Site icon BnBoi.Com

গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান – শামসুর রাহমান

গোরস্থানে কোকিলের করুণ আহবান - শামসুর রাহমান

অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া

গভীর রাতে অগ্নিবর্ণ এক ঘোড়া উন্মুক্ত প্রান্তরে বেধড়ক
দৌড়ুতে থাকে এদিক সেদিক। কেউ দেখুক আর না-ই দেখুক,
সেদিকে বন্দুমাত্র দৃষ্টি নেই তার। তার এই দৌড়ে ছন্দ আছে কি
নেই, এ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। ছুটতে তো ছুটছেই।

কখন যে সে নিখুঁত চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছে মোহন
এক বাগানের পাশে, সেদিকে ওর খেয়াল নেই। এই ঘোরাতেই
সে আনন্দের ঝিলিক উপভোগ করছে প্রতিটি মুহূর্তে।
সে কি ইতিমধ্যে ক্লান্তির কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েনি?
ওর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কি ব্যথা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে না?
সে কি এই মুহূর্তেই স্বেদাক্ত শরীরে লুটিয়ে পড়বে না ধুলোয়?

না, তার তেজী আকাঙ্ক্ষাকে এখনও ম্লান করতে পারেনি
এই শ্রম। যতই স্বেদ ঝরুক ওর শরীর থেকে, ক্লান্তি যতই
থাবা সবাক ওর সত্তায়, দমে কুঁকড়ে যাওয়ার পাত্র সে
নয়। এখনও ওর শরীরে প্রতিটি রন্ধ্রে ঘোরার বাসনা চঞ্চল।

অন্ধকার নয়, আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের সঞ্জীবনী আলো ঘোড়াকে
টগবগে করে তোলে আরও। মৃত্তিকাবিহারী অশ্ব মুহূর্তে
চলে যায় আসমানে তারার মেলায়। সেখানে মহানন্দে
বেশ কিছুক্ষণ উড়ে বেড়ানোর পর মাটির টান তাকে নিচে
নেমে আসার জন্যে উতলা করে তোলে। টগবগে ঘোড়া মর্ত্যে নেমে আসে।
১২.০৪.২০০৪

 অচেনা নয়

নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি
করতে পারি কি এই বয়সেও? যদি
বলি, দু’তিনটি
ভাষার কতক বাক্য অর্থসমেত বলতে পারি,
লিখতেও পারি, মিথ্যা উক্তি হবে না তা। সমাজের
কোনও কোনও স্তরে সম্মানের কিছু উপঢৌকন মিলবে বটে।

অথচ আমার প্রতিবেশী না হ’লেও
অচেনাও নয় যে পাখিটা
আমার নিঝুম বারান্দায় এসে বসে, চিঁড়া মুড়ি
দিলে মুখে তুলে নেয়, উড়ে চলে যায়
আমার অজানা কোনও জায়গায়। গায়ক পাখির
গীতসুধা পান করে তৃপ্ত হই, যদিও সুরের ভাষা নেই।

অথচ করোনি মাথা নত

(হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে)

তিমির-বিলাসী যারা তারা অন্ধকারে মাথা গুঁজে
থাকে সর্বক্ষণ। তুমি বন্ধু, আলোপ্রিয়,-
বুঝি তাই জীবনের প্রায়
সকল প্রহর কাটিয়েছো জ্ঞান আহরণে আর
বিভিন্ন খাতার পাতা সাজিয়েছো সৃজন-মুখর
পঙ্‌ক্তিমালা দিয়ে। এভাবেই কেটে গেছে কত না বিনিদ্র রাত।

অথচ করোনি অবহেলা কোনওদিন ছাত্রদের,
দিয়েছো উজাড় ক’রে জ্ঞানের ভাণ্ডার। ওরা সব
তোমার উৎসুক, প্রিয় শিক্ষার্থী সবাই নিবেদন
করেছে সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। ধন্য তুমি; জানলে না
যদিও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজপথে, চায়ের দোকানে,
এবং পণ্ডিতদের প্রতিটি আসরে, কবি-সংঘে,
গ্রামে-গঞ্জে, উদ্দীপ্ত মিছিলে আজ হচ্ছে উচ্চারিত
তোমার হীরার মতো জ্বলজ্বলে নাম। এই নাম
স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে
এখন তো প্রস্ফুটিত দেশ-দেশান্তরে।

তুমি যে অম্লান অবদান রেখেছো গচ্ছিত
জাতির ভাণ্ডারে তার বিনিময়ে কতিপয়
সন্ত্রাসীর দাগাবাজ অস্ত্রাঘাতে হয়েছো ভীষণ জর্জরিত
অথচ করোনি মাথা নত, রেখেছো উন্নত সর্বক্ষণ।

তোমার সুপ্রিয়া কোহিনূর, জীবন সঙ্গিনী, কন্যাদ্বয় মৌলি,
স্মিতা, পুত্র অনন্য এখন
তোমাকে হারিয়ে দিশেহারা; শূন্যতার নিপীড়নে
দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে দিচ্ছে বারবার। হায়, আজ
তাদের প্রশস্ত সেই তোমার বুকেই টেনে নাও। অতীতের
ধরনে স্নেহের জ্যোৎস্না ওদের অস্তিত্বে মেখে দাও, দাও আজও।
দেবে নাকি মেঘ থেকে কিংবা আলগোছে
গোধূলির অপসৃয়মাণ আভা থেকে চুম্বনের ছাপটুকু?
১৭.০৮.২০০৪

অন্ধকারের কেল্লা হবে বিলীন

তা’হলে আমি কি আমার একালা ছেড়ে একলা
কোথাও চলে যাবো? বহুদূরে
খোলা মাঠে কিংবা উপবনে? গাছপালা দেখে,
পাখির গান শুনে কাটিয়ে দেবো সারা বেলা?

এভাবেই কি মানুষের মুখ না দেখে প্রকৃতির
সৌন্দর্যে মজে থাকতে পারবো ? কী ক’রে আমার
ছয় বছরের দৌহিত্রীর মুখ না দেখে থাকবো
বহুকাল? না, এই শহরের ভিড়ভাট্রা, চুরি-চামারি, ডাকাতি
যতই হোক এই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও।
ভুলেও কোনও আস্তানা বাঁধবো না কখনও।

কখনও কখনও ক্লান্তির সবগুলো নাছোড়
আঙুল চেপে ধরে গলা রাত দুপুরে,
যখন আমি তখনকার মতো লেখার পাট চুকিয়ে তিমিরে
শয্যায় আশ্রয় খুঁজি। দম বন্ধ হয়ে আসতে
চায়; উঠে বসে স্যুইচবোর্ড হাতড়াতে থাকি। স্যুইচ
চকিতে আঙুলের দখলে আসে, আলোকিত হয় কামরা।

কে বা কারা আমার পথে বিস্তর কাঁটা বিছিয়ে
আমাকে রক্তাক্ত দেখে বিকট
ভঙ্গিতে নাচতে থাকে, ছড়া কাটে, থুতু ছিটোয়
আমার দিকে। নিশ্চুপ আমি হেঁটে যেতে থাকি উঁচিয়ে
মাথা অন্য কোনওখানে। অন্ধকারের কেল্লা নিশ্চিত
একদিন সুশীল, সুগঠিত, বিশাল মিছিলের স্লোগানে হবে বিলীন।
২২.১০.২০০৪

অপরূপ হাত

প্রিয় এই শহরের কোনও পথ দিয়ে
হেঁটে যাই যখন একাকী
ভোরবেলা হাওয়ার আদর উপভোগ করতে করতে আর
বিরান বাগান ব’লে মনে হয় পরিবেশ,
আর কেন যেন হাহাকার হু হু ক’রে জেগে ওঠে
বারবার; নিজেকে কবরস্তানে অনুভব করি।

কিছুক্ষণ পরে রোদ শিশুর হাসির মতো জেগে
উঠে চুমো খায় সঙ্গীহীন
এই পথচ্চারীটিকে। ভাবনার গোরস্তান দ্রুত উবে যায়,
মানুষের সাড়া জাগে নানা দিকে আর
কার যেন জ্বলজ্বলে ডাক আমাকে আচ্ছন্ন করে।
এদিক সেদিক দৃষ্টি মেলে দিই আর কান পাতি।

না, কেউ আমাকে ডাকছে না কোনও গলি
অথবা কাছের চা-খানায়
আপ্যায়ন করার উদ্দেশে। তবু কেন মনে হয়
কে যেন ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে আমন্ত্রণ ক্রমাগত
জানাচ্ছে আমাকে। তাকে অবহেলা করে
চলে যাওয়া অনুচিত হবে ব’লে সেদিকে বাড়াই পদযুগ।

হায়, এগোতেই দৃষ্টি থেকে ঘরবাড়ি, মুক্ত পার্ক
এবং দোকানপাট বেবাক উধাও
চতুর্দিকে বালি, শুধু বালি আর আমি ক্রমাগত
ডুবে যাচ্ছি বড় দ্রুত বালির ভেতরে। ক্ষণকাল
পরে যেন কার, সম্ভবত কোনও কল্যাণ কামিনী
তার অপরূপ হাতে মুক্ত করেন আমাকে অনাবিল হেসে।
২৯.১০.২০০৪

আকাশে অনেক মুখ

এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার
প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে
গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের
বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা।

