Site icon BnBoi.Com

তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি – শামসুর রাহমান

তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি - শামসুর রাহমান

 অঙ্গুরি এসেছ তুমি

অঙ্গুরি এসেছ তুমি ফিরে অজ্ঞাতবাসের পর
আমার এ ঘরে আজ। বহুদিন ছিলে অন্ধকারে
বস্তুত গা ঢাকা দিয়ে; তোমাকে ভেবেছি বারে বারে,
দেখেছি তোমার স্বপ্ন কত, ইতিমধ্যে বহু ঝড়
ঝাপ্টা গ্যাছে, বিস্মৃতির এক্কা দোক্কা তোমার খবর
সহজে ফেলেছে মুছে কখনো সখনো। কোন্‌ তারে
কখন লেগেছে সুর পুনরায় কোমল গান্ধারে,
আমিতো পাইনি টের; ছিল খুব হৃদয়ের জ্বর!

হে অঙ্গুরি, তোমার শরীরে লতাগুল্ম, বুনো ঘাস,
গৃহত্যাগী যুবকের স্বেদ, ধুলো ইত্যাদির ঘ্রাণ
লেগে আছে, সবচেয়ে বেশি আছে ভালোবাসবার
সাধ ও ক্ষমতা যা সহজে মুমূর্ষুকে পারে প্রাণ-
শক্তি ধার দিতে আর লহমায় দূরের আকাশ
বুকে এনে স্বপ্ন দেখাতেও পারে ঘর বাঁধবার।
১৬.৫.৯৬

অনেক শতাব্দী জুড়ে

অনেক শতাব্দী জুড়ে প্রতিক্ষণ আমার হৃদয়
বস্তুত স্পন্দিত হচ্ছে তোমার জন্যেই। বিষণ্নতা
প্রত্যহ আমাকে ঘাট থেকে ঘাটান্তরে নানা কথা
জপিয়েছে, চেয়েছে ফেলতে মুছে ধ্যানের সময়,
যাতে ভুলে থাকি তোমাকেই, তবু আমি সুনিশ্চয়
ভ্রমের গোলকধাঁধা আর বহুরূপী বিরূপতা
উজিয়ে বিস্ময়ে দেখি গোধূলিতে তুমি অবনতা
বঙ্গোপসাগর তীরে আমার জন্যেই, মনে হয়।

কখনো মহেঞ্জোদারো অথবা কখনো মথুরায়
ছিলে, পায়ে মল বেজে উঠতো মধুর নিশাকালে,
কখনো সমরখন্দে, কখনো বা বোখারায় জানি
সুরতের রোশ্‌নি তোমার শায়েরের তারানায়
ঝলসাতো বারবার। কখনো বাংলার মত্ত খালে
বাইতে মহুয়ারূপে আমারই উদ্দেশে তরীখানি।
৮.৯.৯৬

অশনি সঙ্কেত

চাঁদের আংশিক ক্ষয় আর নক্ষত্রের ত্রস্তরূপ
দেখে বুড়ো শিরিষের ডালে রাতজাগা প্যাঁচা বলে-
‘কবি আর বুদ্ধিজীবী হননের কাল ফের শুরু
হলো বুঝি! জেনেছি, সদর স্ট্রিটে ক’জন সন্ত্রাসী
ক্রোধে জ্বলে একজন দীপ্ত বুদ্ধিজীবীকে শাসায়
সতেজ জীবনকে প্রাণহীন ধূলায় লুটিয়ে দেবে
বলে ক্ষিপ্র বুলেটে, আরেকজন অপহৃত হতে
হতে কোনোমতে জীবনের কণ্ঠলগ্ন থেকে যান।

কী কসুর তাঁদের? বস্তুত যারা অন্যের ভিটায়
প্রায়শ চড়ায় ঘুঘু, ছড়ায় আন্ধার চতুর্দিকে,
শহরকে জঙ্গল বানাতে চায় ক্রূরতায় মজে,
ওদের বিপক্ষে দৃঢ়চিত্ত কবি আর বুদ্ধিজীবী
আমজনতাকে বাগানের, অন্ধ কুয়ো নয়, নীল
সমুদ্রের স্বপ্ন আর ঠিক পথ দেখান সর্বদা।
৮.২.৯৭

আজ কার কাছে

আজ কার কাছে উন্মোচন করি আমার হৃদয়?
এই যে বাড়ির কাছে গাছপালা দাঁড়ানো সেগুলো
এখন সবুজ মনে হচ্ছে না তেমন, আকাশের
নীলিমা, নক্ষত্র আকর্ষণহারা, যে গায়ক পাখি
রেলিঙে বসলো এসে তার শিস কেমন বেসুরো
লাগে আর মহান দান্তের কাব্যগ্রন্থ ‘নরক’-এর
মাত্র দু’তিনটি পঙ্‌ক্তি পড়ার পরেই রেখে দিই,
রবীন্দ্রনাথের গানও আন্দোলিত করে না আমাকে।

এ শহর থেকে তুমি বিদায় নেওয়ার পর এই
অত্যন্ত করুণ হাল হয়েছে আমার, প্রিয়তমা।
হৈ-হৈ বইমেলা, মানুষের ভিড়, আড্ডা, মদ্যপান-
কিছুই লাগে না ভালো। একা একা থাকি, নিজেকেই
ছন্নছাড়া প্রেতপ্রায় মনে হয়। নিভৃতে হৃদয়
খুঁড়ি, ঘুরি, খুঁজি আমাদের অন্তরঙ্গ ক্ষণগুলি।
১২.২.৯৬

আন্ধারে হারিয়ে পথ

আন্ধারে হারিয়ে পথ বেদিশা ঘুরেছি কতকাল
জটিল অরণ্যে, গণকবরের বিরানায়; খাদে
আর চোরাবালিতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যেতে
যেতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি। রক্তপায়ী বাদুড়ের
ডানার আঘাতে, চিতাবাঘের থাবার হামলায়
সন্ত্রস্ত ছিলাম বহুকাল। কখনো কখনো পথ
খোঁজার উদ্যম লুপ্ত হয়েছে, মোহিনী রূপে কত
ডাকিনী নিয়েছে ডেকে গুহায় সংহারে অবিচল।

হতাশায় চুল ছিঁড়ে, মাথা কুটে শ্মশান ঘাটের
কাছে, গোরস্তানে পথক্লেশে পরিশ্রান্ত ঘুমিয়েছি
সর্পিনীর ফণার ছায়ায়। অকস্মাৎ তুমি এসে
আমাকে প্রকৃত পথ দেখিয়ে সম্মুখে নিয়ে গিয়ে
বললে, দ্যাখো, আমাদের গন্তব্যের স্বর্ণচূড়া কাছে
এসে গ্যাছে, এইতো অদূরে বেজে ওঠে নহবৎ।
১০.২.৯৬

আবার নিভৃতে

আবার নিভৃতে বসন্তকে কী ব্যাকুল আলিঙ্গন
করলাম রাত্রির প্রথম যামে; জ্যোৎস্না ঝলসিত
সরোবরে স্নিগ্ধতায় অবগাহনের অনুপম
মুগ্ধতা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল অলকনন্দার
তটে যেন মন্ত্রবলে। পুনরায় বাঁচার আনন্দে
আশ্চর্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠি, গীতবিতানের পাতা
খুলে বসি, গীতধারা বয় শিরায় শিরায় আর
ওষ্ঠ সিক্ত হয় ক্ষণে ক্ষণে পুলকের মদিনায়।

এ প্রখর শীতে অনুভব করি আমার শরীরে
গজায় সবুজ পাতা, রঙ-বেরঙের ফুল ফোটে
অকস্মাৎ বহুদিন পর। সে, রূপসী সাহসিকা,
আমাকে জাগিয়ে তোলে শোকগ্রস্ত ভস্মস্তূপ থেকে
কী সহজে; করিনি শিকার কুড়া বন-বনান্তরে,
তবুও পেয়েছি আমি মলুয়াকে কদমতলায়!
২১.৬.৯৬

আমাকে অস্থির করে

আমাকে অস্থির করে কী লাভ তোমার, প্রিয়তমা?
এই যে আমার নিদ্রা নির্বাসিত মাঝে-মাঝে, দম
বন্ধ হয়ে আসে কোনো কোনো দিন, অকস্মাৎ যম
করে উপদ্রব, চতুর্দিকে খুব গাঢ় হয় অমা
তাতে তুমি ভাসো কি সুখের সরোবরে? করো ক্ষমা
আমার কসুর হলে অথবা স্খলন হলে কম
কিংবা বেশি; তুমি তো ভালোই জানো, এই বেরহম,
অশুদ্ধ সময়ে শুধু পতনের কালি হয় জমা!

নক্ষত্র, সজীব নদী, গাছের পত্রালি জুড়ে থাকে
অস্থিরতা, কখনো তা চোখে পড়ে কখনো-পড়ে না;
বস্তুত আমার সিংহভাগ ছটফটি আড়ালেই
থেকে যায়। কবিতা লেখার কালে যে-ঝড় আমাকে
ধ্বস্ত করে, তারও বেশি ছন্নছাড়া প্রাণের এরেনা
আমার তোমার কষ্টে। মনে আজ প্রসন্নতা নেই।
৬.৭.৯৬

আমার এ ছোট ঘর

আমার এ ছোট ঘর সামান্য হলেও আহরণ
করেছে জ্ঞানের নুড়ি। ইতিহাস, দর্শন সে জানে
কিছু কিছু, বিশ্বকাব্য আর রবীন্দ্রনাথের গানে
নিয়ত হয়েছে স্নাত এবং করেছে অন্বেষণ
মণিরত্ব নৃতত্ত্বের অন্ধকারে। এ ঘর মোহন
বাঁশি শোনে মধ্যরাতে, সর্বক্ষণ প্রগতির টানে
মজা খাল নয়, সমুদ্রকে চায়; তিমিরের কানে
জপায় আলোর মন্ত্র নিত্য, তা জানে আমার মন।

আমার জামার ঘ্রাণ, জুতোর গড়ন, হাঁচি, কাশ,
দীর্ঘশ্বাস, হাসি, ঘুম-বেবাক মুখস্থ এ ঘরের।
আমার এ ঘর ভিন্ন সাজে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে,
যখন কবিতা আর গৌরী মাঝে-মধ্যে চলে আসে,
আমার নিবিড় কাছে বসেন, যুগপৎ নীলাকাশ
আর শান্তি নীড় হয় ঘর, ঢেউ জাগে আনন্দের।
১৮.৩.৯৬

আমার ব্রত

তরুণ উজ্জ্বল তিনজন কবি গাঢ় সায়াহ্নকে
ঝাঁঝালো দুপুর করে আমার পড়ার ঘরে এসে
বলে, ‘ওরা আপনার দিকে ছুঁড়েছে বিস্তর কাদা
খোলা পথে শাঁসালো মণ্ডপে; আমরা তা কিছুতেই
আর মেনে নেবো না, জবাব দিতে চাই এই নোংরা,
ক্লিন্ন আচরণটির। স্পষ্টত ওদের চোখে ছিল
উষ্মা আর বেদনার ঈষৎ গোধূলি। আমি হেসে
কবিতা ঢেউয়ে ভেসে চকিতে উত্তর-আধুনিক।

আমার পড়ার ঘরে তিনজন তরুণ কবির অস্তমিত
ক্ষোভ ভালো লাগে, জমে ওঠে দিব্যি ষড়জে নিখাদে
আলাপ এখনকার কবিতা বিষয়ে। ওরা নিলে
বিদায় ফুরফুরে মনে, উদার আকাশে মগ্ন হই,
নক্ষত্রপাড়ার গুঞ্জরণ শুনি, তার কথা মনে
পড়ে; ভাবি, কাদাতেই ফুল ফোটানো আমার ব্রত।
৪.২.৯৭

আমার হারিয়ে-যাওয়া ডায়েরি

আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়েরিটি মধ্যরাতে এসে
প্রেতের ধরনে হাসে, যেন সেই হাসিতে ক্রন্দনই
বেশি ছিল; বল্‌ল ধূসরিম কণ্ঠে, “আমাকে অনেক
অবহেলা করেছো হে কবি, কোন্‌ সে আঁধারে তুমি
আমাকে রেখেছ ফেলে, আমার শরীরে ঢের ধুলো
পুরু হয়ে জমেছিল। একবারও ভুলে পাতাগুলো
খানিক দেখনি খুলে; হায়, তাকাওনি ভালোবেসে
পুরোনো পাতার দিকে কিংবা স্নেহভরে ক’বছর।

অথচ সুদূর একাত্তরে ভরেছ আমার পাতা
বেদনার্ত কিছু কবিতায়, কখনো হয়েছি স্নাত
তোমার অশ্রুতে আর তুমি বারবার বুকে টেনে
নিয়েছ আমাকে আর রেখেছ আগলে অগোচরে,
ছিলাম লুকানো যত্নে। আজ আমি অভিমানে, ক্ষোভে
হারিয়ে গিয়েছি শূন্যে, ইতিহাসে হলো নাকো ঠাঁই।“
২২.১.৯৬

আমি কি নিজের ঘরে

আমি কি নিজের ঘরে বসে একা পেশেন্স খেলেই
সময় কাটিয়ে দেবো? অন্য কিছু করার বাসনা
মগজে তোলে না মাথা। এমনকি কবিতার কণা
উদার প্রকৃতি থেকে আজ কুড়ানোর সাধ নেই;
নিজেকে বিরান চর মনে হয় এই সকালেই,
যেহেতু তোমার কণ্ঠস্বর, হে আমার সুলোচনা,
শুনছি না দু’শতাব্দী ধরে; তোমাকে যে দেখব না
কতকাল তা জানি না; চিন্তার হারিয়ে যাচ্ছে খেই।

এখন আমাকে দেখে যে কেউ সহজে নেবে বুঝে
আমি যে ভূতলবাসী। তাজা রোদ, জ্যোৎস্না বহুকাল
আমাকে করেনি স্পর্শ; আমার চোয়ালে পাবে খুঁজে
লুণ্ঠিত বাড়ির ছায়া; সারারাত বাঘিনীর ছাল
ঝুলে থাকে আমার ওপর, চেয়ে থাকি নিষ্পলক
এক উন্মাদের দিকে, বুকে জ্বলে অসুস্থ ঝলক।
১২.৭.৯৬

 আষাঢ়ী পূর্ণিমায়

পুনরায় চুপিসারে দয়ার্দ্র আষাঢ়ী পূর্ণিমায়
দেখা হলো আমাদের, যেন ক্লাশ-পালানো দু’জন
ছাত্রছাত্রী সেরে নিয়ে অন্তরঙ্গ সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ
জ্যোৎস্নার চুম্বন নিয়ে দেহমনে চীনা রেস্তোরাঁয়
খুঁজে নিই অস্থায়ী আশ্রয়। নিভৃতির প্রত্যাশায়
একটি কেবিনে ঢুকি; দৃষ্টিপথে তোমার যৌবন
আশ্চর্য ঝলসে ওঠে, সরোবরে চাঁদিনী যেমন;
হৃদয়ে হরিণী এক হাঁটে চর্যাপদের ভাষায়।

সহজে পাই না এরকম মুহূর্তের উপহার
এ শহরে; কেবলি জড়িয়ে যাই সুকঠিন লতা
আর ক্যাকটাসে, সারা শরীর, দু’চোখ ছিঁড়ে ফেটে
যেতে চায়। এরই মধ্যে কালেভদ্রে ভুল লোকাচার
এ মিলন উদগ্র মরুর বুকে মরূদ্যান যথা-
যতদিন বেঁচে আছি, অন্তত এভাবে যাক কেটে।

১০.৮.৯৬

ঈগল এবং আমি

আমাকে প্রায়শ এক স্বাস্থ্যেজ্জ্বল স্বর্ণাভ ঈগল
উপহাস করে দূর পর্বতশিখর থেকে; ঠারে
ঠোরে দ্যাখে দাগাবাজ অসুখ আমাকে বারে বারে
বেড়াল-ইঁদুর খেলা খেলে, আর করে বেদখল-
রোদে ঘুরে বেড়ানো বৃষ্টিতে ঝিম ভেজা-এ সকল
ছোট ছোট সুখ থেকে। তার সঙ্গে শীতসাঁঝে হিম
সয়ে বাগিচায় বসা কি কঠিন, চোখের পিদিম
এখনই নিভল বলে, গ্রর্ন্থপাঠ হতেছে নিশ্চল

স্বর্ণপ্রভ হে ঈগল জেনেছি তোমার তকব্বরি
প্রসিদ্ধ জগতে, কিন্তু জেনে রাখো আমিও চূড়ায়
আমি পক্ষী, যেখানে পুষ্পিত করে বসবাস গৌরী
আমার আপন মনে; তোমার মতোই অধীশ্বার
আছি, করায়ত্ত যার রত্নদ্বীপ, তারার গুঁড়ায়
গড়া, যার তীরে বাঁধা ইচ্ছাতরী এক অনশ্বর।
১২.৪.৯৬

 উৎসব

আজ উৎসবের দিন; চতুর্দিক খুব ঝলমলে
পোশাকে সেজেছে যেন। মিহি বৃষ্টি, দূর আকাশের
ঘন আবলুসী মেঘ আনন্দ-চঞ্চল মানুষের
মুখ ম্লান করে দিতে ব্যর্থ হলো। কোন্‌ যাদুবলে
এ শহর গলায় আলোর নেকলেস নিয়ে জ্বলে
এমন আন্ধারে? শুধু আমি এ আনন্দ বাসরের
ছটা থেকে বঞ্চিত, ফলত আজ নিজের ঘরের
কোণে একা মগ্ন ধ্যানে; অন্যেরা মেতেছে কোলাহলে।

