প্রতীক্ষায়
তোমার ফেরার দিন আসন্ন বলেই প্রিয়তমা
আমার আকাঙ্ক্ষাগুলি পলাশ-মঞ্জরি হয়ে রোদ
জ্যোৎস্না মেখে নেয়। ভাবি, এ মুহূর্তে নির্জনতাবোধ,
যা বিরহ, তোমাকে দখল করে দূর রমরমা
হোটেলের লাউঞ্জে অথবা কামরায়। ঘন অমা
তোমাকে ধরে কি ঘিরে? না কি হাস্যে লাস্যে পরিবার
পরিজন নিয়ে কাটে বেলা? আমি বেদনার ভার
বয়ে চলি, করোটিতে আশঙ্কার ছায়া হয় জমা।
তোমার প্রহর কাটে, অনুমান করি, স্বপ্ন ঘোরে
দোকানে, মোটরকারে কখনো বা হাঁটো রাজপথে
যাও কোনো বিখ্যাত উদ্যানে, আর তোমার শরীর
মনোমুগ্ধকর ছন্দে দুলে ওঠে সমুদ্র সৈকতে
যেখানে দুপুরবেলা দলে দলে স্নানার্থীরা ভিড়
জমায়, এখানে প্রতীক্ষায় আমার অন্তর পোড়ে।
২১.২.৯৬
প্রত্যাশা ছিল না কোনো
প্রত্যাশা ছিল না কোনো, তবু যেন কে ঐন্দ্রজালিক
হঠাৎ ঘটিয়ে দিল চোখের পলকে এই সব
আশ্চর্য আমার জন্যে-এই অলৌকিক কলরব,
দুয়ারে পুষ্পক রথ, অন্তরে নিভৃত মাঙ্গলিক।
এই যে তোমার মুখোমুখি বসে আছি শীতাতপ
নিয়ান্ত্রিত ঘরে নিরিবিলি, দেবব্রত গানে গানে
মুহূর্তগুলোকে অনুপম সাজিয়ে দিচ্ছেন, প্রাণে
সুদূরের তৃষ্ণা জাগে, ঘর করে সুন্দরের জপ।
যেন দিব্যনদীতীরে পেয়ে গ্যাছে ঠাঁই ভগ্নস্বাস্থ্য
এই কবি। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে করোনি বড়াই
কোনোদিন, কিন্তু আমি তোমার বাহির-অন্তরের
রূপে মুগ্ধ, ‘মাঝে-মধ্যে ছন্নছাড়া লোকটা আসতো
এখানে’, বলবে কেউ কেউ, ‘সে তো করতো লড়াই
অশুভের সঙ্গে, মুহূর্তের মুক্তো কুড়াতে সে ঢের!
৮.৫.৯৬
বরাভয়
গত কয়েকটি দিন আমাদের বড়ো এলোমেলো,
শরবিদ্ধ ছিল, চতুর্দিকে হৈ-হুল্লোড়, ধূলিঝড়
ছিল, ছিল তর্ক আর কর্কশ বচসা, বুনো জ্বর,
যা স্পর্শ করেছে আমাদেরও, কখন যে খুব খেলো
হয়েছি নিজেরই কাছে, বস্তুত পাইনি টের। ভুল
করেছি আমিও জেনেশুনে, কলহের সূত্রপাতে
পারিনি টানতে ছেদ, পড়েনি সে-তথ্য মনে, যাতে
ছিল সত্য, ফলে বিদ্ধ করেছে আমাকে শত হুল।
তুমি কি আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহের দোলা
কখনো পুষেছ মনে? আমাকে নির্দয় আর খল
ভেবেছ কি বিভ্রান্তির-ঝাপ্সা কোনো ক্ষণে? শোনো, ঘোলা
জলে মৎস্যশিকারি তো আমি নই উপরন্তু ছল
ধাতে নেই, পেয়েছি প্রেমের দেবতার বরাভয়-
প্রলয়েও আমাদের ভালোবাসা অম্লান, অক্ষয়।
১৯.৬.৯৬
বর্ণমালা দিয়ে
কবিতা লিখতে গিয়ে হঠাৎ পড়ল মনে এই
কিছুদিন আগে তুমি আমার একটি কবিতায়
ওষ্ঠ রঞ্জনীর গাঢ় ছাপ রেখেছিলে মমতায়
তোমার নিজস্ব ঘরে। এ ঘটনা গাঁথা স্মৃতিতেই।
এতকাল কেটেছে একুশে ফেব্রুয়ারি কী রকম
নিস্তেজ, নিষ্প্রভ যেন। মন ভালো ছিল না, ফলত
