দেহতত্ত্ব
কখনো নিইনি কোনো গুরুর নিকট দীক্ষা, দেহে
ভস্ম মেখে বৃক্ষতলে ধূপ ধূনা জ্বেলে জোরেশোরে
চিমটা বাজিয়ে লোক জড়ো করিনি কস্মিনকালে।
মানবতাবাদী বাউলের তরিকায় নিত্যদিন
দেহের বন্দনা করি; গীত রচনায় নিমজ্জিত,
দোতারা ছাড়াই ঘুরি এ ভবের হাটে। ক্লান্ত হলে
জিরোই দিঘির ঘাটে, মল্লিকার বনে, যাই ছুটে
তোমার দেহের তীরে উন্মুখর পিপাসা মেটাতে।
মাঝে-মধ্যে দেহমন কেমন বিষাদে ছন্নছাড়,
নতঝুঁটি মোরগের মতো চেয়ে থাকি শূন্যতায়;
দেহের ক্রন্দন ঘন কুয়াশা ছড়ায়, হয়ে যাই
দীর্ঘশ্বাস। হে অতুলনীয়া গৌরী, তোমার দেহের
পুশিদা মোকামে যে অপূর্ব পদ্ম আছে, কালেভদ্রে
তার ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড় বাই কাব্যের গহীন গাঙে।
২২.১.৯৬
নিজের শহর ছেড়ে
নিজের শহর ছেড়ে যখন বিদেশে যেতে হয়,
নিরানন্দ হয়ে পড়ি, মনে জমে মেঘ ইতস্তত,
বিষণ্নতা এসে বসে মুখোমুখি ঘাতকের মতো
ঠাণ্ডা চক্ষুদ্বয় নিয়ে, সারাক্ষণ মনে জাগে ভয়।
যদি না কখনো ফিরে আসি আর, এই ঘরদোর,
বই, কবিতার খাতা, লেখার টেবিল, জানালার
পর্দা, খাট, রবীন্দ্রনাথের ছবি ক্যাসেট প্লেয়ার
কোনোদিন মনে জাগাবে না পুলক, স্বপ্নের-ঘোর।
প্রিয়জনদের মুখ দেখব না, চার বছরের
পৌত্রীর কোমল কথা শুনব না, দেখব না, হায়,
ওর হাসি আর যাকে একদিন না দেখলে মনে
সভ্যতা বিলুপ্ত হয় লহমায়, তার দু’চোখের
মমতায় কখনো আমার চিত্ত আনন্দ-ধারায়
হবে না বিশদ স্নাত পাশাপাশি বসে ক্ষণে ক্ষণে!
৭.৫.৯৬
নিঠুরা যমজ ভগ্নী
কিছুদিন ধরে খুব বিস্রস্ত, ব্যাকুল হয়ে আছি;
আমাকে শিকার করে অস্থির প্রহর বারবার
দ্বিধাহীন, বুঝি কোনো চিত্তহারী ক্রীড়ায় মেতেছে।
আমার এ ব্যাকুলতা একান্ত নাছোড়, কিছুতেই
পাই না ঈষৎ মুক্তি। সঙ্গিনীবিহীন পাখি হয়ে
নীড় ছেড়ে উড়ে উড়ে ঘুরে ফিরি দূরের আকাশে,
পদ্মার ঊষর চরে, বিলে, ঝিলে, গহীন বনের
গাছে গাছে। উন্মোচিত যন্ত্রণার ফোয়ারা হৃদয়ে।
কী করব আমার এ ব্যাকুলতা নিয়ে অবেলায়?
