প্রকৃতির কাছে
জীবনানন্দীয় পরিবেশে অপরাহ্নে পাশাপাশি,
মনে পড়ে, ছায়াচ্ছন্নতায় আমরা ছিলাম বসে
মাঝে-মধ্যে গাছ থেকে শুক্নো পাতা পড়ছিলো খসে;
উচ্ছ্বসিত বিকেলের রঙ এবং তোমার হাসি
একাকার, প্রকৃতির কাছে আজো কিসের প্রত্যাশী
আমরা ভাবছিলাম। দেখি, হংস-হংসী ঠোঁট ঘষে
পরস্পর উড়ে যায় বিল ছেড়ে; মগজের কোষে
কোষে কী মদির শিখা জ্বলে, বাজে স্বেচ্ছাচারী বাঁশি।
আমিতো পারিনি হতে বনহংস, তুমিও পারোনি
বনহংসী হতে সে বিলের ধারে। পাঁশুটে ভব্যতা
আঁকড়ে ছিলাম ব’সে চুপচাপ, যদিও শিরায়
উঠেছিলো জেগে শত পালতোলা মাতাল তরণী।
বুঝতে পারিনি, হায় তোমার সত্তায় ব্যাকুলতা,
কী-যে ছিলো তোমার চোখের দুটি অসিত হীরায়।
প্রেমিকের গুণ
কেমন প্রেমিক আমি? বহু দীর্ঘ বছরের পর
এ প্রশ্ন তুলছে মাখা অন্ধকার মনের বিবরে।
তুমিও আমার প্রতি, হায়, তারাও এমন ক’রে
আজকাল মাঝে-মাঝে, মনে হয়, প্রশ্নের উত্তর
একান্ত জরুরি- নইলে একটি দেয়াল নিমেষেই
ভীষণ দাঁড়িয়ে যাবে আমাদের মধ্যে। হয়তো ভাবো
কোনো কোনো বিক্ষুব্ধ প্রহরে, আমি কী এমন পাবো
এই খাপছাড়া লোকটার কাছে বস্তুত যা নেই
অন্যের আয়ত্তে আজ? প্রেমিকের গুণাবলী কী-যে
জানি না সঠিক কিছু, শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
যখন আমাকে দ্যাখো তুমি, আমার হৃদয়ে বাঁশি
বেজে ওঠে, চোখে জাগে নতুন সভ্যতা, দীপ্র বীজে
ধনী হয় মনোভূমি। তোমারই উদ্দেশে দুটি হাত
বাড়াই, আবার থামি, পাছে করো ঘৃণা অকস্মাৎ।
ফিনিক্সের গান
আমি তো ছিলাম ভস্মরাশি হয়ে গৌরববিহীন
অন্ধকারে সুনসান এলাকায় অনেক বছর।
আমার ওপর বয়ে গ্যাছে কত যে বৈশাখী ঝড়,
তুহিন বাতাস তীক্ষ্ম ছুঁয়েছে আমাকে রাত্রিদিন।
তবুও নিস্পন্দ একা ছিলাম নিয়ত গমগীন্
অগ্নিদগ্ধ বেহালার ভস্মের মতন স্তব্ধতায়;
করেনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত কেউ, বেলা যায়
বলে আমি করেছি চিৎকার, তবু ছিলো উদাসীন
প্রতিবেশ সারাক্ষণ, পাইনি জীয়ন স্পর্শ কারো।
আমাকে জাগালে তুমি রুক্ষ অবেলায়, দিলে গান
অস্তিত্বের তন্তুজালে। অথচ আমি তো জানি গাঢ়
এই দান ব্যর্থ হবে, যদি নাও বিদায় হঠাৎ।
তোমাকে ডাকছে দূরযাত্রা, বেজে ওঠে অবসান-
সূর্যোদয় দিলে কেন, পাবোই যখন অন্ধ রাত?