উৎসবের ঝর্নাধারা কী করে করাবে ফুল স্নান
আমাকে যখন আমি বিচ্ছেদের স্রোতের কামড়ে
ক্ষয়ে যাচ্ছি প্রতিক্ষণ? যার নাম করি উচ্চারণ
বারবার জাগরণে, এমনকি স্বপ্নের ভেতরে,
যে আমার অন্তরে বাহিরে নিত্য গুঞ্জরিত গান,
সে নিজেই অন্যত্র উৎসব হয়ে জ্বলে সর্বক্ষণ।
২৯.৪.৯৬

এ শহরে এক কোণে

এ শহরে এক কোণে নিরিবিলি করে বসবাস
একজন লোক, প্রায়শই কী জানি কীসের ঝোঁকে
শব্দ দিয়ে ভরে খাতা, ফলে কবি তাকে বলে লোকে।
কেউ কেউ আসে তার কাছে নিতে মনের সুবাস
নিজেরই অজ্ঞাতে আর সুন্দরের, শিবের আভাস
পেয়ে যায়। লোকটা কখনো কারো খোলা পথে কাঁটা
বিছায় নি, অমঙ্গল করে নি কামনা কারো, ঝাঁটা
মারে নি কাউকে ক্রোধে, চিত্ত তার সুনীল আকাশ।

তবু তাকে গঞ্জনা সইতে হয়, শজারু খোঁচায়
যখন তখন, ঠাট্রা-তামাশার উৎস হয় কোনো
কোনো আড্ডা, গুলজার চায়ের আসরে। লোকটার
কসুর সে দিনরাত সুরছুট পরিবেশে, হায়,
সুরের সাধনা করে! বিপক্ষের শত উপেক্ষার
হিমে স্থির আর দিশেহারা নয় তারিফে কখনো।
৩০.৪.৯৬

 এই সন্ধ্যেবেলা

আজকের সন্ধ্যেটির নির্জনতা আমাকে কাতর
করেছে ভীষণ, ইচ্ছে হলো নদী আনি, মাঠ, গাছ
নিয়ে আসি, আনি দোল পূর্ণিমার তিথি আর নাচ
দেবদূতদের নদীতটে। তুমি স্মৃতির আতর
সিল্কের রুমালে নিয়ে আসবে এখানে, থর থর
হৃদয়ে অপেক্ষা করি, অথচ তোমার শাড়িটিকে
ঝলসাতে দেখছি না একবারও এখনো এদিকে;
আমার সত্তায় বয় কী-যে স্থিতি ওপড়ানো ঝড়।

এই সন্ধ্যেবেলা তুমি ছিলে না আমার পাশে খুব
অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে এবং চতুর্দিকে ছিল ধু ধু
মরুভূর দীর্ঘশ্বাস, নিঃসঙ্গতা আমাকে লেহন
করছিলো কুকুরের মতো, আমি বারবার ডুব
দিচ্ছিলাম অসহায়তার জলে। ঘাটে ছিলো শুধু
তলাহীন নৌকা এক, কিয়দ্দূরে ভয়ঙ্কর বন।
১৩.৩.৯৬

এইতো দু’দিন পরে

এইতো দু’দিন পরে তুমি চলে যাবে পরদেশে
এ শহর ছেড়ে; ভ্রমণের আনন্দে তোমার মন
ভরপুর-এ কথা বলি না। তবু তুমি চলে যাবে,
তোমাকে যেতেই হবে, যদিও এখানে আমি একা
থাকব লুকিয়ে মনোবেদনা তোমার না থাকার
হেতু, বিচ্ছেদের দিনগুলি রাতগুলি হিংস্রতায়
বসাবে ধারালো দাঁত-নখ হৃদয়ে আমার আর
শোকগ্রস্ত এ ঘর প্রত্যহ খুব করবে বিলাপ।

যাবো না তোমার বাড়ি, কেননা দরজা, দ্বাররক্ষী,
সিঁড়ি, সোফা, কোমল গালিচা জানাবে না অভ্যর্থনা
আমাকে সেখানে তুমিহীনতায়। স্মৃতির সুঘ্রাণ
নেয়ার আশায় সে বাড়ির কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে
হলেও থাকব দূরে। ফিরে এলে স্বগৃহে ক্লান্তির
ভারে নত, আর্তকণ্ঠ সিঁড়ি আমাকে প্রবোধ দেবে।
৬.২.৯৭

এইসব ফুল

ঘুম থেকে জেগে দেখি টেবিলে সাজানো কিছু ফুল,
যে-ফুল দেখেছি স্বপ্নে অচিন উপত্যকার গাছে।
জানি, সে নীরবে রেখে গ্যাছে ফুল হৃদয়ের কাছে
অগোচরে, ফুলগুচ্ছ ঘিরে গীত হয় বুলবুল
ক্ষণে ক্ষণে কে জানে কী সুখে! পৃথিবীতে কোনো ভুল
কোথাও হয়নি যেন আজ; হতাশ মুমূর্ষ বাঁচে,
এমনকী ধূমায়িত আমারও সত্তায় আলো নাচে
অমেয় সৌরভে; এই জানলায় ওড়ে কার চুল?

মহান আলিগিয়েরি দান্তের উদ্দেশে কোনো নারী
দূর ফ্লোরেন্সের বাগিচায় একা, করি অনুমান,
চয়ন করেছে ফুল একদা সপ্রেম; হয়তো-বা
কবির অমর কাব্যে সে-পুষ্পের অপরূপ শোভা
নিভৃতে পেয়েছে ঠাঁই। যে-ফুলে আমার এই বাড়ি
হেসে ওঠে, তার কিছু ঘ্রাণ পাবে কি আমার গান?
৮.৪.৯৬

 একজন কবি দেখছেন

কচ্ছপের উদোম পেটের মতো বিন্যস্ত টেবিলে
একটি গোলাপ নম্র শুয়ে আছে খাতাটির বুকে
সেই কবে থেকে, মনে হয় দান্তের নির্বাসনের
কাল থেকে। আজ কোন্‌ আর্সেনিক আর কীট মিলে
কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে? একজন কবি ধুঁকে ধুঁকে
দেখছেন পারমাণবিক দহন বির্বাপণের
আয়োজন নেই কোনো; ক্রুদ্ধ এরোস্পেস খাবে গিলে
সভ্যতার হাড়গোড়, অনন্তর হিশেব নিকেশ যাবে চুকে।

চূর্ণ এরোড্রোম আর হাইরাইজ বিল্ডিং-এর
স্তূপ থেকে না-মানুষ, না-জন্তু বেরিয়ে ইতস্তত
চরে বুঝি হারানো স্মৃতির মোহে শারদ জ্যোৎস্নায়।
সেসব প্রাণীর রূঢ় পদতলে গীতবিতানের
পোড়া পাতা পিষ্ট হয় আর স্তনের ক্ষতের মতো
দগদগে নক্ষত্রেরা উপহাসে মেতে মদ খায়!
৯.১০.৯৬

একটি পুরনো ফটোগ্রাফ দেখে

যখন পুনেরো বছরের তটে তোমার শরীর
তরঙ্গিত নিরিবিলি সেই তোমাকেই দেখলাম-
রয়েছ দাঁড়িয়ে একা নাগরিক নিসর্গের মাঝে
নিস্তব্ধ রমনা পার্কে শীতের দুপুরে। রোদ, হাওয়া
নীরবে খাচ্ছিল চুমো তোমাকে নিবিড়। নীল শাড়ি,
তোমার প্রথম শাড়ি, আসন্ন প্রখর যৌবনের
সঙ্কেতে কেমন মদালসা। তুমি যেন সদ্য স্নান
সেরে স্নিগ্ধতার সরোবরে মৃদু নিচ্ছিলে বিশ্রাম।

নিষ্প্রভ রঙিন ফটোগ্রাফে প্রস্ফুটিত তরুণীর
প্রেমের অনলে পুড়ি প্রথম দৃষ্টিতে। রূপ তার
চিরদিন থাকবে অম্লান, সময়ের স্পর্শহীন।
অধর,স্তনাগ্র, চোখ, গ্রীবা, ঊরু, নিতম্ব দেখছে
গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন অবিরাম; সে স্বপ্নের অভ্র-গুঁড়ো
এখন আমার কবিতায় অলৌকিক স্পন্দমান।
২৮.১.৯৬

একটি বাগানের কাহিনী

দীর্ঘ খরা দেখে দেখে দু’চোখ ভীষণ ঝলসানো;
অকস্মাৎ ফসলের ঢেউ খেলে যায়, আবাদের
ঘ্রাণে প্রাণ মাতোয়ারা এবং একটি বাগানের
উদ্ভাসনে মনে হয় পটভূমি কেমন পাল্টানো।
বাগানের ফুল, পাখি, মৃদু হাওয়া ডেকে বলে, ‘আনো
জীবনে নতুন করে বাঁচার ফোয়ার; তুমি ঢের
ঘুরেছ বিপথে, বুঝি কখনো-বা আজো তার জের
ছায়া হয়ে নাচে, বিভ্রম ও সব দুঃস্বপ্নকে হানো।

বাগানের শোভা মনে জাগায় উৎসব, লহমায়
মুছে ফেলে নিস্তেজ শরীর থেকে ধুলো আর স্বেদ
দয়িতার স্পর্শ হয়ে। অথচ সে বাগানের মাটি
ফুঁড়ে অমাবস্যা রাতে খটখটে কঙ্কাল হাওয়ায়
ভাসে, হাসে; বিষধর সাপ গাছের বাকল ভেদ
করে তেড়ে আসে, সঙ্গী হয় প্রেত, তারই পাশে হাঁটি।
১৮.৫.৯৬

একটি ভ্রূণের উক্তি

নারীদেহ লোলুপ পুরুষ বারবার তোকে তার
শয্যায় নিয়েছে; তুই ভ্রষ্টা না কি ক্ষণিক প্রেমিকা-
এই বিচারের ভার নিতে পারব না। কেন তুই
হে নিঠুরা আমাকে কুরিয়ে ফেলে দিলি সার্জনের
ক্লিনিকে গোপনে? তোর নিজস্ব গুহায় ক্রমান্বয়ে
আমাকে সপ্রাণ বেড়ে উঠতে দিলি না? মা বলার
সাধ অঙ্কুরেই নষ্ট, আলো অন্ধকার আর বুক
ধুক ধুক করা খেলা নিয়ে হৈ হৈ জানতেই দিলি না।

আমার তো বড়ো সাধ ছিল তোর গুহামুখ ঠেলে
এই রৌদ্রছায়াময় পৃথিবীতে বেরিয়ে আসার
সুতীব্র ঘোষণা দিয়ে। এ দুনিয়া কী-যে অপরূপ
শোভাময়, প্রাণের আনন্দমেলা চতুর্দিকে; সত্য
আছে দুঃখশোক, তবু কী-যে ভালো লাগে বেঁচে থাকা;
সবাই নির্দয় নয়, নয় শুধু ভ্রূণ হত্যাকারী।
৫.২.৯৭

একটি মাছের স্মৃতি

একটি ক্রন্দনরত বড়ো মাছ শুয়ে আছে ডিশে
মশলাসজ্জিত রূপে; আহার্য সে, আমরা ক’জন
তবু তাকে স্পর্শ করা থেকে বিরত ছিলাম, বুঝি
মাছের কান্নার জল সে-রাতে দেখেছিলাম, ফলে
অন্য আহার্যের স্বাদে রসনাকে সিক্ত করে ফিরে
গেলাম যে-যার ঘরে। সেই মাছ সঙ্গে ছিল এই
বয়েসী কবির, তার চোখে স্বপ্নের অজস্র কুঁড়ি
ফোটার আশায় ছিল, কবির তা মনে হয়েছিল।

ঘরে বসে ভাবি সে-রাতের রেস্তোঁরার কিছু কথা,-
একটি টেবিলে গোল হয়ে বসেছিল তিনজন
নারী আর একজন অর্ধনারীশ্বর। মৃদু পর্যটন
ছিল কারো কারো নয়নের, ছিল মার্জিত তামাশা;
একজন স্বর্ণাভ রমণী আর এই কবি আজো
স্মৃতিতে ধারণ করে মাছটির অশ্রুর শিশির।
৫.১.৯৬

 এখানেই আছে ঘর

আমার সুপ্রিয়া মুখ ভার করে আছে, বুকে তার
কান্না ঠেলে ঠেলে ওঠে নিশিদিন, অব্যক্ত আক্রোশে
ফেটে যেতে চায় বুক, কখনো হঠাৎ রুদ্র রোষে
জ্বলে ওঠে। অসহায় চোখে দ্যাখে হয়েছে উজাড়
কোনো কোনো শান্ত গ্রাম গুলির ধমকে, হাহাকার
শোনা যায় দিকে দিকে, যে রকম দূর একাত্তরে
উঠত মাতম এই দুখিনী বাংলায় ঘরে ঘরে;
নির্যাতনে কম দড় নয় পুলিশ ও বিডিআর।

সরকারের অস্ত্রধারী ক্যাডার চৌদিকে দৃপ্ত ঘোরে,
ক্রমশ দাপট বাড়ে উহাদের, পথ চলা দায়।
নিরাপত্তা পলাতক এইসব দেখে শুনে, হায়,
সুপ্রিয়া তুমি কি দূরে গিয়ে নতুন পথের মোড়ে
দাঁড়িয়ে ডাকছে আমাকেও? উপদ্রুত এ নগর
ছেড়ে দূরে যাবো না কোথাও, এখানেই আছে ঘর।
১১.৩.৯৬

এখানেই বেইলি রোডে

(বিপ্রদাশ, বড়ুয়া প্রিয়বরেষু)

এখানে বেইলি রোডে তোমরা এসেছো আজ বিনা
আমন্ত্রণে ওগো পক্ষীকুল দূরদেশ থেকে জানি
আশ্রয়ের খোঁজে; তোমরাও নিরাপত্তা চাও, ধূর্ত
শিকারির শর কিংবা গুলি এড়িয়ে বাঁচার সাধ
তোমাদেরও বুকে জ্বলে প্রদীপের মতো। এইসব
নাগরিক গাছে কেন নিলে ঠাঁই শীতের দুপুরে?
পাড়াটা নীরব কিছু, তবু মোটর কারের হর্ন
বেজে ওঠে মাঝে মাঝে, কালো ধোঁয়া পথে ভাসমান।

যাকে ভালোবাসি, সে কখনো সখনো হঠাৎ
পাখি হয়ে নীলিমায় কিংবা কোনো ঝিলে কী খেয়ালে
উড়ে যেতে চায় হাফ ধরে এলে শহুরে জীবনে।
অনেকেই নির্দয় শহর ছেড়ে অন্য কোনোখানে
যাত্রায় আগ্রহী খুব চকচকে ছোরা, বুলেটের
ভয়ে; হায়, কেন যে তোমরা এলে এখানে সুন্দর?
২১.১.৯৬

কত আর কেটে ছেঁটে

কত আর কেটে ছেঁটে রাখব নিজেকে প্রতিদিন
অন্যদের পছন্দমাফিক? নিষেধের কাঁটাতারে
ঘেরা এ জীবন কাতরায় আর নির্দয় প্রহারে
বিবেক আমাকে মোড়ে মোড়ে খুব করেছে মলিন।

যদি হতে পারতাম শুধু শিশ্নোদরপরায়ণ
এক জীব কিংবা কোনো বিবাগী সন্ন্যাসী বনচারী,
তাহলে হৃদয় আজ হতো না এমন হঠকারী,
অবিরত করতাম না তালাশ তৃতীয় নয়ন।

অচেনা অপর কেউ নয়, যারা আমার আপন
পরিবার পরিজন, তারা চায় আমি পড়ে থাকি
গৃহকোণে, ডানাছাঁটা পাখি নিরন্তর এঁদো ডোবা
আমাকে করুক গ্রাস, ছাঁচে-গড়া জীবন, যাপন
যেন করি আগাগোড়া। তবু প্রতিক্ষণ মনে রাখি-
আমাকে দিয়েছে গৌরী নীলাকাশ, সমুদ্রের শোভা।
১০.৩.৯৬

কবিতা লিখতে না পারা

এই তো কদিন হলো কবিতার একটি পঙ্‌ক্তিও
লিখতে পারিনি শত চেষ্টা করে। বাজে কাগজের
ঝুড়ি ভরে ওঠে কাটাকুটিময় বাতিল কাগজে।
লেখার টেবিলে ঝুঁকে কাটে কত বেলা, স্নানাহার
কখনো স্থগিত থাকে, ক’দিনের না কামানো দাড়ি,
যেন গালে কালো ঘাস; অস্থিরতা কয়েদি পাখির
মতো পাখায় ঝাপ্টায়, কী এক অভিমানে নিজেকেই
নিমেষে পুড়িয়ে শেষে দু’হাতে ওড়াই শুধু ছাই।

বর্থ্যতা হরণ করে দিনের বিশ্রাম, নিশীথের
নিদ্রা, বেদনায় ছেয়ে যায় চিদাকাশ, দূরে বসে
প্যাঁচা হয়ে ওঠে উপহাসপ্রিয়, ঝুলন্ত বাদুড়
তাচ্ছিল্যে তাকায় মিটিমিটি। অকস্মাৎ তুমি এলে
এই ঘরে কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা জন্ম নেয় মনে।
৪.১.৯৬

কবিতার আসা না-আসা

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, বসে আছি পুরানো চেয়ারে
নিশ্চুপ, নিঝুম খুব, যদিও অন্তরে আঁধিঝড়
বইছে অনেকক্ষণ। মাঝে-মাঝে এদিক ওদিক
চেয়ে দেখি, চোখ পড়ে সারি সারি বই, জানলার
পর্দায়, সোফায় আর টেলিফোন সেটে। যেন আমি
কারো মৃদু পদধ্বনি শোনার আশায় কান পেতে
রয়েছি কখন থেকে। এখানে সে পা রাখে কিনা এ
সন্ধ্যেবেলা আমার দৃষ্টির গালিচায়, দেখা যাক।

