রাহুগ্রাস
আমাকে থাকতে হবে অপেক্ষার ধু ধু সাহারায়
আরো কিছুকাল, মনে হয়ঃ স্বৈরাচারী আঁধিঝড়
চতুর্দিকে ক্রমান্বয়ে উপড়ে নিয়েছে বহু ঘর।
সন্ত্রাসশাসিত মানুষের মুখ দেখে দিন যায়
কোনো মতে, দুঃস্বপ্নের ভয়ে রাত কাটে অনুদ্রায়,
মাঝে মাঝে অজান্তে শিউরে উঠি না জানি কীসের
শংকায়; আমার হাতেও কি ক্রূরা ঘাতক বিষের
পাত্র তুলে দেবে আজ? আছি সত্যি কসাইখানায়।
কত আর ধৈর্য ধরি প্রিয়তমা? তোমার চৌদিকে
উঁচিয়ে রয়েছে মাথা প্রথার শান্ত্রীরা সর্বক্ষণ,
আমিও কপাল ঠুকি দিনরাত নিষেধের শিকে।
তোমাকে না দেখার বেদনা করে ক্রমশ হরণ
প্রাণশক্তি; ভয়ংকর রাহুগ্রাসমুক্ত হলে দেশ,
আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার রুদ্ধ কাল হবে শেষ।
১৯.৩.৯৬
শকুন্তলা
শকুন্তলা নও, পতিগৃহেও যাচ্ছো না, তবু দেখি
আশ্রমের নয়, শহরের বাগানের চারাগাছ
তোমার আঁচল জোরে জড়িয়ে ধরেছে, পাতা নাচ
কখন দিয়েছি জুড়ে প্রতিবাদে; ধরন সাবেকি।
তোমার যাবার আগে বাঁধা দিতে পারছি না, আছি
বিষণ্ন, নিশ্চুপ, তুমি দেখবে না, জানবে না আর
সবান্ধবী চলে যাবে বিমানবন্দরে। অন্ধকার
ঘরে আমি নৈরাশ্যের সঙ্গে কথোপকথনে বাঁচি।
আমার নিকট নেই এমন হরিণ, যার টানে
হবে না তোমার যাওয়া, আমার মনের তপোবন
অতটা মায়াবী নয়, সব ছেড়ে ছুঁড়ে তুমি ফিরে
আসবে এখনই এই শূন্য ঘরে হৃদয়ের গানে
আমাকে দুলিয়ে দিতে ঢেউয়ের নাওয়ের মতো। মন
ভালো নেই, তবুও যাবো না করুণার ভাঙা তীরে।
৭.৩.৯৬
শান্তিনিকেতনে গৌরী
জানতাম অসম্বব, তবু কলকাতার কলরবে
তোমার মধুর কণ্ঠস্বর শুনি অতিথি নিবাসে
আমার অস্থায়ী ঘরে। প্রত্যুষের পাখির সঙ্গীতে
জেগে উঠে দেখি একি রয়েছে দাঁড়িয়ে নিরিবিলি
চায়ের পেয়ালা হাতে। বসলে শয্যার ধারে এসে,
তোমার চুলের ঢল নামে আমার মুখের পরে,
আমার জাগ্রত ওষ্ঠে ফোটে কিছু চুমোর কুসুম,
সারা ঘর ভরে যায় অপরূপ তোমার সৌরভে।
শান্তিনিকেতনে, খোয়াই-এর তীরে, রামকিঙ্করের
কঙ্কালীতলার পথে যেতে দেখি হঠাৎ গৌরীকে।
ছাতিমতলায় বসে আছে একাকিনী গোধূলিতে,
সন্ধেবেলা কবিতা উৎসবে দ্যাখে কবিতা পড়তে
আমাকে তন্ময় হয়ে, যে কবিতা বস্তুত রচিত
তারই জন্যে, জ্বলে আসমানে কালপুরুষ নীরবে।
১৯.২.৯৬
শুধু গৌরী নিজে
প্রায়শ এমনই হয়, অনিদ্রার অঙ্গার ভীষণ
পোড়ায় রাত্রিকে আর শরীরকে আমার; যেদিকে
তাকাই কেবল পোড়া গন্ধ পাই। অন্ধকার ফিকে
হয়ে এলে মনে হয় পাখির উৎসব এ দহন
বেবাক ফেলবে মুছে, শান্তি জলে স্নাত হবে মন,
বঞ্চনার হাহাকার থাকবে না, এ জগতে টিকে
থাকার দুর্মর বাসনায় কোনো মন্ত্র নেব শিখে
