আমার এ ছোট ঘর
আমার এ ছোট ঘর সামান্য হলেও আহরণ
করেছে জ্ঞানের নুড়ি। ইতিহাস, দর্শন সে জানে
কিছু কিছু, বিশ্বকাব্য আর রবীন্দ্রনাথের গানে
নিয়ত হয়েছে স্নাত এবং করেছে অন্বেষণ
মণিরত্ব নৃতত্ত্বের অন্ধকারে। এ ঘর মোহন
বাঁশি শোনে মধ্যরাতে, সর্বক্ষণ প্রগতির টানে
মজা খাল নয়, সমুদ্রকে চায়; তিমিরের কানে
জপায় আলোর মন্ত্র নিত্য, তা জানে আমার মন।
আমার জামার ঘ্রাণ, জুতোর গড়ন, হাঁচি, কাশ,
দীর্ঘশ্বাস, হাসি, ঘুম-বেবাক মুখস্থ এ ঘরের।
আমার এ ঘর ভিন্ন সাজে হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসে,
যখন কবিতা আর গৌরী মাঝে-মধ্যে চলে আসে,
আমার নিবিড় কাছে বসেন, যুগপৎ নীলাকাশ
আর শান্তি নীড় হয় ঘর, ঢেউ জাগে আনন্দের।
১৮.৩.৯৬
আমার ব্রত
তরুণ উজ্জ্বল তিনজন কবি গাঢ় সায়াহ্নকে
ঝাঁঝালো দুপুর করে আমার পড়ার ঘরে এসে
বলে, ‘ওরা আপনার দিকে ছুঁড়েছে বিস্তর কাদা
খোলা পথে শাঁসালো মণ্ডপে; আমরা তা কিছুতেই
আর মেনে নেবো না, জবাব দিতে চাই এই নোংরা,
ক্লিন্ন আচরণটির। স্পষ্টত ওদের চোখে ছিল
উষ্মা আর বেদনার ঈষৎ গোধূলি। আমি হেসে
কবিতা ঢেউয়ে ভেসে চকিতে উত্তর-আধুনিক।
আমার পড়ার ঘরে তিনজন তরুণ কবির অস্তমিত
ক্ষোভ ভালো লাগে, জমে ওঠে দিব্যি ষড়জে নিখাদে
আলাপ এখনকার কবিতা বিষয়ে। ওরা নিলে
বিদায় ফুরফুরে মনে, উদার আকাশে মগ্ন হই,
নক্ষত্রপাড়ার গুঞ্জরণ শুনি, তার কথা মনে
পড়ে; ভাবি, কাদাতেই ফুল ফোটানো আমার ব্রত।
৪.২.৯৭
আমার হারিয়ে-যাওয়া ডায়েরি
আমার হারিয়ে যাওয়া ডায়েরিটি মধ্যরাতে এসে
প্রেতের ধরনে হাসে, যেন সেই হাসিতে ক্রন্দনই
বেশি ছিল; বল্ল ধূসরিম কণ্ঠে, “আমাকে অনেক
অবহেলা করেছো হে কবি, কোন্ সে আঁধারে তুমি
আমাকে রেখেছ ফেলে, আমার শরীরে ঢের ধুলো
পুরু হয়ে জমেছিল। একবারও ভুলে পাতাগুলো
খানিক দেখনি খুলে; হায়, তাকাওনি ভালোবেসে
পুরোনো পাতার দিকে কিংবা স্নেহভরে ক’বছর।
অথচ সুদূর একাত্তরে ভরেছ আমার পাতা
বেদনার্ত কিছু কবিতায়, কখনো হয়েছি স্নাত
তোমার অশ্রুতে আর তুমি বারবার বুকে টেনে
নিয়েছ আমাকে আর রেখেছ আগলে অগোচরে,
ছিলাম লুকানো যত্নে। আজ আমি অভিমানে, ক্ষোভে
হারিয়ে গিয়েছি শূন্যে, ইতিহাসে হলো নাকো ঠাঁই।“
২২.১.৯৬
আমি কি নিজের ঘরে
আমি কি নিজের ঘরে বসে একা পেশেন্স খেলেই
সময় কাটিয়ে দেবো? অন্য কিছু করার বাসনা
মগজে তোলে না মাথা। এমনকি কবিতার কণা
উদার প্রকৃতি থেকে আজ কুড়ানোর সাধ নেই;
নিজেকে বিরান চর মনে হয় এই সকালেই,
যেহেতু তোমার কণ্ঠস্বর, হে আমার সুলোচনা,
শুনছি না দু’শতাব্দী ধরে; তোমাকে যে দেখব না
