এ শহরে এক কোণে
এ শহরে এক কোণে নিরিবিলি করে বসবাস
একজন লোক, প্রায়শই কী জানি কীসের ঝোঁকে
শব্দ দিয়ে ভরে খাতা, ফলে কবি তাকে বলে লোকে।
কেউ কেউ আসে তার কাছে নিতে মনের সুবাস
নিজেরই অজ্ঞাতে আর সুন্দরের, শিবের আভাস
পেয়ে যায়। লোকটা কখনো কারো খোলা পথে কাঁটা
বিছায় নি, অমঙ্গল করে নি কামনা কারো, ঝাঁটা
মারে নি কাউকে ক্রোধে, চিত্ত তার সুনীল আকাশ।
তবু তাকে গঞ্জনা সইতে হয়, শজারু খোঁচায়
যখন তখন, ঠাট্রা-তামাশার উৎস হয় কোনো
কোনো আড্ডা, গুলজার চায়ের আসরে। লোকটার
কসুর সে দিনরাত সুরছুট পরিবেশে, হায়,
সুরের সাধনা করে! বিপক্ষের শত উপেক্ষার
হিমে স্থির আর দিশেহারা নয় তারিফে কখনো।
৩০.৪.৯৬
এই সন্ধ্যেবেলা
আজকের সন্ধ্যেটির নির্জনতা আমাকে কাতর
করেছে ভীষণ, ইচ্ছে হলো নদী আনি, মাঠ, গাছ
নিয়ে আসি, আনি দোল পূর্ণিমার তিথি আর নাচ
দেবদূতদের নদীতটে। তুমি স্মৃতির আতর
সিল্কের রুমালে নিয়ে আসবে এখানে, থর থর
হৃদয়ে অপেক্ষা করি, অথচ তোমার শাড়িটিকে
ঝলসাতে দেখছি না একবারও এখনো এদিকে;
আমার সত্তায় বয় কী-যে স্থিতি ওপড়ানো ঝড়।
এই সন্ধ্যেবেলা তুমি ছিলে না আমার পাশে খুব
অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে এবং চতুর্দিকে ছিল ধু ধু
মরুভূর দীর্ঘশ্বাস, নিঃসঙ্গতা আমাকে লেহন
করছিলো কুকুরের মতো, আমি বারবার ডুব
দিচ্ছিলাম অসহায়তার জলে। ঘাটে ছিলো শুধু
তলাহীন নৌকা এক, কিয়দ্দূরে ভয়ঙ্কর বন।
১৩.৩.৯৬
এইতো দু’দিন পরে
এইতো দু’দিন পরে তুমি চলে যাবে পরদেশে
এ শহর ছেড়ে; ভ্রমণের আনন্দে তোমার মন
ভরপুর-এ কথা বলি না। তবু তুমি চলে যাবে,
তোমাকে যেতেই হবে, যদিও এখানে আমি একা
থাকব লুকিয়ে মনোবেদনা তোমার না থাকার
হেতু, বিচ্ছেদের দিনগুলি রাতগুলি হিংস্রতায়
বসাবে ধারালো দাঁত-নখ হৃদয়ে আমার আর
শোকগ্রস্ত এ ঘর প্রত্যহ খুব করবে বিলাপ।
যাবো না তোমার বাড়ি, কেননা দরজা, দ্বাররক্ষী,
সিঁড়ি, সোফা, কোমল গালিচা জানাবে না অভ্যর্থনা
আমাকে সেখানে তুমিহীনতায়। স্মৃতির সুঘ্রাণ
নেয়ার আশায় সে বাড়ির কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে
হলেও থাকব দূরে। ফিরে এলে স্বগৃহে ক্লান্তির
ভারে নত, আর্তকণ্ঠ সিঁড়ি আমাকে প্রবোধ দেবে।
৬.২.৯৭
এইসব ফুল
ঘুম থেকে জেগে দেখি টেবিলে সাজানো কিছু ফুল,
যে-ফুল দেখেছি স্বপ্নে অচিন উপত্যকার গাছে।
জানি, সে নীরবে রেখে গ্যাছে ফুল হৃদয়ের কাছে
অগোচরে, ফুলগুচ্ছ ঘিরে গীত হয় বুলবুল
ক্ষণে ক্ষণে কে জানে কী সুখে! পৃথিবীতে কোনো ভুল
কোথাও হয়নি যেন আজ; হতাশ মুমূর্ষ বাঁচে,
এমনকী ধূমায়িত আমারও সত্তায় আলো নাচে
অমেয় সৌরভে; এই জানলায় ওড়ে কার চুল?