এই তো নিজেকে আমি হট, পাথরের
স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখে আশেপাশে,
সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও
স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা।

আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে
আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা
জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে
একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই।

আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দু’টি পাতা
গায়েব হ’লেও অবশিষ্ট বেশ ক’টি পাতা জুড়ে
রয়েছে কবিতা সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য
পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়।

কখন যে রাত ওর কোমল শরীর
নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের
পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে
জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।
১৪.০১.২০০৫

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, তোমাকে

এই যে এখন বসে পুরনো চেয়ারে
এবং ঈষৎ ঝুঁকে টেবিলে লিখতে শুরু ক’রে
মনে গাছপালা, নদী, জ্যোৎস্নাস্নাত ক্ষেত
জেগে ওঠে বয়েসী আমার কিয়দ্দূরে। মাঝে মাঝে
পাখি গান গেয়ে ওঠে, জ্যোৎস্না নৃত্যপরায়ণ হয়।
এমন সময়ে মনে পড়লো তোমার কথা হে বন্ধু, যে-তুমি
সুদূর বিদেশে একা শীতার্ত রাত্তিরে
পড়ছো জরুরি বই অথবা লিখছো স্বদেশের
পত্রিকার প্রয়োজনে নিয়মিত তুখোড় কলাম,
যেগুলোর সাড়া দ্রুত পড়ছে পাঠক-পাঠিকার মজলিশে।

হে বন্ধু, তোমার কখনও কি মধ্যরাতে অনুতাপ
জেগে ওঠে সাহিত্য-রচনা অবহেলিত হয়েছে
বড় বেশি ব’লে? না কি নিজেকে প্রবোধ দাও কাগজে কলম
ছোঁয়াবার কালে দেশবাসীদের জাগাবার কাজ
অবহেলা করা অনুচিত ভেবে লিখছো নিয়ত?

শোনো বন্ধু, যে যাই বলুক, রাশি রাশি
লেখক বিস্মৃত হবে ভাবী কালে, অথচ তোমার নাম নিশ্চিত ঘুরবে
গুণীজন আর জনতার মুখে যুগে যুগে। এই সত্য
উজ্জ্বল তোমার কাছে, বুঝি তাই তুমি প্রায়শই
চালাও কলম সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে।

জানি বন্ধু, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মৃতিপটে
রাখবে সাজিয়ে ভালোবেসে, শ্রদ্ধাভরে
তোমার অক্ষয় নাম, গাইবে তোমার গান যুগ-যুগান্তর-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?’ বন্ধু, তোমাকেও
ভুলবে না প্রকৃত বাঙালি কোনও কালে।

আমি আর আমি নই

মধ্যরাতে আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখি-
আমার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
এগোচ্ছে দেয়ালের দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত আমি
চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ। আবার
চোখ মেলতেই বিচ্ছিন্ন হাতকে দেখি দেয়াল আর
ছাদ ভ্রমণের তোফা জায়গা ঠাউরে নিয়েছে।

বেহাত আমি কাকে ডাকবো গহন রাতে?
চেঁচাতে গিয়ে বেজায় নির্বাক হয়ে শুধু
পড়ে থাকি বিছানায়। হঠাৎ মনে হয়, এ কি!
আমার নিজের ভাষা, অন্য যে-ভাষা
জানা আছে-সবই বিস্মৃতির তিমিরে
নিমজ্জিত। কিছু বলতে গেলে জাগছে
অবোধ্য শব্দের বেখাপ্পা কিছু ধ্বনি। আমাকে
নিয়ে এ কেমন খেলা চলছে? চৌদিকে আজব
সব ছবি ভাসছে, ডুবছে বারবার। দেয়াল
ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিক। আমি আর আমি নই।

আমাকে ঠুকরে খাচ্ছে কয়েকটি আজব
মিশকালো কাক। কখন থেকে পড়ে আছি
এঁদো কাদায়, বলা দায়। আমাকে এখানে এনেছে
কারা-কেউ কি বলে দেবে? অস্থিরতা চেপে ধরেছে!
বীভৎস শব্দ সব ধেয়ে আসছে
চতুর্দিক থেকে। কারা যেন আমার শরীর থেকে
খসিয়ে নিচ্ছে মাংস, কতিপয় ক্ষধার্ত শকুন
সোৎসাহে ধেয়ে আসছে নেমে আমার দিকে।

এ কি! আমার শরীর থেকে মাথা
বিচ্ছিন্ন হয়ে কিয়দ্দূরে বিষণ্ন এক
বটগাছের প্রায় শরীর ছুঁয়ে নাচতে
শুরু করে। অথচ আমার শ্বাসপ্রশ্বাস
বইছে রীতিমতো। উপরন্তু আমার মনে
অসমাপ্ত কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি
গজিয়ে উঠলো গাছের সতেজ পাতার মতো
স্বচ্ছন্দ, অনাবিল। পাশেই ধ্বনিত পাখির গান।
০৪.০৯.২০০৪

আমি কোথায় এসে পড়েছি

আমার জীবন কখন যে আচমকা
মুছে যাবে, জানা নেই। হোক না যখনই,
দৈবক্রমে যদি দুনিয়ায় ফিরে আসি
হাজার বছর পর শ্যামলীতে, তখন কি খুঁজে
পাবো এই আমার নিজের বাড়িটিকে? কিছুতেই
পড়বে না দৃষ্টিতে বিনীত সেই বাড়ি। বহুতল
শৌখিন মহল কোনও করবে বিরাজ সেই স্থানে। হয়তো-বা
আগেকার চেনা জায়গাটা, মাথা কুটে মরলেও, চিনবো না।

আমার নিজের বংশধর কেউ চিনে নিয়ে এই
আমাকে স্বাগত
জানিয়ে শ্রদ্ধাত আভা ছড়িয়ে সানন্দে বসাবে না
অপরূপ আসনে এবং
আমার দু’চোখ ভিজে যাবে কি তখন ঠিক মানুষের
মতো নয়, অথচ মানব-সন্তানের
বিকৃত ধরনের গড়ে-ওঠা জীব যেন নিয়মিত
ওঠে বসে, হাঁটে আর দরজা, জানালা বন্ধ করে, খুলে দেয়

সম্ভবত বিলুপ্ত আমার বংশধর। বৃথা আমি
উঠবো সন্ধানে মেতে তাদের কাউকে
এবং হাঁটবো ডানে বামে। প্রশ কি করবো
কখনও সখনও পথচারীদের? নিরুত্তর চলে যাবে ওরা
যে যার গন্তব্যে। প্রকৃতই আছে কি গন্তব্য কোনও?
‘নেই, নেই’ ধ্বনি শুধু কানে এসে ঝরে যায় নির্বাক ধুলায়।

এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখি শুধু পাথরের
ঘরবাড়ি, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, হায়,
নেই কোনও গাছ-গাছালির
এতটুকু চিহ্ন কোনওখানে। মাঝে মাঝে
চোখে পড়ে পাথরের মূর্তি কিছু সাজানো, গোছানো;
দোকানে পসরা ঢের, অথচ কোথাও এক রত্তি ফুল নেই।

এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? বৃষ্টিধারা
কস্মিনকালেও স্নান করিয়ে দেয় না
এই শহরকে, শুধু ধু ধু তাপে বেঁচে আছে এই
নগরের বাসিন্দারা সব, পুতুলের মতো ওরা
পারে না ওঠাতে মাথা কিছুতেই মহীয়ান
লৌহমানবের প্রিয় হুকুমবরদারদের ত্রাসে
দিনরাত। বেহেস্তে করছে বসবাস, সদা মেনে নিতে হয়।

মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি সারাটা শরীর
ঘামে ভেজা, রাতের স্বপ্নের দানে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ি।
১৪.০৩.২০০৪

 আলাদা এক রাজ্য

এই যে কবি ভর দুপুরে
হন্তদন্ত হয়ে এখন যাচ্ছো কোথায়
কোন্‌ ঠিকানা লক্ষ্য ক’রে? উশকো খুশকো
ঢেউ-খেলানো লম্বা চুলের নিচে আছে
মস্ত দামি মগজ বটে, সেখানে এক ফুল-বাগানে
গানের পাখি সৃষ্টি করে সুরের আলো।

হায়রে কবি, ধুলোয় তোমার
পাঞ্জাবি আর পায়জামাটা ধূসর হলো, তবু হাঁটা
থামছে না যে। আর কতটা পথ তোমাকে হাঁটতে হবে?
দুপুরটি কি বিকেল হবে? নাকি কালো
সন্ধ্যা হয়ে ভেঙচি কেটে ভয় দেখাবে ক্লান্ত এই
পথচারীকে! কবি তুমি পথ হারালে বেলা শেষে?

