- বইয়ের নামঃ তোমাকেই ডেকে ডেকে রক্তচক্ষু কোকিল হয়েছি
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অঙ্গুরি এসেছ তুমি
অঙ্গুরি এসেছ তুমি ফিরে অজ্ঞাতবাসের পর
আমার এ ঘরে আজ। বহুদিন ছিলে অন্ধকারে
বস্তুত গা ঢাকা দিয়ে; তোমাকে ভেবেছি বারে বারে,
দেখেছি তোমার স্বপ্ন কত, ইতিমধ্যে বহু ঝড়
ঝাপ্টা গ্যাছে, বিস্মৃতির এক্কা দোক্কা তোমার খবর
সহজে ফেলেছে মুছে কখনো সখনো। কোন্ তারে
কখন লেগেছে সুর পুনরায় কোমল গান্ধারে,
আমিতো পাইনি টের; ছিল খুব হৃদয়ের জ্বর!
হে অঙ্গুরি, তোমার শরীরে লতাগুল্ম, বুনো ঘাস,
গৃহত্যাগী যুবকের স্বেদ, ধুলো ইত্যাদির ঘ্রাণ
লেগে আছে, সবচেয়ে বেশি আছে ভালোবাসবার
সাধ ও ক্ষমতা যা সহজে মুমূর্ষুকে পারে প্রাণ-
শক্তি ধার দিতে আর লহমায় দূরের আকাশ
বুকে এনে স্বপ্ন দেখাতেও পারে ঘর বাঁধবার।
১৬.৫.৯৬
অনেক শতাব্দী জুড়ে
অনেক শতাব্দী জুড়ে প্রতিক্ষণ আমার হৃদয়
বস্তুত স্পন্দিত হচ্ছে তোমার জন্যেই। বিষণ্নতা
প্রত্যহ আমাকে ঘাট থেকে ঘাটান্তরে নানা কথা
জপিয়েছে, চেয়েছে ফেলতে মুছে ধ্যানের সময়,
যাতে ভুলে থাকি তোমাকেই, তবু আমি সুনিশ্চয়
ভ্রমের গোলকধাঁধা আর বহুরূপী বিরূপতা
উজিয়ে বিস্ময়ে দেখি গোধূলিতে তুমি অবনতা
বঙ্গোপসাগর তীরে আমার জন্যেই, মনে হয়।
কখনো মহেঞ্জোদারো অথবা কখনো মথুরায়
ছিলে, পায়ে মল বেজে উঠতো মধুর নিশাকালে,
কখনো সমরখন্দে, কখনো বা বোখারায় জানি
সুরতের রোশ্নি তোমার শায়েরের তারানায়
ঝলসাতো বারবার। কখনো বাংলার মত্ত খালে
বাইতে মহুয়ারূপে আমারই উদ্দেশে তরীখানি।
৮.৯.৯৬
অশনি সঙ্কেত
চাঁদের আংশিক ক্ষয় আর নক্ষত্রের ত্রস্তরূপ
দেখে বুড়ো শিরিষের ডালে রাতজাগা প্যাঁচা বলে-
‘কবি আর বুদ্ধিজীবী হননের কাল ফের শুরু
হলো বুঝি! জেনেছি, সদর স্ট্রিটে ক’জন সন্ত্রাসী
ক্রোধে জ্বলে একজন দীপ্ত বুদ্ধিজীবীকে শাসায়
সতেজ জীবনকে প্রাণহীন ধূলায় লুটিয়ে দেবে
বলে ক্ষিপ্র বুলেটে, আরেকজন অপহৃত হতে
হতে কোনোমতে জীবনের কণ্ঠলগ্ন থেকে যান।
কী কসুর তাঁদের? বস্তুত যারা অন্যের ভিটায়
প্রায়শ চড়ায় ঘুঘু, ছড়ায় আন্ধার চতুর্দিকে,
শহরকে জঙ্গল বানাতে চায় ক্রূরতায় মজে,
ওদের বিপক্ষে দৃঢ়চিত্ত কবি আর বুদ্ধিজীবী
আমজনতাকে বাগানের, অন্ধ কুয়ো নয়, নীল
সমুদ্রের স্বপ্ন আর ঠিক পথ দেখান সর্বদা।
৮.২.৯৭
আজ কার কাছে
আজ কার কাছে উন্মোচন করি আমার হৃদয়?
