দ্য সনেট: ১৫
তোমার অভিমানগুলো রাতের দেয়ালে
মাথা কুটে কুটে গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ল
নিঝুম মেঝেতে এবং আমি
সেগুলো জড়ো করে একটি পুষ্পস্তবক বানিয়ে
তার চৌদিকে ভ্রমরের মতো
গুঞ্জরণ তুলি। সেই সুর নকশা আঁকে নৈশ প্রহরে।
তোমার দুচোখের কান্না, হৃদয়ের অশ্রু-ফোঁটা শ্রাবণ-দুপুরে,
বিকেলে, সন্ধ্যায়, রাতে ঝরতে থাকে অবিরল;
আমি সেই অশ্রুকণাগুলো কুড়িয়ে নিয়ে
তৈরি করি মুক্তার এক অনুপম হার।
রাতজাগা পাখির বুকে পুষ্পস্তবক আর
মুক্তোর হারের কবিতা লিখে
তাকে পাঠিয়ে দিলাম শুকনো মেঘের কাছে;
মেঘ ওকে আলিঙ্গন করে ভিজে উঠলো ঝরে পড়ার জন্যে।
১৯.৮.৯৬
গদ্য সনেট: ২
বাড়িতে ঢুকলেই তুমি দেখবে সব আছে ঠিকঠাক,
সিঁড়ি, কুত্রিম ঝরনাধারায়
কেলিপরায়ণ মাছ, সোফাসেট, শয়নকক্ষ, স্নানঘর এবং
গাড়িবারান্দা, সর্বোপরি রবীন্দ্র রচনাবলী।
তোমার দু’টি চোখ যাকে খুঁজে বেড়াবে অনুপস্থিতির
আলো-আঁধারিতে, যার হৃদয়-নিঙড়ানো
কবিতার কোনো কোনো চরণ অকস্মাৎ ভ্রমর হয়ে
গুঞ্জরণ তুলবে মনে, তাকে দেখবে না কোথাও।
টেলিফোন উঠলে বেজে লোকটা পড়ি মরি
তুলবে রিসিভার, ভুল নম্বরের ধাক্কা খেয়ে সে কিছুক্ষণ
থাকবে বসে, চেয়ারে একলা ঘরে, উল্টোপাল্টে দেখবে কিছু কবিতার বই।
টেলিফোনে লোকটার কণ্ঠস্বর শুনেও তুমি
বুঝতে পারবে না সে কেমন ছিল, এলে বস্তুত হবে
মাটির নিচে থেকে তোলা ভাঙাচোরা মূর্তির মুখোমুখি।
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ৩
সারা দিন গেল, ইঁদুরমুখো বাদুড়
সন্ধ্যাকে ডেকে আনে ডানার হাওয়ায়, আজকে
রাতও বুঝি যায়। এখনো তুমি পা রাখলে না
এই প্রিয়তম শহরে আমার। দু’সপ্তাহ তোমাকে
না দেখে কোনো মতে দিন যাপন করেছি। অথচ আজ
প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হচ্ছে শতাব্দী। আজ তুমি এলেও
তোমাকে দেখতে পাবো না, পরের তিনটি দিনও
আমাদের সম্ভাব্য সাক্ষাতের মাঝখানে অলঙ্ঘ্য প্রাচীর।
হায়, যদি কবিতা লিখতে না পারতাম, তাহলে
কী করে কাটতো তুমিহীন আমার শূন্য প্রহরগুলি?
