নীরবই থাকবো আজ
নীরবই থাকবো আজ। হে মেয়ে তোমার যত সাধ
গালমন্দ দাও, দাও অপবাদ, চোখের আগুন
ঝরাও আমার সত্তা জুড়ে, যত পারো; করো খুন
আমাকে, দেবো না বাধা, জানাবো না কোনো প্রতিবাদ।
আমাকে হেলায় তুমি ত্যাগ করে যাবে বলে খাদ
জেগে ওঠে চতুর্ধারে যেন গিলে খাবে নিমেষেই।
তোমার নিষ্ঠুরতায় দ্রুত হারিয়ে ফেলছি খেই
জীবনের; সময়-যাপন, মনে হয়, কী বিস্বাদ।
আমিতো তোমার হাতে আমার হৃৎপিন্ড থেকে ছেঁড়া
একটি গোলাপ, খুব টকটকে, করেছি অর্পণ;
তোমার চলার পথে দিয়েছি উড়িয়ে স্বপ্নঘেরা
রঙিন নিশান সংখ্যাহীন আর যখন তখন
পাঠিয়ে কপোত কিছু তোমারই উদ্দেশে দূর নীলে
নিবদ্ধ রেখোছ দৃষ্টি, তবু তুমি বিভীষিকা দিলে।
নৈঃসঙ্গ্য-লালিত আমি
নৈঃসঙ্গ্য লালিত আমি। শিরায় শিরায়, লোমকূপে
কী শীতল স্রোত বয় সারাক্ষণ, অস্থিমজ্জা
নিঝুম পল্লীর মতো। নিজে খাপছাড়া বলে লজ্জা
পাই খুব একান্ত নিজেরই কাছে। নৈরাশের যূপে
প্রায়শ আমাকে ঠেলে দ্যায়, দ্যায় বিরূপ দঙ্গলে
ছুঁড়ে ক্ষিপ্র আমার ভেতরকার কোনো প্রতিপক্ষ
এবং মনুষ্যরূপী মড়াখেকেদের সঙ্গে সখ্য
জমে ওঠে নিত্য দিকচিহ্নহীন অসিত জঙ্গলে।
আমি কি নৈঃসঙ্গপ্রিয় আজীবন? গাছপালা, পাখি
পাখালির ভিড়ে, পশুদের কাছে, খরগোশের গায়ে
মুখ ঢেকে, জনহীন ঝর্নাতলে আনন্দ আনন্দ
ব’লে মেতে থাকতেই চাই জীবনের সব ফাঁকি,
উন্মত্ত সংঘর্ষ রক্ত ফেনিলতা ভুলে বনচ্ছায়ে?
মানুষের সঙ্গ অভিলাষী আমি, থাক শত দ্বন্দ্ব।
পারি না ফোটাতে
তোমার কি মনে পড়ে আলোকিত ঘরে সন্ধেবেলা
তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে, যেন অন্তরাল থেকে
ভীষণ বিকারী কেউ চোখে লালসার রঙ মেখে
তোমাকে দেখেছে ফেলে গগ্ন? অথচ আমার খেলা
বুঝতে পারোনি তুমি; চুপিসারে ছিপছিপে ভেলা
ভাসিয়েছিলাম আমি আটপৌরে বাস্তবকে ঢেকে
একটি স্বপ্নের মসলিনে; আমার ভেতরে পেকে
উঠেছিলো কামফল উজিয়ে সকল অবহেলা।
রাত বাড়ে, তোমার ক্রোধের তাপ আস্তে আস্তে ধিমে
হয়ে আসে, যেমন শঙ্খিনী সাপুড়ের বাঁশি শুনে
শান্ত হয় ক্রমান্বয়ে। ভস্মীভূত বাসনার হিমে
ভিজে মুঢ় বালকের মতো মর্মর মূর্তির পাশে
বসে থাকি চুপচাপ, ভাবি, বৃথাই চলেছি বুনে
শব্দজাল, পারি না ফোটাতে তারা কারো চিদাকাশে।
পিঁপড়ের দ্বীপে
নৈশ ভোজনের পর মার্কিন টাইম ম্যাগজিন
উল্টেপাল্টে তুলে নিই ডিফোর রবিনসন ক্রূশো,
কিছুক্ষণ ঘুরি তার সঙ্গে; কী অদ্ভুত বেশভূষো
নিজের শরীরে দেখি, ছাগগন্ধে এই ঘুমহীন
রাত্রি ভরপুর, অকস্মাৎ পিঁপড়ের ঝাঁক ধেয়ে
আসে চতুর্দিকে থেকে। অতিকায় ওরা, টেলিফোন
তার, খাট, দেয়ালের মাঠ, যেন অত্যন্ত গোপন
ষড়যন্ত্রে বুঁদ হয়ে, উঠছে চেয়ার বেয়ে বেয়ে।
পিঁপড়েগুলি চকচকে লাল গ্রেনেডের মতো,
যে কোনো মুহূর্তে ওরা ভীষণ পড়বে ফেটে, ঘর
নিমেষে কাঠের গুঁড়ো হবে, জলপাইরঙ জীপে
চেপে এসে আমার হদিশ কেউ পাবে না, আহত
আমি রইবো ঢাকা ভগ্নতূপে, দুঃস্বপ্নের এ প্রহর
এত দীর্ঘ কেন? কেন বন্দী আমি পিঁপড়ের দ্বীপে?