সম্ভবত আসবে সে যে-কোনো মুহূর্তে, ঘরে ঢুকে
তাকাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ, ধরবে জড়িয়ে,
পায়েল উঠবে বেজে তার পায়ে, চোখ থেকে তার
ঝরবে নানান চিত্রকল্প, চুল দেবে প্রতীকের
ঘন ছায়া; কবিতা আসবে এভাবেই অকস্মাৎ
আমার সান্নিধ্যে কিংবা ব্যর্থ হবে ব্যাকুল প্রতীক্ষা।
৩১.১২.৯৫

কবির জীবন

কবির জীবন নয় পুষ্পছাওয়া পথ, পেরেকের
মতো কাঁটা সর্বত্র ছড়ানো, এমনকি অগ্নিময়
পথ অতিক্রম করে তাকে বহুদূর যেতে হয়
বিপদের সঙ্গে লড়ে, অন্তহীন কায়ক্লেশ, ঢের
মনোকষ্ট সয়ে, সাপ ফুঁসে ওঠে গহন বনের
ছায়াচ্ছন্ন ছমছমে পথে আর ক্ষণে ক্ষণে ভয়
সমুখে হাজির হয় নানা রূপে। এ বিপত্তি জয়
করতে ব্যর্থ হলে তাকে টেনে নেবে কালি পাতালের।

এঁদো ডোবা প্রায় ফুসফুস, মেটে রঙ কফ, জ্বর,
উচ্চ রক্তচাপ, স্মৃতিবিভ্রম ইত্যাদি নিয়ে কবি
খাতাকে পরাবে রত্নহার বারবার, এ প্রত্যাশা
অনেকের; ব্যর্থ হোক সব নিন্দুকের বাক্যঝড়
উপেক্ষায়, প্রশংসায় নির্বিকার আঁকবে সে ছবি,
অর্ফিউস-এর ছিন্ন মস্তকের গান হবে ভাষা।
২.৫.৯৬

কলঙ্ক

কেন তুমি এত দেরি করছ বলো তো? পরদেশ
থেকে কোনো টেলিগ্রাম কিংবা এক টুকরো চিঠি তুমি
পাঠাওনি, পাইনি তোমার টেলিফোন, মনোভূমি
বড়োই তৃষিত, রুক্ষ, কিন্তু আমি পুষি না বিদ্বেষ।
রুগ্ন ফুসফুস আর কতটা টানবে দীর্ঘশ্বাস
এতদিন? ডিপ্রেশনে কাতর সম্প্রতি; চাতকের
মতো চেয়ে থাকি প্রতিক্ষণ, কাটে না যে বিরহের
দিনরাত্রি, পরদেশে ভালো আছো, আমার বিশ্বাস।

তোমার ফেরার আগে যদি আয়ু ফুরায় আমার
তা হলে কী হবে গৌরী? অনুশোচনার ক্লান্ত ভেলা
ভিড়বে সে কোন্‌ ঘাটে? যাক ভাবতাম কবিতার
কবুতর উড়িয়ে তোমাকে আগে ভাগে ভোরবেলা
আনতে পারবো ঠিক এ শহরে। ব্যর্থতার গাঢ়
কলঙ্ক বইছি কবি রূপে, দেরি করো যত পারো।
২২.২.৯৬

কাঁদতে পারি না

‘এমন বিমর্ষ কেন তুমি’, আমাকে সওয়াল করে
আমার ঘরের বাতি। জানলার পর্দা কাঁপা কাঁপা
স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কবি তোমার নিষ্প্রভ চোখ দু’টি
এমন কাতর কেন আজ?’ বারান্দার বুলবুলি
বলে, ‘কোন্‌ কাঁটা এসে তোমার হৃদয় অবেলায়
এমন জখম করে?’ ফ্লাওয়ার ভাসের ফুলগুলি
প্রশ্নাকুল, ‘কোন্‌ কীট তোমার অন্তর কুরে কুরে
খাচ্ছে আজ? আমার লেখার খাতা বড়ই নিশ্চুপ।

এসব প্রশ্নের আমি কী দেবো জবাব? বলব কি
একজন নারী, যে আমার দয়িতা, না বুঝে এই
ছন্নছাড়া বেঢপ আমাকে নিজে খুব কষ্ট পেয়ে
যন্ত্রণার ক্রূর তটে করেছে নিক্ষেপ তার প্রিয়
কবিকে? বিষণ্ন কেন আমি আজ নিজেই বুঝি না;
বুক ঠেলে কান্না আসতে চায়, কিন্তু কাঁদতে পারি না।
৪.২.৯৬

কাক কাহিনী

একজন কাকের কাহিনী এ শহরে অনেকেই
জানে, গাঁও গেরামেও তার কিছু পরিচিতি আছে
বলে শুনি একদা প্রভাবশালী এই কাক খুব
সাধ করে একটি কোকিল হতে চেয়েছিল, ফলে
চাতুর্য শানিয়ে বোকা বানিয়ে গায়ক পাখিদের
সহজে তাদের ঝানু পুরোহিত সেজে গেলো আর
তার তাঁবেদারি করবার কোকিলের অনটন
হলো না কোথাও, দেখি তার জমজমাট প্রসার।

অথচ কাকের খাসলত আগের মতোই থাকে
নোংরা ঘাঁটে, আঁস্তাকুড়ে ঘোরে দিনরাত
ভীষণ কর্কশ ডাকে যথারীতি; প্রতিপত্তি কমে
যাওয়ার দরুণ আজ কোকিল, দোয়েল শ্যামা পাখি,-
যাকে পায় তাকেই ঠোকর মারে তীব্র হিংস্রতায়;
তবুও হয় না বন্ধ সুরমও পাখিদের গান।

কাকে ভালোবাসবে

আমার ভেতরে করে বসবাস অচিন মানব
একজন; আহার্য, পানীয় কোনো কিছু তার কাছে
মোটেই জরুরি নয়। বড়ো নিরালায় থাকে, নাচে
মাঝে-মধ্যে, সুর ভাঁজে অন্তরালে, কখনো-বা শব
সাধনায় মেতে ওঠে। অকস্মাৎ করে কলরব,
শূন্যে ছোঁড়ে প্রাচীন করোটি, তার শীর্ণ দুটি হাতে
সাপ ক্রীড়ামগ্ন আর নির্জন নিথর মধ্যরাতে
ঠোঁটে তার ঘন ঘন স্পন্দমান তন্ত্রের উৎসব।

যে-আমি স্নানের পরে চুলে সিঁথি কাটি, দাঁত ব্রাশ
করি ভোরে, রাতে ঘুমোবার আগে, বই পড়ি, হেসে
কথা বলি অতিথির সঙ্গে, সাহিত্য সভায় যাই,
তোমার উদ্দেশে গড়ি তারাচূর্ণ শব্দ, যে সন্ত্রাস
শাসক ছড়ায় দেশে, তাকে তীব্র ধিক্কার জানাই-
এ-আমিকে না কি সেই তান্ত্রিককে যাবে ভালোবেসে?
১৩.৩.৯৬

কাজ

তুমি কি কলেজ স্ট্রিটে ঘুরছ এখন? নাকি নিউ
মার্কেটে করছ বেশ কেনাকাটা প্রিয় বান্ধবীর
সঙ্গে ঘুরে ঘুরে খর রোদে? কলকাতায় বড়ো ভিড়,
তোমার কি ভালো লাগে দম আটকানো কোনো ভিউ?

এই যে এখানে তুমি নেই, এখন আমার কাছে
চিরচেনা এ শহর বড়ো জনশূন্য নিষ্প্রদীপ
মনে হয়, যেন ঢাকা আজ পরেনি কপালে টিপ
শোকে; ফুল নয়, অশ্রুবিন্দু ফুটে আছে সব গাছে।

কোথাও যাবার নেই; সময় পাথর হয়ে চেপে
আছে বুকে, মাকড়সা জাল বোনে দু’চোখে আমার
ক্রমাগত, প্রায় ধৃতরাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা আজ
তোমার অভাবে। খবরের কাগজে হৃদয় ছেপে
তোমারই বন্দনা গাই; এলো বুঝি পাতালে নামার
সময়, তোমার প্রতীক্ষায় মগ্ন থাকাটাই কাজ।
১০.৩.৯৬

কাঠের ঘোড়া

এ বয়সে একটি কাঠের ঘোড়া স্বপ্নের ভেতরে
নিরিবিলি চলে আসে। চমৎকার এই খেলনার
কাছে বেশ কিছু শিক্ষণীয় আছে, সে বাংলা ভাষার
দেহে স্বপ্নগুঁড়ো ছড়াবার পর রীতির শেকড়ে
দেয় টান; ছিঁড়ে ফেলে প্রথার নির্মোক মত্ত ঝড়ে
নিরালম্ব যুক্তিহীনতায় ফুল্ল স্বেচ্ছাচারিতার
দীপ জ্বালে এলোমেলো। নানাবিধ বস্তুর আঁধার
হননের পর ক্রীড়াপ্রিয় ভাষা অন্য পথ ধরে।

স্বপ্নাশ্রিত কাঠের ঘোড়াটি ভাঙচুর সমর্থন
করে আর দৃষ্টি তার নিবদ্ধ উত্তর-আধুনিক
শিল্পের দিকেই আর রূপকল্পে আনে আলোড়ন।
অভিনব এবং খরার পরে সবুজের বানে
ভেসে যাই; অতঃপর হেলেনের চেয়েও অধিক
মহুয়ার রূপের কদর হয় গাথা আর গানে।
২৮.৭.৯৬

কান্না

আমারই কাঁটার ঘায়ে গৌরী তুমি কেঁদেছ সে-রাতে
নিজেকে অকূল নদী করে; সে কান্নার রুদ্ধ জল
অকস্মাৎ রাত্রির হৃদয় জুড়ে করে ছল ছল,
স্তব্ধতা ছাপিয়ে ওঠে, মিশে যায় তিমির-প্রপাতে।
আমি নিজে নিরন্তর অন্তরের নির্দয় সংঘাতে
বিপর্যস্ত, নিজেকেই ছিঁড়ি-খুঁড়ি, তোমাকেও কষ্ট
দিই খুব জানি না কিসের জন্যে। হায়, আমি নষ্ট,
বিবেচনাহীন লোক, অহেতুক যে ভাঙনে মাতে।

যখন তোমার বুক চিরে অসিত পাথর-চাপা
কান্নার দুর্বার জল নিমেষে বেরিয়ে পড়ে আর
তুমি থর কাঁপো অন্তর্গত শীতে, অসহায়
লাগে বড়ো নিজেকে তখন; আজ কোনো লুকোছাপা
নয়, সরাসরি বলা যাক-আমাদের মনোভার
ঘুচে যাবে, গৌরী শোনো, আহত পাখিও গান গায়!
৫.৭.৯৬

কারো দণ্ডে

কারো দণ্ডে দেশান্তরী হইনি, তবুও মনে হয়
সর্বক্ষণ নির্বাসনে আছি। কোথাও দেখি না কোনো
চেনা মুখ; যাদের কাছের লোক বলে জানতাম
এতকাল, তারাও কেমন অচেনার আবরণে
উপস্থিত হয় পথে। এখন ব্যাপক অগ্নিঝড়
পাড়ায় পাড়ায়, কী সহজে দিনের আলোয় দিব্যি
খুন হয় আদম-সন্তান আর রক্ষক ভক্ষক
হয়ে যায় মসনদে খুব জেঁকে বসবার মোহে।

এরকম ডামাডোলে, উৎপীড়নে, ধোঁয়ায়, লাঠির,
বন্দুকের কর্কশ চিৎকারে ত্রস্ত দিনরাত এই
কসাইখানাকে আজ কী করে স্বদেশ বলে ভাবি?
প্রিয়তমা, এখন তুমিও নেই এ শহরে, সব
স্থানে অমাবস্যা ছেয়ে আছে, এই দিশেহারা কবি
নির্বাসিত জনের বেদনা বয়ে একা, জীবন্মৃত।
১১.২.৯৬

 কিছু ঘুড়ি

আকাশে ওড়াই ঘুড়ি নানা রঙের ধাঁচের প্রায়
প্রতিদিন অনুরাগে; ওরা কোথায় যে চলে যায়
পরিযায়ী পাখিদের মতো, কোনো সন্ধান রাখি না
স্বভাববশত। একজন প্রবীণ সমাজতত্ত্ববিদ
অধ্যাপক হেঁটে যেতে যেতে ভাবেন আমাকে দেখে-
কী অবাক কাণ্ড, লোকটা এ বয়সেও এই মতো
ছেলেখেলা নিয়ে মেতে আছে সারাবেলা আর ক’টি
যুবকও আঠার মতো দিব্বি তার সঙ্গে আছে লেগে।

কখনো দিই না কান কারো কোনো মন্তব্যে, কেবল
ঔদাস্যের ভেলা বেয়ে চলি। গুণীজন লিপ্ত নানা
সমাজ-কাঁপানো কাজে, এই ব্যর্থ অকর্মণ্য আমি
নিজস্ব খেলায় মগ্ন। কখনো জ্বরের ঘোরে দেখি,
ইতস্তত পড়ে-থাকা আমার নির্মিত কিছু ঘুড়ি
মাঘের জ্যোৎস্নায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আগামীর কবি।
৬.২.৯৭

কী করে বোঝাবো?

কত না জায়গায় চলে যাই, কত বেগানা শহরে,
শহরতলীতে ঘুরি, অথচ যাই না দীর্ঘকাল
পিতৃপুরুষের গ্রামে। সেখানে ঘুমন্ত পিতামহ,
মাতামহ এবং আমার পিতা, স্বল্পায়ু আত্মজ,
আরো অনেকেই পারিবারিক কবরস্থানে। ভাবি,
কবরের স্তব্ধতাকে প্রায়শই ঈষৎ বিব্রত
করে ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর আন্ধারকে বুঝি চম্‌কিয়ে
দেয় জোনাকির দল, ঘাসগুলো দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে।

কোনো কোনো মধ্যরাতে মনে হয়, দূর থেকে ভেসে
আসে গাঢ় কণ্ঠস্বর, ‘আমার কেমন পুত্র তুই
এখানে আমার পাশে দাঁড়াবার সময় হয় না
তোর?’ আর একটি সবুজ জলমগ্ন কণ্ঠ ‘বাবা’
বলে থেমে যায় অভিমানে। আমি এই নাগরিক
জীবনঘানিতে বাঁধা দিনরাত, কী করে বোঝাবো?
৪.২.৯৭

কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি

মনে হয়, কেবলি তলিয়ে যাচ্ছি কূলকিনারার
পাচ্ছি না সন্ধান, কাছে ধারে খড়কুটো তা-ও চোখে
পড়ছে না কিছতেই। এ কেমন ঘূর্ণি টেনে নিতে
চায় শুধু বুভুক্ষু অতলে? কে আমাকে ভুল পথে এনে
ফেলেছে এমন দুর্বিপাকে? সঙ্কট কখনো আসে
ভয়ঙ্কর রূপে, কখনোবা খুব মোহনীয় বেশে
অকস্মাৎ; আখেরে পরমা এল ভেবে অনুরাগে
ক্লান্ত গোধূলিতে কুহকিনীকেই করি আলিঙ্গন।

ক্রূর কত জলজ প্রাণীর কোলাহলে সারাক্ষণ
হাবুডুবু খাচ্ছি, তবু সবাই নিষ্পৃহ অতিশয়;
এখন আমার দিকে এমন কি মায়াময়ী সে-ও
বাড়িয়ে দেয় না হাত। কী এক দহনে দগ্ধ হয়ে
নিজের প্রকৃত রূপ অন্তরালে রেখে প্রতিশোধ
নিচ্ছে আজ আমার ওপর নাকি নিজেরই উপর?
৫.২.৯৭

 কোকিলের ডাক

বহুদিন পর আজ কোকিলের ডাক শুনলাম
বন্ধুর সৌজন্যে টেলিফোনে কথা বলার সময়।
তার রিসিভার থেকে আচানক মাদকতাময়
কুহু কুহু স্বর এলো ভেসে কানে, যেন শূন্য জাম
ভরে ওঠে সাকীর সুরায়, আমি ওমর খৈয়াম
যেন, বুঁদ হয়ে যাই। শ্যামলীতে কখনো শুনিনি
কোকিলের ডাক, অন্য পাখিদের কাছে আমি ঋণী
সর্বদাই, যেহেতু এখানে ওরা আসে ছিমছাম।

নিঃসঙ্গ কোকিল কী ব্যাকুল ডাকে সন্ত্রস্ত শহরে
বারবার। কাকে ডাকে? কাকে তার খুব প্রয়োজন
এ মুহূর্তে ভূতুড়ে দুপুরে? আমার ভেতরকার
একজন তারই মতো ডেকে যাচ্ছে প্রতিটি প্রহরে
অন্তরতমাকে। এ ভয়ার্ত নগরকে, বলে মন-
সুন্দর করেনি ত্যাগ, যতই বাড়ুক অন্ধকার।
১৮.৩.৯৬

 ক্ষ্যাপার মতোই ঘুরি

এখন প্রত্যূষ, ফিকে অন্ধকার, হৃদয়ে শ্রাবণ
অবিরাম; বসে আছি, নির্ঘুম কেটেছে সারারাত,
দু’চোখে মরিচ-গুঁড়ো, এই প্রভাতী হাওয়ার হাত
বুলোয় প্রলেপ কিছু, তবু শুধু হু হু করে মন।

যে আমার স্থৈর্য, নিদ্রা অগোচরে করেছে হরণ,
তাকেই সঁপেছি মনপ্রাণ, তারই উদ্দেশে কবিতা
লিখি নিত্য ভূতগ্রস্ততায়; সে-যে প্রজ্ঞাপারমিতা
কষ্ট দেয়, তবু তারই কাছে চাই সর্বদা শরণ।

