গদ্য সনেট: ৮
কী করে প্রকাশ করবো আমার আজকের
অনুভূতি? কাল রাত্তিরে যন্ত্রণার ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে
শেষ প্রহর পর্যন্ত নির্ঘুম কাটিয়েছি, যতক্ষণ না
মুয়াজ্জিন ফজরের আজানের সুর ছড়িয়ে দিলেন
ঘুমন্ত পাড়ায়। আজ আমি পদ্মফুলের অজস্র
পাপড়ির আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছি, আমার সকল
রোমকূপে আনন্দধারা, এই মুহূর্তে আমি বসন্ত বাহার;
কেননা, দু’সপ্তাহ পর তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি।
এই লক্ষ্মীছাড়া কবিকে তুমি রক্ষা করলে
কথার ঝরনাতলায়। যে অভিমানের জ্বালাধরানো
ক্রূর শুঁড়গুলি ক্ষত তৈরি করছিল হৃদয়ে, যেসব
এখন শুকনো পাতার মতো খুলে গ্যাছে,
এখন আমি স্নিগ্ধ সরোবরে সাঁতার কাটছি আর তোমার দিকেই
ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে মাছের মতো আমার দু’টি স্পন্দিত হাত।
২৪.৩.৯৬
গদ্য সনেটঃ: ৯
বহুকাল থেকে দেখছি সুখ আমার বেশিদিন
সয় না। বালকবেলা আম্মার দেওয়া ইস্কুলের
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে মহানন্দে দুলদুল ঘোড়ার
একটা রঙিন ছবি কিনেছিলাম। কিছুদিন না যেতেই সেটি কোথায়
হারিয়ে গেল, তার হদিশই পেলাম না আর। যখন আমি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আব্বা আমাকে কফি রঙের একটি শেফার্স কলম
কিনে দিয়েছিলেন, পেয়ে কী-যে সুখী হয়েছিলাম; কিন্তু
পুরনো না হতেই সেটি চলে গেল পকেটমারের কব্জায়।
গতকাল অনেকদিন পর সকালে টেলিফোনে গৌরীর
কণ্ঠস্বর শুনে কী-যে সুখ পেয়েছিলাম, কী করে বোঝাবো অন্য
কাউকে? আমার দেহমন হয়ে উঠেছিল উৎসবের আলোকসজ্জা।
দুপুরেই রিসিভার রাগী কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ
করছিল, কিছুক্ষণ পরেই স্তব্ধ। হায়, এমনই বরাত আমার, ক’দিন
তার সঙ্গে কথা বলতে পারবো না, দেখা হওয়ার পথও বন্ধ।
২৫.২.৯৬
জিন্দা লাশ
প্রস্থানের কালে তুমি বলেছিলে, ‘প্রিয়তম কবি,
খারাপ করো না মন, ক’টা দিন হাসিখুশি থেকো।
কী করে ফুটবে হাসি মনে, যখন তোমাকে আমি
দেখতে পাবো না আর শুনতে পাবো না কণ্ঠস্বর
তোমার? তা ছাড়া দেশ রাহুগ্রস্ত, মৃত্যুর খবর
পাই প্রতিদিন, নরহত্যা নেহাত মামুলি, দেখি
পুলিশের লাঠির আঘাতে মিছিলের ক্ষুব্ধ ছাত্রী
রাস্তায় রক্তাক্ত পড়ে থাকে হায়, যেন বাংলাদেশ।
প্রিয়তমা আমার, তোমার কথা, প্রেমময়ী দৃষ্টি
মনে পড়ে প্রতিক্ষণ মনে হয়, রেখেছো আমার
হাতে এসে তোমার উৎসুক হাত পল, অনুপল
শতাব্দীর রূপ নেয় স্বপ্নঘোরে। সমূহ সঙ্কট,
স্বৈরাচারী দুঃশাসন এবং তোমার বিচ্ছেদের
ধারালো দাঁতের হিংস্রতায় জিন্দা লাশ হয়ে হাঁটি।
১২.২.৯৬
জ্বলছে স্বদেশ
কবীর চৌধুরী ঠিকই বলেছেন, জ্বলছে স্বদেশ-
প্রায় প্রতিদিন মরে লোক গুলি খেয়ে খোলা পথে,