আমার এখনকার কবিতায় সকল চরণ কেবল তোমাকেই
স্মরণ করে সারাবেলা। তোমার অনুপস্থিতির বেদনা ওরা মুছে ফেলতে
ব্যর্থ, তবু জানি তুমি শহরে এলে পর ওরাই তোমার
মুখ চুম্বন করবে বারংবার, তোমাকে ঘিরে বসাবে নক্ষত্রের মেলা।
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ৪
অনেকদিন যাবত চিলেকোঠা বিষয়ে একটি ধারণা
লালন করছি। দূরের আকাশে মেঘেদের কোলে কোথাও
যদি আমার নিজস্ব একটা চিলেকোঠা থাকতো
তা হলে কী ভালোই না হতো। সেখানে কিছু চমৎকার
সময় কাটানোর জন্যে যখন তখন
চলে যেতে পারবো; কোনো সিঁড়ির প্রয়োজন হবে না,
ব্যবহার করতে হবে না বায়ুযান। আমার সেই চিলেকোঠায়
নিষিদ্ধ হবে খবরের কাগজ, থাকবে শুধু বই আর ক্যাসেট প্লেয়ার।
চিলেকোঠায় হাত নেড়ে গালিবের ধরনে ডেকে আনবো কবিতাকে,
কোনো কোনোদিন তুমি আসবে হাওয়ায় আঁচল উড়িয়ে,
বসে গল্প করবে আমার সঙ্গে, ইচ্ছে হলে গান গাইবে
কিংবা কিছু না বলে আমার বুকে মাথা রেখে দেখবে কালপুরুষ
আর আমি তোমার চুল নিয়ে খেলা করবো। কখনো নীল পাখির
গানের সুরে ভেসে আমরা কবিতার শীশমহলে পৌঁছে যাবো।
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ৫
অন্তত তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবো আজ, এমন
প্রত্যাশার দোয়েল শিস দিয়েছিল বারবার ভাবনার উঠোনে।
এইমাত্র ঘড়িতে রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের
সঙ্কেত; পাশের শিশুপল্লী ঘুমোচ্ছে, গলি নিঝুম,
রাত্রি কালো কফিনের ভিতর শুয়ে আছে, কুয়াশা
নামছে তার চোখে। দূরের নক্ষত্রেরা তাকিয়ে রয়েছে
কফিনের দিকে, অথচ তোমার টেলিফোন সরোদের তানের
ধরনে বেজে ওঠে নি। তুমি কি আসো নি এখনো?
আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দুর্ভিক্ষকবলিত
বিশুষ্ক, করুণ মানুষের মতো ত্রাণসামগ্রীর আশায়?
আমার ওপর ছুটে যাচ্ছে নাদির শাহের কেশর দোলানো
অশ্বপাল, তৈমুরের নাঙা তলোয়ার আমাকে ক্রমাগত
রক্তাক্ত করছে এবং মেরুপ্রদেশের ক্ষুধার্ত নেকড়ের দল
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আমি আর কত সইব এই স্বৈরাচার?
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ৬
বুকের কাছে একগুচ্ছ নীল ফুল ফুটল, আমি ওদের
নাম রাখলাম অভিমান। ফুলগুলোর
ভেতরে অকস্মাৎ অজস্র কাঁটা গজিয়ে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে
প্রায় উন্মত্ততার খাদের ধারে নিয়ে গেল।
আমি কি বলিনি আমাকে তুমি এভাবে দণ্ড দিও না
কখনো, যা আমার রক্ত শুষে নেয় ড্রাকুলার মতো?
তোমার কথা ভেবে ভেবে আমি আজ প্রতি মুহূর্তে
আতশবাজি হয়ে জ্বলেছি, হয়েছি ফিনিক্স পাখি।
তোমাকে ঘিরে আমার স্বপ্নেরা মেতেছে সুফী-নৃত্যে
আমার অন্তরের তন্তুজাল থেকে বেরিয়ে এসেছে শব্দের ঝাঁক,
সেসব শব্দকে তোমার প্রিয়ংবদা সহচরী বানিয়ে
নিজেকে বুভুক্ষু রেখেছি। অথচ তুমি
উদাসীনতায় মজে একটি শব্দও খরচ করলে না
কিছুতেই, এখন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির মতো অনিদ্রায় ভুগছি।
২৩.২.৯৬
গদ্য সনেট: ৭
আজ প্রত্যুষ ঘুম ভাঙতেই আমার দৃষ্টির
দিগন্তে তোমার মুখের চন্দ্রোদয়। তুমি ফিরে আসছো
ভাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্নতার আবির ছড়িয়ে পড়ে
সারা ঘরে, বইয়ের র্যাবকে, কবিতার খাতায়,
আমার দেহমনে। আজকের দিন ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁর
সেতারের আলাপের মাধুর্য হয়ে ওঠে। রাত বাড়তেই অধৈর্য
আমি তোমাকে দু’বার টেলিফোন করি। লাইনের
ব্যস্ততায় সঙ্কোচ ও লজ্জায় অন্ধডোবায় হাবুডুবু খাই।
এই শহরের সবচেয়ে তুখোড় সাংবাদিক, যার
নখদর্পণে সারা দেশের নাড়ি-নক্ষত্র, আমাকে
জানাতে পারলেন না তোমার প্রত্যাবর্তনের খবর; মেঘ, পলাশ
এমন কি কোনো রাতজাগা পাখিও বলতে পারলো না তুমি এলে
কি এলে না। তবুও কি গাইতে হবে ওদের বন্দনাগীতি? এখন আমি
উদয়শঙ্করের নটরাজ। অন্তর্গত ধ্বংস ও নির্মাণে ভয়ঙ্কর চঞ্চল।