একটি ভ্রূণের উক্তি
নারীদেহ লোলুপ পুরুষ বারবার তোকে তার
শয্যায় নিয়েছে; তুই ভ্রষ্টা না কি ক্ষণিক প্রেমিকা-
এই বিচারের ভার নিতে পারব না। কেন তুই
হে নিঠুরা আমাকে কুরিয়ে ফেলে দিলি সার্জনের
ক্লিনিকে গোপনে? তোর নিজস্ব গুহায় ক্রমান্বয়ে
আমাকে সপ্রাণ বেড়ে উঠতে দিলি না? মা বলার
সাধ অঙ্কুরেই নষ্ট, আলো অন্ধকার আর বুক
ধুক ধুক করা খেলা নিয়ে হৈ হৈ জানতেই দিলি না।
আমার তো বড়ো সাধ ছিল তোর গুহামুখ ঠেলে
এই রৌদ্রছায়াময় পৃথিবীতে বেরিয়ে আসার
সুতীব্র ঘোষণা দিয়ে। এ দুনিয়া কী-যে অপরূপ
শোভাময়, প্রাণের আনন্দমেলা চতুর্দিকে; সত্য
আছে দুঃখশোক, তবু কী-যে ভালো লাগে বেঁচে থাকা;
সবাই নির্দয় নয়, নয় শুধু ভ্রূণ হত্যাকারী।
৫.২.৯৭
একটি মাছের স্মৃতি
একটি ক্রন্দনরত বড়ো মাছ শুয়ে আছে ডিশে
মশলাসজ্জিত রূপে; আহার্য সে, আমরা ক’জন
তবু তাকে স্পর্শ করা থেকে বিরত ছিলাম, বুঝি
মাছের কান্নার জল সে-রাতে দেখেছিলাম, ফলে
অন্য আহার্যের স্বাদে রসনাকে সিক্ত করে ফিরে
গেলাম যে-যার ঘরে। সেই মাছ সঙ্গে ছিল এই
বয়েসী কবির, তার চোখে স্বপ্নের অজস্র কুঁড়ি
ফোটার আশায় ছিল, কবির তা মনে হয়েছিল।
ঘরে বসে ভাবি সে-রাতের রেস্তোঁরার কিছু কথা,-
একটি টেবিলে গোল হয়ে বসেছিল তিনজন
নারী আর একজন অর্ধনারীশ্বর। মৃদু পর্যটন
ছিল কারো কারো নয়নের, ছিল মার্জিত তামাশা;
একজন স্বর্ণাভ রমণী আর এই কবি আজো
স্মৃতিতে ধারণ করে মাছটির অশ্রুর শিশির।
৫.১.৯৬
এখানেই আছে ঘর
আমার সুপ্রিয়া মুখ ভার করে আছে, বুকে তার
কান্না ঠেলে ঠেলে ওঠে নিশিদিন, অব্যক্ত আক্রোশে
ফেটে যেতে চায় বুক, কখনো হঠাৎ রুদ্র রোষে
জ্বলে ওঠে। অসহায় চোখে দ্যাখে হয়েছে উজাড়
কোনো কোনো শান্ত গ্রাম গুলির ধমকে, হাহাকার
শোনা যায় দিকে দিকে, যে রকম দূর একাত্তরে
উঠত মাতম এই দুখিনী বাংলায় ঘরে ঘরে;
নির্যাতনে কম দড় নয় পুলিশ ও বিডিআর।
সরকারের অস্ত্রধারী ক্যাডার চৌদিকে দৃপ্ত ঘোরে,
ক্রমশ দাপট বাড়ে উহাদের, পথ চলা দায়।
নিরাপত্তা পলাতক এইসব দেখে শুনে, হায়,
সুপ্রিয়া তুমি কি দূরে গিয়ে নতুন পথের মোড়ে
দাঁড়িয়ে ডাকছে আমাকেও? উপদ্রুত এ নগর
ছেড়ে দূরে যাবো না কোথাও, এখানেই আছে ঘর।
১১.৩.৯৬
এখানেই বেইলি রোডে
(বিপ্রদাশ, বড়ুয়া প্রিয়বরেষু)
এখানে বেইলি রোডে তোমরা এসেছো আজ বিনা
আমন্ত্রণে ওগো পক্ষীকুল দূরদেশ থেকে জানি
আশ্রয়ের খোঁজে; তোমরাও নিরাপত্তা চাও, ধূর্ত
শিকারির শর কিংবা গুলি এড়িয়ে বাঁচার সাধ
তোমাদেরও বুকে জ্বলে প্রদীপের মতো। এইসব
নাগরিক গাছে কেন নিলে ঠাঁই শীতের দুপুরে?
