সময় ফুরায় যত
এখন কোথায় আছো তুমি? জানার উপায় নেই
কিছুতেই; যদি কোনোক্রমে হয়ে যেতাম নাবিক
সিন্দাবাদ, তবে সাত সাগরের তরঙ্গে তরঙ্গে
দিতাম ভাসিয়ে এক সন্ধানী জাহাজ অবিলম্বে
তোমার উদ্দেশে আজ, অথবা সী-মোরগের পিঠে
উদ্দাম সওয়ার হয়ে, যদি ধনকুবের হতাম
তাহলে চার্টার্ড প্লেনে চড়ে চলে যেতাম তোমার
ঠিকানার সুলুক সন্ধান করে বিদ্যুৎগতিতে।
আগেও বিদেশে গেছ, কাটিয়েছে বেশ কিছুদিন,
সানন্দে ট্যুরিস্ট হয়ে। তখন হইনি এরকম
ব্যাকুল, অস্থির কোনোদিন। মন যেন বোমাধ্বস্ত
নিষ্প্রদীপ নির্জন নগর, বড়ো একা বসে থাকি
গৃহকোণে, কবিতার খাতা একমাত্র সঙ্গী, ভাবি-
সময় ফুরায় যত ব্যাকুলতা বেড়ে যায় তত।
১১.২.৯৬
সরোবর
আজকাল খুব ভোরবেলা উঠে পড়ি, মাঝে মাঝে
দেরি হয়ে যায়। কেন উঠি? এই চোখের অসুখ
বেড়ে গেল যখন, তখন থেকে চোখ, কান বুক
আকাশে আবির মাখা হওয়ার আগেই মাতে কাজে।
ঘুম ভাঙতেই শুনি পাখিদের শিস, আচানক
কোথা থেকে ভেসে আসে বকুল ফুলের গন্ধে, দেখি
আমার নৈঃসঙ্গ্য গাছতলা থেকে দেখছেন একি
মহৎ রবীন্দ্রনাথ। আমি দুর্ভোগের ক্রীড়নক।
তোমাকে দেখি না বলে সবকিছু মন খারাপের
স্পর্শে আজ কেমন বিবর্ণ, বড়ো অর্থহীন লাগে।
একুশের বই মেলা টানে না আমাকে, দিনভর
বসে থাকি গৃহকোণে, তৈরি করি এক সরোবর
যার জলে তোমার সুন্দর মুখ দেখি অনুরাগে,
বারবার সেই মুখ সরে গিয়ে ভেসে ওঠে ফের।
১৮.২.৯৬
সেই চিঠি
পরদেশে কোনো এক সতেজ সকালে জেগে উঠে
প্রেরণাতাড়িত কোনো কবির মতোই প্রিয়তমা
তোমাকে লিখেছিলাম চিঠি থর থর হৃদয়ের
হরফে; সে চিঠি তুমি পাওনি কখনো। ডাকঘর
থেকে বিলি হয়নি নিশ্চিত। ফলে কারো কোনো ক্ষতি
না হলেও আমার আবেগ কিছু হয়ে গ্যাছে গুম
অজানায় দু’পাতা লেখার সঙ্গে। যে পত্র পায়নি
তোমার হাতের স্পর্শ, তারই জন্যে করি শোক আজো।
অনেকের কাছেই এ এক তুচ্ছ ঘটনা। অথচ
ভেবেছি বিদেশে কত নিঃসঙ্গ প্রহরে, সেই চিঠি
পড়েছে সবার অগোচরে সমাজ সংসার ভুলে আর
তোমার চুম্বনে হরফের ঠোঁট সমৃদ্ধ হয়েছে।
হায়, সেই প্রতীক্ষা তোমার আর কিছু স্বপ্ন, কথা
ঝরে গ্যাছে বিনষ্ট ফলের মতো নীরব আন্ধারে।
৪.২.৯৬
স্বপ্নের জন্যে
আমার ভেতরকার ছবিগুলো প্রাণবন্ত হয়ে
ওঠার অক্লান্ত সাধনায় চার দেয়ালের খাঁ খাঁ
পরিধিকে কেবলি আঁকড়ে ধরে। স্তব্ধতায় ঢাকা
মুহূর্তগুলিকে আমি কী সহজে অবিরত ক্ষয়ে
যেতে দিচ্ছি। বৃক্ষচারী কোকিলেরা নিয়ত বমন
করছে স্বপ্নের দলা, স্বপ্নহীন যারা তারা দলে
দলে জোটে শোরগোল তুলে দিনরাত বৃক্ষতলে,
ওরা শুধু কোলাহলে মাটি করে হৃদয় রতন।