পথ হারালে যাবে কোথায় এ শহরে
আলোবিহীন কোন্‌ অজানা আস্তানেতে?
কেউ কি তোমার হাতটি ধ’রে নিয়ে যাবে
শান্তিময়ী কারও কাছে, যার মোহিনী ছোঁয়ায় তুমি
ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাবে ? কবি তোমার
মনে তখন ফুলের মতো পদ্য কোনও উঠবে ফুটে।

এইতো দ্যাখো কবি, তোমার কল্পনাকে ধনী ক’রে
চতুর্দিকে আঁধার ছিঁড়ে জ্বলে ওঠে হাজার বাতি,
এখন তুমি এই শহরে রাজা বটে। হাতে একটি
কলম পেলে আলাদা এক রাজ্য জানি উঠবে গড়ে।
২৯.০১.২০০৪

ঈর্ষা-বিছা

তোমার সঙ্গে দেখা হলো কোন্‌ দশকে ?
নাকি সুদূর ধূসর কোনও ভিন শতকে ?
তখন তুমি এই আমাকে চিনতে পেরেছিলে কি ?
আমি তোমায় চিনতে পেরে হ্রদের দিএক গিয়েছিলাম।

কিন্তু তুমি অচেনা এক যুবার সাথে
গল্পে মেতে ছিল বটে। আমি তোমার
দৃষ্টিপথে পড়িনি যে, বুঝতে আমার
হয়নি কষ্ট। হয়তো খানিক চিন্‌তে পেরে
ইচ্ছে করেই অবহেলা করেছিলে। এখন কিছু
পুষ্প জানি ঝরেছিলো মাটির বুকে।

আচ্ছা তুমি এই আমাকে এমন ঝাঁ ঝাঁ
অবহেলা করলে কেন ? না হয় আমি
ক্ষয়ে গেছি কালের চড়ে, কিন্তু আমার
মন এখনও সজীব কোনও ফুলের মতোই
রয়ে গেছে। এই তো আমি তোমায় দেখে
অনেক পরে হয়ে গেছি আবার যুবা সন্ধ্যা রাতে!

কিন্তু তুমি এই আমাকে রাখলে দূরে
হেলায় ঠেলে। মেতে আছো যুবার সঙ্গে
হ্রদের ধারে। জানি না কোন্‌ সুখের টানে
যাচ্ছো ভেসে! ঈর্ষা-বিছা আমায় জ্বালায় ক্ষণে ক্ষণে!
০৭.০২.২০০৪

উৎফুল্ল পূর্ণিমা যখন প্রখর অমাবস্যা

এই যে দেখছি আকাশ, পায়ের তলার
সোঁদা মাটি, বাতাসের গাছের
সবুজ পাতার কম্পন ক্ষণে ক্ষণে, পাখির
উড়ে এসে বসা পাশের বাড়ির উন্মোচিত ছাদে,
কিয়দ্দূরে একজন পথিকের হেঁটে-যাওয়া সবই
নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে, সত্যি বলতে কি,
বিশিষ্ট করে তুলেছে, যদিও এই গলিতে
তেমন কোনও আয়োজন নেই উৎসবের।

তা’হলে কেন মনে এই বুড়ো সুড়ো আমার অন্তরে
এই অবেলায় ফুটেছে নানা সুগন্ধি ফুল,
কেন সত্তা-নাচানো গানের সুর প্রস্ফুটিত?
কেন তিনজন বয়েসী ব্যক্তি
হাত ধরাধরি করে গাইছেন পুরনো দিনের বিস্মৃত
এক গান। আকাশের বঙ্কিম চাঁদ ডেকে আনে নক্ষত্রদের।

এই আমি কিছুক্ষণ আগেও নববর্ষের আহ্বান,
সত্যি বলতে কি, শুনতে পাইনি। তিনজন বুড়োর
মিলিত নৃত্য আমাকে
চকিতে উৎসবে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে
ভুলিয়ে দিলো বাস্তবের নির্দয় প্রহার এবং
সমাজের কাণ্ডারিদের প্রতারণা, ভ্রূকুটি,
হঠাৎ মনে হলো, আকাশের উৎফুল্ল পূর্ণিমা
প্রখর অমাবস্যা হয়ে আমাদের ভীষণ কামড়াতে থাকে।
১৩.০৪.২০০৪

এ কার স্মরণসভা

সত্যি বলতে কী বেশ কিছুদিন থেকে
রাতে ঠিক মতো
ঘুমোতে পারিনে। বালিশে
মাথা রাখলেই কী সব আজব
ছবি ভেসে ওঠে চোখের সম্মুখে,
বিভিন্ন হাতিয়ার নাচতে থাকে
আমার চারদিকে, জল্লাদের চিৎকারে
কান ফেটে যেতে চায়, চোখ বুজে ফেলি

জল্লাদ কি কাউকে হুকুম দিচ্ছে আমাকে
ধরে আনার জন্য? হয়তো;
আমার বুক ধুকধুক করতে থাকে এবং
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি বাঁচা মরার দোটানায়
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষৎ গুলিয়ে ফেলি।
বিশ বছর আগেকার এক বিকেলবেলার
দৃশ্য ভেসে ওঠে স্মৃতিতে, একজন বিষণ্ন তরুণীকে
দেখতে পাই আমার বেষ্টনীতে।

অকস্মাৎ এক জনসভায় দেখি আমাকে
বক্তৃতাপ্রবণ, আমার বক্তব্য হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে
নাকি শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করছে বুঝতে
পারার আগেই শুরু হয় বেজায় হট্রগোল
পুলিশের লাঠির সারি হামলায় মাতে বেধড়ক
আমি কি আহত হয়ে ধুলোয় লুটিয়ে কাতরাচ্ছি বেজায়।
বহুদিন পর নিজেকে দেখতে পাই এক স্মরণসভায়
এ কার স্মরণসভা, অন্য কারও নাকি ভাঙাচোরা আমার?
০৬.০৯.২০০৪

 এ কেমন কালবেলা

অন্ধকার, বড় বেশি অন্ধকার আস্তানা গেড়েছে
চারদিকে। খুব কাছের বস্তুও
এখন যাচ্ছে না দেখা। সম্মুখে এগিয়ে
যেতে গেলে কী যেন কিসের
হোঁচট পেছনে ঠেলে দেয় এই বিব্রত আমাকে
কিয়দ্দূরে। নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক পথ খুঁজে নিতে চাই।

‘কে তুমি এমন বিরানায় আমাদের
আস্তানায় তস্করের মতো
গোপনে পড়েছো ঢুকে?’ ভীষণ ভড়কে গিয়ে কথা
বলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি আর
অদৃশ্য ব্যক্তির অবয়ব খুঁজে খুঁজে ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে
পাথুরে মূর্তির মতো হয়ে থাকি।

কে আমাকে বলে দেবে কতদূর গেলে খাঁটি কোনও
মানুষের দেখা পাবো? এখন আমার
আশেপাশে খল, ভণ্ড আর ষোলোআনা স্বার্থপর
লোক আসা-যাওয়া করে। যে গাছকে ছায়াময় ভেবে
ঠাঁই নিই ওর নিচে, নিমেষেই সেটি উবে গিয়ে
এক রাশ কাঁটা হয়ে আমাকেই কামড়াতে থাকে।

ছুটতে ছুটতে শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে এ কোথায়
এসে পড়লাম সন্ধ্যাবেলা? আশ্রয়ের
এক রত্তি চিহ্ন নেই, শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা আমাকে
ত্বরিত গ্রাসের বাসনায় ক্রমাগত জিহ্বা চাটে।

তাহ’লে আখেরে, হায়, এই কালবেলায় কোথায়
বিশ্বাস্ত আশ্রয় পাবো খুঁজে? কে আমাকে
বুকে টেনে নিয়ে সুমধুর কণ্ঠস্বরে
বলবে, ‘বান্ধব, ভয় পেও না, এখানে ঠাঁই নেই ঘাতকের।

এ কেমন রাত এলো?

সারাদিন কাজ করে সন্ধেবেলা রহমত আলী
গৃহিণীর জন্যে কিছু ফুল নিয়ে বস্তিতে ফেরার
পথে দ্যাখে আসমানে রূপালি টাকার মতো চাঁদ
হাসছে। হঠাৎ এ কী! মিশমিশে অন্ধকার থাবা
দিয়ে ঢেকে ফেলে চতুর্দিক। এ কেমন
তুফান কাঁপিয়ে দিচ্ছে সব কিছু? কেমন ধ্বংসের আলামত?
‘এ কেমন রাত এলো’? রহমত আলী নিজেকেই
প্রশ্ন করে। নড়বড়ে ঘর তার জ্বরতপ্ত রোগীর লাহান
ভীষণ কাঁপছে, যেন এক্ষুণি পানিতে
ভেসে যাবে। তার গৃহিণী রহিমা
বেজায় ভয়ার্ত চোখে তাকায় স্বামীর দিকে আর
কোলের সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরে।

আসমান বেজায় গর্জনে চতুর্দিক
কাঁপিয়ে তুলছে; রহমত আলী কেঁপে-ওঠা ঘরে
বসে দ্যাখে, বড় জোরে পানি
ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে
দিয়েছে হাঙ্গাম জুড়ে। বুঝি নিমেষেই
সব কিছু ডুবে যাবে, ভেসে যাবে, বুঝিবা নিশ্চিহ্ন
হবে সব কিছু, যাবে মুছে, হায়, সাধের সংসার।
এ কেমন মশারি ধরেছে ঘিরে চতুর্দিক থেকে?
কখন যে ডুবেছে কুটির তার, রহমত বুঝতে পারেনি।
ডুবতে ডুবতে
ঘুমের সজল মায়াজাল থেকে জেগে
রহমত নিজেকে দেখতে পায় কাঠের তক্তায়।
কোথায় সংসার তার? কোথায় রহিমা?
হা কপাল! কোথায় সন্তান? ধোঁয়া, সব কিছু ধোঁয়া।
২৯.০৬.২০০৪

এই পরিণতি জেনেও এখনও

গভীর নিশীথে যখন বাড়ির সবাই ঘুমের
চুমোয় অচিন বাগানে মুগ্ধ, আমি জাগ্রত
একাকী লেখার টেবিলে কলম হাতে নিয়ে আর
দূরের আকাশে তারাগুলো হাসে কবির কাণ্ডে।
এই যে নিজেকে কবি বলে মেনে নিয়েছি কিছুটা-
ব্যাপারটি ঠিক হয়নি শোভন। মাঝে মাঝে ভাবি,
সত্যি কি আমি পেরেছি দাঁড়াতে এখনও প্রকৃত
সৃজন-মুখর কবির সারিতে? কে দেবে ভরসা?

