- বইয়ের নামঃ মাতাল ঋত্বিক
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ বিভাস
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অথচ তোমার মধ্যে
ছায়াতেই থেকো তুমি, বাইরে যেও না। ইদানীং
রোদ্রে বড় বেশি আঁচ, উপরন্তু পাজীর পা ঝাড়া
এ সময়, কী বেয়াড়া লোকজন। এ পাড়া ও পাড়া
সর্বত্র লুটেরা ঘোরে, আর কত যে পার্টি মিটিং,
বশ্ম্বদ, কবন্ধ তো বটে, চলে বিরামবিহীন।
আড়ালে থাকবে তুমি নির্বিবাদে, কোমল রাত্তিরে
বলবো তোমার কানে কানে কথা, জোনাকির ভিড়ে,
মল্লিকার কাছে যাবো, স্বপ্ন-মসলিনে হবো লীন!
অথচ তোমার মধ্যে কী-যে এক বিদ্যুৎ চমক
খেলে যায় বারংবার, বুঝি তাই গোলাপে, জবায়
খোঁজো তুমি জীবনের ভিন্নরূপ, চিরচেনা ছক
ছেড়ে সহজেই চলে আসো, বলো আমার উদ্দেশে-
থাকবো তোমারই পাশে রৌদ্রদগ্ধ পথে, যাবো ভেসে
জাগর জোয়ারে দীপ্র, যাবো রুদ্র মিছিলে, সভায়।
অনুবাদ
তোমার ঘুমানো, জেগে-থাকা, হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া
ঘর ছেড়ে কিংবা শীর্ণ ভিখারীর ক্ষয়া হলদে দাঁতে
চোখ রাখা, কাজান্তজাকিস পড়া, স্তব্ধ মধ্যরাতে
সুদূর গ্রীসের কথা ভাবা, ছিপছিপে নৌকো বাওয়া
স্বপ্নের অসীম ঝিলে বুকে নিয়ে স্মৃতিময় হাওয়া,
মরণ আবৃত্তিকারী এক ঝাঁক লাল-নীল বুড়ো
কাকাতুয়া দেখা, চোখে অতিদূর পূর্ণিমার গুঁড়ো,
বেডশীট আঁকড়েধর- সবই কে ধরনের পাওয়া।
ধরা যাক অর্থহীন সকল কিছুই, তবু তুমি
সযত্নে এসব কোনোদিন হয়তো করবে অনুবাদ।
শহুরে প্রচ্ছন্ন গলি, সবুজ পুকুর মহল্লায়
প্রত্যহ ভ্রমণকারী জন্মান্ধ কুকুর, বধ্যভূমি,
গোধূলিতে বেশ্যার মতন রাঙা, মৃত মুখ, খাদ-
এ-ও কি তোমার হাতে দীপ্র অনূদিত হতে চায়?
অর্ফিয়ূস, ১৯৭৮
কোথায় ফেলেছি বীণা, মনে নেই। মোটর বাইকে চেপে
দূটো মূর্তি দ্রুত ছুটে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আহত তরুণ কবি। আমি আর গেরস্তের ঘরে
পারিনা থাকতে, ছুটে যাই, চতুর্দিকে আসে ব্যেপে
লোকজন, আসবাবপত্র তছনছ আর কেঁপে
ওঠে রাজপথ, গূঢ় রহস্যের সচকিত স্তরে
হেঁটে যায় কে মোহিনী, গুহাহিত ক্ষুধিত প্রস্তরে
বারবার এলোমেলো মাথা কুটি কী কৃষ্ণ আক্ষেপে।
আমার ইউরিদিকে হাসপাতালের কাছে এসে
মূর্ছা যায়, বীণা একপাশে মৃত পাখির মতন
পড়ে আছে। ইউরিদিকের চেয়ে বেশি ভালোবেসে
মৃত্যুরই গেয়েছি গান। নইলে কেন তাকালাম ফিরে?