মহান আলিগিয়েরি দান্তের উদ্দেশে কোনো নারী
দূর ফ্লোরেন্সের বাগিচায় একা, করি অনুমান,
চয়ন করেছে ফুল একদা সপ্রেম; হয়তো-বা
কবির অমর কাব্যে সে-পুষ্পের অপরূপ শোভা
নিভৃতে পেয়েছে ঠাঁই। যে-ফুলে আমার এই বাড়ি
হেসে ওঠে, তার কিছু ঘ্রাণ পাবে কি আমার গান?
৮.৪.৯৬
একজন কবি দেখছেন
কচ্ছপের উদোম পেটের মতো বিন্যস্ত টেবিলে
একটি গোলাপ নম্র শুয়ে আছে খাতাটির বুকে
সেই কবে থেকে, মনে হয় দান্তের নির্বাসনের
কাল থেকে। আজ কোন্ আর্সেনিক আর কীট মিলে
কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে? একজন কবি ধুঁকে ধুঁকে
দেখছেন পারমাণবিক দহন বির্বাপণের
আয়োজন নেই কোনো; ক্রুদ্ধ এরোস্পেস খাবে গিলে
সভ্যতার হাড়গোড়, অনন্তর হিশেব নিকেশ যাবে চুকে।
চূর্ণ এরোড্রোম আর হাইরাইজ বিল্ডিং-এর
স্তূপ থেকে না-মানুষ, না-জন্তু বেরিয়ে ইতস্তত
চরে বুঝি হারানো স্মৃতির মোহে শারদ জ্যোৎস্নায়।
সেসব প্রাণীর রূঢ় পদতলে গীতবিতানের
পোড়া পাতা পিষ্ট হয় আর স্তনের ক্ষতের মতো
দগদগে নক্ষত্রেরা উপহাসে মেতে মদ খায়!
৯.১০.৯৬
একটি পুরনো ফটোগ্রাফ দেখে
যখন পুনেরো বছরের তটে তোমার শরীর
তরঙ্গিত নিরিবিলি সেই তোমাকেই দেখলাম-
রয়েছ দাঁড়িয়ে একা নাগরিক নিসর্গের মাঝে
নিস্তব্ধ রমনা পার্কে শীতের দুপুরে। রোদ, হাওয়া
নীরবে খাচ্ছিল চুমো তোমাকে নিবিড়। নীল শাড়ি,
তোমার প্রথম শাড়ি, আসন্ন প্রখর যৌবনের
সঙ্কেতে কেমন মদালসা। তুমি যেন সদ্য স্নান
সেরে স্নিগ্ধতার সরোবরে মৃদু নিচ্ছিলে বিশ্রাম।
নিষ্প্রভ রঙিন ফটোগ্রাফে প্রস্ফুটিত তরুণীর
প্রেমের অনলে পুড়ি প্রথম দৃষ্টিতে। রূপ তার
চিরদিন থাকবে অম্লান, সময়ের স্পর্শহীন।
অধর,স্তনাগ্র, চোখ, গ্রীবা, ঊরু, নিতম্ব দেখছে
গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন অবিরাম; সে স্বপ্নের অভ্র-গুঁড়ো
এখন আমার কবিতায় অলৌকিক স্পন্দমান।
২৮.১.৯৬
একটি বাগানের কাহিনী
দীর্ঘ খরা দেখে দেখে দু’চোখ ভীষণ ঝলসানো;
অকস্মাৎ ফসলের ঢেউ খেলে যায়, আবাদের
ঘ্রাণে প্রাণ মাতোয়ারা এবং একটি বাগানের
উদ্ভাসনে মনে হয় পটভূমি কেমন পাল্টানো।
বাগানের ফুল, পাখি, মৃদু হাওয়া ডেকে বলে, ‘আনো
জীবনে নতুন করে বাঁচার ফোয়ার; তুমি ঢের
ঘুরেছ বিপথে, বুঝি কখনো-বা আজো তার জের
ছায়া হয়ে নাচে, বিভ্রম ও সব দুঃস্বপ্নকে হানো।
বাগানের শোভা মনে জাগায় উৎসব, লহমায়
মুছে ফেলে নিস্তেজ শরীর থেকে ধুলো আর স্বেদ
দয়িতার স্পর্শ হয়ে। অথচ সে বাগানের মাটি
ফুঁড়ে অমাবস্যা রাতে খটখটে কঙ্কাল হাওয়ায়
ভাসে, হাসে; বিষধর সাপ গাছের বাকল ভেদ
করে তেড়ে আসে, সঙ্গী হয় প্রেত, তারই পাশে হাঁটি।
১৮.৫.৯৬