ভীষণ আঁধার আমাকে চকিতে মুছে ফেলে দিলে,
আমার সৃষ্টি শব্দমালা কি ঝুলবে তখনও
পাঠক-সমাজে? জানবো না, হায়, কিছুতেই আর।
তবুও সফেদ কাগজ সাজাই কালো অক্ষরে।

হয়তো আড়ালে জাঁদরেল কোনও ক্রিটিক অধরে
বাঁকা হাসি টেনে আমার বেচারা কবিতার বই
ছুড়ে ফেলে দেন বাজে কাগজের ঘৃণ্য পাহাড়ে।
এই পরিণতি জেনেও এখনও বেহায়া মাথায়
এক রাশ শাদা কাশফুল নিয়ে কখনও সকালে
দুপুরে অথবা গভীর নিশীথে কলম চালাই।
২১.০৯.২০০৪

একটি এলিজি

(খন্দকার মজহারুল করিম স্বরণে)

কেন তুমি হুট করে এত প্রিয় এই আসরের
আকর্ষণ ছেড়ে চলে গেলে? কেন গেলে?
তোমার তো ছিলো না বিতৃষ্ণা,
যতদূর জানি, স্বদেশের নদী, মাঠ, গ্রামগঞ্জ,
শহরের ঘরবাড়ি, রাজপথ, অলিগলি আর
দীপ্ত জনসভা আর জনতা-শোভিত দীর্ঘ মিছিলের প্রতি।

সংসার সুখেরই ছিলো; ছিলো না কি? জীবনসঙ্গিনী
আর প্রিয় দু’টি সন্তানের সঙ্গ তুমি উপভোগ
করেছো সর্বদা। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে
মেতেছো আড্ডায়। দেশ, দেশবাসী, কখনও হতাশা,
কখনও-বা ভোরের সূর্যের মতো আশা
উঠেছে ঝলসে প্রাণে। দেশের দশের কল্যাণের,
প্রগতির পথ কী ক’রে যে প্রসারিত হবে, তার
ভাবনায় কেটেছে বিনিদ্র রাত বহুবার। স্বাস্থ্য গেছে ক্ষয়ে।

প্রায়শই মধ্যরাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, একা
কোনার টেবিলে ঝুঁকে প্রবন্ধ লিখেছো ঢের চাহিদা মেটাতে
পত্রিকার। তোমার জীবনে ছিলো নক্ষত্রের আলো
এবং সূর্যের হাসি; প্রগতির পথে
হেঁটেছো, তবুও কেন এই অবেলায়
চলে গেলে প্রিয় কাজ অসমাপ্ত রেখে?
২২.০১.২০০৪

 একটি প্রাচীন সংলাপ

বয়স কম তো নয়, উড়ছে মাথায়
এখনও সফেদ চুল, কোনও
কোনও দাঁত নড়বড়ে। তদুপরি কফের ধমকে হামেশাই
বুক ফেটে যেতে চায়। তবুও কলম তার প্রায়শ চঞ্চল।
আজকাল কখনও কখনও বটগাছ থেকে নেমে
একজন অতিশয় বেঁকে-যাওয়া বুড়ো,
অনন্ত কালের মতো বুড়ো,
কবির বিনীত দোরে কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেন।

খানিক পরেই কবি দোর খুলে দাঁড়ান, তাকান
অতিশয় নুয়ে-পড়া প্রবীণের দিকে। অনন্ত কালের মতো
যিনি তাঁর কণ্ঠ ধীরে করে উচ্চারণ-
‘তোমার লেখার ধার অস্তগামী, অবিলম্বে থামাও লেখনী।
নয়তো বুকের রক্ত ঝরিয়ে হলেও
খাতার পাতায় ফের সাজাও সতেজ প্রাণ বেগ, সৃষ্টি করো
পুষ্পদল। নয়তো কী লাভ বলো নিজেকেই
নিজেরই ডোবায় নিত্য নাকানি চুবানি খেতে দেয়া?

ক্ষণকাল পরে সেই অতিশয় প্রবীণ মানব
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে বয়স্ক কবির
মনে ভাবনার ঢেউ খেলে যায় বারবার; আখেরে চকিতে
কবিতার খাতা খুলে তিনি
রচনা করেন এক নতুন কবিতা, রূপ যার
আকাশের তারার মতোই জ্বলজ্বলে,-হাসি ফোটে
কবিতার খাতায়, এমন হাসি আর
ঝরায়নি ঝর্নাধারা কোনও কবিতার পঙ্‌ক্তিমালা।
০১.১১.২০০৪

কখন পাবো মুক্তি?

এই তো আমি
অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে সন্ধেবেলা
পৌঁছে গেছি তিন শো বছর পুরনো এক
গাছের নিচে। কিন্তু আমি এমন স্থানে এলাম কেন?
নিজেকে এই
প্রশ্ন ক’রে জবাব খুঁজে পাই না কোনও।
আমার ভেতর মুষড়ে-পড়া সঙ্গীবিহীন পথিকটিকে
কী ক’রে যে বটের তলায় এই অবেলায় করি সুখী!

নই তো সাধু,
কিংবা তস্‌বি-হাতে কোনও শুদ্ধ ফকির নষ্ট কালে।
এই তো চোখে আসছে নেমে ঘুমের পর্দা; এই বিরানায়
আয়েশ-ছড়ানো শয্যা আমি পাবো কোথায়?

হঠাৎ একি!
আমার সামনে দাঁড়ায় এসে হরিণ-ছানা
কিন্তু কিছু পরেই এক হিংস্র পশু এসে আমায়
শাসায় বেজায়, নখরগুলো রোদে ভীষণ ঝলসে ওঠে!

দেখছি যা’ যা’
সব কিছু কি সত্যি না কি ক্লান্তি-কালো
দুঃস্বপ্ন এক? চোখে নানা বিশ্রী ছবি উঠছে ভেসে;
কখন পাবো মুক্তি আমি বটতলার এই জুলুম থেকে?
১৭.০১.২০০৪

 কঙ্কালের সঙ্গে

আজকাল কী-যে হয়, বড়
ভুল করে ফেলি বারবার। চিঠি লিখে
খামে ভরবার পর ঠিকানা লিখতে গিয়ে কিছু
বাদ পড়ে যায়
অনিচ্ছাবশত আর সেই ভ্রম ভ্রমরের মতো
হুল ফোটাতেই থাকে। চিঠিখানি ডাকঘরে বেঘোরে ঘুমায়।

বয়সকে দোষী ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা
দিই বটে, তবু এই বেয়াড়া মনের হঠকারি আচরণে
ক্রদ্ধ হয়ে আমারই মাথার চুল ছিঁড়ি
আর কষে চড় দিই টেবিলের গালে। অকস্মাৎ
নিকটে ঝিমিয়ে-থাকা অসমাপ্ত কবিতা আমার
হায়, ভীতত্রস্ত হয়ে দৃষ্টিপাত করে ডানে, বামে।

তা হ’লে আমি কি খাতা বন্ধ করে রাখবো সর্বদা ?
কলমের মুখে এঁকে দেবো
খিল যতদিন বেঁচে থাকি ? ‘কেন তুমি এই মতো
ভাবনাকে আজকাল চলেছো প্রশ্রয় দিয়ে ?’- নিজেকে সওয়াল
করি; ‘মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু স্বাভাবিক জীবনের পথে
হেঁটে ফের তুখোড় আড্ডায় ঝেড়ে ফেলো ক্লান্তির কুয়াশা।‘

অথচ আমাকে নানা উদ্ভট দৃশ্যের ছায়াছবি
কেবলই দেখায় ভয়। ঘুমোতে গেলেই
কঙ্কালেরা আমার শয্যার পাশে এসে
দাঁড়ায় অথবা বসে। নিঃশব্দ হাসির তোড়ে ভাসায় আমাকে!