কে আমাকে বলে দেবে একে আড়ালে রাখার
নিখুঁত পদ্ধতি? ফণিমনসার সহিংস আঁচড়ে
রক্তের বুদ্বুদ জাগে অধীর সত্তায়। থাক, তবু
থাক, এই ব্যাকুলতা, এই অস্থিরতা-এই দুই
নিঠুরা যমজ ভগ্নী প্রেমের কাব্যের উৎসভূমি।
৬.২.৯৭
পঁচিশ বছর ধরে
পঁচিশ বছর ধরে তোমাকে রেখেছি ভরে এই
হৃদয়ে আমার, যেন শকুনের চঞ্চু ও নখর
ব্যর্থ হয় তোমার দুচোখ তুলে নিতে, যেন কোনো
জখম না হয় অঙ্গে। থাকো তুমি সর্বদা নিখুঁত
পদ্মের ধরনে, এই স্বপ্ন আমাকে বসিয়ে রাখে নিত্য
প্রান্তরে, দিঘির ঘাটে, বকুলতলায়। কবিতাকে
বারবার করেছি উৎসর্গ ভালোবেসে অরুণিমা
তনিমার, যা তোমার। হৃদয়ের রৌদ্র-জ্যোৎস্না নাও।
তোমাকে বিকৃত করে, অপবাদে কালিমায় মুখ
লেপে দিয়ে বেজায় অনগ্রসর উদ্ভট মানুষ
কতিপয় বাজায় কর্কশ ঢোল, অন্ধকার স্রোত
কেবলি বইয়ে দেয় মগজের কোষে দিনরাত।
কোকিল, দোয়েল গানে গানে বাগানের পথে আনে
বসন্ত, পূর্ণিমা, তুমি, স্বাধীনতা, স্বাগত জানাও।
২২.১১.৯৬
প্রকৃত কবিতা
আমি কি খাইনি ভোরে এবং দুপুরে নীলিমার
রুটি আর খাইনি কি পেট পুরে নক্ষত্রের ভাত
চন্দিমার ঝোল দিয়ে? আঁধারের পুরনো মদিরা
করিনি আকণ্ঠ পান? কখনো চাঁদের নাও কাঁধে
বয়ে পথ চলি, কখনোবা সুরুজের খব কাছে
গিয়ে দগ্ধ হয়ে যাই আপাদমস্তক। সামুদ্রিক
হাঙরের সঙ্গে যুঝে রক্তাক্ত শরীরে খুঁজে পাই
একটি প্রবাল-দ্বীপ, যা চকিতে শূন্যে মিশে যায়।
তান্ত্রিকের মতো ক্ষণে ক্ষণে করি মন্ত্র উচ্চারণ
গহন অরণ্যে কিংবা পর্বত চূড়ায় মগ্নতায়
এবং সুফীর মতো নাচি জিকিরের ছন্দে আজো
সারারাত। এই সবকিছু কবিতারই জন্যে, জানি;
প্রেমিকা ও কবিতায় মানি না প্রভেদ। প্রিয়তমা
এখন অধরা নয়, দেবে নাকি ধরা প্রকৃত কবিতা?
প্রগতির পথে প্রতিক্ষণে
কৃতী সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন স্মরণে
যাই নি পায়রাবন্দে, তবুও বেগম রোকেয়ার
কবেকার শোকগ্রস্ত বাড়ির কঙ্কাল, ভিটেমাটি
এবং সেখানকার ধূলিকণা, লতাগুল্ম আর
লাউয়ের মাচান, ধানক্ষেত, কুয়োতলা, ছেঁড়া পাটি
বর্গচাষি, বাল্য বিয়ে-পড়ানো মৌলভী, ছমিরণ,
দিনভর খাটুনির ধকল-পোহানো কিশোরীর
খড়ের উপর ঘুম-ইত্যাদি দেখেছি, মোনাজাত,
তোমারই সৌজন্যে; সেই ঋণ স্বীকারে অকুণ্ঠ আমি।
কী করে ভুলব মাকড়া বুড়ো, তার চৌদ্দ বছরের
দীপ্ত বউ, হাওয়া বিবি এবং সুরমা নাম্নী এক
পরিণীতা বালিকার কথা? তুমি ছিলে বলে অবজ্ঞাত
তারা ঠাঁই পেলো ঝকঝকে ছাপার অক্ষরে। ছিলে
লাজুক, অথচ দৃঢ়চেতা, আদর্শে অটল আর
প্রগতির পথে প্রতিক্ষণ সংগ্রামী, নিঃশঙ্ক যাত্রী।
৩১.১.৯৬
প্রণয়ের সংজ্ঞা
বিশ্ববিদ্যালয়ে লগ্ন একজন মেদুর যুবক
ঝাঁ ঝাঁ এক দুপুরে আমার কাছে এসে সবিনয়ে
কিছুক্ষণ এটা সেটা বলে আমার নিকট থেকে
লাজনম্র স্বরে, যেন নিজের সঙ্গেই আলাপের
সূত্রপাত করে, জেনে নিতে চায় প্রণয়ের সংজ্ঞা
ঈষৎ গভীরভাবে। হরিচরণের অভিধান
বিশদ স্মরণ করি, গুণিজনদের তহবিল
উপুড় করেও শেষ অব্দি থেকে যাই নিরুত্তর।
যখন তোমার চোখে চোখ রেখে তন্ময় ডুবুরি
হই, হাত ছুঁয়ে নিজে বীণা হয়ে বেজে উঠি আর
তোমার কথার ছায়া চামর দোলায় হৃদপুরে,
তখন আমার খুব ইচ্ছে হয় জ্ঞানপিপাসু ঐ
বিদ্যার্থীকে ডেকে বলি, ভালোবাসা কাকে বলে যদি
জানতো চাও, মানবীর চোখের তুমি গভীর তাকাও।
২৭.১.৯৭