নীরবে ছিলাম আমি শহীদের স্মৃতিতে প্রণত
এবং হৃদয় জুড়ে ছিলে তুমি কিউপিডের কসম।
আমার কবিতা ডানা মুড়ে ঘুমোচ্ছিল, আমি তাকে
শিস দিয়ে ব্যাকুল জাগিয়ে তুলি, স্মরণ করিয়ে
দিই তুমি নেই বলে ওকে বেশি চাই, ওর সঙ্গ
না পেলে আমার চতুর্দিকে প্রেত নেচে নেচে ভঙ্গ
করবে মনের শান্তি। আজ বাংলা বর্ণমালা দিয়ে
নক্ষত্রের আভা মেখে পরিপূর্ণ সাজাবো তোমাকে।
২২.২.৯৬
বলো তো তোমাকে ছেড়ে
বলো তো তোমাকে ছেড়ে কী করে থাকব এতদিন
এ শহরে? শহরের পথ চেনে আমার নিভৃত
পদধ্বনি, কোনো পুরনো গলির মোড় জানে
আমার জুতোর গন্ধ কী রকম; এ চেনা নগরে
কিছুদিন তোমাকে কোথাও খুঁজে পাবো না নিশ্চিত।
তোমাকে না দেখে আর তোমার সুরেলা কণ্ঠস্বর
না শুনে থাকতে হবে ভাবতেই পারি না, অথচ
আমাকে দণ্ডাজ্ঞা মেনে নিতে হবে প্রতিবাদহীন!
এখন শহর খুব বিপন্ন, আতঙ্কে কম্পমান;
শান্তি-ছাওয়া ছাত্রাবাসে নেকড়ের মতো হানা দেয়
জালিম পুলিশ, বুট লাথি মেরে হাওয়ায় ওড়ায়
ছাত্রের ভাতের থালা; বন্দুকের বাঁট ভেঙে ফেলে
হাত-পা নিদ্রিত শিক্ষার্থীর, ক্রুশবিদ্ধ মানবতা-
এরই মধ্যে, প্রিয়তমা, নিরন্তর তোমাকেই ভাবি।
৮.২.৯৬
বাগান দেখালে তুমি
‘দ্যাখো, দ্যাখো, কেমন ফুটেছে ফুল আমার বাগানে;
বল্লে তুমি আমাকে সে-রাতে। দেখি গাঁদা আর কিছু
ডালিয়ার স্মিত মুখ। ‘এখানে গোলাপও ছিল ঢের
কখনো, কুকুর কষ্ট পাবে বলে, কাঁটার আঘাতে
গোলাপ মরেছে যত্নাভাবে-তোমার কথায় ছিল
বেদনার রেশ আর আসমানে পঞ্চমীর চাঁদ
যেন বা তোমার কণ্ঠে হর্ষবর্ধনের আমলের
হাঁসুলি, তোমার দেহে আমার দু’চোখ পর্যটক।
পঞ্চমীর চাঁদের অজানা নয় সে-রাতে তখন
আমার হৃদয়ে ফুটেছিল অজস্র রঙিন ফুল
তোমার সান্নিধ্যে সেই বাগানের কাছে, তুমি টের
পাওনি, এমন মশগুল ছিলে বিবরণে। শেষে
প্রস্থানের কালে দেখি কলোনি কংকাল অতিকায়
এবং পথের ধারে দুধের বাতিল কৌটো, এঁটো।
২৭.১.৯৬
বালুচরে
আমার দুঃখের বালুচরে কাকজ্যোৎস্না দেখে তুমি
ভেবো না সুখের নাও ভিড়েছে আমার ঘাটে। দেখো,
ভালো করে দেখো, এই নিঃসঙ্গতা সঙিন উঁচিয়ে
রেখেছে আমার দিকে; বাতাসে উড়ছে বালিকণা
হা হা স্বরে, নির্জনতা নিজেই ভীষণ ভীত স্ফীত
নদীটির খল খল শব্দে, সঙ্গিবিহীন এক
চখা চক্রাকারে ওড়ে মাথার ওপর অবিরাম-
তার হৃৎকমল ছিঁড়েছে শিকারির হিংস্র ক্রীড়া।
এসো না তুমিও এই বালুচরে সতর্ক পাহারা
এড়িয়ে কয়েক ঘণ্টা ভাসিয়ে ময়ূরপঙ্খী নাও।
মহুয়া হবে কি তুমি আধুনিক সাজসজ্জা ছেড়ে?
নিমেষে নদের চাঁদ হয়ে আমি সাজাবো তোমাকে
আমার ব্যাকুল প্রেমে, নাকি চখী হয়ে উড়ে এসে
ডাকবে আমাকে? সেই ডাকে হয়ে যাবো ফুল্ল চখা!
১৫.১.৯৬