আর রোদে হাস্যেজ্জ্বল হবে হৃদয়ের উপবন।
পাখির ডানার ছন্দ, রোদের সিস্ফনি জানি আজ
পারবে না আমাকে ফিরিয়ে দিতে গত নিশীথের
লুণ্ঠিত সময়, গুণী ভাস্করের কোনো কারুকাজ
আমার জ্বলন্ত কামনার ভস্মরাশি থেকে ফের
গড়তে অনিন্দ্য মূর্তি ব্যর্থ হবে। শুধু গৌরী নিজে
পারে এ দহন মুছে দিতে প্রণয়-ধারায় ভিজে।
৫.৭.৯৬
সনেটের শতদল
হে আমার সনেটের নিঃসীমা, তোমাকেই
কী ব্যাকুল চায় খরাচিহ্নময় কবিতার খাতা
তুচ্ছতা সরিয়ে পাশে। ‘সেজে ওঠো তুমি শূন্যে পাতা’
বলে প্রার্থনার স্বরে আর প্রায় প্রতিদিন এই
রোগশয্যা খুব মেতে ওঠে সকলের আড়ালেই
নক্ষত্রের কণাসমূহের নাচে, বসন্ত-উৎসবে;
অষ্টক ঘটক আসে বারে বারে উল্লাসে গৌরবে।
হে সনেটমালা তোমাদের বিনা আজ সুখ নেই।
রোগশয্যা ক্রমশ উন্নীত হয়, যেন নীলিমায়
নিশ্চিন্ত আশ্রয় নেবে। শয্যাগত আমি মেঘ ছুঁই,
কে এক সুন্দরীতমা ছুঁয়ে যায় আমাকে আঁচল
দিয়ে তার; অভ্রের গুঁড়োর মতো শব্দ ঝরে যায়
চারপাশে; কোনো শব্দ কল্যাবতী, কোনো শব্দ জুঁই,
কোনো শব্দ বেলী রূপে হয় সনেটের শতদল।
২২.৪.৯৬
সন্ধ্যাভাষা
নও বিদেশিনী, বাংলাই বলো, তবু মাঝে মাঝে
বুঝি না তোমার ভাষা পুরোপুরি, ফলে বেশ ভুল
বোঝাবুঝি হয়, যেন জমে মনে, অন্তর্গত ফুল
কেমন মুষঢ়ে পড়ে এবং বসে না মন কাজে।
কখনো কখনো এরকম হয় ভোরে কিংবা সাঁঝে
কয়লার গুঁড়ো আর ধুলোবালি ছায়ায় পুতুল
হয়ে আসে, চিকচিকে মরীচিকা এবং অকূল
দরিয়া আছড়ে পড়ে, ভ্রান্তির অর্কেস্ট্রা তীব্র বাজে।
প্রজাপতি আর জোনাকিরা দলে দলে আজকাল
আমার চৌদিকে গড়ে পাঁচিল, নির্বিঘ্নে থাকে, বলে-
‘যাকে ভালোবাসো, কখনো সে কথার অস্পষ্ট জাল
ছড়িয়ে প্রয়োগ করে সান্ধ্যভাষা কড়ি ও কোমলে,
আত্মহননের অন্ধ ইচ্ছেটাকে দূরে রাখবার
শিল্প জানে। ধোঁয়াশা সরাতে চাই তোমার ভাষার।
১২.৮.৯৬
সম্পর্কে গ্রহণ দেখে
কখনো আমার প্রতি এরকম তীক্ষ্ম বিরূপতা
দেখিনি তোমার ইতিপূর্বে। আমি সত্যি অপরাধ
করেছি, স্বীকার করি, নিজের অজ্ঞাতসারে, সাধ
করে নয়, তবু কেন আজো দিচ্ছ ছুঁড়ে বিষলতা
হে গৌরী আমার দিকে? রূঢ়ভাবে আমাকে বেজায়
একপেশে বলে খুব দিয়েছ ধিক্কার বারে বারে,
ফলে লুকিয়েছি মুখ স্বরচিত ভীরু অন্ধকারে
ভাসতে ভাসতে গ্লানি-সমুদ্দুরে ভঙ্গুর খেয়ায়।
তোমাকে ফিরিয়ে আনবার কোনো পথ জানা নেই;
তেমন কুশলী নই বাক্যের তুবড়ি তাড়াতাড়ি
জ্বেলে টেলিফোনে কিংবা সাক্ষাতে ভেজাব মন এই
দীপ্ত অনুরাগের খরায়। মতান্তর মনান্তরে
রূপ নিলে শুরুতেই অপটু আনাড়ি আমি হারি,
সম্পর্কে গ্রহণ দেখে কেঁপে উঠি বাহিরে-অন্তরে।
১৬.৬.৯৬