কাদের ভগ্নাংশ এরা? কোন্‌ দশক অথবা শতকের ধুলো
ঝেড়েঝুড়ে এসেছে এখানে? দাঁতহারা, শব্দহারা
হাসি যাচ্ছে দেখা মুখমণ্ডলে ওদের। কঙ্কালের
হাসি কি আমাকে কোনও পরমার্থ বোঝাবার চেষ্টা
করছে নির্জন ঘরে? পরমুহূর্তেই ওরা ঘরের রেলিং-এ
ঝুলে পড়ে, যেন কোনও ঘৃণ্য অপরাধের আসামি।
আচমকা নিজেকেই সেই কঙ্কালের মতো
মনে হয় আর আমি শুয়ে আছি যেন কোনও
পুরনো কবরে; নানা কীট শরীরের মাংসহীন,
ক্ষয়া হাড়ে হেঁটে হেঁটে ভীষণ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ খুব! সেই দৃশ্য
থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে করে ভারী
ক্লান্ত হয়ে পড়ি, নখ দিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটি আঁচড়াতে থাকি।
১৪.০২.২০০৪

কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার বাসনায়

কখন যে আমাকে ভীষণ এক পশু এ পাড়ায়
তাড়িয়ে এনেছে, টের পাইনি। তা’হলে এতক্ষণ
দুঃস্বপ্ন দেখেছি ঘুমে? মনে
হলো সারা শরীরে রয়েছে
গাঁথা সারি সারি কাঁটা। কেন
এই শাস্তি ভোগ করে চলেছি, বুঝি না কিছুতেই।

কখনও কখনও ক্ষণকাল অপরূপ গাছঘেরা
হ্রদের কিনারে দেখি নিজেকে শায়িত। কানে আসে
পাখিদের সুরেলা আওয়াজ। অপক্ষণে মনে হয়, কারা যেন
চুপিসারে চলে গেলো অজানায়। আমি ঘাসময়
মাটি থেকে উঠে আস্তে গা ঝেড়ে এগোই
অন্যদিকে ভিন্ন দৃশ্য দেখার আশায়। আসমানে জাগে চাঁদ।

ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে চলে যাই, ঠিক বুঝে
ওঠা ঢের মুশকিল। কানামাছি খেলার ধরনে
প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছে স্বস্তি বোধ করা হয় না সহজ আর।
ঝরিয়ে প্রচুর ঘাম ডানে বামে শেষে
বস্তুত নিজের নির্বুদ্ধিতা ভীষণ অসহ্য লাগে। ঘরে ফিরে
ক্লান্তির অসহ্য চাপ দু’ চোখে ঘুমের ছায়া মাখে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙে সমস্ত শরীরে যেন কেউ শত
তীক্ষ্ণ সুচ বিঁধিয়েছে শাস্তিরূপে। আখেরে ক্লান্তির
কালিমা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে
যেন জাদুবলে দিব্যি আলাদা মানুষ হয়ে ফের
কাছের টেবিলে ঝুঁকে অসমাপ্ত এক
কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার বাসনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠি।
১৭.১০.২০০৪

কবির আভায় প্রজ্বলিত

ইদানিং কখনও কখনও হঠাৎ কী-যে হয়,
আমার চোখের সামনে কিছু
ছবি ঝলসে ওঠে, যেগুলো বড় বেখাপ্পা, বেগানা।
সেসব ছবি আমাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে
বেশ কিছুক্ষণ। তখন আমার বেহুঁশ হওয়ার
উপক্রম। নিজেকে সামলে রাখি কোনও মতে।

ক্ষণিক পরে নিজেকে দেখতে পাই একটি বাগানে।
বাগানের সৌন্দর্য এমনই, যা’
বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, শুধুউ অসামান্য
কোনও শিল্পী তার চিত্রে ফোটাতে সক্ষম
সেই সৃষ্টি। আমার বিস্ময় মুছে যাওয়ার
আগেই দেখি আমি পড়ে আছি এক হতশ্রী ভাগাড়ে।

কে আমাকে মুক্তি দেবে এই ভয়ঙ্কর
পরিবেশ থেকে? আমি কি এখানে পচতে থাকবো?
অবিরাম বমি কি আমাকে বেহুঁশ করে ফেলবে?
দুশ্চিন্তায় অবসন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
একটি প্রফুল্ল সারস আমাকে তার ডানায়
আশ্রয় দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলো মেঘলোকে।

কখন যে মেঘলোক থেকে অপরূপ এক উদ্যানে
এসে গাছতলায় ঠাঁই পেলাম,
টের পাইনি। নিজেকে কেমন পরিবর্তিত মনে হলো।
একি! আমার ভেতর এক পরিবর্তিত ব্যক্তিকে
অনুভব করি। অজানা কে যেন আড়াল থেকে
আমাকে কবির আভায় জ্বলজ্বল্ব করে!
১৯.০৯.২০০৪

 কী তবে আমার কাজ

কী তবে আমার কাজ? কেউ বলে, ময়দানে গিয়ে
স্টেজে উঠে আগুন-ঝরানো,
জনতা-জাগানো বক্তৃতায় মেতে ওঠো। কেউ
বলে, যত পারো লিফলেট লিখে সর্বত্র ছড়াও।

এইসব পরামর্শ শুনে শুনে দু’বেলা কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায়! উত্তেজক মিছিলে প্রায়শ
সোৎসাহে সামিল হয়ে স্লোগান ছড়ালে
হবে কি সার্থক এই মানব জীবন শান্তশিষ্ট এ বান্দার?

বস্তুত এসব কাজে দক্ষতা দেখানো,
বাহবা কুড়ানো ক্ষণে ক্ষণে সাধ্যাতীত
আমার, বরং এর চেয়ে ঢের ভালো নিজ ঘরে বসে কোনও
কবিতার ধ্যানে কিছু সময় কাটিয়ে লিখে ওঠা।
সে-কবিতা যদি মানুষকে দিন বদলের কাজে
প্রেরণা জোগায় বহুবার,
তাহ’লে জীবন এই নগণ্য আমার
সার্থকতা পেয়ে যাবে, অন্তরালে ধন্য হবে কবি।
১৭.০২.২০০৪

কোকিলের গানে

আমি তো এখন দূরে, বহুদূরে চলে
যেতে চাই। যদি হেঁটে যেতে হয়, তবু
দ্বিধাহীন চলে যাবো। যদি ঘামে নেয়ে উঠি, তবু
থামাবো না গতি, বেপরোয়া যাত্রী আমি।

এই যে হেঁটেছি ইতিমধ্যে ঢের পথ, বাধা পেয়ে
যাইনি ভড়কে কিছুতেই। প্রধানত
আলোয়, অথচ ঘোর অমাবস্যা হলেও যাত্রার
বেগ না থামিয়ে চালিয়েছি পদযুগল
সামনের দিকে আর যখন হঠাৎ হিংস্র কোনও
পাখি এসে হামলা করেছে, ওকে দিয়েছি তাড়িয়ে।

ছিল না সহজ কিছু, পদে পদে কত যে বিভ্রম
নানা ছদ্মবেশে এসে মধুর আলাপে
আমাকে ভুলিয়ে সর্বনাশ সাধনের
চোখ-ঝলসানো প্রক্রিয়াকে প্রায়-সফল করেছে
ভেবে চারদিক তীক্ষ্ম হাসি-ঝড়ে ভীষণ কাঁপায়।

অকস্মাৎ চোখ খুলে গেলে দেখি এক
নিঝুম কবরস্থানে শুয়ে আছি। নানা ধরনের
কবরের ভেতর কত যে
কাহিনী ঘুমিয়ে আছে, কোন্‌ গল্পকার
রূপায়িত করতে পারবে সেই অজানাকে? কোকিলের গানে
গুঞ্জরিত হয়ে গোরস্তান আরও বেশি স্তব্ধতায় মগ্ন হয়।
১০.০৪.২০০৪

কোন্‌ সে ব্যাধির

কে তুমি আমাকে লাটিমের মতো
ঘুরোতে ঘুরোতে আখেরে কোথাও
দূরে ছুড়ে ফেলো? কখনও তোমার
পাই না তো খোঁজ। কত পথে হাঁটি,
কত মাঠে ছুটি, নদীর কিনারে
বসে থাকি এক ধ্যানীর ধরনে।

প্রায়শ কতো রাত কেটে যায়
নির্ঘুম আর সারাদিন কাটে
ঘরের ভেতর পায়চারি করে।
কখনও আহার মুখে তুলে নিতে
ভুলে যাই আর গাছে পাখিদের
সংসার দেখে কত যে সময়
কেটে যায় আর জরুরি চিঠির
পাতা ছিঁড়ে ফেলি বড় ভুলো মনে।

যদি ভাবে কেউ রমণীর প্রেমে
মজে এই আমি এমন হয়েছি
তা’হলে বেজায় ভুল হয়ে যাবে।
ভালোবাসবার বয়সের কোনও
সীমানা যদিও বাঁধাধরা নেই,
সে কারণে আজ হইনি এমন।

ভুলো-মন তবে? বুঝি না, জানি না।
কেউ কি আমাকে দয়াপরবশ
হয়ে বলে দেবে কেন আজকাল
এমন উতলা এ-মন আমার?
কোন্‌ সে ব্যাধির হয়েছি শিকার?
এই ব্যাধি থেকে আমাকে মুক্তি
দেয়ার সাধ্য হাকিমের নেই।
০৯.০৪.২০০৪

 কোন্‌ সে মানবী

তিন শতকের প্রাচীন অথচ
নব যুবতীর অপরূপ মুখ,
জ্বলজ্বলে চোখ, উন্নত বুক
বুকের সোনালি আঁচিল চকিতে
জাগে স্মৃতিপটে চোখ বুজলেই।
কাকে মনে পড়ে? কোন্‌ সে মানবী?

