মহুয়ার মন
মাত্র দু’বছর আগে আমাদের এই পরিচয়
অকস্মাৎ এ শহরে বিলম্বিত গোধূলি বেলায়।
আমরা দু’জন একই ঘাটে মহাকালের খেলায়
মিলিত হয়েছি, আমাদের হৃদয়ের পরিণয়
বহু যুগ আগেই হয়েছে বীথিকায় মনে হয়
সম্পূর্ণ গান্ধর্ব মতে। কদমতলার স্মৃতি আজো
রূপালি মাছের মতো ভেসে ওঠে। বাজো, বাঁশি বাজো,
উঠুক পায়ের মল নেচে আজ এ শহরময়।
গৌরী, তুমি আধুনিকা; উন্নত মানের শিক্ষা দীক্ষা
পেয়েছ, বস্তুত তুমি রুচির সৌরভ প্রতিক্ষণ
ছড়াও আলাপে, আচরণে; তোমার সময় ভিক্ষা
চাই কিছু প্রায়শই; দাও, জানি; কোনো কোনো স্তরে
তোমার এবং গ্রাম্য গীতিকার মহুয়ার মন
অভিন্ন প্রণয়ে, ঘর-কাঁপানো আবেগে, জলঝড়ে!
২৯.১.৯৬
মাপকাঠি
তুমিই আমাকে জপিয়েছে সাধারণ মাপকাঠি
দিয়ে পরিমাপ করা চলে না আমাকে কিছুতেই;
সমাজে আমার আচরণ হবে খুব পরিপাটি
এবং নিখুঁত-এই তুচ্ছতার প্রয়োজন নেই।
‘কবি তুমি, শব্দশিল্পে নিবেদিত থাকবে সর্বদা
অন্য সব কিছু গৌণ হোক, তাহলেই হবো সুখী,’
বলেছিলে তুমি একদিন কথাচ্ছলে প্রিয়ংবদা
নিভৃত ড্রইংরুমে। ভাবনার অন্য আঁকি-বুঁকি
ছিল না তোমার মনে, অনুমান করি। কিন্তু কাল
কী-যে হলো অকস্মাৎ সামাজিক তুচ্ছতার টানে
ছিঁড়ে গেল হৃদয়ের সূক্ষ্ম তার, বেসামাল
হয়ে তুমি আগুন ঝরালে খুব তালছুট গানে;
সামাজিকতায় ছিল আমার অবুঝ-ভুলক্রটি,
বুঝি তাই দিয়েছে আমাকে কালো ভর্ৎসনা, ভ্রূকুটি।
১৫.৬.৯৬
ম্লান হয়ে যাই
খুব ভোরে জেগে উঠে দেখি চেনা সুন্দর পৃথিবী
আমার দিকেই গাঢ় মমতায় তাকিয়ে রয়েছে;
গাছ, লাল গোলাপ কাছের নার্সারির, খোলা পথ
নীলকণ্ঠ, ভাসমান মেঘ শুভেচ্ছা জানায়, ভাবি-
আজ তুমি প্রিয়তমা, সুস্থ থাকবে, আনন্দে ভরে
রইবে তোমার মন। কেননা আবার কাল রাতে
দেখা হলো আমাদের। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা
বলে কণ্ঠস্বর শুনে তোমাকে নীরোগ জানলাম।
এমত ধারণা হলো, আমার গভীর ভালোবাসা
তোমার শরীর থেকে সহজে ফেলেছে মুছে সব
যন্ত্রণা, মনের ক্লেশ। এ ধারণা আমার গর্বের
ঝুঁটিকে অধিক দীপ্ত করে তোলে। অথচ সন্ধ্যায়
তোমার মধুর কণ্ঠে ফুটে ওঠে অসুখের স্বর-
ব্যর্থতা আমাকে করে গ্রাস, বড়ো ম্লান হয়ে যাই।
৭.২.৯৭
যখন ছিলে না তুমি
আখেরে অসিত বিচ্ছেদের দিন হলো অবসান
আজ এই প্রসন্ন বেলায়। আনন্দের অনাগত
মুহূর্তের তীব্র প্রতীক্ষায় হৃদয়ের অন্তর্গত
গানে-পাওয়া পাখি গেয়ে ওঠে পুনর্মিলনের গান।
একেকটি দিন ছিল বহুশত বর্ষের অবসান,
যখন ছিল না তুমি কাছে, প্রতিদিন অবিরত
দেখেছি তোমার মুখ মেঘে, স্বপ্ন-সরোবরে নত
পদ্মের আভায়, শুধু তোমাকেই করেছি সন্ধান।