পুতুল নাচের ইতিকথা
নিজে সে অলক্ষ্যে থাকে, হাতে তার নানাবিধ সুতো,
কলকাঠি, নানা রঙা, নাড়ে চাড়ে যখন তখন,
এবং যেমন খুশি রাত্রিদিন বলায় ওদের দিয়ে টন
টন কথা, আসলে সে নিজেরই একান্ত মনঃপুত
বাছা বাছা শব্দাবলী আওড়ায়; তার ছলছুতো
বোঝা দায়, তারই কণ্ঠস্বর বাজে, কেবল ক’জন
ওরা ঠোঁট নাড়ে, নাচে পুতুলের আত্মীয় স্বজন
পুষ্পাকুল স্টেজে, মাঝে মাঝে হয় বটে তালচ্যুত।
এ এক মজার খেলা চলে রাত্রিদিন। এজলাসে
ভারিক্কী বিচারপতী, চুপচাপ, আসামী হাজির।
চতুর উকিলদ্বয় তোতাপাখি। পরিণামহীন
মামলায় শুধু বাদ-বিসম্বাদই সার; চোখে ভাসে
সুতোবন্দী নানাজন, কেউকেটা, উজির, নাজির।
যার হাতে সুতো সেকি নিজেও পুতুল সমাসীন?
পুলিশও প্রত্যক্ষ করে
ক্ষমাহীন নিষেধের বেয়নেট উদ্যত চৌদিকে
এবং ডাইনে বাঁয়ে কাঁটাতার, যেন বর্ধমান
ফণিমনসার বন। ব্যক্তিগত নিবাসসমূহ
গিসগিসে গোয়েন্দার অবাধ আস্তানা, শিরস্ত্রাণ-
নিয়ন্ত্রিত জীবনের, কিছু গনতান্ত্রিক বিকার
এখনো গোলাপ চায় এ মড়কে। মৃত্যুভয় ফিকে
হ’য়ে এলে আমাদের প্রিয় লুম্পেন ইচ্ছার ব্যূহ
হিজড়োর মতন নেচে ওঠে নিরাশ্রিত চমৎকার।
প্রধান সড়কে আ প্রতিটি গলির মোড়ে মোড়ে
কাঁটামারা জুতো ঘোরে। এরই মধ্যে হতচ্ছাড়া মন
তোমার সংকেত পায়, হৃদয়ের সাহসের তোড়ে
আমরা দু’জন ভেসে চলি রূঢ় পথে স্বপ্ন বেয়ে।
বনেদী বাড়ির চোখ, গাছপালা, পাখি দ্যাখে চেয়ে,
পুলিশও প্রত্যক্ষ করে আমাদের প্রথম চুম্বন।
পূর্বপুরুষের রক্ত
আমার শিরায় পূর্বপুরুষের রক্ত কী উচ্ছল
নাচে আগোচরে। অগ্নিকুন্ড, বর্শা অসি ক্ষুরধার,
স্বেদসিক্ত ঘোড়া, চিত্রায়িত রাঙা কাচ, সিংহদ্বার
ঝলসানো হরিণ এবং মল্লযুদ্ধ রক্তোৎপল
মাঝে মধ্যে আনে ঘোর স্তরে স্তরে অবচেতনের।
আমিও ছিলাম সেই দূর শতকের সুবিশাল
দূর্গের প্রাকার আর আমার গন্ডারচর্ম ঢাল
ঝলসে উঠেছে রণক্ষেত্রে, ডঙ্কা শক্রূ হননের
নেশা ধরিয়েছে রক্তে। আবার এ কোন সুপ্রাচীন
ভেসে ওঠে জলজ্ব্যান্ত? নিভৃত প্রকোষ্ঠে বসে শীতে
নিমগ্ন কিসের ধ্যানে সে মানব এমন একাকী?
চঞ্চল পালক তার হাতে, কোনো মায়াবী সংগীতে
যেন সে গভীর আন্দোলিত, তার দিকে চেয়ে থাকি
নিষ্পলক; সে-তো আমি, গানে-পাওয়া, আর্ত উদাসীন।