যত দূর জানি, নয় সে সুদূর
বাগদাদ কিবা দ্বারকার কেউ।
সে আমার এই জন্ম-শহরে
থাকে তার প্রিয় সংসারে আর
আমি থাকি দূরে, মানে বহুদূরে
এই শহরেই কবিতাকে বুকে প্রবল জড়িয়ে।

গৌরী নামের সেই যুবতীকে
হৃদয় আমার দিয়েছি যখন,
ছিলাম কি আমি যুবক তখন?
নয় তা মোটেই। তখন আমার
কেশর-সুলভ কেশের চূড়ায়
ধরেছিল পাক রীতি অনুসারে।

তবুও আমাকে দিয়েছিলে তুমি
পুশিদা পুষ্প হৃদয়-তরুর।
সেই পুষ্পের সুগন্ধে আমি
স্বর্গের আভা পেয়েছি নিত্য।
অথচ এখন সেই আভা তুমি
কেন যে হঠাৎ নিয়েছো ছিনিয়ে!
২০.০২.২০০৪

খোঁপায় সাজায় লাল ফুল

বসন্ত, এখন আমি যুবা নই আর,
উচ্ছ্বাস আমাকে মানায় না,
এখন যুবক যুবতীরা সহজেই
তোমার শোভায় মেতে ওঠে দিগ্ধিদিক।

যখন গাছের ডালে জ্বলজ্বলে পুষ্পরাজি দেখা
দেয়, আর সুরে সুরে তারুণ্যের
বিজয় ঘোষিত হয়, পরিবেশ যেন
রবীন্দ্রনাথের গীতসুধা হয়ে যায় লহমায়।

জীবনে বঞ্চনা আছে, আছে অত্যাচার,
অবিচার, প্রতারণা, তবু
যখন হাওয়ায় দুলে ওঠে গাছের সবুজ পাতা,
রঙিন ফুলের শোভা হৃদয়ের গভীরে বেহেস্তি আলো আনে।

ঘরে ঘরে, হে বসন্ত, তোমার উদ্দেশে গীতিমালা,
কবিতা এখন নিবেদিত, নৃত্যশিল্পী
বিচিত্র মুদ্রায় তুলে ধরে ক্ষণে ক্ষণে তোমাকেই।
ওগো ঋতুরাজ ঘরে ঘরে তোমারই বন্দনা আজ।

সচ্ছল ঘরেই শুধু এখন নন্দিত নও তুমি,
চেয়ে দ্যাখো তোমার রঙিন চোখ মেলে,
শহরের ঘিঞ্জি এক মহল্লার দীন ঘরে
একজন কুট্রি যুবা সঙ্গিনীর খোঁপায় সাজায় লাল ফুল।

খোলা উঠোন জুড়ে

এই যে খোলা উঠোন জুড়ে
চলছে নৃত্য, গানের সুরে দুলছে সত্যি
গেরস্তদের বসতবাড়ি। নাচ জমেছে
ডানে বামে। কাছের, দূরের সবার প্রাণে।

হঠাৎ কিছু মন্দ লোকের অত্যাচারে
নৃত্য-গানের আসর ভাঙে।
লাঠির বাড়ি মাথায় পড়ে শিল্পীজনের।
নারী, পুরুষ প্রাণের ভয়ে কাঁপতে থাকে।

কিন্তু ক’জন তরুণ রুখে দাঁড়ায় এবং
তাদের রণমূর্তি দেখে গুণ্ডারা সব
লেজ গুটিয়ে পালায় দূরে। খানিক পরে
বসলো হেসে গানের আসর, নাচের পালা।

সেখানে কেউ কখনও আর
নাটক কিংবা গানের আসর পণ্ড করে
দেয়ার খায়েশ নিয়ে লাঠি হাতে আসেনি।
নৃত্য-গীতের আসর জমে, জিন্দাবাদ।
২২.০৩.২০০৪

 গলে-যাওয়া দীর্ঘকায় লোক

একজন দীর্ঘকায় লোক গলি থেকে
বেরিয়ে প্রধান পথে মাথা উঁচু ক’রে
হেঁটে হেঁটে সামনে এগোতে থাকে। অকস্মাৎ এ কি!
লোকটা মোমের মতো ধীরে
গলে যেতে থাকে আর পথচারী অনেকেই তার
দিকে অতিশয় বিচলিত দৃষ্টি গেঁথে দেয় যেন।

কারও দিকে দৃষ্টি নেই চলন্ত, গলন্ত লোকটার। পথে জমে
ক্রমাগত পথচারীদের ভিড়। কোন্‌
কে যে তীক্ষ্ণ খঞ্জর বসিয়ে দেয় বুকে,
এমন দুশ্চিন্তা নড়ে চড়ে মাঝে মাঝে,
যেমন ইঁদুর কোনও ক্রিয়াপ্রিয় বিড়ালের মতো।
আসমানে কৃষ্ণ মেঘমালা চন্দ্রমাকে গ্রাস করে!

শহরে পড়েছে ঢুকে জাঁহাবাজ ডাকাতের দল
চারদিক থেকে, ভীত-সন্ত্রস্ত শহরবাসীদের
চোখ থেকে গায়েব হয়েছে ঘুম। নারীদের সম্ভ্রম হানির
আশঙ্কা এবং পুরুষের শোণিতের বন্যা বয়ে
যাওয়ার শিউরে-ওঠা রক্তিম প্রহর কাটাবার
চেতনা, সাহস আর বিজয়ের ধ্বনি কখন তুলবে কারা?
যখন শহরবাসী হতাশার হিম-অন্ধকারে
হাবুডুবু খাচ্ছিল, হঠাৎ চৌদিক থেকে আলো
জেগে ওঠে আর কিয়দ্দূর থেকে অপরূপ গীত
ভেসে আসে। কী আশ্চর্য! গলিত মোমের
স্তূপ থেকে দীর্ঘদেহী রূপবান পুরুষেরা জেগে
উঠে শক্র-তাড়ানোর যুদ্ধে জয়ী হতে ছুটে যায়।
০৬.০১.২০০৫

গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান

এই যে আমি কে জানে কতদিন, কতকাল পর
সোঁদা মাটির ভেতর থেকে আচানক বেরিয়ে এসে
তাকাচ্ছি এদিক সেদিক, কে এই আমি?
এমন সুনসান এলাকায় কোন্‌ মানব বলে দেবে কে আমি?

থমথমে নৈশ প্রহরে মাটির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে
কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হলো
নিজেকে। আত্মপরিচয় কোথায় কখন যে হঠাৎ
লুপ্ত হয়েছে! নামহীন, ঠিকানাবিহীন, কে
বলবে?

মাংসহারা, হাড়সর্বস্ব আমার শরীর কবর থেকে
বেরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিকেলের মৃত রোদ
আমার প্রবীণ কঙ্কালের সঙ্গে
ইয়ার্কি মারার মতলবে ঘন ঘন
চুমো খায়, সুড়সুড়ি দেয় মাংসবিহীন
বগলে। আমার কঙ্কাল হাঁটতে থাকে দিশাহীন।

আমার করুণ কঙ্কাল বিরান গোরস্তানে
অদৃশ্য মহিমায় পথ চলে, দেহলগ্ন মাটি
খসে না কোথাও। হঠাৎ দু’টি কাক কোত্থেকে
উড়ে এসে সওয়ার হয় আমার কাঁধে। চেঁচাতে
চেষ্টা করে প্রাণপণে, অথচ নীরবতা! ভর করে
ওদের ওপর। হঠাৎ তিনটি কোকিল কিয়দ্দূরে
মহানন্দে সুরের ঝরনা সৃষ্টি করে। আমার
কঙ্কাল কারও চোখে পড়ুক না পড়ুক,
কোকিলের সুর সজীব।

গলায় বজ্রপ্রায় আওয়াজ এনে
নিজের উপস্থিতি প্রচারে শত চেষ্টা
সত্ত্বেও ব্যর্থ হই বারবার। শরীরের ভীষণ
শুষ্ক, ভঙ্গুর হাড়গুলো শীতার্ত গাছের
পাতার মতো ঝরতে থাকে। আকাশে
নক্ষত্রের ঝাঁক মেতে ওঠে উপহাসে। বিরান
গোরস্তানের স্তব্ধতাকে মাঝে-মধ্যে সঙ্গীতের
আভা দিয়ে
সাজিয়ে তোলে কোকিলের করুণ আহ্বান।

চলবেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম

কত কিছুই তো ঘটে অজান্তে কত বিজ্ঞ
জ্ঞাতসার ব্যক্তির অজ্ঞাতে। কখনও কখনও
তিনি জানার ভান করেন বটে, অথচ
তার অন্তরে একটি কি দু’টি কীট কামড় দিতেই থাকে।

দেখেছি কোনও কোনও আড্ডায় ঘণ্টার পরেও
ঢের বেশি সময় গড়ায়, আড্ডাবাজগণ
টেবিল চাপড়ান। কেউ কেউ রঙিন কাগজে বেজায়
ঝুঁকে আস্তে সুস্থে কলম চালান প্রেমিকার উদ্দেশে।

কেউ কেউ গালভরা দাড়ি নিয়ে একেবারে নিঝুম
বসে থাকে হাতের পাশে চার পাঁচটি
ইংরেজি বই নিয়ে। চেহারায় তার বিদগ্ধ
প্রচ্ছায়া জাগরিত। তাকে ঘিরে আরও কেউ কেউ জমায় তুমুল আসর।

তরুণ, বিগত-তরুণদের সেই প্রিয় আড্ডায়,
মাঝারি দোকান নামজাদা হয়ে ওঠে চা-বিস্কুট এবং
লেখক ও শিল্পীদের আসা-যাওয়ার কারণে। সে দোকানে চোখ
পড়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তি এবং গুপ্তচরদের ভীষণ কুটিল দৃষ্টিতে।