এলোকেশী নারীসংঘ এসে আমাকে আক্রোশে ছিঁড়ে
ফেলে; দর্পণেরে করি আলিঙ্গন, স্বচ্ছ আলিঙ্গন।
অসামান্য তিথি
অনেক বছর আগে আমি ভালোবেসেছিলাম যাদের
তারা আজ অতিশয় আবছা বিবর্ণ ফ্রীজ শটে।
অকস্মাৎ কোনো কোনোদিন ওরা স্মৃতির নিকটে
চাঞ্চল্য প্রার্থনা করে গূঢ় ইন্দ্রজালে শরীরের
খুব কাছে এসে। অশরীরী ছায়ার মতন ফের
করে ব্যবহার নিমেষেই। দৃশ্যপটে কী-যে ঘটে,
ওরা মিশে যায় বায়ুস্তরে; শোনো, বলি অকপটে-
চিরদিন কিছু ছায়ামোহ থেকে যায় মানুষের।
কিন্তু তুমি ছায়া নও, নও তুমি অশরীরী কেউ,
তোমার বেদেনী-চোখ, ক্ষীণ কটি আর স্তনভার
নিয়ে তুমি আজো কী সজীব জ্বলজ্বলে উপস্থিতি।
যেখানেই থাকো, যতদূরে বিস্মৃতির ক্রূর ঢেউ
তোমাকে সরিয়ে নিতে পারে না কখনো; বারবার
ফিরে আসে আমাদের কী মদির অসামান্য তিথি।
অসিত উত্থানে
চতুষ্পার্শ্বে যাচ্ছে শোনা মুহুর্মুহু পিশাচের হল্লা,
ওদের শরীরে পচা মাংসের উৎকট গন্ধ, বুনো
অন্ধকারে পদশব্দ এলোমেলো, ক্ষুধার্ত শকুনও
পালায় সে দৃশ্য দেখে; অতিশয় সন্ত্রস্ত মহল্লা।
প্রতিটি মুহূর্ত কাটে, যেন কোনো ভীষণ দন্তুর
নেকড়ে ছিঁড়ছে খরগোশ। সর্বব্যাপী ভয়ংকর
অসিত উত্থানে বুঝি না কে শক্রু মিত্র কেবা। খর
ছলনায় খল মাতে, হতবুদ্ধি বান্ধবও জন্তুর
মতোই আমার দিকে আসে ধেয়ে। আজ ছদ্মবেশ
করেছি ধারণ, নইলে আত্মরক্ষা দায়। প্রেমিকার
সঙ্গেও ট্রাজিক চতুরালি চলে, বোঝে না সে কারা
ক্রীড়নক বানিয়েছে ওকে, তার রুক্ষ এলোকেশ
ভাসবে নদীর জলে, ভাঁড় হবে মূক, আমি পরিখার
পাশে করোটির সঙ্গে জুড়বো আলাপ দিশেহারা।
অসুস্থ ঈগল নীলিমায়
অসুস্থ ঈগল নীলিমায় তার পক্ষ বিস্তারের
স্মৃতি নিয়ে যেমন অনেক নিচে সময়ের ভার
ব’য়ে চলে, ক্ষীণ দৃষ্টি মেলে দূর নীলিমায়র
দিকে দ্যাখে মাঝে মাঝে, কখনোর পাহাড়ের
চড়ার সৌন্দর্য ভাবে, তেমনি আমিও হাহাকারের
প্রতিমৃর্তি হয়ে রুক্ষ ধুলায় ছিলাম পড়ে ধার
ছিলোনা অস্তিত্বে প্রায়, আতংকিত বিধ্বস্ত ডানার
প্রতিটি পালকে চিহ্ন নিষাদের ক্রূর প্রহারের।
সহসা ধুলায় কী সুন্দর ফুলের সম্ভার জাগে,
আর রুক্ষ কৃষ্ণপথে বসন্তবাহার মুখরিত,
তোমাকে দেখেই রোগা ঈগলের আর্ত চক্ষুদ্বয়
যৌবনের মতো জ্বলজ্বলে হয়, দীপ্র অনুরাগে
বুকের ভেতর হ্রদ দুলে ওঠে, পুনরায় ভীত
সন্ত্রস্ত সত্তায় তার উদ্ভাসিত বাঁচার বিস্ময়।
আততায়ী
বহুদিন থেকে তাকে আমি খুব চোখে চোখে রাখি,
এবং সে আমাকেও। কতদিন তাকে স্তব্ধ রাতে
দেখেছি নিঃশব্দে হেঁটে যেতে কী নির্জন ফুটপাতে।
সমুখে চায়ের কাপ নিয়ে নিষ্পলক চেয়ে থাকি
পরস্পর মাঝে-মধ্যে। বই পড়ে, লেখে সে একাকী
টেবিল ল্যাম্পের নিচে আলোদ্বীপে আত্মবন্দী, মাতে
কল্পনায়; সর্বক্ষণ আমরা থাকি গূঢ় এক সাথে,
একই রুটি ভাগাভাগি করে খাই, দেখি একই পাখি।
অভিমানে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে
বহুকাল তীব্র একাকিত্বের তুহিন কূপে বাস
করে ফিরে আসে ফের মনুষ্য নিবাসে অবিশ্বাস
ঝেড়ে ফেলে; প্রতিদিন তাকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে
বেললাইনের দিক নিয়ে যাই, আমার নিশ্বাস
কেড়ে নিতে চায় সে প্রায়শ ছোরা গলায় বসিয়ে।