বিচ্ছেদ বিষয়ক
এক শহরেই থাকি আমরা দু’জন, গৌরী আর
আমি, কিন্তু কেউ কারো সঙ্গে দেখা করতে পারি না
আজকাল; এ কেমন কাল এলো? লুট, হত্যা বিনা
যায় না একটি দিনও। জালিমের কর্কশ হুঙ্কার
ত্রাস সৃষ্টি করে চতুর্দিকে, কোনোদিকে বেরুবার
তেমন সুবিধে নেই। সরকার শ্বাপদ হলে, কেউ
নিলে কিছু, সন্ত্রাসীর বাড়লে দাপট, তবে কেউ
নিরাপদ নয় প্রেমও হয় মুখোমুখি হায়নার।
এখন গৌরীর মুখ দেখি কল্পনায়, বয়ে চলি
প্রতিদিন বিচ্ছেদের ভার; গৌরী আর রাজপথে
লেগে-থাকা রক্তচিহ্ন স্পষ্ট পাশাপাশি, অন্ধ গলি
মনে হয় এ জীবন। একা-একা মানস-সৈকতে
হাঁটি, শুই; ভাবি, এ বিচ্ছেদ এমন দুঃসহ এই
মুহূর্তে মৃত্যুতে চির বিচ্ছেদের যন্ত্রণাই নেই।
২৭.২.৯৬
বিপন্ন হয়ে যাই
নিজেই নিজের আচরণ নিশ্লেষণ করে খুব
বিস্মিত, বিপন্ন হয়ে যাই। আমার ভেতরকার
কোন্ অন্ধকার স্তর থেকে ক্ষিপ্ত এক জাগুয়ার
হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। কখনো অতলে দিয়ে ডুব
আমি যেন জলজ সহিংস প্রাণী ছিঁড়ে খুঁড়ে
খাবো পাবো যা সমুখে, লেজের আঘাতে চতুর্দিক
তছনছ করে শেষে নিজেকেই ভয়ঙ্কর শিক
দিয়ে গেঁথে ভব্যতার খোলস ফেলবো ভেঙেচুরে।
এই ভাঙচুর লক্ষ্য করে তুমি এর ব্যাখ্যা চেয়ে
আমাকে বৃথাই করো অপ্রস্তুত। কত ব্যাখ্যাতীত
বিষয় রয়েছে ভবে, অমীমাংসা যার অসহায়
করে রাখে মানুষকে, মাঝে মধ্যে অস্তিত্বের ভিত
ভয়ানক কেঁপে ওঠে। কালসন্ধ্যা নেমেছে, হে মেয়ে
ডোবাচ্ছো পীড়ন-গাঙে, আবার ভাসাও কিনারায়।
৫.৫.৯৬
বিপর্যয় এবং একজন কোকিল
আজ আমি, বলা যেতে পারে, পর্যুদস্ত ভয়ানক।
আমাকে ধরেছে ঘিরে ধূর্ত কাক, হাড়গিলা আর
কাদাখোঁচা, ক্রমাগত চঞ্চুর আঘাতে অন্ধকার
দেখছি, নিজের ক্ষত দেখে ভয় পাই। কাঁহাতক
সইব এমন নির্যাতন? হায়, আমার পালক
নেই যে ত্বরিৎ উড়ে যাবো বহুদূরে নীলিমার
নিভৃত অভয়াশ্রমে। সাধগুলো হচ্ছে ছারখার
কর্কশ চিৎকারে, আমি ভূলুণ্ঠিত, উদ্যত ঘাতক।
একজন কোকিল শহরে আছে যার গানে গানে
আমার প্রহর খুব উদ্ভাসিত; আমি নিত্য কান
পেতে থাকি; হা কপাল, আজকাল সে-ও তো আহত
ভীষণ, হৃদয় তার জর্জরিত বিপক্ষের বাণে;
কণ্ঠ থেকে তার ঝরে ক্ষোভ আর বেদনার তান,
তবু সুপ্রভাত শুভরাত্রি জ্বলে নক্ষত্রের মতো।
২৮.৭.৯৬
ভরে নাও ঘড়া
পাঠাওনি তুমি আজ কোনো পাখি আমার নিকট
কবির খবর দিতে। যে পাখিটা পুষছো হৃদয়ে
দীর্ঘকাল, রেখেছ আড়াল করে তাকে, যাচ্ছে বয়ে
দিনরাত, কার পদাঘাতে ভাঙলো মঙ্গলঘট?