ক্ষ্যাপার মতোই ঘুরি ফুটপাতে, পার্কে নদীতীরে
তার টানে, যে আমাকে হাতছানি দেয় বারবার।
আমিতো মুখশ্রী তার খুঁজে ফিরি এই ঘেমো ভিড়ে,
কখনো মাতাল ক্লাবে, কখনো সিঁড়িতে সিনেমার
ক্লান্তিতে ভীষণ ডুবে। দেখা দিয়ে চকিতে মিলায়,
আমি অসহায় একা; শুয়ে আছে সে তার ভিলায়।
৩০.৭.৯৬

খুঁজি ক্ষুব্ধ অনুরাগে

স্বদেশে এসেছি ফিরে অবসন্ন আট দিন পর
আপন শহরে আজ। যতটা আনন্দ পাবো বলে
সম্যক ধারণা ছিল, বিমান বন্দর থেকে দলে
বলে স্মিত বেরিয়ে এসেই মন লাশকাটা ঘর!
এ কেমন শহর দেখছি অপরাহ্নে? যেন ঝড়
মুড়িয়ে ফেলেছে একে, রেখে গ্যাছে ধ্বংস চিহ্নগুলি
ইতস্তত। নিসর্গ বিষাদগ্রস্ত; শ্যামা, বুলবুলি
কারো কণ্ঠে গান নেই, ফুটপাথ বিমর্ষ, ধূসর।

ফের গৃহপ্রবেশের পরেও খুশির কোনো ঢেউ
হৃদয়ে করে না খেলা। সব কিছু ছায়াচ্ছন্ন লাগে,
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা মাংস, সব্জির ঘ্রাণ
আকর্ষণহীন আর বই, কবিতার খাতা, কেউ
টানে না তেমন, কাকে যেন খুঁজি ক্ষুব্ধ অনুরাগে
চৌদিকে; কুয়াশা ঘন হয়, অশ্রুপাত করে প্রাণ।
২০.২.৯৬

গদ্য সনেট: ১

ক’দিক সামলাবো আর? একটি মাত্রই ঘর, তা-ও আবার
গর্ত ফোকরময়; এদিক থেকে গন্ধমূষিক,
ওদিক থেকে ঢোকে ইঁদুর। নড়বড়ে ঘরের ছাদ ভাঙা,-
পূর্ণিমা-রাতে মেঝেতে জ্যোৎস্নার আলপনা
আর বর্ষার দিনে ঘর থৈ থৈ বিল, থালাবাসন
ভাসে পানিতে। এই ঘর নিয়ে কী আর করি? এ গর্তের
মুখ বন্ধ করতে উদ্যোগী হই তো সেই ফোকর
জলহস্তীর মুখের হাঁ। জংধরা আঙটায় ঝুলে থাকে বাদুড়।

একটি মাত্র ঘরে হাওয়ার ঝাপ্টা সয়ে দু’টি পিদিম
টিম টিম জ্বলছে রুক্ষ আন্ধারে, কখন যে
দপ করে নিভে যাবে, জানি না। মাঝে-মাঝে
লক্ষ্মীছাড়া ঘরটা রক্তবমনে হয়ে ওঠে
অপ্রতিরোধ্য। গৌরী, তুমি বেহাল আমাকে শক্ত হাতে হাল
ধরতে বলো; আমি যে আর ভাঙা নাও বাইতে পারি না।
২৩.২.৯৬

গদ্য সনেট: ১০

সেদিন পথে যেতে বিরানায় চোখে পড়ল
এক ধ্বংসস্তূপ তার ক্ষয়াটে শোকগ্রস্ত
অস্তিত্ব ঘোষণা করছে নিস্তব্ধ দীর্ঘশ্বাস
এবং হাহাকার ছড়িয়ে। তার বুকে
গুচ্ছের বুনো ঘাসের দাপট।
হঠাৎ কোথা থেকে একটি শঙ্খচিল
উড়ে এসে বসলো সেই ধ্বংসস্তূপে, ওর চোখের
তীক্ষ্ণতায় সংগ্রামী মানুষের অদম্য জেদ।

ঘরে ফিরে এসেও দৃষ্টিতে ভেসে উঠছিল
ধ্বংসস্তূপটির ছন্নছাড়া চেহারা, বুঝিরা আমার
বিগত জীবন আর সেদিনই যখন তুমি বললে, ‘তোমাকে
ভালোবাসি, ভালোবাসি যে, তক্ষুণি দেখলাম, ধ্বংসস্তূপে
অজস্র ফুলের বাহার আর একটি রামধুন নিবিড়
আলিঙ্গনরত, যেন খাজুরাহোর মিথুনমূর্তির বিমূর্ত রূপ।
১৬.৩.৯৬

গদ্য সনেট: ১১

একটা লোক নিয়মিত আমার বাড়ির দিকে
আড়চোখে খানিক তাকিয়ে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে
খোলা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। অবাক কাণ্ড,
সে যখন যায়, তখন গলিতে কাছে ধারে
কাউকে আমি দেখি না; এমন জনশূন্যতা রোজ কী করে হয়,
ভেবে পাই না। লোকটার হাতে কিংবা ঠোঁটে জ্বলন্ত
সিগারেট দেখিনি কোনোদিন; মৃদু হাসির রেখাও
ফোটেনি মুখে কখনো, শুধু পাথুরে কাঠিন্যের প্রাধান্য।

লোকটা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে,
যখন আমি যে কাজই করি-চুপচাপ বসে থাকি, বইয়ের
পাতা ওল্টাই, চিঠি লিখি, কবিতার খসড়া তৈরি করি,
অথবা চা খাই, আমার গায়ে কাঁটা দেয়,
হাত-পা কেন জানি হিম হয়ে আসে, চোখের পিদিম নিভে যেতে চায়;
লোকটা যেদিন এ-পথে হাঁটবে না, সেদিন আমি থাকব না।
১৫.৪.৯৬

গদ্য সনেট: ১২

হায়রে মন, না জেনে আমি, আপন খবর
তালাশ করি চেতন গুরু; আন্ধারে হোঁচট খেতে-খেতে
জনমভর দেখলাম না লালনেরে। হঠাৎ
কীসের ঝলক দিলো দিলে, শুনি গাঢ় মেঘের
আড়াল থেকে লালন কয়, ‘পাঠাস নাই তুই আমার
নামে পত্র কোনো; অনেককাল হেলার কাদায়
রেখেছিস ফেলে। কোতায় পাবো অচিন ডাকটিকিট?
কোথায় তেমন নীল ডাকরাক্স? কোথায় আপনি সাঁই?

দোতারায় আলো-কুসুম ফুটিয়ে লালন
বলেন উদাস কণ্ঠস্বরে, ‘ফোটাতে চাস আনন্দকুসুম
শূন্য ডালে? তবে কেন একলা এলি আমার সন্ধানে জেল্লা-অলা
পোশাক পরে? হৃদয়রতন কোথায় রেখে এসেছিস কোন্‌
ঝরা পাতাদের কবরে? গৌরীকে ফেলে এসে সামান্যে
তারার হাটে, ওরে ক্ষ্যাপা, তুই অসামান্যের সুর বাজাবি?’
১৫.৪.৯৬

গদ্য সনেট: ১৩

অনেক কাল আগেকার দিঘিটা নিঝুম ঘুমোচ্ছে, লাল
শাপলা ফুলদের স্বপ্নের নানা স্তরে
ভেসে-যাওয়া। পাশের ঘন পাতাময় গাছের
তন্দ্রাচ্ছন্নতা চিরে বেজে ওঠে দোয়েলের মেদুর শিস।
আড়মোড়া ভাঙে প্রাচীন দিঘি, শাপলা
ফুলগুলোর চোখে আঠা ধুয়ে যায় শিশিরে; গাছতলায়
গেরুয়া আলখাল্লা-পরা বাউল মেঘের দিকে
তাকিয়ে দোতারায় অলীক ভোরের সুর জাগায়।

গ্রাম্যবধূ এদিক ওদিক তাকিয়ে যৌবনকে
দিঘির জলে ভাসায়। ভোরের টাটকা রোদ ওর ভেজা
যৌবনকে চুমোয় চুমোয় রক্তিম করে; বাউলের গান স্নানার্থিনীর
শরীরে পিছলে যেতে থাকে, খয়েরি বাছুর ঢুঁ মারে শাদা গাভীর ওলানে,
কৃশকায় চাষি লাঙল কাঁধে আলে হেঁটে যায়, দিঘির ধার ঘেঁষে
সাইকেল চালিয়ে মাঠে যাচ্ছেন এনজিও মহিলা কর্মী।
১৫.৪.৯৬

গদ্য সনেট: ১৪

সে-রাতে তোমার বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে
আমিও ছিলাম একজন, ঈষৎ দূরত্ব আর নৈকট্যের
নানা কোণ থেকে তোমাকে দেখে আমি আতশবাজি, সরোদের ঝংকার।
তখন মুক্ত কণ্ঠে বলতেই তো পারতাম,
তোমার সৌন্দর্যধারায় স্নাত আমি,
বলতেই তো পারতাম, তোমার কথার লাবণ্যে
আমার হৃদয়ে ফুটছে নানা রঙের ফুল, অথচ
আমার মুখ ছিল যেন কুলুপ-আটা।

মগজে জ্যোৎস্না পুরো সোফায় নিশ্চুপ বসেছিলাম এক কোণে;
কখনো স্যান্ডেলিয়ারের দিকে, কখনো
দেয়ালের বিমূর্ত পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে তোমার সঙ্গে
কথা বলার প্রবল ইচ্ছের মুখ সেলাই করে রেখেছিলাম আর
সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোনো নিষাদ কোকিলের কণ্ঠে
তীর বিদ্ধ করলে গায়ক পাখিও হয়ে যায় রক্তাক্ত, মুক।
১৭.৮.৯৬

দ্য সনেট: ১৫

তোমার অভিমানগুলো রাতের দেয়ালে
মাথা কুটে কুটে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল
নিঝুম মেঝেতে এবং আমি
সেগুলো জড়ো করে একটি পুষ্পস্তবক বানিয়ে
তার চৌদিকে ভ্রমরের মতো
গুঞ্জরণ তুলি। সেই সুর নকশা আঁকে নৈশ প্রহরে।

তোমার দুচোখের কান্না, হৃদয়ের অশ্রু-ফোঁটা শ্রাবণ-দুপুরে,
বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে ঝরতে থাকে অবিরল;
আমি সেই অশ্রুকণাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে
তৈরি করি মুক্তার এক অনুপম হার।

রাতজাগা পাখির বুকে পুষ্পস্তবক আর
মুক্তোর হারের কবিতা লিখে
তাকে পাঠিয়ে দিলাম শুকনো মেঘের কাছে;
মেঘ ওকে আলিঙ্গন করে ভিজে উঠলো ঝরে পড়ার জন্যে।
১৯.৮.৯৬

গদ্য সনেট: ২

বাড়িতে ঢুকলেই তুমি দেখবে সব আছে ঠিকঠাক,
সিঁড়ি, কুত্রিম ঝরনাধারায়
কেলিপরায়ণ মাছ, সোফাসেট, শয়নকক্ষ, স্নানঘর এবং
গাড়িবারান্দা, সর্বোপরি রবীন্দ্র রচনাবলী।
তোমার দু’টি চোখ যাকে খুঁজে বেড়াবে অনুপস্থিতির
আলো-আঁধারিতে, যার হৃদয়-নিঙড়ানো
কবিতার কোনো কোনো চরণ অকস্মাৎ ভ্রমর হয়ে
গুঞ্জরণ তুলবে মনে, তাকে দেখবে না কোথাও।

টেলিফোন উঠলে বেজে লোকটা পড়ি মরি
তুলবে রিসিভার, ভুল নম্বরের ধাক্কা খেয়ে সে কিছুক্ষণ
থাকবে বসে, চেয়ারে একলা ঘরে, উল্টোপাল্টে দেখবে কিছু কবিতার বই।
টেলিফোনে লোকটার কণ্ঠস্বর শুনেও তুমি
বুঝতে পারবে না সে কেমন ছিল, এলে বস্তুত হবে
মাটির নিচে থেকে তোলা ভাঙাচোরা মূর্তির মুখোমুখি।
২৩.২.৯৬

গদ্য সনেট: ৩

সারা দিন গেল, ইঁদুরমুখো বাদুড়
সন্ধ্যাকে ডেকে আনে ডানার হাওয়ায়, আজকে
রাতও বুঝি যায়। এখনো তুমি পা রাখলে না
এই প্রিয়তম শহরে আমার। দু’সপ্তাহ তোমাকে
না দেখে কোনো মতে দিন যাপন করেছি। অথচ আজ
প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে শতাব্দী। আজ তুমি এলেও
তোমাকে দেখতে পাবো না, পরের তিনটি দিনও
আমাদের সম্ভাব্য সাক্ষাতের মাঝখানে অলঙ্ঘ্য প্রাচীর।

হায়, যদি কবিতা লিখতে না পারতাম, তাহলে
কী করে কাটতো তুমিহীন আমার শূন্য প্রহরগুলি?
আমার এখনকার কবিতায় সকল চরণ কেবল তোমাকেই
স্মরণ করে সারাবেলা। তোমার অনুপস্থিতির বেদনা ওরা মুছে ফেলতে
ব্যর্থ, তবু জানি তুমি শহরে এলে পর ওরাই তোমার
মুখ চুম্বন করবে বারংবার, তোমাকে ঘিরে বসাবে নক্ষত্রের মেলা।
২৩.২.৯৬

গদ্য সনেট: ৪

অনেকদিন যাবত চিলেকোঠা বিষয়ে একটি ধারণা
লালন করছি। দূরের আকাশে মেঘেদের কোলে কোথাও
যদি আমার নিজস্ব একটা চিলেকোঠা থাকতো
তা হলে কী ভালোই না হতো। সেখানে কিছু চমৎকার
সময় কাটানোর জন্যে যখন তখন
চলে যেতে পারবো; কোনো সিঁড়ির প্রয়োজন হবে না,
ব্যবহার করতে হবে না বায়ুযান। আমার সেই চিলেকোঠায়
নিষিদ্ধ হবে খবরের কাগজ, থাকবে শুধু বই আর ক্যাসেট প্লেয়ার।

চিলেকোঠায় হাত নেড়ে গালিবের ধরনে ডেকে আনবো কবিতাকে,
কোনো কোনোদিন তুমি আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে,
বসে গল্প করবে আমার সঙ্গে, ইচ্ছে হলে গান গাইবে
কিংবা কিছু না বলে আমার বুকে মাথা রেখে দেখবে কালপুরুষ
আর আমি তোমার চুল নিয়ে খেলা করবো। কখনো নীল পাখির
গানের সুরে ভেসে আমরা কবিতার শীশমহলে পৌঁছে যাবো।
২৩.২.৯৬

 গদ্য সনেট: ৫

অন্তত তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবো আজ, এমন
প্রত্যাশার দোয়েল শিস দিয়েছিল বারবার ভাবনার উঠোনে।
এইমাত্র ঘড়িতে রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের
সঙ্কেত; পাশের শিশুপল্লী ঘুমোচ্ছে, গলি নিঝুম,
রাত্রি কালো কফিনের ভিতর শুয়ে আছে, কুয়াশা
নামছে তার চোখে। দূরের নক্ষত্রেরা তাকিয়ে রয়েছে
কফিনের দিকে, অথচ তোমার টেলিফোন সরোদের তানের
ধরনে বেজে ওঠে নি। তুমি কি আসো নি এখনো?

আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দুর্ভিক্ষকবলিত
বিশুষ্ক, করুণ মানুষের মতো ত্রাণসামগ্রীর আশায়?
আমার ওপর ছুটে যাচ্ছে নাদির শাহের কেশর দোলানো
অশ্বপাল, তৈমুরের নাঙা তলোয়ার আমাকে ক্রমাগত
রক্তাক্ত করছে এবং মেরুপ্রদেশের ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমি আর কত সইব এই স্বৈরাচার?
২৩.২.৯৬

গদ্য সনেট: ৬

বুকের কাছে একগুচ্ছ নীল ফুল ফুটল, আমি ওদের
নাম রাখলাম অভিমান। ফুলগুলোর
ভেতরে অকস্মাৎ অজস্র কাঁটা গজিয়ে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
প্রায় উন্মত্ততার খাদের ধারে নিয়ে গেল।
আমি কি বলিনি আমাকে তুমি এভাবে দণ্ড দিও না
কখনো, যা আমার রক্ত শুষে নেয় ড্রাকুলার মতো?
তোমার কথা ভেবে ভেবে আমি আজ প্রতি মুহূর্তে
আতশবাজি হয়ে জ্বলেছি, হয়েছি ফিনিক্স পাখি।

তোমাকে ঘিরে আমার স্বপ্নেরা মেতেছে সুফী-নৃত্যে
আমার অন্তরের তন্তুজাল থেকে বেরিয়ে এসেছে শব্দের ঝাঁক,
সেসব শব্দকে তোমার প্রিয়ংবদা সহচরী বানিয়ে
নিজেকে বুভুক্ষু রেখেছি। অথচ তুমি
উদাসীনতায় মজে একটি শব্দও খরচ করলে না
কিছুতেই, এখন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির মতো অনিদ্রায় ভুগছি।
২৩.২.৯৬

 গদ্য সনেট: ৭

আজ প্রত্যুষ ঘুম ভাঙতেই আমার দৃষ্টির
দিগন্তে তোমার মুখের চন্দ্রোদয়। তুমি ফিরে আসছো
ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্নতার আবির ছড়িয়ে পড়ে
সারা ঘরে, বইয়ের র্যাবকে, কবিতার খাতায়,
আমার দেহমনে। আজকের দিন ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর
সেতারের আলাপের মাধুর্য হয়ে ওঠে। রাত বাড়তেই অধৈর্য
আমি তোমাকে দু’বার টেলিফোন করি। লাইনের
ব্যস্ততায় সঙ্কোচ ও লজ্জায় অন্ধডোবায় হাবুডুবু খাই।

এই শহরের সবচেয়ে তুখোড় সাংবাদিক, যার
নখদর্পণে সারা দেশের নাড়ি-নক্ষত্র, আমাকে
জানাতে পারলেন না তোমার প্রত্যাবর্তনের খবর; মেঘ, পলাশ
এমন কি কোনো রাতজাগা পাখিও বলতে পারলো না তুমি এলে
কি এলে না। তবুও কি গাইতে হবে ওদের বন্দনাগীতি? এখন আমি
উদয়শঙ্করের নটরাজ। অন্তর্গত ধ্বংস ও নির্মাণে ভয়ঙ্কর চঞ্চল।

গদ্য সনেট: ৮

কী করে প্রকাশ করবো আমার আজকের
অনুভূতি? কাল রাত্তিরে যন্ত্রণার ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে
শেষ প্রহর পর্যন্ত নির্ঘুম কাটিয়েছি, যতক্ষণ না
মুয়াজ্জিন ফজরের আজানের সুর ছড়িয়ে দিলেন
ঘুমন্ত পাড়ায়। আজ আমি পদ্মফুলের অজস্র
পাপড়ির আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছি, আমার সকল
রোমকূপে আনন্দধারা, এই মুহূর্তে আমি বসন্ত বাহার;
কেননা, দু’সপ্তাহ পর তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি।

এই লক্ষ্মীছাড়া কবিকে তুমি রক্ষা করলে
কথার ঝরনাতলায়। যে অভিমানের জ্বালাধরানো
ক্রূর শুঁড়গুলি ক্ষত তৈরি করছিল হৃদয়ে, যেসব
এখন শুকনো পাতার মতো খুলে গ্যাছে,
এখন আমি স্নিগ্ধ সরোবরে সাঁতার কাটছি আর তোমার দিকেই
ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে মাছের মতো আমার দু’টি স্পন্দিত হাত।
২৪.৩.৯৬

গদ্য সনেটঃ: ৯

বহুকাল থেকে দেখছি সুখ আমার বেশিদিন
সয় না। বালকবেলা আম্মার দেওয়া ইস্কুলের
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মহানন্দে দুলদুল ঘোড়ার
একটা রঙিন ছবি কিনেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই সেটি কোথায়
হারিয়ে গেল, তার হদিশই পেলাম না আর। যখন আমি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আব্বা আমাকে কফি রঙের একটি শেফার্স কলম
কিনে দিয়েছিলেন, পেয়ে কী-যে সুখী হয়েছিলাম; কিন্তু
পুরনো না হতেই সেটি চলে গেল পকেটমারের কব্জায়।

গতকাল অনেকদিন পর সকালে টেলিফোনে গৌরীর
কণ্ঠস্বর শুনে কী-যে সুখ পেয়েছিলাম, কী করে বোঝাবো অন্য
কাউকে? আমার দেহমন হয়ে উঠেছিল উৎসবের আলোকসজ্জা।
দুপুরেই রিসিভার রাগী কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ
করছিল, কিছুক্ষণ পরেই স্তব্ধ। হায়, এমনই বরাত আমার, ক’দিন
তার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না, দেখা হওয়ার পথও বন্ধ।
২৫.২.৯৬

জিন্দা লাশ

প্রস্থানের কালে তুমি বলেছিলে, ‘প্রিয়তম কবি,
খারাপ করো না মন, ক’টা দিন হাসিখুশি থেকো।
কী করে ফুটবে হাসি মনে, যখন তোমাকে আমি
দেখতে পাবো না আর শুনতে পাবো না কণ্ঠস্বর
তোমার? তা ছাড়া দেশ রাহুগ্রস্ত, মৃত্যুর খবর
পাই প্রতিদিন, নরহত্যা নেহাত মামুলি, দেখি
পুলিশের লাঠির আঘাতে মিছিলের ক্ষুব্ধ ছাত্রী
রাস্তায় রক্তাক্ত পড়ে থাকে হায়, যেন বাংলাদেশ।

প্রিয়তমা আমার, তোমার কথা, প্রেমময়ী দৃষ্টি
মনে পড়ে প্রতিক্ষণ মনে হয়, রেখেছো আমার
হাতে এসে তোমার উৎসুক হাত পল, অনুপল
শতাব্দীর রূপ নেয় স্বপ্নঘোরে। সমূহ সঙ্কট,
স্বৈরাচারী দুঃশাসন এবং তোমার বিচ্ছেদের
ধারালো দাঁতের হিংস্রতায় জিন্দা লাশ হয়ে হাঁটি।
১২.২.৯৬

জ্বলছে স্বদেশ

কবীর চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, জ্বলছে স্বদেশ-
প্রায় প্রতিদিন মরে লোক গুলি খেয়ে খোলা পথে,
পুলিশের জুলুমে জর্জর দেশবাসী, কোনো মতে
দিন কাটে প্রতিবাদী নেতাদের প্রত্যহ অশেষ
ঝুঁকিতে এবং অনেকেই হচ্ছেন আটক। বেশ
আছেন আনন্দে মেতে নারী নীরো, বাজাচ্ছেন বাঁশি
মসনদে বসে, ঠোঁটে তার খেলে যায় ক্রূর হাসি
ক্ষণে ক্ষণে, পারিষদবর্গ তার কাছে সুখবর করে পেশ।

অবৈধ শাসক যারা, তারা সাধারণ মানুষের
ইচ্ছা অনিচ্ছায় সারে দাফন নিমেষে, স্বৈরাচারে
বুঁদ হয়ে থাকে; কিন্তু বোঝে না দেশের জনগণ
শক্তিমান স্যামসন, অন্ধ করে রাখলেও টের
পায় অনাচার, অবিচার আর প্রবল হুঙ্কারে
কেশর দুলিয়ে ত্বরান্বিত করে শক্রর পতন।

 তবুও তাণ্ডবে

বর্বরতা অভ্যাস করে না ত্যাগ; ভয়ঙ্কর পশু
হয়ে কুশ্রী মাথা তোলে যখন তখন; শান্তিপ্রিয়
প্রাণীদের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে
নেয়, এক লহমায়-বস্তুত জীবন ক্রমাগত
আর্তনাদ করে বর্বরের পদতলে। যখন সে
নিঃশ্বাসে বাতাস ভারি করে তাড়াতাড়ি নিভে যায়
বসতির প্রতিটি ঘরের দীপ, প্রেমিক-প্রেমিকা
কোমল প্রণয়বাক্য উচ্চারণে ভয়ে কেঁপে ওঠে।

সভ্যতাকে বিদ্রূপের তুমুল ফুৎকারে ভাগাড়ের
এক কোণে ফেলে রেখে মুখ খোলে, কষ বেয়ে তার
রক্ত ঝরে, সুকুসার বৃত্তি সমুদয় তার নখরের ঘায়ে
ভীষণ জখম হয় সময়ের প্রতি পর্বে, তবু তাণ্ডবেও
জন্ম নেয় আর্ফিয়ুস যুগে যুগে, বংশীধ্বনি জাগে।
১১.৪.৯৬

তার উদ্দেশেই ন্যস্ত

এখনো আমার কবিতার যারা আগ্রহী পাঠক
আর যারা কখনো ছুঁয়েও দ্যাখেন না এইসব
পঙ্‌ক্তিমালা, তাদের জরুরি মূল্যবান কলরব
স্তব্ধতায় ঝিমোলে খানিক, মুছে ফেলে কিছু ছক
আমার কবিতা এই ক্রান্তিকালে গূঢ় পর্যটক
নান্দনিক ভূমণ্ডলে। জীবনের শিঙ ধরে যুঝি
সাধ্যমতো; নানা স্তরে রূপের আড়ালে রূপ খুঁজি,
যতই ধরুন খুঁত বিজ্ঞ, সন্ধানী সমালোচক।

এই শহরেই আছে একজন যার ধ্যানে কাটে
সারাবেলা, যার নাম উচ্চারণে ক্লান্তি নেই আর
যার কথাশিল্প থেকে পাই কত কবিতার শাঁস,
যার পদধ্বনি বাজে আমার সনেটে বারবার,
যাকে খুঁজে পেতে চায় কৌতূহলী জন এই বাটে,
তার উদ্দেশেই ন্যস্ত আমার এ নিঃশ্বাস, বিশ্বাস।
১৫.৭.৯৬

তুমি চলে গেলেও

আমার এ ছোট ঘরে কিছুক্ষণ বসে চুপচাপ
চলে গেলে তুমি নিশীথকে অধিক আন্ধার করে।
চেয়ে থাকি শূন্য চেয়ারের দিকে ছায়াচ্ছন্ন ঘোরে,
চায়ের পেয়ালা আর্ত বুলবুলি, যেন চায় মাফ
বুকে গান নেই বলে। আমরা দুজন যে-আলাপ
করেছি তোমার প্রস্থানের আগে তা-ই ফের দোরে,
জানালার পর্দায়, বইয়ের র্যাফকে আর ঠাণ্ডা ফ্লোরে
ছায়া হয়ে ঝোলে, রয়ে যায় তোমার প্রাণের ছাপ।

তুমি চলে গেলেও কেন যে মনে হয় এই ঘরে
আছো বসে, হাসছে তোমার চোখ, শাড়িটার ভাঁজ
নদীর তীরের মতো; তুমি আছো, যেমন কবিতা
আবৃত্তি করার শেষে ছন্দিত মঞ্জুল রেশ নড়ে
মর্মমূলে, যে রকম মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ
জমে থাকে স্তব্ধ মাঠে। ভুলে যাই তুমি পরিণীতা
২২.৮.৯৬

তোমাকেই ডেকে ডেকে

এখন তোমার ঘুম নিশীথের দিঘিতে নিটোল
পদ্ম আর তোমার নিদ্রিত যৌবনের পূর্ণিমায়
উদ্ভসিত বন্ধ ঘর। আমার চোখের পাতা জুড়ে
নেই আজ নিদ্রার কুসুম, জ্বালাধরা চোখ মেলে
কাটাই প্রহর, শুনি প্রতারক জ্যোৎস্নার প্রভাবে
স্তব্ধ নিসর্গকে অপ্রস্তুত করে আচানক কাক
ডেকে ওঠে। আমার খাতার পাতা অসমাপ্ত এক
চতুর্দশপদী বুকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছে মাতম।

কখন যে ভাঙবে তোমার ঘুম পাবো নাকো টের,
যদি না জানাও টেলিফোনে; রাত পোশাকের ভাঁজে
ভাঁজে জমে স্বপ্নের ভগ্নাংশ। সেই কণাগুলি খুব
সন্তর্পণে পারব কি কুড়োতে বিহানে কোনো দিন
তোমার ঘুমের অন্তরালে, স্বপ্নে চিড় না ধরিয়ে?
তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি!
১৫.১.৯৬

তোমার গোলাপগুলি

তোমার গোলাপগুলি আমাকে দেখছে অপলক
অনুরাগে ফুলদানি থেকে। বুঝি ওরা প্রতিনিধি
তোমার; ফলত প্রতিক্ষণ অমন তাকিয়ে থাকে
কেবলি আমার দিকে। লক্ষ করে এই ঘরে বসে
কী করছি আমি, কোন্‌ বই পড়ি, কিছু লিখি কিনা,
বুঝে নিতে চায় আমি তোমার স্মরণে কতটুকু
মগ্ন আছি, তোমার সুন্দর মুখ আমার দু’ চোখে
পরিস্ফুট কতখানি, দেখে নেয় দর্জির দৃষ্টিতে।

যখন ফিরবে তুমি ভ্রমণের শেষে এ শহরে,
তখন গোলাপগুলি থাকবে না। ওরা মরে যাবে,
ঝরে যাবে; সৌন্দর্য বড়োই ক্ষণজীবী, আমি এই
ক’টি দিন সুপ্রিয় তোমাকে ভুলে ছিলাম অথবা
ব্যাকুল ছিলাম খুব তোমার জন্যেই। তার কোনো
বিবরণ কখনো পাবে না তুমি প্রতিনিধিহীনা!
১০.২.৯৬

তোমার জন্যেই বাঁচি

একান্ত আমার করে পাই না কখনো তাকে, তার
বৃত্তে আছে বহু কুশীলব, যারা ওর সিংহভাগ
সময় ওড়ায়, সহজে সে কলরবে সানুরাগ
মেতে থাকে। ফাঁপা, ফাঁকা, রঙচঙে সামাজিকতার
নানা ঢঙ পছন্দ করে সে; আমি স্বার্থপরতার
আগুনে বৃথাই পুড়ি, দেখাতে পারি না পোড়া দাগ
অন্তরের কাউকেই, দহনকে হৃদয়ের ফাগ
ভেবে এমন কি সে-ও পরিহাসে জিভে দেয় ধার।

মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় একটি ফুৎকারে এই খেলা
পণ্ড করে দিই, ছিঁড়ে ফেলি মেকি জগতের জাল,
অথবা চুকিয়ে দিই জীবনের দেনা অগোচরে
বিষে কিংবা একটি ছোরায়। সরোবরে ছুঁড়ে ঢেলা
কাটাবো সময় না কি শক্ত হাতে সরিয়ে জঞ্জাল
তোমার জন্যেই বাঁচি বলে থেকে যাবো এ শহরে?
৩০.৭.৯৬

তোমার ভয়ের কথা

তোমার ভয়ের কথা বলেছ আমাকে বহুবার
কখনো গল্পের ছলে, কখনো বা ভয়ে কেঁপে উঠে;
হঠাৎ নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দ্যাখো ছুটে
আসে শত সরীসৃপ তোমার দিকেই দুর্নিবার
বেগে, ভীতসন্ত্রস্ত তোমার কাছে সে বেডকভার
অজগর হয়ে যায় এবং দর্পণে ওঠে ফুটে
খুব ভয়ঙ্কর মুখ কারো, যেন সে সম্ভ্রম লুটে
নেবে কিংবা খুনী রূপে চকিতে ছোরায় দেবে ধার।

রাত্তিরে তোমাকে ছেড়ে যায় না কখনো ভয়, তাই
ঘাটতি তোমার ঘুমে। আমার মৃত্যুর দিন তুমি
আসবে না দেখতে আমার লাশ, পাছে মৃত মুখ
আমার তোমার রাতে হানা দেয়, ভীতিকর ছাই
ওড়ায় ঘুমের ঘরে, অথচ তোমার মনোভূমি
সে মুখের আলোয় হয়েছে নিত্যদিন গুলরুখ।
১৩.৭.৯৬

 তোমার যাবার আগে

সব কিছু ঠিকঠাক, আজই তুমি যাবে দ্বিপ্রহরে
বায়ুযানে; আমার অবুঝ মনোকষ্ট, দীর্ঘশ্বাস
অথবা চোখের জল ক্ষণে ক্ষণে খুসখুসে কাশ
করবে না পথ অবরোধ আর কবিতার ঘরে
হবে না এখন হরতাল। দিয়েছি বারণ করে
সবাইকে, আমার না-লেখা কবিতারা আজ নীল
পাখি হয়ে উড়বে তোমার খুব কাছে। ঝিলমিল
করলে কোথাও কিছু ভেবো আমার আনন্দ ঝরে।

আজ কবিতার খাতাটিকে সাক্ষী রেখে দিচ্ছি কথা-
তোমার যাবার আগে আর পরে মন খারাপের
ভেলা ভাসবে না কোনোক্রমে, জেনো কাটাবো সময়
গান শুনে ক্যাসেট প্লেয়ারে, আড্ডা দিয়ে। মনোব্যথা
মেঘদলে, পাখির ডানায় হবে নীল, তুমি ফের
ফিরে এসে দেখবে আমার মুখ কত দীপ্ত হয়।
৮.৩.৯৬

দীপ্র ধ্বনি তুলি

নির্জন গুহায় থাকি হাঁটু মুড়ে, কখনো নিদ্রায়
অভিভূত। আলো নেই কোনোখানে, বেরুতে পারি না,
পাছে ওরা শিকারি কুকুরগুলো আমার পেছনে
ভীষণ লেলিয়ে দেয়। আমার রক্তের ধারা বয়ে
গেলে ওরা হো হো হেসে আর কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে
দশদিক আনন্দ ধ্বনিতে ভরে দেবে। পড়ে আছি
এক কোণে অসহায়; ভাবনার ভেলা পারাপার
করে এই দুঃখিত আমাকে। গুহাগাত্রে হিজিবিজি

ছায়াগুলো সঙ্গ দেয়। অন্ধকারের চাঙড় ভেঙে
কেবলি পড়তে থাকে আমার উপর; চেষ্টাহীন
থাকবো কী পড়ে সর্বক্ষণ? যতই আলোর দিকে
যেতে চাই, ততই আঁধার আসে ব্যেপে, যেন ক্রূর
বাইসন আমাকে ধারালো শিঙে গেঁথে নিয়ে ছোটে
দিগ্ধিদিক; আমি আলো, আলো বলে দীপ্র ধ্বনি তুলি।

দেখা হওয়া না-হওয়া

দেখা হওয়া না-হওয়ার মধ্যে কেন জয় পরাজয়
সেদিন আনলে টেনে আচানক? কার জিৎ আর
কার হার হলো বলে ধরে নিলে মনের গহনে?
আমিতো ভাবিনি এইমতো কস্মিনকালেও, তাই
দ্রুত বিস্ময়ের পাকে জড়িয়ে গেলাম; দু’টি দিন
প্রার্থনা করেও আমি পাইনি তোমার কাছে, ফলে
আমার পড়ার ঘর শীতল কফিন, পড়ে আছে
লেখার টেবিলে ম্লান, শোকগ্রস্ত কলম আমার।