বিষাদের মুখে হাসি ফোটে, হাওয়া এসে দিলখোলা
কথা বলে, বুলায় রেশমি হাত চুলে, গৃহকোণ
বাসর শয্যার ঘ্রাণে পুলকিত; এ কিসের দোলা
আমার অস্তিত্বে? এই বুঝি বেজে ওঠে টেলিফোন,
যার অপেক্ষায় আছি স্বরচিত মনোজ নিবাসে
ঘাতক কালের মোড়ে, শাসকের ব্যাপক সন্ত্রাসে।
১৫.৩.৯৬
যখন তোমার কণ্ঠস্বর
যখন তোমার কণ্ঠস্বর মঞ্জুরিত টেলিফোনে
সকালে দুপুরে রাতে, আশ্চর্য পুষ্টিত সেই স্বর
নিভৃতে আমার শরীরকে স্পর্শ করে, থর থর
অস্তিত্ব আমার কথাগুলো স্বপ্নময়তায় শোনে।
যদিও রয়েছে কিয়দ্দূরে, তবু এই গৃহকোণে
বসে তারবাহী কিছু কথা শুনে এ সামান্য ঘর
অলৌকিক অনন্য বাসরঘর হয়; অতঃপর
আমরা সঙ্গমসুখে ভাসি, নক্ষত্রেরা স্বপ্ন বোনে।
টেলিফোনে আমাদের দু’জনের কথোপকথন
শেষ হলে আমার নিঝুম করোটিতে রয়ে যায়
দেবালয়ে গুণীর তানের মতো কিছু গুঞ্জরণ
বেলা অবেলায়, ঘাসবনে নিরিবিলি যুগ্মতায়
অবিরল বয়ে যাওয়া রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় ঝুলে থাকে
অসংবৃত টেলিফোন; চন্দ্রোদয়ে বিনিদ্র চকোর ডাকে।
২৭.৮.৯৬
যখন শিল্পও হার মানে
তুমিতো যাবার আগে বিবর্ণ রোগীকে চমৎকার
প্রেসক্রিপশন আর কিছু পথ্য দিয়ে গেলে হেসে,
অবশ্য তুমি তা আন্তরিক উষ্ণতায় ভালোবেসে
করেছ; স্বীকার করি। মনে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার
মেঘ যদি ঘনায়, তা হলে যেন ক্যাসেট প্লেয়ার
নিমেষে চালিয়ে দিই, রবীন্দ্রনাথের গানে ভেসে
যাই কিংবা ‘শেষের কবিতা’ শুনি নিভৃত আবেশে
ইত্যাদি বলার ক্ষণে তুমি ছিলে নিজেও আঁধার।
ইচ্ছে করলেই কেউ বেদনার নিষ্করুণ চাপ
থেকে মুক্ত হতে যে পারে না, এই সত্য সুনিশ্চয়
তোমার অজানা নয়। মানি, শিল্প প্রলেপ বুলিয়ে
মনোভাব কিছুটা লাঘব করে; দহমনের তাপ
অত্যন্ত প্রখর হলে শিল্পকে হার মেনে নিয়ে
ব্যর্থতার গহ্বরে প্রস্থিত মুখ লুকাতেই হয়।
২৯.৪.৯৬
রাজনীতি
রাজনীতি আজকাল ধূর্ত, খল, ভ্রষ্ট, নীতিহীন
অতিশয়; রাজনীতি বড়োই কর্কশ, মিথ্যা বুলি
প্রায়শই সহিংসতা, মানুষের চোখে কড়া ঠুলি
পরিয়ে ঘোরানো, উপহার দেয়া ছলনার দিন।
রাজনীতি এমনকি সুন্দরীর মুখকেও খুব
কঠিন বিকৃত করে তোলে নিমেষে এবং চোখে
মুখে তার জ্বেলে দেয় চৈত্রদাহ, তখন ত্রিলোকে
প্রেমিক অনুপস্থিত, জলাশয়ে প্রেমও দেয় ডুব!
তবুও বিবর্ণ জীবনের কাঠামোয় রাজনীতি
চাই আজ আমরা সবাই সুস্থতা ও প্রগতির
স্থির লক্ষ্যে, যেখানে ছলনা নেই, নেই কোনো ভীতি
ভ্রষ্টাচার, অকল্যাণ, আস্ফালন মারণাস্ত্র আর
সযত্নে লালিত সন্ত্রাসীর, যেখানে প্রেমিক নীড়
পেয়ে যায় অকর্কশ সুস্মিতা সত্তায় দয়িতার।
১৪.৬.৯৬