কতকাল তা জানি না; চিন্তার হারিয়ে যাচ্ছে খেই।
এখন আমাকে দেখে যে কেউ সহজে নেবে বুঝে
আমি যে ভূতলবাসী। তাজা রোদ, জ্যোৎস্না বহুকাল
আমাকে করেনি স্পর্শ; আমার চোয়ালে পাবে খুঁজে
লুণ্ঠিত বাড়ির ছায়া; সারারাত বাঘিনীর ছাল
ঝুলে থাকে আমার ওপর, চেয়ে থাকি নিষ্পলক
এক উন্মাদের দিকে, বুকে জ্বলে অসুস্থ ঝলক।
১২.৭.৯৬
আষাঢ়ী পূর্ণিমায়
পুনরায় চুপিসারে দয়ার্দ্র আষাঢ়ী পূর্ণিমায়
দেখা হলো আমাদের, যেন ক্লাশ-পালানো দু’জন
ছাত্রছাত্রী সেরে নিয়ে অন্তরঙ্গ সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ
জ্যোৎস্নার চুম্বন নিয়ে দেহমনে চীনা রেস্তোরাঁয়
খুঁজে নিই অস্থায়ী আশ্রয়। নিভৃতির প্রত্যাশায়
একটি কেবিনে ঢুকি; দৃষ্টিপথে তোমার যৌবন
আশ্চর্য ঝলসে ওঠে, সরোবরে চাঁদিনী যেমন;
হৃদয়ে হরিণী এক হাঁটে চর্যাপদের ভাষায়।
সহজে পাই না এরকম মুহূর্তের উপহার
এ শহরে; কেবলি জড়িয়ে যাই সুকঠিন লতা
আর ক্যাকটাসে, সারা শরীর, দু’চোখ ছিঁড়ে ফেটে
যেতে চায়। এরই মধ্যে কালেভদ্রে ভুল লোকাচার
এ মিলন উদগ্র মরুর বুকে মরূদ্যান যথা-
যতদিন বেঁচে আছি, অন্তত এভাবে যাক কেটে।
১০.৮.৯৬
ঈগল এবং আমি
আমাকে প্রায়শ এক স্বাস্থ্যেজ্জ্বল স্বর্ণাভ ঈগল
উপহাস করে দূর পর্বতশিখর থেকে; ঠারে
ঠোরে দ্যাখে দাগাবাজ অসুখ আমাকে বারে বারে
বেড়াল-ইঁদুর খেলা খেলে, আর করে বেদখল-
রোদে ঘুরে বেড়ানো বৃষ্টিতে ঝিম ভেজা-এ সকল
ছোট ছোট সুখ থেকে। তার সঙ্গে শীতসাঁঝে হিম
সয়ে বাগিচায় বসা কি কঠিন, চোখের পিদিম
এখনই নিভল বলে, গ্রর্ন্থপাঠ হতেছে নিশ্চল
স্বর্ণপ্রভ হে ঈগল জেনেছি তোমার তকব্বরি
প্রসিদ্ধ জগতে, কিন্তু জেনে রাখো আমিও চূড়ায়
আমি পক্ষী, যেখানে পুষ্পিত করে বসবাস গৌরী
আমার আপন মনে; তোমার মতোই অধীশ্বার
আছি, করায়ত্ত যার রত্নদ্বীপ, তারার গুঁড়ায়
গড়া, যার তীরে বাঁধা ইচ্ছাতরী এক অনশ্বর।
১২.৪.৯৬
উৎসব
আজ উৎসবের দিন; চতুর্দিক খুব ঝলমলে
পোশাকে সেজেছে যেন। মিহি বৃষ্টি, দূর আকাশের
ঘন আবলুসী মেঘ আনন্দ-চঞ্চল মানুষের
মুখ ম্লান করে দিতে ব্যর্থ হলো। কোন্ যাদুবলে
এ শহর গলায় আলোর নেকলেস নিয়ে জ্বলে
এমন আন্ধারে? শুধু আমি এ আনন্দ বাসরের
ছটা থেকে বঞ্চিত, ফলত আজ নিজের ঘরের
কোণে একা মগ্ন ধ্যানে; অন্যেরা মেতেছে কোলাহলে।
উৎসবের ঝর্নাধারা কী করে করাবে ফুল স্নান
আমাকে যখন আমি বিচ্ছেদের স্রোতের কামড়ে
ক্ষয়ে যাচ্ছি প্রতিক্ষণ? যার নাম করি উচ্চারণ
বারবার জাগরণে, এমনকি স্বপ্নের ভেতরে,
যে আমার অন্তরে বাহিরে নিত্য গুঞ্জরিত গান,
সে নিজেই অন্যত্র উৎসব হয়ে জ্বলে সর্বক্ষণ।
২৯.৪.৯৬