উড়ন্ত গালিচা যদি থাকতো দখলে, তবে আজ
চোখের পলকে উড়ে যেতাম তোমার নিকেতনে।
সইতে হতো না প্যাঁচা আর বাদুড়ের কৃষ্ণপক্ষ
উপহাস ক্ষণে ক্ষণে; নিঃসঙ্গতা আমাকে এখন
সঙ্গ দেয়, হাওয়া আলাপের সূত্রপাত করে, ঘরে
অকস্মাৎ নড়ে ওঠে অতিকায় মত্ত সরীসৃপ।
১৫.১.৯৬

 দেহতত্ত্ব

কখনো নিইনি কোনো গুরুর নিকট দীক্ষা, দেহে
ভস্ম মেখে বৃক্ষতলে ধূপ ধূনা জ্বেলে জোরেশোরে
চিমটা বাজিয়ে লোক জড়ো করিনি কস্মিনকালে।
মানবতাবাদী বাউলের তরিকায় নিত্যদিন
দেহের বন্দনা করি; গীত রচনায় নিমজ্জিত,
দোতারা ছাড়াই ঘুরি এ ভবের হাটে। ক্লান্ত হলে
জিরোই দিঘির ঘাটে, মল্লিকার বনে, যাই ছুটে
তোমার দেহের তীরে উন্মুখর পিপাসা মেটাতে।

মাঝে-মধ্যে দেহমন কেমন বিষাদে ছন্নছাড়,
নতঝুঁটি মোরগের মতো চেয়ে থাকি শূন্যতায়;
দেহের ক্রন্দন ঘন কুয়াশা ছড়ায়, হয়ে যাই
দীর্ঘশ্বাস। হে অতুলনীয়া গৌরী, তোমার দেহের
পুশিদা মোকামে যে অপূর্ব পদ্ম আছে, কালেভদ্রে
তার ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড় বাই কাব্যের গহীন গাঙে।
২২.১.৯৬

নিজের শহর ছেড়ে

নিজের শহর ছেড়ে যখন বিদেশে যেতে হয়,
নিরানন্দ হয়ে পড়ি, মনে জমে মেঘ ইতস্তত,
বিষণ্নতা এসে বসে মুখোমুখি ঘাতকের মতো
ঠাণ্ডা চক্ষুদ্বয় নিয়ে, সারাক্ষণ মনে জাগে ভয়।

যদি না কখনো ফিরে আসি আর, এই ঘরদোর,
বই, কবিতার খাতা, লেখার টেবিল, জানালার
পর্দা, খাট, রবীন্দ্রনাথের ছবি ক্যাসেট প্লেয়ার
কোনোদিন মনে জাগাবে না পুলক, স্বপ্নের-ঘোর।

প্রিয়জনদের মুখ দেখব না, চার বছরের
পৌত্রীর কোমল কথা শুনব না, দেখব না, হায়,
ওর হাসি আর যাকে একদিন না দেখলে মনে
সভ্যতা বিলুপ্ত হয় লহমায়, তার দু’চোখের
মমতায় কখনো আমার চিত্ত আনন্দ-ধারায়
হবে না বিশদ স্নাত পাশাপাশি বসে ক্ষণে ক্ষণে!
৭.৫.৯৬

নিঠুরা যমজ ভগ্নী

কিছুদিন ধরে খুব বিস্রস্ত, ব্যাকুল হয়ে আছি;
আমাকে শিকার করে অস্থির প্রহর বারবার
দ্বিধাহীন, বুঝি কোনো চিত্তহারী ক্রীড়ায় মেতেছে।
আমার এ ব্যাকুলতা একান্ত নাছোড়, কিছুতেই
পাই না ঈষৎ মুক্তি। সঙ্গিনীবিহীন পাখি হয়ে
নীড় ছেড়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ফিরি দূরের আকাশে,
পদ্মার ঊষর চরে, বিলে, ঝিলে, গহীন বনের
গাছে গাছে। উন্মোচিত যন্ত্রণার ফোয়ারা হৃদয়ে।

কী করব আমার এ ব্যাকুলতা নিয়ে অবেলায়?
কে আমাকে বলে দেবে একে আড়ালে রাখার
নিখুঁত পদ্ধতি? ফণিমনসার সহিংস আঁচড়ে
রক্তের বুদ্বুদ জাগে অধীর সত্তায়। থাক, তবু
থাক, এই ব্যাকুলতা, এই অস্থিরতা-এই দুই
নিঠুরা যমজ ভগ্নী প্রেমের কাব্যের উৎসভূমি।
৬.২.৯৭

পঁচিশ বছর ধরে

পঁচিশ বছর ধরে তোমাকে রেখেছি ভরে এই
হৃদয়ে আমার, যেন শকুনের চঞ্চু ও নখর
ব্যর্থ হয় তোমার দুচোখ তুলে নিতে, যেন কোনো
জখম না হয় অঙ্গে। থাকো তুমি সর্বদা নিখুঁত
পদ্মের ধরনে, এই স্বপ্ন আমাকে বসিয়ে রাখে নিত্য
প্রান্তরে, দিঘির ঘাটে, বকুলতলায়। কবিতাকে
বারবার করেছি উৎসর্গ ভালোবেসে অরুণিমা
তনিমার, যা তোমার। হৃদয়ের রৌদ্র-জ্যোৎস্না নাও।

তোমাকে বিকৃত করে, অপবাদে কালিমায় মুখ
লেপে দিয়ে বেজায় অনগ্রসর উদ্ভট মানুষ
কতিপয় বাজায় কর্কশ ঢোল, অন্ধকার স্রোত
কেবলি বইয়ে দেয় মগজের কোষে দিনরাত।
কোকিল, দোয়েল গানে গানে বাগানের পথে আনে
বসন্ত, পূর্ণিমা, তুমি, স্বাধীনতা, স্বাগত জানাও।
২২.১১.৯৬

প্রকৃত কবিতা

আমি কি খাইনি ভোরে এবং দুপুরে নীলিমার
রুটি আর খাইনি কি পেট পুরে নক্ষত্রের ভাত
চন্দিমার ঝোল দিয়ে? আঁধারের পুরনো মদিরা
করিনি আকণ্ঠ পান? কখনো চাঁদের নাও কাঁধে
বয়ে পথ চলি, কখনোবা সুরুজের খব কাছে
গিয়ে দগ্ধ হয়ে যাই আপাদমস্তক। সামুদ্রিক
হাঙরের সঙ্গে যুঝে রক্তাক্ত শরীরে খুঁজে পাই
একটি প্রবাল-দ্বীপ, যা চকিতে শূন্যে মিশে যায়।

তান্ত্রিকের মতো ক্ষণে ক্ষণে করি মন্ত্র উচ্চারণ
গহন অরণ্যে কিংবা পর্বত চূড়ায় মগ্নতায়
এবং সুফীর মতো নাচি জিকিরের ছন্দে আজো
সারারাত। এই সবকিছু কবিতারই জন্যে, জানি;
প্রেমিকা ও কবিতায় মানি না প্রভেদ। প্রিয়তমা
এখন অধরা নয়, দেবে নাকি ধরা প্রকৃত কবিতা?

 প্রগতির পথে প্রতিক্ষণে

কৃতী সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মরণে

যাই নি পায়রাবন্দে, তবুও বেগম রোকেয়ার
কবেকার শোকগ্রস্ত বাড়ির কঙ্কাল, ভিটেমাটি
এবং সেখানকার ধূলিকণা, লতাগুল্ম আর
লাউয়ের মাচান, ধানক্ষেত, কুয়োতলা, ছেঁড়া পাটি
বর্গচাষি, বাল্য বিয়ে-পড়ানো মৌলভী, ছমিরণ,
দিনভর খাটুনির ধকল-পোহানো কিশোরীর
খড়ের উপর ঘুম-ইত্যাদি দেখেছি, মোনাজাত,
তোমারই সৌজন্যে; সেই ঋণ স্বীকারে অকুণ্ঠ আমি।

কী করে ভুলব মাকড়া বুড়ো, তার চৌদ্দ বছরের
দীপ্ত বউ, হাওয়া বিবি এবং সুরমা নাম্নী এক
পরিণীতা বালিকার কথা? তুমি ছিলে বলে অবজ্ঞাত
তারা ঠাঁই পেলো ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে। ছিলে
লাজুক, অথচ দৃঢ়চেতা, আদর্শে অটল আর
প্রগতির পথে প্রতিক্ষণ সংগ্রামী, নিঃশঙ্ক যাত্রী।
৩১.১.৯৬

 প্রণয়ের সংজ্ঞা

বিশ্ববিদ্যালয়ে লগ্ন একজন মেদুর যুবক
ঝাঁ ঝাঁ এক দুপুরে আমার কাছে এসে সবিনয়ে
কিছুক্ষণ এটা সেটা বলে আমার নিকট থেকে
লাজনম্র স্বরে, যেন নিজের সঙ্গেই আলাপের
সূত্রপাত করে, জেনে নিতে চায় প্রণয়ের সংজ্ঞা
ঈষৎ গভীরভাবে। হরিচরণের অভিধান
বিশদ স্মরণ করি, গুণিজনদের তহবিল
উপুড় করেও শেষ অব্দি থেকে যাই নিরুত্তর।

যখন তোমার চোখে চোখ রেখে তন্ময় ডুবুরি
হই, হাত ছুঁয়ে নিজে বীণা হয়ে বেজে উঠি আর
তোমার কথার ছায়া চামর দোলায় হৃদপুরে,
তখন আমার খুব ইচ্ছে হয় জ্ঞানপিপাসু ঐ
বিদ্যার্থীকে ডেকে বলি, ভালোবাসা কাকে বলে যদি
জানতো চাও, মানবীর চোখের তুমি গভীর তাকাও।
২৭.১.৯৭

প্রতীক্ষায়

তোমার ফেরার দিন আসন্ন বলেই প্রিয়তমা
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি পলাশ-মঞ্জরি হয়ে রোদ
জ্যোৎস্না মেখে নেয়। ভাবি, এ মুহূর্তে নির্জনতাবোধ,
যা বিরহ, তোমাকে দখল করে দূর রমরমা
হোটেলের লাউঞ্জে অথবা কামরায়। ঘন অমা
তোমাকে ধরে কি ঘিরে? না কি হাস্যে লাস্যে পরিবার
পরিজন নিয়ে কাটে বেলা? আমি বেদনার ভার
বয়ে চলি, করোটিতে আশঙ্কার ছায়া হয় জমা।

তোমার প্রহর কাটে, অনুমান করি, স্বপ্ন ঘোরে
দোকানে, মোটরকারে কখনো বা হাঁটো রাজপথে
যাও কোনো বিখ্যাত উদ্যানে, আর তোমার শরীর
মনোমুগ্ধকর ছন্দে দুলে ওঠে সমুদ্র সৈকতে
যেখানে দুপুরবেলা দলে দলে স্নানার্থীরা ভিড়
জমায়, এখানে প্রতীক্ষায় আমার অন্তর পোড়ে।
২১.২.৯৬

প্রত্যাশা ছিল না কোনো

প্রত্যাশা ছিল না কোনো, তবু যেন কে ঐন্দ্রজালিক
হঠাৎ ঘটিয়ে দিল চোখের পলকে এই সব
আশ্চর্য আমার জন্যে-এই অলৌকিক কলরব,
দুয়ারে পুষ্পক রথ, অন্তরে নিভৃত মাঙ্গলিক।

এই যে তোমার মুখোমুখি বসে আছি শীতাতপ
নিয়ান্ত্রিত ঘরে নিরিবিলি, দেবব্রত গানে গানে
মুহূর্তগুলোকে অনুপম সাজিয়ে দিচ্ছেন, প্রাণে
সুদূরের তৃষ্ণা জাগে, ঘর করে সুন্দরের জপ।

যেন দিব্যনদীতীরে পেয়ে গ্যাছে ঠাঁই ভগ্নস্বাস্থ্য
এই কবি। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে করোনি বড়াই
কোনোদিন, কিন্তু আমি তোমার বাহির-অন্তরের
রূপে মুগ্ধ, ‘মাঝে-মধ্যে ছন্নছাড়া লোকটা আসতো
এখানে’, বলবে কেউ কেউ, ‘সে তো করতো লড়াই
অশুভের সঙ্গে, মুহূর্তের মুক্তো কুড়াতে সে ঢের!
৮.৫.৯৬

বরাভয়

গত কয়েকটি দিন আমাদের বড়ো এলোমেলো,
শরবিদ্ধ ছিল, চতুর্দিকে হৈ-হুল্লোড়, ধূলিঝড়
ছিল, ছিল তর্ক আর কর্কশ বচসা, বুনো জ্বর,
যা স্পর্শ করেছে আমাদেরও, কখন যে খুব খেলো
হয়েছি নিজেরই কাছে, বস্তুত পাইনি টের। ভুল
করেছি আমিও জেনেশুনে, কলহের সূত্রপাতে
পারিনি টানতে ছেদ, পড়েনি সে-তথ্য মনে, যাতে
ছিল সত্য, ফলে বিদ্ধ করেছে আমাকে শত হুল।

তুমি কি আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহের দোলা
কখনো পুষেছ মনে? আমাকে নির্দয় আর খল
ভেবেছ কি বিভ্রান্তির-ঝাপ্‌সা কোনো ক্ষণে? শোনো, ঘোলা
জলে মৎস্যশিকারি তো আমি নই উপরন্তু ছল
ধাতে নেই, পেয়েছি প্রেমের দেবতার বরাভয়-
প্রলয়েও আমাদের ভালোবাসা অম্লান, অক্ষয়।
১৯.৬.৯৬

 বর্ণমালা দিয়ে

কবিতা লিখতে গিয়ে হঠাৎ পড়ল মনে এই
কিছুদিন আগে তুমি আমার একটি কবিতায়
ওষ্ঠ রঞ্জনীর গাঢ় ছাপ রেখেছিলে মমতায়
তোমার নিজস্ব ঘরে। এ ঘটনা গাঁথা স্মৃতিতেই।

এতকাল কেটেছে একুশে ফেব্রুয়ারি কী রকম
নিস্তেজ, নিষ্প্রভ যেন। মন ভালো ছিল না, ফলত
নীরবে ছিলাম আমি শহীদের স্মৃতিতে প্রণত
এবং হৃদয় জুড়ে ছিলে তুমি কিউপিডের কসম।

আমার কবিতা ডানা মুড়ে ঘুমোচ্ছিল, আমি তাকে
শিস দিয়ে ব্যাকুল জাগিয়ে তুলি, স্মরণ করিয়ে
দিই তুমি নেই বলে ওকে বেশি চাই, ওর সঙ্গ
না পেলে আমার চতুর্দিকে প্রেত নেচে নেচে ভঙ্গ
করবে মনের শান্তি। আজ বাংলা বর্ণমালা দিয়ে
নক্ষত্রের আভা মেখে পরিপূর্ণ সাজাবো তোমাকে।
২২.২.৯৬

বলো তো তোমাকে ছেড়ে

বলো তো তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব এতদিন
এ শহরে? শহরের পথ চেনে আমার নিভৃত
পদধ্বনি, কোনো পুরনো গলির মোড় জানে
আমার জুতোর গন্ধ কী রকম; এ চেনা নগরে
কিছুদিন তোমাকে কোথাও খুঁজে পাবো না নিশ্চিত।
তোমাকে না দেখে আর তোমার সুরেলা কণ্ঠস্বর
না শুনে থাকতে হবে ভাবতেই পারি না, অথচ
আমাকে দণ্ডাজ্ঞা মেনে নিতে হবে প্রতিবাদহীন!

