।
ভিন্ন কোনো স্মৃতি
প্রত্যহ চৌদিকে দেখি চর্মচোখে অনেক কিছুই-
ছায়াচ্ছন্ন নিরিবিলি গলির ভেতরে সারি সারি
ছোট গাছ, মৃত চিল, প্লাস্টিক চিরুনি; নীল শাড়ি
বারান্দাকে চুমো খায়। মৃৎপাত্রে একরাশ জুঁই।
টেবিলে কলম একা পোহায় বিশ্রাম, আস্তে ছুঁই
তাকে, বই স্বপ্ন দ্যাখে, দেয়ালে প্রাচীন তরবারি,
রুক্ষ গোরখোদকের কোদাল, মালীর ফুলঝারি-
বস্তুময় সব জায়গা, দেশ কিংবা বিদেশ বিভূঁই।
শুধু কি বস্তুর বহিরঙ্গ দেখে তৃপ্ত হবো আমি?
এখন নিজেকে বলি- বস্তুর নিছক উপস্থিতি
ইসস্তত আশেপাশে আমার গভীর ভালো লাগে,
তবু চাই তশ্তরি, তম্বুরা এক নিবিড় সংরাগে
নতুন বিমূর্ত হোক বর্ণোচ্ছ্বসে আর অস্তগামী
সূর্য, জলপানকারী ঘোড়া হোক ভিন্ন কোনো স্মৃতি।
ভুলের ভিতরে
শরীরের রঙ তার ধূসর কালচে, ধূত ব’লে
নাম ডাক আছে, লোকে তাকে মিহি সৌজন্যবশত
পক্ষী বলে, কেউ কেউ, রাশভারি, বস্তুত সতত
কাককে বায়স বলে করে সম্বোধন। কলরোলে
আসক্ত সে, আজন্ম সংগীত-ছুট, তবু খুব গুণী
গায়কের মতো ভঙ্গিমায় মাতে; কণ্ঠে তার, হায়,
মদির বসন্তদিন হয় না নন্দিত, নিরুপায়
ডেকে যায় ব্যর্থ মানুষের মতো, শুনি আমরা শুনি।
ডেকে যায় ভোরবেলা, ধু-ধু দ্বিপ্রহরে কখনো বা
স্তব্ধ মধ্যরাতে ভুল সকালের উদ্দেশে ব্যাকুল।
ভাবে, তার আর্ত হৃদয়ের তন্ত্রী-ছেড়া স্বরে
নিমেষেই আশপাশে জেগে ওঠে নিরিবিলি শোভা।
আমার মগজে কাক ডাকে জপে কী সুন্দর ভুল-
বিপুল জ্যোৎস্নায় উড়ে চলে যায় ভুলের ভিতরে।
মাতাল ঋত্বিক
কখনো কখনো মনে হয় আট কোটি লোক শোনে
আমার নিভৃত উচ্চারণ, কখনো-বা মনে হয়
আমার কথার জন্যে পিপাসার্ত একজনও নয়।
প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অত্যন্ত একাকী গৃহকোণে
বসে শব্দ দাও শব্দ দাও বলে কী গহন বনে,
পর্বতে, পাতালে হই নতজানু, করি আয়ুক্ষয়
প্রতীকের প্রতীক্ষায়, কম্পমান একটি হৃদয়
বিজন সৈকতে সারাক্ষণ রহস্যের ঢেউ গোনে।
যে-কথা হৃদয়ে ফোটে, হৃদয়ের ধ্বনির মতন
অন্তরঙ্গ বেজে ওঠে, তা যদি না শোনে কেউ কান
পেতে কিংবা না বোঝে কখনো, ক্ষতি নেই, নেই খেদ।
তোমার উদ্দেশে আমি যখন যা করি উচ্চারণ,
সে ধ্বনি তোমার কানে সকল সময় হোক গান;
মাতাল ঋত্বিক আমি, প্রেমকথা আমার ঋগ্বেদ।
মাম
সাধক যেমন ধ্যানে জপেন নিয়ত পুণ্যশ্লোক,
আমার হৃদয়ও তেম্নি বার-বার করে উচ্চারণ
তোমার মধুর নাম। ঘরে ভ্রমরের গুঞ্জরণ,
বাইরে পাখির শিস, হাওকেয়ার বিলাপ, যাই হোক-
সবই তো বিশেষ ধ্বনি, সুর বলে কোনো কোনো লোক।
শুধু সুর এসব তাদের কাছে। কিন্তু বলে মন,
আমার বিস্মিত মন কী তন্ময় যখন তখন-
সেই সুর তোমারই নামের ধ্বনি, ধ্বনির কোরক।
আমার শিরায় ফোটে নক্ষত্রের মতো অবিরাম
কেবলই তোমার নাম, আর যেখানেই চোখ রাখি
দেয়ালে কপাটে কিংবা গাছ-গাছালিতে, ঘর দোরে,
বেড়ালের পিঠে, দেখি সদা জ্বলছে তোমারই নাম।
বলি না কাউকে নাম, শুধু কবিতায় রাখি ধরে
আড়ালে, সে-নাম ভাবীকালে গুঞ্জরিত হবে নাকি?
মূর্তি
না, আমি ভাস্কর নই, রোজ তাল তাল কাদামাটি
নিয়ে মূর্তি গড়ি না, অথবা পাথরের স্তব্ধতায়
পারি না জাগাতে কোনোক্রমে মৃত্যুঞ্জয় ধ্বনি, হায়,
প্রতিমার। আমার আঙুলে নয় দীপ্র জাদুকাঠি,
স্পর্শে যার দেয়াল চকিতে যাবে ছেয়ে কিছু খাঁটি
অজর ফ্রেস্কোয় কিংবা জাগবে জোয়ার সাহারায়,
অথবা উঠবে গড়ে মরুদ্যান; আমিতো ভূতল আস্তানায়
একা ছন্দমিল খুঁজে খনি শ্রমিকের মতো খাটি।
মৃত্যুদন্ড
বেকসুর আমি তবু আমাকেই মৃত্যুদন্ড দিলে।
কী করে তোমার কাছে অপরাধী, এখনো জানি না;
কস্মিকালেও আমি শক্রুতা সাধিনি, শুধু বাণী,
অলৌকিক, প্রেমময়, বাজিয়েছি। সেই সুরে ছিলে
মিশে তুমি বসন্তের পাতার গভীরে, শান্ত ঝিলে,
শস্যক্ষেতে, নীলিমায়। এই কি আমার অপরাধ?
আমার সর্বস্ব দিয়ে রাত্রিদিন একটি নিখাদ
প্রেমস্বপ্ন গড়ি, তা-ও ভেঙে যায় কী ককর্শ ঢিলে।
আমাকে পাঠালে নির্বাসনে, দিলে দন্ড ভয়ংকার।
তোমার সান্নিধ্য থেকে, অমন দৃষ্টির থেকে দূরে,
বহুদূরে চকিতে সরিয়ে দিলে-এই শাস্তি, বলো,
মৃত্যুর চেয়েও বেশি, ঢের বেশি নয় কি কঠোর?
তুমি কি দেখতে চাও সর্বদা আমার ছলোছলো
চোখ? চাও আমার হৃদয় খাক কীট কুরে-কুরে?