আমি তো তোমারই স্বপ্নে ডুবে থাকি হৃদ সরোবরে,
জাগরণে যখন কবিতা লিখি, তুমিই তখন
স্বপ্ন হয়ে ধরা দাও, এত কাছে বসো, পারি ছুঁতে
হাত বাড়ালেই আর আমারই কবিতা মৃদুস্বরে
পাঠ করো বস্তুত স্বপ্নের জন্যে কোনো ঘন বন
কিংবা দাতা পাখির নিকট প্রার্থী হই না কিছুতে।
১৭.৪.৯৬
স্বাগত জানাবে
তোমার ফেরার দিন আজ। ঘর-বার ঘর-বার
করছি কেবল, কোনো কিছুতেই মন বসছে না
এ মুহূর্তে, এ রকম তোলপাড় চেনা কি অচেনা
সহজে যায় না বলা। আজ লঘু হবে মনোভার।
কী ভাবে বরণ করি তোমাকে? স্বাগত জানাবার
নেই কো আমার অধিকার বিমান বন্দুরে গিয়ে;
আমার নিজের ঘরে বসে যদি রুমাল উড়িয়ে
অদেখা তোমাকে ছুঁই, কে থাকে বারণ করবার?
তোমার উদ্দেশে আজ হীরকের তোরণ নির্মাণ
করব সযত্নে আর আমার সকল স্বপ্ন এসে
হবে লাল গালিচা নিভৃতে, তুমি লঘু পায়
হেঁটে যেও তোমার মোটরকারে। আমি যত গান,
প্রেমের কবিতা লিখে এতকাল রেখেছি খাতায়,
ওরা সব স্বাগত জানাবে তোমাকেই ভালোবেসে।
২৩.২.৯৬
স্মৃতিভ্রংশ
ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে টেলিফোন করি,
কিছুতে পড়ে না মনে তার নাম। ফলে, রিসিভার
রেখে দিই; তারপর হঠাৎ আমার পরিবার
পরিজন, এমনকি আমার আত্মার সহচরী
নামহীন আমার নিকট। আমি যেন সেই তরী,
যার দিশা হারিয়ে গিয়েছে খুব ঘন কুয়াশার
আবরণে; আকস্মিক বিস্মরণে বাড়ে মনোভার।
তবে কি ভাঙছি আমি না জেনেই সযত্নে যা গড়ি?
এ আমার কী হলো হঠাৎ? যাকে সকল সময়
দেখি, তাকে যদি প্রশ্ন করি, ‘কী তোমার নাম’, তবে
সে কি আজ আমার বিভ্রান্ত দৃষ্টি লক্ষ্য করে ভয়
পাবে না? এবং গৌরী আমার দু’ চোখে অচেনার
ব্যাসকূট দেখে যদি দুঃখ পায়, তাহলে কী হবে?
আমাদের দু’জনের মধ্যে এ কেমন রুদ্ধ দ্বার?
১.৫.৯৬
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল
হৃদয় নিঃসঙ্গ চিল হয়ে কেঁদেছে ক’দিন তার
খবর রাখেনি কেউ। শূন্যতায় বেড়িয়েছি ভেসে,
যেন আমি কাটা ঘুড়ি, অনেক কষ্টেও মৃদু হেসে
সহজে নিয়েছি মেনে সামাজিকতার অত্যাচার।
আমাকে নিষণ্ন পেয়ে গৌরী প্রশ্ন করে, ‘কবি তুমি
এমন নিষ্পৃহ কেন আজকাল, এমন শীতল
উচ্চারণে, আচরণে? আমি কি ঢেলেছি ঠাণ্ডা জল
তোমার উদ্দীপনায়? ভাবাচ্ছে সন্ত্রন্ত জন্মভূমি?
কী দেবো উত্তর আমি? নিজেই জানি না, শুধু জানি
অন্ধকার গোলকধাঁধায় ঘুরি দিনরাত কেঁপে
উঠি ঘন ঘন একা ঘরে, ছায়াচ্ছন্ন এক প্রাণী
শিঙ নাড়ে, কষ বেয়ে তার রক্ত ঝরে, আসে ব্যেপে
কুঞ্জটিকা হৃদয়ে আমার, তবু তোমাকেই খুঁজি
প্রতিক্ষণ, এদিকে ফুরায় দ্রুত পরমায়ু-পুঁজি।
৩.৩.৯৬