নামজাদা সেই চায়ের দোকান চকিতে মরুর ধরনে
হয়ে গেলো। লেখক-শিল্পীরা কিংবা অধ্যাপক কেউ
আসেন না এই পথে ইদানিং, যদিও ভাবনা এবং লেখনী
কিছুই থামেনি তাদের; চলছেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম।
২০.১০.২০০৪

জনৈক বিপ্লবীর কথামালা

ছুটছি, ছুটছি,
প্রাণপণে দৌড়ে যাচ্ছি জানি না কোথায়।
গন্তব্য যে খুঁজে নেবো সুস্থির মাথায়
তেমন সুযোগ নেই এবড়ো এই পথে।

আমাকে পালাতে
হবে, শুধু এইটুকু জানি। পায়ে যত
কাঁটাই বিঁধুক জাঁহাবাজ লোকদের
পাশব পাঞ্জার চাপ থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে।

এইটুকু জানি
আমি একা নই, আরও আরও অনেকেই
আছে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আমার মতোই ওরা অন্ধকারে আলো দিতে চায়।

কেউ কেউ আজ
জালিমের কণ্টকিত জালে মৃতপ্রায়।
অনেকে আমার মতো বনবাদাড়ের
ঝোপঝাড়ে, পতিত গুহায় ফলমূল খেয়ে থাকে।

মাথাভরা দীর্ঘ
বুনো চুল, বেয়াড়া সুদীর্ঘ দাড়ি মুখে
আমাকে কিম্ভূতকিমাকার বানিয়েছে।
জ্বালাতে মুক্তির আলো এই মতো জীবন আমার।
০৫.১০.২০০৪

জীবনের নানা বাঁকে

সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে
পৌঁছে যাই, বুঝতে পারি না। আচমকা
অচেনা একটি পাখি এই পথচারী
আমাকে আলতো ছুঁয়ে উড়ে চলে গেলো
না জানি কোথায় আর নিজেরই অজ্ঞাতে কেঁপে উঠে,
মুহূর্তে শুকিয়ে যায় তালু, পদযুগল গেঁথে যায় মৃত্তিকায়।

তবু আমি মাটি থেকে কোনওমতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন
করে ফের সামনের দিকে
হেঁটে যেতে শুরু করি। পুরনো দিনের
কোনও গীত গাইবার চেষ্টা করি আর আকাশের
মেঘের আড়ালে পূর্ণিমার
চাঁদ আবিষ্কারে খুব মনোযোগী হই।

ঘর ছেড়ে দূরে, বহু দূরে ঘুরে ঘুরে অতিশয়
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এখন। যাত্রাকালে
মনে হয়েছিলো হীরা, মোতি পেয়ে যাবো ডানে বামে,
নক্ষত্রের সুকোমল ঝড় জানাবে অভিবাদন
কবিকে এবং আমি শক্রদের উপহাস, বক্রোক্তিকে তুচ্ছ
জ্ঞান করে হাসিমুখে বসবো কীর্তির সিংহাসনে।
না, আমি কখনও এমনকি ভুলক্রমেও কখনও
আত্মগরিমায় ডুবে থাকবো না। যারা
আমার স্খলন, ক্রটি দিয়েছেন দেখিয়ে সর্বদা, হাসিমুখে
সর্বদা মাথায় পেতে নেবো জীবনের নানা বাঁকে।
২২.০৩.২০০৪

জ্যোৎস্নারাতে পাঁচজন বুড়ো

পাঁচজন বুড়ো জ্যোৎস্নারাতে গোল হয়ে
বসে আছে একটি বিরান মাঠে বড়
চুপচাপ। কখনও চাঁদের দিকে তাকায়, যে যার
ভঙ্গিতে খানিক হাসে, চোখ বন্ধ করে, বিড়ি ফোঁকে
কখনও-বা। ফুরোলে বিড়ির আয়ু দূরে
ছুড়ে ফেলে দেয়। বহুক্ষণ আলাপবিহীন থাকে।

আচমকা একজন বুড়ো স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে বলে, ‘তা’হলে কি
আমরা এখানে এভাবেই স্তব্ধতার
প্রতিমূর্তি হয়ে
আলাপকে বনবাস দিয়ে এই মাঠে শূন্যতাকে চুষে খাবো?’

তার বাক্যে অন্যজন নড়েচড়ে বসে, বন্ধুদের
দিকে হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘তুমিও তো পাথরের
ধরনে নিশ্চুপ বসে ছিলে এতক্ষণ। শোনো ভায়া,
তুমি কিছু শোনাও যা আমরা অতীতে
শুনিনি। তা’হলে বুঝি কতটা তোমার দৌড়, মাথা
নুয়ে মেনে নেবো ঠিক তোমার সিদ্ধির জেল্লা ভায়া।‘
এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো যে প্রবীণ, দৃষ্টি মেলে
এদিক সেদিক দ্রুত তাকিয়ে আবার
নিমেষে দৃষ্টির ঝাঁপি বন্ধ ক’রে বলে, ‘শোনা ভাইসব, যত
কথাই বলো না কেন, এই দুনিয়ায় পুরনোকে পুরোপুরি
খারিজের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ষোলো-আনা নতুন কথার
আমদানি বস্তুত সম্ভব নয়। প্রাচীনের রেশ রয়ে যায় শেষতক।‘
অকস্মাৎ বিরান মাঠের বুক থেকে পাঁচ বুড়োর আসর
মুছে যায়। সতেজ, সবুজ ঘাস আর
দূরবর্তী গাছপালা-সব কিছু গায়েব এবং
ধোঁয়াটে একটি গোলকের চঞ্চলতা পরিবেশে
শূন্যতাকে সদ্যবিধবার
বুক-চেরা মাতম বানিয়ে আবর্তিত হতে থাকে!
০৭.০৪.২০০৪

তিনজন ঘোড়সওয়ার

তিনজন ঘোড়সওয়ার সারাদিন অনেক
এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে
ঘোর সন্ধ্যাবেলা এসে পৌঁছলো ঢের পুরনো
এক দালানের সামনে। ঘোড়াদের পিঠ থেকে
নেমে বেঁধে ওদের গাছের ডালে বেঁধে দালানে
প্রবেশ করেই গা ছমছমিয়ে ওঠে তাদের।
পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে তারা খানিক
চমকে ওঠে। কোনও কথাই ঝরে না কণ্ঠস্বর থেকে।

ঘোড়সওয়ারেরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ক’রে দালানে
বসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। বেশ পরে খানিক
চাঁদের ফিকে আলো ভাঙা জানলা
দিয়ে ঘরে ঢোকে সলজ্জ অতিথির ধরনে।

অতিশয় ক্লান্ত ঘোড়সওয়ারেরা মেঝেতে ঘুমোবার
চেষ্টা করতেই কানে ভেসে আসে কাদের
যেন পদধ্বনি। ওরা ভাঙা জানলা থেকে দৃষ্টি
মেলে দিতেই দ্যাখে ক’জন অপরূপ সুন্দরী
হেঁটে যেতে-যেতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। স্তম্ভিত
ঘোড়সওয়ারদের ঘোর কাটতে কাটতে কত যুগ কেটে গেলো, কে বলবে?

ঘোড়সওয়ারত্রয় জানলার কাছে মূর্তির ধরনে
রইলো দাঁড়িয়ে। বাইরে নানা গাছের ডালে সতেজ ভোরের
পাখিদের কোরাস ঝরায় অকৃপণ সুর। ঘোড়সওয়ারেরা
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো? কত শতাব্দী? ঘোড়সওয়ারেরা
কোথায়, কখন গেলে পাবে তাদের
মনের মতো জগৎ? কোথাও তেমন কিছু বাস্তবিক আছে কি?

আলোর আহ্বানে ঘোড়সওয়ারত্রয় অতিশয় পুরোনো
দালান থেকে বেখাপ্পা হাসিতে কাঁপতে
কাঁপতে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি মেলে পরস্পর
অর্থহীন, মারমুখো ঝগড়া বাঁধিয়ে
একে অন্যকে ভয়ঙ্কর জখম করে। অদূরে
গাছের ডালে বন্দি শাদা, কালো এবং
লাল রঙের তিনটি ঘোড়া ওদের
মালিকদের কাণ্ডে ভয়ে, ঘৃণায়, ক্রোধে বন্ধন ছিঁড়ে পালায়।
১১.১২.২০০৪

 তিনজন যুবকের গর্জে ওঠা

(হরিপদ দত্ত প্রিয়বরেষু)

চোখের সম্মুখে আমি বড়সড় একটি বাড়িকে
অতি দ্রুত খসে যেতে দেখছি এখন। এমন তো
ভুলেও ভাবিনি কোনওকালে। বেশ কিছুকাল আগে,
যখন সৌন্দর্য নিয়ে বাড়িটিকে দাঁড়াতে দেখেছি,
করেছি কত না গল্প দিকে দিকে, জনে জনে, আজ
সেই স্মৃতি আমাকে করছে নিত্য ব্যঙ্গ।