পাড়াটা নীরব কিছু, তবু মোটর কারের হর্ন
বেজে ওঠে মাঝে মাঝে, কালো ধোঁয়া পথে ভাসমান।
যাকে ভালোবাসি, সে কখনো সখনো হঠাৎ
পাখি হয়ে নীলিমায় কিংবা কোনো ঝিলে কী খেয়ালে
উড়ে যেতে চায় হাফ ধরে এলে শহুরে জীবনে।
অনেকেই নির্দয় শহর ছেড়ে অন্য কোনোখানে
যাত্রায় আগ্রহী খুব চকচকে ছোরা, বুলেটের
ভয়ে; হায়, কেন যে তোমরা এলে এখানে সুন্দর?
২১.১.৯৬
কত আর কেটে ছেঁটে
কত আর কেটে ছেঁটে রাখব নিজেকে প্রতিদিন
অন্যদের পছন্দমাফিক? নিষেধের কাঁটাতারে
ঘেরা এ জীবন কাতরায় আর নির্দয় প্রহারে
বিবেক আমাকে মোড়ে মোড়ে খুব করেছে মলিন।
যদি হতে পারতাম শুধু শিশ্নোদরপরায়ণ
এক জীব কিংবা কোনো বিবাগী সন্ন্যাসী বনচারী,
তাহলে হৃদয় আজ হতো না এমন হঠকারী,
অবিরত করতাম না তালাশ তৃতীয় নয়ন।
অচেনা অপর কেউ নয়, যারা আমার আপন
পরিবার পরিজন, তারা চায় আমি পড়ে থাকি
গৃহকোণে, ডানাছাঁটা পাখি নিরন্তর এঁদো ডোবা
আমাকে করুক গ্রাস, ছাঁচে-গড়া জীবন, যাপন
যেন করি আগাগোড়া। তবু প্রতিক্ষণ মনে রাখি-
আমাকে দিয়েছে গৌরী নীলাকাশ, সমুদ্রের শোভা।
১০.৩.৯৬
কবিতা লিখতে না পারা
এই তো কদিন হলো কবিতার একটি পঙ্ক্তিও
লিখতে পারিনি শত চেষ্টা করে। বাজে কাগজের
ঝুড়ি ভরে ওঠে কাটাকুটিময় বাতিল কাগজে।
লেখার টেবিলে ঝুঁকে কাটে কত বেলা, স্নানাহার
কখনো স্থগিত থাকে, ক’দিনের না কামানো দাড়ি,
যেন গালে কালো ঘাস; অস্থিরতা কয়েদি পাখির
মতো পাখায় ঝাপ্টায়, কী এক অভিমানে নিজেকেই
নিমেষে পুড়িয়ে শেষে দু’হাতে ওড়াই শুধু ছাই।
বর্থ্যতা হরণ করে দিনের বিশ্রাম, নিশীথের
নিদ্রা, বেদনায় ছেয়ে যায় চিদাকাশ, দূরে বসে
প্যাঁচা হয়ে ওঠে উপহাসপ্রিয়, ঝুলন্ত বাদুড়
তাচ্ছিল্যে তাকায় মিটিমিটি। অকস্মাৎ তুমি এলে
এই ঘরে কবিতার পঙ্ক্তিমালা জন্ম নেয় মনে।
৪.১.৯৬
কবিতার আসা না-আসা
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, বসে আছি পুরানো চেয়ারে
নিশ্চুপ, নিঝুম খুব, যদিও অন্তরে আঁধিঝড়
বইছে অনেকক্ষণ। মাঝে-মাঝে এদিক ওদিক
চেয়ে দেখি, চোখ পড়ে সারি সারি বই, জানলার
পর্দায়, সোফায় আর টেলিফোন সেটে। যেন আমি
কারো মৃদু পদধ্বনি শোনার আশায় কান পেতে
রয়েছি কখন থেকে। এখানে সে পা রাখে কিনা এ
সন্ধ্যেবেলা আমার দৃষ্টির গালিচায়, দেখা যাক।
সম্ভবত আসবে সে যে-কোনো মুহূর্তে, ঘরে ঢুকে
তাকাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ, ধরবে জড়িয়ে,
পায়েল উঠবে বেজে তার পায়ে, চোখ থেকে তার
ঝরবে নানান চিত্রকল্প, চুল দেবে প্রতীকের
ঘন ছায়া; কবিতা আসবে এভাবেই অকস্মাৎ
আমার সান্নিধ্যে কিংবা ব্যর্থ হবে ব্যাকুল প্রতীক্ষা।
৩১.১২.৯৫