বাজপাখি
ক্রূর ঝড় থেমে গ্যাছে, এখন আকাশ বড়ো নীল-
গাছের সবুজ পাতা কেঁপে কেঁপে অত্যন্ত সুষম
বিন্যাসে আবার স্থির। খরগোশের চঞ্চল উদ্যম
আশপাশে, বাজপাখি উঁচু চূড়া থেকে অনাবিল
আনন্দে তাকায় চতুর্দিকে, কোনো নিষ্ঠুর দুঃশীল
চিন্তা নেই আপাতত, বিস্তর বয়স, চোখে কম
দ্যাখে, নখ উদ্যমরহিত, বুকে গোপন জখম,
তবুও ডরায় তাকে নিম্নচারী পাখির মিছিল।
পাহাড়ে পড়েছে তার ছায়া কতদিন, মাঝ-মাঝে
এখনো সে করে যাত্রা মেঘলোকে, যখন হাঁপায়
অন্তরালে গুটিয়ে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত ডানা, চোখ বুজে-
দুঃস্বপ্ন দখল করে তাকে, শোকাবহ সুর বাজে
বুকের ভেতরে, কিন্তু নিমেষেই চৈত্র পূর্ণিমায়
চোখ তার ভাবময়, ডাকে তাকে কে যেন গম্বুজে।
বিচ্ছেদ
একটি গোলাপ স্বপ্নে মোহন ভাস্কর ফরহাদ
দেখেছিলো, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও তার ঘ্রাণ
নিবিড় থাকতো জেগে সর্বক্ষণ, এবং নিষ্প্রাণ
পাথর দেখাতো তাকে গাঢ় স্বপ্ন একটি নিখাদ
প্রতিমার; সে প্রতিমা নিজে এক নতুন বিষাদ
হয়ে দীপ্ত ভাস্করের সত্তাময় বলে অফুরান
কথা, ছেনী হাতে ফরহাদ শোনে নহরের গান
কান পেতে; সেই গানে নেই কোনো মিলন সংবাদ।
আমারও জীবনে আজো মিলনের মুহূর্ত আসেনি।
আমার দৃষ্টিতে তার স্তন যুগল হয়নি উন্মোচিত,
সুস্মিত অধর তার অন্তরালে থাকে চিরদিন,
আমার দোতারা তার শরীর-মেঘনাকে কল্লোলিত
করবে কি কোনোদিন? হবে না বিস্রস্ত তার বেণী?
বিচ্ছেদ-মরুর জ্বালা বাড়ে চরাচরে সীমাহীন।
বিদায় গান
কেন এ বিদায় গান বারবার শোনাও আমাকে?
কেউ কি কখনো মুমূর্ষের কানে কানে আওড়ায়-
ফুরালো তোমার বেলা মগ্ন আমি স্বপ্নের পাড়ায়,
কেন গুঁড়ো ক’রে দিতে চাও কাচের মতন তাকে?
আমি তো স্বপ্নের পথ্যে ক্রমাগত বাঁচাই সত্তাকে।
জীবন কাটাতে চাই সেই দু’টি চোখের তারায়
চোখ রেখে, অথচ আমার দিকে প্রেত পা বাড়ায়
অন্ধকারে, ঘুরি দিশাহারা ভীষণ নিশির ডাকে।
আমাকে বিদায় গান কোনো ছলে শুনিও না আর;
বরং আশ্বাস দাও সান্নিধ্যের এবং চুম্বন
দাও আজ আমার তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠে নিবিড়-মদির।
সে চুন্বনে তপ্ত অন্ধ উদ্বেলিত শেণিতে আমার
উঠবে জেগে অতিদূর শতাব্দীর স্মৃতি-বিস্মরণ
আর নিমেষেই হবে দীপান্বিতা তোমার শরীর।
বিস্মৃতির ডোবায়
বিস্মৃতির ডোবায় আমাকে ছুঁড়ে দিয়ে নিদ্বির্ধায়
সে কি আজ তারাভরা আকাশকে শোভা দ্যাখে, নেয়
গোলাপের ঘ্রাণ কিংবা অন্য কারো আলিঙ্গনে ধরা
দেয় বারবার? না কি শোনে রাতে আমজাদ খাঁর
দরবারী, গাছের সবুজে আর গেরুয়া মাটিতে
বৃষ্টিপাত? বিছানায় নিঃসঙ্গতা ঘুমায় আমার
পাশে আ জপায় আমাকে অন্ধকারে, সে তোমাকে
হেলায় ফেলেছে মুছে দ্রুত জলছবির মতন।
মনকে প্রবোধ দিই। জানলার ধারে গিয়ে দেখি
জনহীন পথ বহুদূরে গেছে বৃষ্টির মঞ্জীর
বুকে নিয়ে, গাছে পাখি নিয়েছে আশ্রয় ভেজা গায়ে।
হয়তো সে ভোলে নি আমাকে। যত আমি তাকে ভুলে
থাকতে চাই ততই মুখশ্রী তার মনে পড়ে আর
মনে হয়, দরজায় রয়েছে দাঁড়িয়ে সে প্রতিমা।