পুলিশের জুলুমে জর্জর দেশবাসী, কোনো মতে
দিন কাটে প্রতিবাদী নেতাদের প্রত্যহ অশেষ
ঝুঁকিতে এবং অনেকেই হচ্ছেন আটক। বেশ
আছেন আনন্দে মেতে নারী নীরো, বাজাচ্ছেন বাঁশি
মসনদে বসে, ঠোঁটে তার খেলে যায় ক্রূর হাসি
ক্ষণে ক্ষণে, পারিষদবর্গ তার কাছে সুখবর করে পেশ।
অবৈধ শাসক যারা, তারা সাধারণ মানুষের
ইচ্ছা অনিচ্ছায় সারে দাফন নিমেষে, স্বৈরাচারে
বুঁদ হয়ে থাকে; কিন্তু বোঝে না দেশের জনগণ
শক্তিমান স্যামসন, অন্ধ করে রাখলেও টের
পায় অনাচার, অবিচার আর প্রবল হুঙ্কারে
কেশর দুলিয়ে ত্বরান্বিত করে শক্রর পতন।
তবুও তাণ্ডবে
বর্বরতা অভ্যাস করে না ত্যাগ; ভয়ঙ্কর পশু
হয়ে কুশ্রী মাথা তোলে যখন তখন; শান্তিপ্রিয়
প্রাণীদের কণ্ঠনালী ছিঁড়ে ফেলে, হৃৎপিণ্ড উপড়ে
নেয়, এক লহমায়-বস্তুত জীবন ক্রমাগত
আর্তনাদ করে বর্বরের পদতলে। যখন সে
নিঃশ্বাসে বাতাস ভারি করে তাড়াতাড়ি নিভে যায়
বসতির প্রতিটি ঘরের দীপ, প্রেমিক-প্রেমিকা
কোমল প্রণয়বাক্য উচ্চারণে ভয়ে কেঁপে ওঠে।
সভ্যতাকে বিদ্রূপের তুমুল ফুৎকারে ভাগাড়ের
এক কোণে ফেলে রেখে মুখ খোলে, কষ বেয়ে তার
রক্ত ঝরে, সুকুসার বৃত্তি সমুদয় তার নখরের ঘায়ে
ভীষণ জখম হয় সময়ের প্রতি পর্বে, তবু তাণ্ডবেও
জন্ম নেয় আর্ফিয়ুস যুগে যুগে, বংশীধ্বনি জাগে।
১১.৪.৯৬
তার উদ্দেশেই ন্যস্ত
এখনো আমার কবিতার যারা আগ্রহী পাঠক
আর যারা কখনো ছুঁয়েও দ্যাখেন না এইসব
পঙ্ক্তিমালা, তাদের জরুরি মূল্যবান কলরব
স্তব্ধতায় ঝিমোলে খানিক, মুছে ফেলে কিছু ছক
আমার কবিতা এই ক্রান্তিকালে গূঢ় পর্যটক
নান্দনিক ভূমণ্ডলে। জীবনের শিঙ ধরে যুঝি
সাধ্যমতো; নানা স্তরে রূপের আড়ালে রূপ খুঁজি,
যতই ধরুন খুঁত বিজ্ঞ, সন্ধানী সমালোচক।
এই শহরেই আছে একজন যার ধ্যানে কাটে
সারাবেলা, যার নাম উচ্চারণে ক্লান্তি নেই আর
যার কথাশিল্প থেকে পাই কত কবিতার শাঁস,
যার পদধ্বনি বাজে আমার সনেটে বারবার,
যাকে খুঁজে পেতে চায় কৌতূহলী জন এই বাটে,
তার উদ্দেশেই ন্যস্ত আমার এ নিঃশ্বাস, বিশ্বাস।
১৫.৭.৯৬
তুমি চলে গেলেও
আমার এ ছোট ঘরে কিছুক্ষণ বসে চুপচাপ
চলে গেলে তুমি নিশীথকে অধিক আন্ধার করে।
চেয়ে থাকি শূন্য চেয়ারের দিকে ছায়াচ্ছন্ন ঘোরে,
চায়ের পেয়ালা আর্ত বুলবুলি, যেন চায় মাফ
বুকে গান নেই বলে। আমরা দুজন যে-আলাপ
করেছি তোমার প্রস্থানের আগে তা-ই ফের দোরে,
জানালার পর্দায়, বইয়ের র্যাফকে আর ঠাণ্ডা ফ্লোরে
ছায়া হয়ে ঝোলে, রয়ে যায় তোমার প্রাণের ছাপ।
তুমি চলে গেলেও কেন যে মনে হয় এই ঘরে
আছো বসে, হাসছে তোমার চোখ, শাড়িটার ভাঁজ
নদীর তীরের মতো; তুমি আছো, যেমন কবিতা
আবৃত্তি করার শেষে ছন্দিত মঞ্জুল রেশ নড়ে
মর্মমূলে, যে রকম মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ
জমে থাকে স্তব্ধ মাঠে। ভুলে যাই তুমি পরিণীতা
২২.৮.৯৬