এখন শহর খুব বিপন্ন, আতঙ্কে কম্পমান;
শান্তি-ছাওয়া ছাত্রাবাসে নেকড়ের মতো হানা দেয়
জালিম পুলিশ, বুট লাথি মেরে হাওয়ায় ওড়ায়
ছাত্রের ভাতের থালা; বন্দুকের বাঁট ভেঙে ফেলে
হাত-পা নিদ্রিত শিক্ষার্থীর, ক্রুশবিদ্ধ মানবতা-
এরই মধ্যে, প্রিয়তমা, নিরন্তর তোমাকেই ভাবি।
৮.২.৯৬

বাগান দেখালে তুমি

‘দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন ফুটেছে ফুল আমার বাগানে;
বল্‌লে তুমি আমাকে সে-রাতে। দেখি গাঁদা আর কিছু
ডালিয়ার স্মিত মুখ। ‘এখানে গোলাপও ছিল ঢের
কখনো, কুকুর কষ্ট পাবে বলে, কাঁটার আঘাতে
গোলাপ মরেছে যত্নাভাবে-তোমার কথায় ছিল
বেদনার রেশ আর আসমানে পঞ্চমীর চাঁদ
যেন বা তোমার কণ্ঠে হর্ষবর্ধনের আমলের
হাঁসুলি, তোমার দেহে আমার দু’চোখ পর্যটক।

পঞ্চমীর চাঁদের অজানা নয় সে-রাতে তখন
আমার হৃদয়ে ফুটেছিল অজস্র রঙিন ফুল
তোমার সান্নিধ্যে সেই বাগানের কাছে, তুমি টের
পাওনি, এমন মশগুল ছিলে বিবরণে। শেষে
প্রস্থানের কালে দেখি কলোনি কংকাল অতিকায়
এবং পথের ধারে দুধের বাতিল কৌটো, এঁটো।
২৭.১.৯৬

বালুচরে

আমার দুঃখের বালুচরে কাকজ্যোৎস্না দেখে তুমি
ভেবো না সুখের নাও ভিড়েছে আমার ঘাটে। দেখো,
ভালো করে দেখো, এই নিঃসঙ্গতা সঙিন উঁচিয়ে
রেখেছে আমার দিকে; বাতাসে উড়ছে বালিকণা
হা হা স্বরে, নির্জনতা নিজেই ভীষণ ভীত স্ফীত
নদীটির খল খল শব্দে, সঙ্গিবিহীন এক
চখা চক্রাকারে ওড়ে মাথার ওপর অবিরাম-
তার হৃৎকমল ছিঁড়েছে শিকারির হিংস্র ক্রীড়া।

এসো না তুমিও এই বালুচরে সতর্ক পাহারা
এড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা ভাসিয়ে ময়ূরপঙ্খী নাও।
মহুয়া হবে কি তুমি আধুনিক সাজসজ্জা ছেড়ে?
নিমেষে নদের চাঁদ হয়ে আমি সাজাবো তোমাকে
আমার ব্যাকুল প্রেমে, নাকি চখী হয়ে উড়ে এসে
ডাকবে আমাকে? সেই ডাকে হয়ে যাবো ফুল্ল চখা!
১৫.১.৯৬

বিচ্ছেদ বিষয়ক

এক শহরেই থাকি আমরা দু’জন, গৌরী আর
আমি, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে দেখা করতে পারি না
আজকাল; এ কেমন কাল এলো? লুট, হত্যা বিনা
যায় না একটি দিনও। জালিমের কর্কশ হুঙ্কার

ত্রাস সৃষ্টি করে চতুর্দিকে, কোনোদিকে বেরুবার
তেমন সুবিধে নেই। সরকার শ্বাপদ হলে, কেউ
নিলে কিছু, সন্ত্রাসীর বাড়লে দাপট, তবে কেউ
নিরাপদ নয় প্রেমও হয় মুখোমুখি হায়নার।

এখন গৌরীর মুখ দেখি কল্পনায়, বয়ে চলি
প্রতিদিন বিচ্ছেদের ভার; গৌরী আর রাজপথে
লেগে-থাকা রক্তচিহ্ন স্পষ্ট পাশাপাশি, অন্ধ গলি
মনে হয় এ জীবন। একা-একা মানস-সৈকতে
হাঁটি, শুই; ভাবি, এ বিচ্ছেদ এমন দুঃসহ এই
মুহূর্তে মৃত্যুতে চির বিচ্ছেদের যন্ত্রণাই নেই।
২৭.২.৯৬

বিপন্ন হয়ে যাই

নিজেই নিজের আচরণ নিশ্লেষণ করে খুব
বিস্মিত, বিপন্ন হয়ে যাই। আমার ভেতরকার
কোন্‌ অন্ধকার স্তর থেকে ক্ষিপ্ত এক জাগুয়ার
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। কখনো অতলে দিয়ে ডুব
আমি যেন জলজ সহিংস প্রাণী ছিঁড়ে খুঁড়ে
খাবো পাবো যা সমুখে, লেজের আঘাতে চতুর্দিক
তছনছ করে শেষে নিজেকেই ভয়ঙ্কর শিক
দিয়ে গেঁথে ভব্যতার খোলস ফেলবো ভেঙেচুরে।

এই ভাঙচুর লক্ষ্য করে তুমি এর ব্যাখ্যা চেয়ে
আমাকে বৃথাই করো অপ্রস্তুত। কত ব্যাখ্যাতীত
বিষয় রয়েছে ভবে, অমীমাংসা যার অসহায়
করে রাখে মানুষকে, মাঝে মধ্যে অস্তিত্বের ভিত
ভয়ানক কেঁপে ওঠে। কালসন্ধ্যা নেমেছে, হে মেয়ে
ডোবাচ্ছো পীড়ন-গাঙে, আবার ভাসাও কিনারায়।
৫.৫.৯৬

বিপর্যয় এবং একজন কোকিল

আজ আমি, বলা যেতে পারে, পর্যুদস্ত ভয়ানক।
আমাকে ধরেছে ঘিরে ধূর্ত কাক, হাড়গিলা আর
কাদাখোঁচা, ক্রমাগত চঞ্চুর আঘাতে অন্ধকার
দেখছি, নিজের ক্ষত দেখে ভয় পাই। কাঁহাতক
সইব এমন নির্যাতন? হায়, আমার পালক
নেই যে ত্বরিৎ উড়ে যাবো বহুদূরে নীলিমার
নিভৃত অভয়াশ্রমে। সাধগুলো হচ্ছে ছারখার
কর্কশ চিৎকারে, আমি ভূলুণ্ঠিত, উদ্যত ঘাতক।

একজন কোকিল শহরে আছে যার গানে গানে
আমার প্রহর খুব উদ্‌ভাসিত; আমি নিত্য কান
পেতে থাকি; হা কপাল, আজকাল সে-ও তো আহত
ভীষণ, হৃদয় তার জর্জরিত বিপক্ষের বাণে;
কণ্ঠ থেকে তার ঝরে ক্ষোভ আর বেদনার তান,
তবু সুপ্রভাত শুভরাত্রি জ্বলে নক্ষত্রের মতো।
২৮.৭.৯৬

ভরে নাও ঘড়া

পাঠাওনি তুমি আজ কোনো পাখি আমার নিকট
কবির খবর দিতে। যে পাখিটা পুষছো হৃদয়ে
দীর্ঘকাল, রেখেছ আড়াল করে তাকে, যাচ্ছে বয়ে
দিনরাত, কার পদাঘাতে ভাঙলো মঙ্গলঘট?

তোমার অশান্ত মন সর্বক্ষণ বইছে পাথর,
এভাবে কি শ্বাস-প্রশ্বাসের সূক্ষ্ম, সাবলীল খেলা
চালানো সম্ভব অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া? স্নিগ্ধ বেলা
বড়ো ক্ষণস্থায়ী, চতুর্দিকে জীব বেদনা-কাতর।

তোমার বেদনা আরো বাড়াতে চাই না বলে থাকি
চুপচাপ, একা-একা সই বিচ্ছেদের স্বৈরাচার।
ফুসফুসে বীজাণুর হট্রগোল অন্তরালে চলে আর
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে খাঁচা; কবে প্রাণ-পাখি
উড়ে যাবে, কে জানে এ ভাবে? তাই বলি, এসো তবে
আমরা দু’জন বাঁচি বেদনার নিঃসীম গৌরবে।
২৯.৩.৯৬

ভাবিনি এমন

ভাবিন এমন ভয়ঙ্কর অন্ধকার তীক্ষ্ণ দাঁত
বের করে দেশকে করবে গ্রাস। ঢ্যাঙা, ক্ষিপ্ত ঘোড়া
চারপায়ে করে তছনছ দেখি দেশজোড়া
চলে কুশাসন লম্বকর্ণদের, ভীষণ সংঘাত
পথে পথে, স্বামীহারা নারী আজ করে অশ্রুপাত
কত ঘরে, সংগ্রামী মানুষ মরে গুলির বৃষ্টিতে,
প্রবল ঝাঁকুনি লাগে মানবিকতার দৃঢ় ভিতে
শ্রেয়োবোধ লুপ্তপ্রায়, সহিংসতা নাচে দিন-রাত।

যেদিকে তাকাই দেখি মাটি ফুঁড়ে বেরোয় অদ্ভুত
প্রাণী দলে দলে, যেন বিকট গণ্ডার, যায় ছুটে
মানুষের পেট চিরে ফেলার উদ্দেশ্যে, এইসব
হিংস্র মূর্তি সংহার করবে যারা তাদের নিখুঁত
প্রক্রিয়া হয়েছে শুরু অন্তরালে, ওরা লুটে-পুটে
খাবে না কিছুই শুধু বাজাবে সৃষ্টির কলরব।
১৮.৩.৯৬

মধ্যরাতে ঘুম থেকে

মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশের বাড়িটা
দু’টি শাদা ডানা পেয়ে চকিতে উড়াল দেয় মেঘে;
একজন বুড়ো লোক শুয়ে আছে গাছের ওপর
কাঁথা মুড়ি দিয়ে, বিড়বিড় করে ঘুমের গুহায়।

আখরোট সদৃশ দরিদ্র বুড়ো স্বপ্নের ভেতর
মড়ার খুলিতে ঢেলে কিছু সর্পরস করে পান
অকাতরে; অন্ধ বাদুড়ের ঝাঁক তাকে ঢেকে ফেলে,
ধেয়ে ইঁদুরের দল ওকে আহার্য ঠাউরে নেয়।

সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি কোমর অবধি কাদাজলে,
চতুর্দিকে বিষ্ঠা ভাসমান, এরই মধ্যে কতগুলো
কোমল, সুন্দর জলচর পাখি প্রফুল্ল সাঁতার
কাটে আর আমিও বাজাই বাঁশি কালো পানি কেটে
এগোতে এগোতে; দেখি লন্ড্রিতে বিশুদ্ধ ধোয়া সত্য
পতপত ওড়ে পথে, লোকজন দৃকপাতহীন।
২৩.১.৯৬

মহুয়া আসছে

মেঘের আড়ালে তুমি লুকাও হে চাঁদ, ঢাকো মুখ
তাড়াতাড়ি, মহুয়া আসছে তার অপরূপ রূপ
নিয়ে ধীর পদক্ষেপে কংসাই নদীর ধারে, ধূপ
জ্বলছে হৃদয়ে তার, নদীর ঢেউয়ের মতো বুক
ওঠা নামা করে আর বস্তুত নদেরচাঁদ নয়,
আমিই জলের ঘাটে একা বসে আছি প্রতীক্ষায়।
তার হাত ধরে নিয়ে যাবো বেদেদের পাহারায়
ধুলো দিয়ে নিজের ডেরায়, পাবে না সে আর ভয়।

সৌন্দর্য ঐশ্বর্য তার, উপরন্তু মন ঝকঝকে
স্বচ্ছ সরোবর এক; গহন দু’চোখ। মাঝে মাঝে
কথায় কৌতুক খেলে, কিন্তু সৌন্দর্যই হলো কাল
শেষ অব্দি; বিষ-ছুরি, পুরুষের সিক্ত, লকলকে
লালসার জিভ থেকে পারিনি বাঁচাতে তাকে, বাজে
তার মৃত্যুধ্বনি, আমাকেও ঘিরে ধরে ক্রূর জাল।
২২.৪.৯৬

মহুয়ার মন

মাত্র দু’বছর আগে আমাদের এই পরিচয়
অকস্মাৎ এ শহরে বিলম্বিত গোধূলি বেলায়।
আমরা দু’জন একই ঘাটে মহাকালের খেলায়
মিলিত হয়েছি, আমাদের হৃদয়ের পরিণয়
বহু যুগ আগেই হয়েছে বীথিকায় মনে হয়
সম্পূর্ণ গান্ধর্ব মতে। কদমতলার স্মৃতি আজো
রূপালি মাছের মতো ভেসে ওঠে। বাজো, বাঁশি বাজো,
উঠুক পায়ের মল নেচে আজ এ শহরময়।

গৌরী, তুমি আধুনিকা; উন্নত মানের শিক্ষা দীক্ষা
পেয়েছ, বস্তুত তুমি রুচির সৌরভ প্রতিক্ষণ
ছড়াও আলাপে, আচরণে; তোমার সময় ভিক্ষা
চাই কিছু প্রায়শই; দাও, জানি; কোনো কোনো স্তরে
তোমার এবং গ্রাম্য গীতিকার মহুয়ার মন
অভিন্ন প্রণয়ে, ঘর-কাঁপানো আবেগে, জলঝড়ে!
২৯.১.৯৬

 মাপকাঠি

তুমিই আমাকে জপিয়েছে সাধারণ মাপকাঠি
দিয়ে পরিমাপ করা চলে না আমাকে কিছুতেই;
সমাজে আমার আচরণ হবে খুব পরিপাটি
এবং নিখুঁত-এই তুচ্ছতার প্রয়োজন নেই।
‘কবি তুমি, শব্দশিল্পে নিবেদিত থাকবে সর্বদা
অন্য সব কিছু গৌণ হোক, তাহলেই হবো সুখী,’
বলেছিলে তুমি একদিন কথাচ্ছলে প্রিয়ংবদা
নিভৃত ড্রইংরুমে। ভাবনার অন্য আঁকি-বুঁকি
ছিল না তোমার মনে, অনুমান করি। কিন্তু কাল
কী-যে হলো অকস্মাৎ সামাজিক তুচ্ছতার টানে
ছিঁড়ে গেল হৃদয়ের সূক্ষ্ম তার, বেসামাল
হয়ে তুমি আগুন ঝরালে খুব তালছুট গানে;
সামাজিকতায় ছিল আমার অবুঝ-ভুলক্রটি,
বুঝি তাই দিয়েছে আমাকে কালো ভর্ৎসনা, ভ্রূকুটি।
১৫.৬.৯৬

ম্লান হয়ে যাই

খুব ভোরে জেগে উঠে দেখি চেনা সুন্দর পৃথিবী
আমার দিকেই গাঢ় মমতায় তাকিয়ে রয়েছে;
গাছ, লাল গোলাপ কাছের নার্সারির, খোলা পথ
নীলকণ্ঠ, ভাসমান মেঘ শুভেচ্ছা জানায়, ভাবি-
আজ তুমি প্রিয়তমা, সুস্থ থাকবে, আনন্দে ভরে
রইবে তোমার মন। কেননা আবার কাল রাতে
দেখা হলো আমাদের। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা
বলে কণ্ঠস্বর শুনে তোমাকে নীরোগ জানলাম।

এমত ধারণা হলো, আমার গভীর ভালোবাসা
তোমার শরীর থেকে সহজে ফেলেছে মুছে সব
যন্ত্রণা, মনের ক্লেশ। এ ধারণা আমার গর্বের
ঝুঁটিকে অধিক দীপ্ত করে তোলে। অথচ সন্ধ্যায়
তোমার মধুর কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসুখের স্বর-
ব্যর্থতা আমাকে করে গ্রাস, বড়ো ম্লান হয়ে যাই।
৭.২.৯৭

যখন ছিলে না তুমি

আখেরে অসিত বিচ্ছেদের দিন হলো অবসান
আজ এই প্রসন্ন বেলায়। আনন্দের অনাগত
মুহূর্তের তীব্র প্রতীক্ষায় হৃদয়ের অন্তর্গত
গানে-পাওয়া পাখি গেয়ে ওঠে পুনর্মিলনের গান।

একেকটি দিন ছিল বহুশত বর্ষের অবসান,
যখন ছিল না তুমি কাছে, প্রতিদিন অবিরত
দেখেছি তোমার মুখ মেঘে, স্বপ্ন-সরোবরে নত
পদ্মের আভায়, শুধু তোমাকেই করেছি সন্ধান।

বিষাদের মুখে হাসি ফোটে, হাওয়া এসে দিলখোলা
কথা বলে, বুলায় রেশমি হাত চুলে, গৃহকোণ
বাসর শয্যার ঘ্রাণে পুলকিত; এ কিসের দোলা
আমার অস্তিত্বে? এই বুঝি বেজে ওঠে টেলিফোন,
যার অপেক্ষায় আছি স্বরচিত মনোজ নিবাসে
ঘাতক কালের মোড়ে, শাসকের ব্যাপক সন্ত্রাসে।
১৫.৩.৯৬

যখন তোমার কণ্ঠস্বর

যখন তোমার কণ্ঠস্বর মঞ্জুরিত টেলিফোনে
সকালে দুপুরে রাতে, আশ্চর্য পুষ্টিত সেই স্বর
নিভৃতে আমার শরীরকে স্পর্শ করে, থর থর
অস্তিত্ব আমার কথাগুলো স্বপ্নময়তায় শোনে।
যদিও রয়েছে কিয়দ্দূরে, তবু এই গৃহকোণে
বসে তারবাহী কিছু কথা শুনে এ সামান্য ঘর
অলৌকিক অনন্য বাসরঘর হয়; অতঃপর
আমরা সঙ্গমসুখে ভাসি, নক্ষত্রেরা স্বপ্ন বোনে।

টেলিফোনে আমাদের দু’জনের কথোপকথন
শেষ হলে আমার নিঝুম করোটিতে রয়ে যায়
দেবালয়ে গুণীর তানের মতো কিছু গুঞ্জরণ
বেলা অবেলায়, ঘাসবনে নিরিবিলি যুগ্মতায়
অবিরল বয়ে যাওয়া রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় ঝুলে থাকে
অসংবৃত টেলিফোন; চন্দ্রোদয়ে বিনিদ্র চকোর ডাকে।
২৭.৮.৯৬

যখন শিল্পও হার মানে

তুমিতো যাবার আগে বিবর্ণ রোগীকে চমৎকার
প্রেসক্রিপশন আর কিছু পথ্য দিয়ে গেলে হেসে,
অবশ্য তুমি তা আন্তরিক উষ্ণতায় ভালোবেসে
করেছ; স্বীকার করি। মনে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার
মেঘ যদি ঘনায়, তা হলে যেন ক্যাসেট প্লেয়ার
নিমেষে চালিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথের গানে ভেসে
যাই কিংবা ‘শেষের কবিতা’ শুনি নিভৃত আবেশে
ইত্যাদি বলার ক্ষণে তুমি ছিলে নিজেও আঁধার।

ইচ্ছে করলেই কেউ বেদনার নিষ্করুণ চাপ
থেকে মুক্ত হতে যে পারে না, এই সত্য সুনিশ্চয়
তোমার অজানা নয়। মানি, শিল্প প্রলেপ বুলিয়ে
মনোভাব কিছুটা লাঘব করে; দহমনের তাপ
অত্যন্ত প্রখর হলে শিল্পকে হার মেনে নিয়ে
ব্যর্থতার গহ্বরে প্রস্থিত মুখ লুকাতেই হয়।
২৯.৪.৯৬

রাজনীতি

রাজনীতি আজকাল ধূর্ত, খল, ভ্রষ্ট, নীতিহীন
অতিশয়; রাজনীতি বড়োই কর্কশ, মিথ্যা বুলি
প্রায়শই সহিংসতা, মানুষের চোখে কড়া ঠুলি
পরিয়ে ঘোরানো, উপহার দেয়া ছলনার দিন।
রাজনীতি এমনকি সুন্দরীর মুখকেও খুব
কঠিন বিকৃত করে তোলে নিমেষে এবং চোখে
মুখে তার জ্বেলে দেয় চৈত্রদাহ, তখন ত্রিলোকে
প্রেমিক অনুপস্থিত, জলাশয়ে প্রেমও দেয় ডুব!

