তোমাকেই ডেকে ডেকে
এখন তোমার ঘুম নিশীথের দিঘিতে নিটোল
পদ্ম আর তোমার নিদ্রিত যৌবনের পূর্ণিমায়
উদ্ভসিত বন্ধ ঘর। আমার চোখের পাতা জুড়ে
নেই আজ নিদ্রার কুসুম, জ্বালাধরা চোখ মেলে
কাটাই প্রহর, শুনি প্রতারক জ্যোৎস্নার প্রভাবে
স্তব্ধ নিসর্গকে অপ্রস্তুত করে আচানক কাক
ডেকে ওঠে। আমার খাতার পাতা অসমাপ্ত এক
চতুর্দশপদী বুকে নিয়ে জুড়ে দিয়েছে মাতম।
কখন যে ভাঙবে তোমার ঘুম পাবো নাকো টের,
যদি না জানাও টেলিফোনে; রাত পোশাকের ভাঁজে
ভাঁজে জমে স্বপ্নের ভগ্নাংশ। সেই কণাগুলি খুব
সন্তর্পণে পারব কি কুড়োতে বিহানে কোনো দিন
তোমার ঘুমের অন্তরালে, স্বপ্নে চিড় না ধরিয়ে?
তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি!
১৫.১.৯৬
তোমার গোলাপগুলি
তোমার গোলাপগুলি আমাকে দেখছে অপলক
অনুরাগে ফুলদানি থেকে। বুঝি ওরা প্রতিনিধি
তোমার; ফলত প্রতিক্ষণ অমন তাকিয়ে থাকে
কেবলি আমার দিকে। লক্ষ করে এই ঘরে বসে
কী করছি আমি, কোন্ বই পড়ি, কিছু লিখি কিনা,
বুঝে নিতে চায় আমি তোমার স্মরণে কতটুকু
মগ্ন আছি, তোমার সুন্দর মুখ আমার দু’ চোখে
পরিস্ফুট কতখানি, দেখে নেয় দর্জির দৃষ্টিতে।
যখন ফিরবে তুমি ভ্রমণের শেষে এ শহরে,
তখন গোলাপগুলি থাকবে না। ওরা মরে যাবে,
ঝরে যাবে; সৌন্দর্য বড়োই ক্ষণজীবী, আমি এই
ক’টি দিন সুপ্রিয় তোমাকে ভুলে ছিলাম অথবা
ব্যাকুল ছিলাম খুব তোমার জন্যেই। তার কোনো
বিবরণ কখনো পাবে না তুমি প্রতিনিধিহীনা!
১০.২.৯৬
তোমার জন্যেই বাঁচি
একান্ত আমার করে পাই না কখনো তাকে, তার
বৃত্তে আছে বহু কুশীলব, যারা ওর সিংহভাগ
সময় ওড়ায়, সহজে সে কলরবে সানুরাগ
মেতে থাকে। ফাঁপা, ফাঁকা, রঙচঙে সামাজিকতার
নানা ঢঙ পছন্দ করে সে; আমি স্বার্থপরতার
আগুনে বৃথাই পুড়ি, দেখাতে পারি না পোড়া দাগ
অন্তরের কাউকেই, দহনকে হৃদয়ের ফাগ
ভেবে এমন কি সে-ও পরিহাসে জিভে দেয় ধার।
মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় একটি ফুৎকারে এই খেলা
পণ্ড করে দিই, ছিঁড়ে ফেলি মেকি জগতের জাল,
অথবা চুকিয়ে দিই জীবনের দেনা অগোচরে
বিষে কিংবা একটি ছোরায়। সরোবরে ছুঁড়ে ঢেলা
কাটাবো সময় না কি শক্ত হাতে সরিয়ে জঞ্জাল
তোমার জন্যেই বাঁচি বলে থেকে যাবো এ শহরে?