তোমার অশান্ত মন সর্বক্ষণ বইছে পাথর,
এভাবে কি শ্বাস-প্রশ্বাসের সূক্ষ্ম, সাবলীল খেলা
চালানো সম্ভব অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া? স্নিগ্ধ বেলা
বড়ো ক্ষণস্থায়ী, চতুর্দিকে জীব বেদনা-কাতর।
তোমার বেদনা আরো বাড়াতে চাই না বলে থাকি
চুপচাপ, একা-একা সই বিচ্ছেদের স্বৈরাচার।
ফুসফুসে বীজাণুর হট্রগোল অন্তরালে চলে আর
ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসে খাঁচা; কবে প্রাণ-পাখি
উড়ে যাবে, কে জানে এ ভাবে? তাই বলি, এসো তবে
আমরা দু’জন বাঁচি বেদনার নিঃসীম গৌরবে।
২৯.৩.৯৬
ভাবিনি এমন
ভাবিন এমন ভয়ঙ্কর অন্ধকার তীক্ষ্ণ দাঁত
বের করে দেশকে করবে গ্রাস। ঢ্যাঙা, ক্ষিপ্ত ঘোড়া
চারপায়ে করে তছনছ দেখি দেশজোড়া
চলে কুশাসন লম্বকর্ণদের, ভীষণ সংঘাত
পথে পথে, স্বামীহারা নারী আজ করে অশ্রুপাত
কত ঘরে, সংগ্রামী মানুষ মরে গুলির বৃষ্টিতে,
প্রবল ঝাঁকুনি লাগে মানবিকতার দৃঢ় ভিতে
শ্রেয়োবোধ লুপ্তপ্রায়, সহিংসতা নাচে দিন-রাত।
যেদিকে তাকাই দেখি মাটি ফুঁড়ে বেরোয় অদ্ভুত
প্রাণী দলে দলে, যেন বিকট গণ্ডার, যায় ছুটে
মানুষের পেট চিরে ফেলার উদ্দেশ্যে, এইসব
হিংস্র মূর্তি সংহার করবে যারা তাদের নিখুঁত
প্রক্রিয়া হয়েছে শুরু অন্তরালে, ওরা লুটে-পুটে
খাবে না কিছুই শুধু বাজাবে সৃষ্টির কলরব।
১৮.৩.৯৬
মধ্যরাতে ঘুম থেকে
মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে দেখি পাশের বাড়িটা
দু’টি শাদা ডানা পেয়ে চকিতে উড়াল দেয় মেঘে;
একজন বুড়ো লোক শুয়ে আছে গাছের ওপর
কাঁথা মুড়ি দিয়ে, বিড়বিড় করে ঘুমের গুহায়।
আখরোট সদৃশ দরিদ্র বুড়ো স্বপ্নের ভেতর
মড়ার খুলিতে ঢেলে কিছু সর্পরস করে পান
অকাতরে; অন্ধ বাদুড়ের ঝাঁক তাকে ঢেকে ফেলে,
ধেয়ে ইঁদুরের দল ওকে আহার্য ঠাউরে নেয়।
সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে আছি কোমর অবধি কাদাজলে,
চতুর্দিকে বিষ্ঠা ভাসমান, এরই মধ্যে কতগুলো
কোমল, সুন্দর জলচর পাখি প্রফুল্ল সাঁতার
কাটে আর আমিও বাজাই বাঁশি কালো পানি কেটে
এগোতে এগোতে; দেখি লন্ড্রিতে বিশুদ্ধ ধোয়া সত্য
পতপত ওড়ে পথে, লোকজন দৃকপাতহীন।
২৩.১.৯৬
মহুয়া আসছে
মেঘের আড়ালে তুমি লুকাও হে চাঁদ, ঢাকো মুখ
তাড়াতাড়ি, মহুয়া আসছে তার অপরূপ রূপ
নিয়ে ধীর পদক্ষেপে কংসাই নদীর ধারে, ধূপ
জ্বলছে হৃদয়ে তার, নদীর ঢেউয়ের মতো বুক
ওঠা নামা করে আর বস্তুত নদেরচাঁদ নয়,
আমিই জলের ঘাটে একা বসে আছি প্রতীক্ষায়।
তার হাত ধরে নিয়ে যাবো বেদেদের পাহারায়
ধুলো দিয়ে নিজের ডেরায়, পাবে না সে আর ভয়।
সৌন্দর্য ঐশ্বর্য তার, উপরন্তু মন ঝকঝকে
স্বচ্ছ সরোবর এক; গহন দু’চোখ। মাঝে মাঝে
কথায় কৌতুক খেলে, কিন্তু সৌন্দর্যই হলো কাল
শেষ অব্দি; বিষ-ছুরি, পুরুষের সিক্ত, লকলকে
লালসার জিভ থেকে পারিনি বাঁচাতে তাকে, বাজে
তার মৃত্যুধ্বনি, আমাকেও ঘিরে ধরে ক্রূর জাল।
২২.৪.৯৬