এই যে বাড়ির কাছে গাছপালা দাঁড়ানো সেগুলো
এখন সবুজ মনে হচ্ছে না তেমন, আকাশের
নীলিমা, নক্ষত্র আকর্ষণহারা, যে গায়ক পাখি
রেলিঙে বসলো এসে তার শিস কেমন বেসুরো
লাগে আর মহান দান্তের কাব্যগ্রন্থ ‘নরক’-এর
মাত্র দু’তিনটি পঙ্ক্তি পড়ার পরেই রেখে দিই,
রবীন্দ্রনাথের গানও আন্দোলিত করে না আমাকে।
এ শহর থেকে তুমি বিদায় নেওয়ার পর এই
অত্যন্ত করুণ হাল হয়েছে আমার, প্রিয়তমা।
হৈ-হৈ বইমেলা, মানুষের ভিড়, আড্ডা, মদ্যপান-
কিছুই লাগে না ভালো। একা একা থাকি, নিজেকেই
ছন্নছাড়া প্রেতপ্রায় মনে হয়। নিভৃতে হৃদয়
খুঁড়ি, ঘুরি, খুঁজি আমাদের অন্তরঙ্গ ক্ষণগুলি।
১২.২.৯৬
আন্ধারে হারিয়ে পথ
আন্ধারে হারিয়ে পথ বেদিশা ঘুরেছি কতকাল
জটিল অরণ্যে, গণকবরের বিরানায়; খাদে
আর চোরাবালিতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যেতে
যেতে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছি। রক্তপায়ী বাদুড়ের
ডানার আঘাতে, চিতাবাঘের থাবার হামলায়
সন্ত্রস্ত ছিলাম বহুকাল। কখনো কখনো পথ
খোঁজার উদ্যম লুপ্ত হয়েছে, মোহিনী রূপে কত
ডাকিনী নিয়েছে ডেকে গুহায় সংহারে অবিচল।
হতাশায় চুল ছিঁড়ে, মাথা কুটে শ্মশান ঘাটের
কাছে, গোরস্তানে পথক্লেশে পরিশ্রান্ত ঘুমিয়েছি
সর্পিনীর ফণার ছায়ায়। অকস্মাৎ তুমি এসে
আমাকে প্রকৃত পথ দেখিয়ে সম্মুখে নিয়ে গিয়ে
বললে, দ্যাখো, আমাদের গন্তব্যের স্বর্ণচূড়া কাছে
এসে গ্যাছে, এইতো অদূরে বেজে ওঠে নহবৎ।
১০.২.৯৬
আবার নিভৃতে
আবার নিভৃতে বসন্তকে কী ব্যাকুল আলিঙ্গন
করলাম রাত্রির প্রথম যামে; জ্যোৎস্না ঝলসিত
সরোবরে স্নিগ্ধতায় অবগাহনের অনুপম
মুগ্ধতা আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল অলকনন্দার
তটে যেন মন্ত্রবলে। পুনরায় বাঁচার আনন্দে
আশ্চর্য গা ঝাড়া দিয়ে উঠি, গীতবিতানের পাতা
খুলে বসি, গীতধারা বয় শিরায় শিরায় আর
ওষ্ঠ সিক্ত হয় ক্ষণে ক্ষণে পুলকের মদিনায়।
এ প্রখর শীতে অনুভব করি আমার শরীরে
গজায় সবুজ পাতা, রঙ-বেরঙের ফুল ফোটে
অকস্মাৎ বহুদিন পর। সে, রূপসী সাহসিকা,
আমাকে জাগিয়ে তোলে শোকগ্রস্ত ভস্মস্তূপ থেকে
কী সহজে; করিনি শিকার কুড়া বন-বনান্তরে,
তবুও পেয়েছি আমি মলুয়াকে কদমতলায়!
২১.৬.৯৬
আমাকে অস্থির করে
আমাকে অস্থির করে কী লাভ তোমার, প্রিয়তমা?
এই যে আমার নিদ্রা নির্বাসিত মাঝে-মাঝে, দম
বন্ধ হয়ে আসে কোনো কোনো দিন, অকস্মাৎ যম
করে উপদ্রব, চতুর্দিকে খুব গাঢ় হয় অমা
তাতে তুমি ভাসো কি সুখের সরোবরে? করো ক্ষমা
আমার কসুর হলে অথবা স্খলন হলে কম
কিংবা বেশি; তুমি তো ভালোই জানো, এই বেরহম,
অশুদ্ধ সময়ে শুধু পতনের কালি হয় জমা!
নক্ষত্র, সজীব নদী, গাছের পত্রালি জুড়ে থাকে
অস্থিরতা, কখনো তা চোখে পড়ে কখনো-পড়ে না;
বস্তুত আমার সিংহভাগ ছটফটি আড়ালেই
থেকে যায়। কবিতা লেখার কালে যে-ঝড় আমাকে
ধ্বস্ত করে, তারও বেশি ছন্নছাড়া প্রাণের এরেনা
আমার তোমার কষ্টে। মনে আজ প্রসন্নতা নেই।
৬.৭.৯৬