৩০.৭.৯৬
তোমার ভয়ের কথা
তোমার ভয়ের কথা বলেছ আমাকে বহুবার
কখনো গল্পের ছলে, কখনো বা ভয়ে কেঁপে উঠে;
হঠাৎ নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দ্যাখো ছুটে
আসে শত সরীসৃপ তোমার দিকেই দুর্নিবার
বেগে, ভীতসন্ত্রস্ত তোমার কাছে সে বেডকভার
অজগর হয়ে যায় এবং দর্পণে ওঠে ফুটে
খুব ভয়ঙ্কর মুখ কারো, যেন সে সম্ভ্রম লুটে
নেবে কিংবা খুনী রূপে চকিতে ছোরায় দেবে ধার।
রাত্তিরে তোমাকে ছেড়ে যায় না কখনো ভয়, তাই
ঘাটতি তোমার ঘুমে। আমার মৃত্যুর দিন তুমি
আসবে না দেখতে আমার লাশ, পাছে মৃত মুখ
আমার তোমার রাতে হানা দেয়, ভীতিকর ছাই
ওড়ায় ঘুমের ঘরে, অথচ তোমার মনোভূমি
সে মুখের আলোয় হয়েছে নিত্যদিন গুলরুখ।
১৩.৭.৯৬
তোমার যাবার আগে
সব কিছু ঠিকঠাক, আজই তুমি যাবে দ্বিপ্রহরে
বায়ুযানে; আমার অবুঝ মনোকষ্ট, দীর্ঘশ্বাস
অথবা চোখের জল ক্ষণে ক্ষণে খুসখুসে কাশ
করবে না পথ অবরোধ আর কবিতার ঘরে
হবে না এখন হরতাল। দিয়েছি বারণ করে
সবাইকে, আমার না-লেখা কবিতারা আজ নীল
পাখি হয়ে উড়বে তোমার খুব কাছে। ঝিলমিল
করলে কোথাও কিছু ভেবো আমার আনন্দ ঝরে।
আজ কবিতার খাতাটিকে সাক্ষী রেখে দিচ্ছি কথা-
তোমার যাবার আগে আর পরে মন খারাপের
ভেলা ভাসবে না কোনোক্রমে, জেনো কাটাবো সময়
গান শুনে ক্যাসেট প্লেয়ারে, আড্ডা দিয়ে। মনোব্যথা
মেঘদলে, পাখির ডানায় হবে নীল, তুমি ফের
ফিরে এসে দেখবে আমার মুখ কত দীপ্ত হয়।
৮.৩.৯৬
দীপ্র ধ্বনি তুলি
নির্জন গুহায় থাকি হাঁটু মুড়ে, কখনো নিদ্রায়
অভিভূত। আলো নেই কোনোখানে, বেরুতে পারি না,
পাছে ওরা শিকারি কুকুরগুলো আমার পেছনে
ভীষণ লেলিয়ে দেয়। আমার রক্তের ধারা বয়ে
গেলে ওরা হো হো হেসে আর কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে
দশদিক আনন্দ ধ্বনিতে ভরে দেবে। পড়ে আছি
এক কোণে অসহায়; ভাবনার ভেলা পারাপার
করে এই দুঃখিত আমাকে। গুহাগাত্রে হিজিবিজি
ছায়াগুলো সঙ্গ দেয়। অন্ধকারের চাঙড় ভেঙে
কেবলি পড়তে থাকে আমার উপর; চেষ্টাহীন
থাকবো কী পড়ে সর্বক্ষণ? যতই আলোর দিকে
যেতে চাই, ততই আঁধার আসে ব্যেপে, যেন ক্রূর
বাইসন আমাকে ধারালো শিঙে গেঁথে নিয়ে ছোটে
দিগ্ধিদিক; আমি আলো, আলো বলে দীপ্র ধ্বনি তুলি।
দেখা হওয়া না-হওয়া
দেখা হওয়া না-হওয়ার মধ্যে কেন জয় পরাজয়
সেদিন আনলে টেনে আচানক? কার জিৎ আর
কার হার হলো বলে ধরে নিলে মনের গহনে?
আমিতো ভাবিনি এইমতো কস্মিনকালেও, তাই
দ্রুত বিস্ময়ের পাকে জড়িয়ে গেলাম; দু’টি দিন
প্রার্থনা করেও আমি পাইনি তোমার কাছে, ফলে
আমার পড়ার ঘর শীতল কফিন, পড়ে আছে
লেখার টেবিলে ম্লান, শোকগ্রস্ত কলম আমার।
উড়ন্ত গালিচা যদি থাকতো দখলে, তবে আজ
চোখের পলকে উড়ে যেতাম তোমার নিকেতনে।
সইতে হতো না প্যাঁচা আর বাদুড়ের কৃষ্ণপক্ষ
উপহাস ক্ষণে ক্ষণে; নিঃসঙ্গতা আমাকে এখন
সঙ্গ দেয়, হাওয়া আলাপের সূত্রপাত করে, ঘরে
অকস্মাৎ নড়ে ওঠে অতিকায় মত্ত সরীসৃপ।
১৫.১.৯৬