তবুও বিবর্ণ জীবনের কাঠামোয় রাজনীতি
চাই আজ আমরা সবাই সুস্থতা ও প্রগতির
স্থির লক্ষ্যে, যেখানে ছলনা নেই, নেই কোনো ভীতি
ভ্রষ্টাচার, অকল্যাণ, আস্ফালন মারণাস্ত্র আর
সযত্নে লালিত সন্ত্রাসীর, যেখানে প্রেমিক নীড়
পেয়ে যায় অকর্কশ সুস্মিতা সত্তায় দয়িতার।
১৪.৬.৯৬

 রাহুগ্রাস

আমাকে থাকতে হবে অপেক্ষার ধু ধু সাহারায়
আরো কিছুকাল, মনে হয়ঃ স্বৈরাচারী আঁধিঝড়
চতুর্দিকে ক্রমান্বয়ে উপড়ে নিয়েছে বহু ঘর।
সন্ত্রাসশাসিত মানুষের মুখ দেখে দিন যায়
কোনো মতে, দুঃস্বপ্নের ভয়ে রাত কাটে অনুদ্রায়,
মাঝে মাঝে অজান্তে শিউরে উঠি না জানি কীসের
শংকায়; আমার হাতেও কি ক্রূরা ঘাতক বিষের
পাত্র তুলে দেবে আজ? আছি সত্যি কসাইখানায়।

কত আর ধৈর্য ধরি প্রিয়তমা? তোমার চৌদিকে
উঁচিয়ে রয়েছে মাথা প্রথার শান্ত্রীরা সর্বক্ষণ,
আমিও কপাল ঠুকি দিনরাত নিষেধের শিকে।
তোমাকে না দেখার বেদনা করে ক্রমশ হরণ
প্রাণশক্তি; ভয়ংকর রাহুগ্রাসমুক্ত হলে দেশ,
আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার রুদ্ধ কাল হবে শেষ।
১৯.৩.৯৬

শকুন্তলা

শকুন্তলা নও, পতিগৃহেও যাচ্ছো না, তবু দেখি
আশ্রমের নয়, শহরের বাগানের চারাগাছ
তোমার আঁচল জোরে জড়িয়ে ধরেছে, পাতা নাচ
কখন দিয়েছি জুড়ে প্রতিবাদে; ধরন সাবেকি।

তোমার যাবার আগে বাঁধা দিতে পারছি না, আছি
বিষণ্ন, নিশ্চুপ, তুমি দেখবে না, জানবে না আর
সবান্ধবী চলে যাবে বিমানবন্দরে। অন্ধকার
ঘরে আমি নৈরাশ্যের সঙ্গে কথোপকথনে বাঁচি।

আমার নিকট নেই এমন হরিণ, যার টানে
হবে না তোমার যাওয়া, আমার মনের তপোবন
অতটা মায়াবী নয়, সব ছেড়ে ছুঁড়ে তুমি ফিরে
আসবে এখনই এই শূন্য ঘরে হৃদয়ের গানে
আমাকে দুলিয়ে দিতে ঢেউয়ের নাওয়ের মতো। মন
ভালো নেই, তবুও যাবো না করুণার ভাঙা তীরে।
৭.৩.৯৬

শান্তিনিকেতনে গৌরী

জানতাম অসম্বব, তবু কলকাতার কলরবে
তোমার মধুর কণ্ঠস্বর শুনি অতিথি নিবাসে
আমার অস্থায়ী ঘরে। প্রত্যুষের পাখির সঙ্গীতে
জেগে উঠে দেখি একি রয়েছে দাঁড়িয়ে নিরিবিলি
চায়ের পেয়ালা হাতে। বসলে শয্যার ধারে এসে,
তোমার চুলের ঢল নামে আমার মুখের পরে,
আমার জাগ্রত ওষ্ঠে ফোটে কিছু চুমোর কুসুম,
সারা ঘর ভরে যায় অপরূপ তোমার সৌরভে।

শান্তিনিকেতনে, খোয়াই-এর তীরে, রামকিঙ্করের
কঙ্কালীতলার পথে যেতে দেখি হঠাৎ গৌরীকে।
ছাতিমতলায় বসে আছে একাকিনী গোধূলিতে,
সন্ধেবেলা কবিতা উৎসবে দ্যাখে কবিতা পড়তে
আমাকে তন্ময় হয়ে, যে কবিতা বস্তুত রচিত
তারই জন্যে, জ্বলে আসমানে কালপুরুষ নীরবে।
১৯.২.৯৬

শুধু গৌরী নিজে

প্রায়শ এমনই হয়, অনিদ্রার অঙ্গার ভীষণ
পোড়ায় রাত্রিকে আর শরীরকে আমার; যেদিকে
তাকাই কেবল পোড়া গন্ধ পাই। অন্ধকার ফিকে
হয়ে এলে মনে হয় পাখির উৎসব এ দহন
বেবাক ফেলবে মুছে, শান্তি জলে স্নাত হবে মন,
বঞ্চনার হাহাকার থাকবে না, এ জগতে টিকে
থাকার দুর্মর বাসনায় কোনো মন্ত্র নেব শিখে
আর রোদে হাস্যেজ্জ্বল হবে হৃদয়ের উপবন।

পাখির ডানার ছন্দ, রোদের সিস্ফনি জানি আজ
পারবে না আমাকে ফিরিয়ে দিতে গত নিশীথের
লুণ্ঠিত সময়, গুণী ভাস্করের কোনো কারুকাজ
আমার জ্বলন্ত কামনার ভস্মরাশি থেকে ফের
গড়তে অনিন্দ্য মূর্তি ব্যর্থ হবে। শুধু গৌরী নিজে
পারে এ দহন মুছে দিতে প্রণয়-ধারায় ভিজে।
৫.৭.৯৬

সনেটের শতদল

হে আমার সনেটের নিঃসীমা, তোমাকেই
কী ব্যাকুল চায় খরাচিহ্নময় কবিতার খাতা
তুচ্ছতা সরিয়ে পাশে। ‘সেজে ওঠো তুমি শূন্যে পাতা’
বলে প্রার্থনার স্বরে আর প্রায় প্রতিদিন এই
রোগশয্যা খুব মেতে ওঠে সকলের আড়ালেই
নক্ষত্রের কণাসমূহের নাচে, বসন্ত-উৎসবে;
অষ্টক ঘটক আসে বারে বারে উল্লাসে গৌরবে।
হে সনেটমালা তোমাদের বিনা আজ সুখ নেই।

রোগশয্যা ক্রমশ উন্নীত হয়, যেন নীলিমায়
নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেবে। শয্যাগত আমি মেঘ ছুঁই,
কে এক সুন্দরীতমা ছুঁয়ে যায় আমাকে আঁচল
দিয়ে তার; অভ্রের গুঁড়োর মতো শব্দ ঝরে যায়
চারপাশে; কোনো শব্দ কল্যাবতী, কোনো শব্দ জুঁই,
কোনো শব্দ বেলী রূপে হয় সনেটের শতদল।
২২.৪.৯৬

সন্ধ্যাভাষা

নও বিদেশিনী, বাংলাই বলো, তবু মাঝে মাঝে
বুঝি না তোমার ভাষা পুরোপুরি, ফলে বেশ ভুল
বোঝাবুঝি হয়, যেন জমে মনে, অন্তর্গত ফুল
কেমন মুষঢ়ে পড়ে এবং বসে না মন কাজে।
কখনো কখনো এরকম হয় ভোরে কিংবা সাঁঝে
কয়লার গুঁড়ো আর ধুলোবালি ছায়ায় পুতুল
হয়ে আসে, চিকচিকে মরীচিকা এবং অকূল
দরিয়া আছড়ে পড়ে, ভ্রান্তির অর্কেস্ট্রা তীব্র বাজে।

প্রজাপতি আর জোনাকিরা দলে দলে আজকাল
আমার চৌদিকে গড়ে পাঁচিল, নির্বিঘ্নে থাকে, বলে-
‘যাকে ভালোবাসো, কখনো সে কথার অস্পষ্ট জাল
ছড়িয়ে প্রয়োগ করে সান্ধ্যভাষা কড়ি ও কোমলে,
আত্মহননের অন্ধ ইচ্ছেটাকে দূরে রাখবার
শিল্প জানে। ধোঁয়াশা সরাতে চাই তোমার ভাষার।
১২.৮.৯৬

সম্পর্কে গ্রহণ দেখে

কখনো আমার প্রতি এরকম তীক্ষ্ম বিরূপতা
দেখিনি তোমার ইতিপূর্বে। আমি সত্যি অপরাধ
করেছি, স্বীকার করি, নিজের অজ্ঞাতসারে, সাধ
করে নয়, তবু কেন আজো দিচ্ছ ছুঁড়ে বিষলতা
হে গৌরী আমার দিকে? রূঢ়ভাবে আমাকে বেজায়
একপেশে বলে খুব দিয়েছ ধিক্কার বারে বারে,
ফলে লুকিয়েছি মুখ স্বরচিত ভীরু অন্ধকারে
ভাসতে ভাসতে গ্লানি-সমুদ্দুরে ভঙ্গুর খেয়ায়।

তোমাকে ফিরিয়ে আনবার কোনো পথ জানা নেই;
তেমন কুশলী নই বাক্যের তুবড়ি তাড়াতাড়ি
জ্বেলে টেলিফোনে কিংবা সাক্ষাতে ভেজাব মন এই
দীপ্ত অনুরাগের খরায়। মতান্তর মনান্তরে
রূপ নিলে শুরুতেই অপটু আনাড়ি আমি হারি,
সম্পর্কে গ্রহণ দেখে কেঁপে উঠি বাহিরে-অন্তরে।
১৬.৬.৯৬

সময় ফুরায় যত

এখন কোথায় আছো তুমি? জানার উপায় নেই
কিছুতেই; যদি কোনোক্রমে হয়ে যেতাম নাবিক
সিন্দাবাদ, তবে সাত সাগরের তরঙ্গে তরঙ্গে
দিতাম ভাসিয়ে এক সন্ধানী জাহাজ অবিলম্বে
তোমার উদ্দেশে আজ, অথবা সী-মোরগের পিঠে
উদ্দাম সওয়ার হয়ে, যদি ধনকুবের হতাম
তাহলে চার্টার্ড প্লেনে চড়ে চলে যেতাম তোমার
ঠিকানার সুলুক সন্ধান করে বিদ্যুৎগতিতে।

আগেও বিদেশে গেছ, কাটিয়েছে বেশ কিছুদিন,
সানন্দে ট্যুরিস্ট হয়ে। তখন হইনি এরকম
ব্যাকুল, অস্থির কোনোদিন। মন যেন বোমাধ্বস্ত
নিষ্প্রদীপ নির্জন নগর, বড়ো একা বসে থাকি
গৃহকোণে, কবিতার খাতা একমাত্র সঙ্গী, ভাবি-
সময় ফুরায় যত ব্যাকুলতা বেড়ে যায় তত।
১১.২.৯৬

 সরোবর

আজকাল খুব ভোরবেলা উঠে পড়ি, মাঝে মাঝে
দেরি হয়ে যায়। কেন উঠি? এই চোখের অসুখ
বেড়ে গেল যখন, তখন থেকে চোখ, কান বুক
আকাশে আবির মাখা হওয়ার আগেই মাতে কাজে।
ঘুম ভাঙতেই শুনি পাখিদের শিস, আচানক
কোথা থেকে ভেসে আসে বকুল ফুলের গন্ধে, দেখি
আমার নৈঃসঙ্গ্য গাছতলা থেকে দেখছেন একি
মহৎ রবীন্দ্রনাথ। আমি দুর্ভোগের ক্রীড়নক।

তোমাকে দেখি না বলে সবকিছু মন খারাপের
স্পর্শে আজ কেমন বিবর্ণ, বড়ো অর্থহীন লাগে।
একুশের বই মেলা টানে না আমাকে, দিনভর
বসে থাকি গৃহকোণে, তৈরি করি এক সরোবর
যার জলে তোমার সুন্দর মুখ দেখি অনুরাগে,
বারবার সেই মুখ সরে গিয়ে ভেসে ওঠে ফের।
১৮.২.৯৬

সেই চিঠি

পরদেশে কোনো এক সতেজ সকালে জেগে উঠে
প্রেরণাতাড়িত কোনো কবির মতোই প্রিয়তমা
তোমাকে লিখেছিলাম চিঠি থর থর হৃদয়ের
হরফে; সে চিঠি তুমি পাওনি কখনো। ডাকঘর
থেকে বিলি হয়নি নিশ্চিত। ফলে কারো কোনো ক্ষতি
না হলেও আমার আবেগ কিছু হয়ে গ্যাছে গুম
অজানায় দু’পাতা লেখার সঙ্গে। যে পত্র পায়নি
তোমার হাতের স্পর্শ, তারই জন্যে করি শোক আজো।

অনেকের কাছেই এ এক তুচ্ছ ঘটনা। অথচ
ভেবেছি বিদেশে কত নিঃসঙ্গ প্রহরে, সেই চিঠি
পড়েছে সবার অগোচরে সমাজ সংসার ভুলে আর
তোমার চুম্বনে হরফের ঠোঁট সমৃদ্ধ হয়েছে।
হায়, সেই প্রতীক্ষা তোমার আর কিছু স্বপ্ন, কথা
ঝরে গ্যাছে বিনষ্ট ফলের মতো নীরব আন্ধারে।
৪.২.৯৬

স্বপ্নের জন্যে

আমার ভেতরকার ছবিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে
ওঠার অক্লান্ত সাধনায় চার দেয়ালের খাঁ খাঁ
পরিধিকে কেবলি আঁকড়ে ধরে। স্তব্ধতায় ঢাকা
মুহূর্তগুলিকে আমি কী সহজে অবিরত ক্ষয়ে
যেতে দিচ্ছি। বৃক্ষচারী কোকিলেরা নিয়ত বমন
করছে স্বপ্নের দলা, স্বপ্নহীন যারা তারা দলে
দলে জোটে শোরগোল তুলে দিনরাত বৃক্ষতলে,
ওরা শুধু কোলাহলে মাটি করে হৃদয় রতন।

আমি তো তোমারই স্বপ্নে ডুবে থাকি হৃদ সরোবরে,
জাগরণে যখন কবিতা লিখি, তুমিই তখন
স্বপ্ন হয়ে ধরা দাও, এত কাছে বসো, পারি ছুঁতে
হাত বাড়ালেই আর আমারই কবিতা মৃদুস্বরে
পাঠ করো বস্তুত স্বপ্নের জন্যে কোনো ঘন বন
কিংবা দাতা পাখির নিকট প্রার্থী হই না কিছুতে।
১৭.৪.৯৬

স্বাগত জানাবে

তোমার ফেরার দিন আজ। ঘর-বার ঘর-বার
করছি কেবল, কোনো কিছুতেই মন বসছে না
এ মুহূর্তে, এ রকম তোলপাড় চেনা কি অচেনা
সহজে যায় না বলা। আজ লঘু হবে মনোভার।
কী ভাবে বরণ করি তোমাকে? স্বাগত জানাবার
নেই কো আমার অধিকার বিমান বন্দুরে গিয়ে;
আমার নিজের ঘরে বসে যদি রুমাল উড়িয়ে
অদেখা তোমাকে ছুঁই, কে থাকে বারণ করবার?

তোমার উদ্দেশে আজ হীরকের তোরণ নির্মাণ
করব সযত্নে আর আমার সকল স্বপ্ন এসে
হবে লাল গালিচা নিভৃতে, তুমি লঘু পায়
হেঁটে যেও তোমার মোটরকারে। আমি যত গান,
প্রেমের কবিতা লিখে এতকাল রেখেছি খাতায়,
ওরা সব স্বাগত জানাবে তোমাকেই ভালোবেসে।
২৩.২.৯৬

স্মৃতিভ্রংশ

ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে টেলিফোন করি,
কিছুতে পড়ে না মনে তার নাম। ফলে, রিসিভার
রেখে দিই; তারপর হঠাৎ আমার পরিবার
পরিজন, এমনকি আমার আত্মার সহচরী
নামহীন আমার নিকট। আমি যেন সেই তরী,
যার দিশা হারিয়ে গিয়েছে খুব ঘন কুয়াশার
আবরণে; আকস্মিক বিস্মরণে বাড়ে মনোভার।
তবে কি ভাঙছি আমি না জেনেই সযত্নে যা গড়ি?

এ আমার কী হলো হঠাৎ? যাকে সকল সময়
দেখি, তাকে যদি প্রশ্ন করি, ‘কী তোমার নাম’, তবে
সে কি আজ আমার বিভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে ভয়
পাবে না? এবং গৌরী আমার দু’ চোখে অচেনার
ব্যাসকূট দেখে যদি দুঃখ পায়, তাহলে কী হবে?
আমাদের দু’জনের মধ্যে এ কেমন রুদ্ধ দ্বার?
১.৫.৯৬

 হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল

হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার
খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে,
যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে
সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার।

আমাকে নিষণ্ন পেয়ে গৌরী প্রশ্ন করে, ‘কবি তুমি
এমন নিষ্পৃহ কেন আজকাল, এমন শীতল
উচ্চারণে, আচরণে? আমি কি ঢেলেছি ঠাণ্ডা জল
তোমার উদ্দীপনায়? ভাবাচ্ছে সন্ত্রন্ত জন্মভূমি?

কী দেবো উত্তর আমি? নিজেই জানি না, শুধু জানি
অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত কেঁপে
উঠি ঘন ঘন একা ঘরে, ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী
শিঙ নাড়ে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, আসে ব্যেপে
কুঞ্জটিকা হৃদয়ে আমার, তবু তোমাকেই খুঁজি
প্রতিক্ষণ, এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু-পুঁজি।
৩.৩.৯৬

Exit mobile version