এ বাড়ির কতিপয় বিভ্রান্ত বাসিন্দা, স্বার্থান্বেষী
যারা, তারা নিভৃত, রহস্যময় স্থানে
গভীর নিশীথে ব’সে নিজেদের মাঝে বাড়িটির
কিছু অংশ অতিশয় ধড়িবাজ ধনীদের হাতে
তুলে দিতে হয়েছে তৎপর। কিয়দ্দূরে বৃক্ষডালে
ব’সে-থাকা পাখিরা বাড়িটির কষ্ট দেখে হাহাকার ক’রে ওঠে

গাছের পাখিরা দূর থেকে দ্যাখে বাড়িটির যত
ভালো বাসিন্দার নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনধারার
ছবি, কিয়দ্দূর থেকে দ্যাখে আর ভাবে-এই
মানুষেরা এমন দুর্দিনে আচানক
কোথায় দাঁড়াবে গিয়ে? নেবে ঠাঁই? অথচ এরাই
একদিন বাড়িঅলাদের নানা কাজে বাড়িয়েছে হাত।

‘এই কি বিধান, হায়? ন্যায় নীতি?’-ব’লে
ওরা শূন্য আসমানে তাকায়, অথচ তিনজন
যুবকের কণ্ঠ গর্জে উঠে করে উচ্চারণ- ‘আর অনাচার,
অবিচার মেনে নিয়ে উঁচু মাথা নিচু
করবো না, করবো না। এই বাণী নুয়ে-পড়া সব
অধিবাসীদের সুপ্ত শোণিতে তরঙ্গ নেচে বলে, ‘হবে জয়।
১৯.১২.২০০৪

তুমি আজ অধিরাজ

(হুমায়ুন আজাদের উদ্দেশে)

গ্যয়েটের ফাউস্টের মতোই কাটছে প্রধানত
ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে জীবন তোমার। জ্ঞানার্জনে
অক্লান্ত সাধক তুমি, উপরন্তু কাব্য রচনায়
সিদ্ধিলাভ করেছো এবং
প্রতিক্রিয়াবিরোধী ব’লেই ওরা অশুভ তিমিরে
তোমার বিশুদ্ধ রক্ত বইয়ে দিয়েছে হিংস্রতায়।

বিদ্যা, যতটুকু জানা আছে, মানসের শ্রীবৃদ্ধির
বস্তুত অপরিহার্য শ্রেষ্ঠ উপাদান। তুমি তাই আভা তার
দিয়েছো ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসুক শিক্ষার্থীদের মনে
নিত্যদিন। সমাজের নানা বয়সের
আগ্রহী পুরুষ, নারী তোমার জ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে
আলোকিত হয়ে ঢের বস্তুত কৃতজ্ঞ বোধ করেছেন যখন তখন।
মূর্খেরা ভেবেছে তুমি অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হ’লেই
নিভে যাবে তোমার সৃষ্টির আলোমালা,
অথচ জানে না ওরা সর্বদা সজীব তুমি, অমর তোমার
প্রোজ্জ্বল রচনাবলি। তোমার শরীর
কোনওকালে মৃত্তিকায় বিলুপ্ত হলেও
যুগ যুগ জ্বলজ্বলে রয়ে যাবে বাংলার দালান,
কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে। দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের
আসনে হে কবি হুমায়ুন তুমি আজ অধিরাজ।
০৪.০৩.২০০৪

 দিগন্তের বুক চিরে

কখনও কখনও আমি একান্তে নিজেকে
বিশ্লেষণ করার ইচ্ছায় গৃহকোণে
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি,
আকাশ পাতাল ভাবি, এলোমেলো অনেক ভাবনা
আমাকে বিব্রত করে। বুকশেলফ থেকে
বই টেনে নিই দুশ্চিন্তার মাকড়সা-জাল থেকে মুক্তি পেতে।
তবুও নিস্তার নেই যেন, আচমকা ভাবনার
খোলা পথে দেশের দশের ছায়াছবি
রূপায়িত হয়ে
কোন্‌ সে পাতালে ঠেলে দেয়, হাবুডুবু
খেতে থাকি। কারও সাতে পাঁচে নেই, তবু
কেন ঘোর অমাবস্যা ভাবনার পূর্ণিমাকে দ্রুত গ্রাস করে?

কী এক আজব খেলা চলছে স্বদেশে ইদানিং,
বুঝেও বুঝি না যেন! আমরা কি
সবাই এখন উল্টো পায়ে হাঁটছি কেবল? ব্যতিক্রম কিছু
আছে বটে, তবে তারা এক কোণে বসে
থিসিসের মায়াজালে বন্দি হয়ে ক্লান্তির বিস্তীর্ণ কুয়াশায়
পথ, বিপথের ফারাক না বুঝে ঘুরছেন, শুধু ঘরছেন।

কালেভদ্রে কিছু কলরব শ্রুত হয় পাড়ায় পাড়ায় আর
জাগৃতির ঢেউ দ্রুত বুদ্বুদের মতো
মিশে যায়। এই কি নিয়তি সকলের? ‘নয়, নয়
কখনও তা নয়’ ধ্বনি জেগে ওঠে দূর দিগন্তের বুক চিরে।

দুই বন্ধুর কথা

শাহেদ বিষণ্ন স্বরে মুখোমুখি বসে-থাকা প্রিয়
সতীশকে বলে, ‘কেন তুমি আজকাল
এরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করো যেগুলো কখনও আগে
উচ্চারণ করতে না? আমাদের ব্যবহৃত কিছু
বিশিষ্ট বিদেশী শব্দ মুসলমানেরা
ব্যবহার করে যাতে বাংলার আভাস নেই মোটে!

‘শুনতে শুনতে উর্দু শব্দ মুখে অবলীলাক্রমে
চলে আসে। কী করবো, বলো ভাই?’ সতীশ সলজ্জ
কণ্ঠস্বরে বলে ঠোঁটে মৃদু হাসি এনে। শাহেদের
কণ্ঠস্বরে বেদনার রেশ জেগে থাকে। সতীশের
হাতে হাত রেখে বলে শাহেদ, ‘শোনো হে বন্ধু, ছাড়ো
এই রীতি, নিজের বৈশিষ্ট্য থেকে হয়ো না বিচ্যুত কোনও কালে।‘

এরপর কেটে গেছে কিছুদিন। শহরে ও গ্রামে
ঘোর, হিংস্র অমাবস্যা নেমে
আসে সংখ্যালঘুদের জীবনে সহসা। কোনও কোনও পুরুষের
প্রাণ ঝরে যায়, যুবতীর মানহানি ঘটে ক্রূর
মনুষ্যরূপের অন্তরালে লুক্কায়িত লোভী পশুর ধর্ষণে।
শাহেদ দেখতে যায় সতীশকে প্রায়শই, সাহস জোগায় সবাইকে।
শাহেদের আরচণ আর আশাবাদী কথামালা
জাগায় সাহস সতীশের ভাবনায়। উপরন্তু নিজেও সে
এই দেশ যা তার আপন জন্মভূমি, এর সোঁদা
মাটি ছেড়ে যাবে না কোথাও কোনও দিন
ডেরা বেঁধে নেয়ার প্রফুল্ল বাসনায়। সতীশের
কথামালা থেকে ইদানিং উর্দু, ফার্সি শব্দাবলী ঝরে গেছে।
১২.১১.২০০৪

দুলবে তারার মালা, হবে জয়ধ্বনি

বাগানের ফুলগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে জাঁহাবাজ
পশুপ্রায় লোকগুলো ডানে বামে নিষ্ঠুর বুলেট
ছুড়তে ছুড়তে ত্রাস সৃষ্টি শুধু-যেন ওরা
কর্কশ বুটের নিচে পিষে
নিরীহ বাঙালিদের মুছে
ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যেন ফুঁসছে চৌদিকে শুধু।

শহরে ও গ্রামে অস্ত্রধারী জল্লাদেরা
নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের
ব্রত নিয়ে পাগলা কুকুর হয়ে রাজপথে আর
অলিতে গলিতে হানা দেয়। রক্ত ভাসে
সবখানে পশ্চিমের রক্তপায়ী পশুদের অস্ত্র
থেকে প্রায় যখন তখন। লুট হতে থাকে নারীর সম্ভ্রম।

অচিরে বাংলায় নানা ঘরে মাথা তোলে
একে একে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বদেশের
সম্ভ্রম রক্ষার জ্বলজ্বলে শপথের
পতাকা উড়িয়ে দিগ্ধিদিক। প্রাণ যায় যাক, ক্ষতি
নেই; দুর্বিনীত শক্রদের আমাদের
ধনধান্যে পুষ্পেভরা জন্মভূমি থেকে
ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে নিজস্ব সত্তাকে সমুন্নত
রেখে ঢের ঝড় পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সাফল্যের বাগিচায়।

হায়, এখন তো নানা ঘাটে ছদ্মবেশী শক্রদল
কী চতুর প্রক্রিয়ায় দেশপ্রেমী বৃদ্ধিজীবী আর
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ক্রূর ফাঁদ পেতে
আড়ালে মুচকি হাসে; আসমানে কেঁপে ওঠে চাঁদ!
তবু জানি, মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় আখেরে ঠিক
দুলবে তারার মালা, চতুর্দিকে হবে জয়ধ্বনি।
০৮.১২.২০০৪

দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর

কী ক’রে যে এত দ্রুত কণ্টকিত আঁধারে
ঢুকে পড়েছি, টের পাইনি।
পথে ক’জন অন্ধ পথিক আমাকে
স্বেচ্ছায় দিব্যি কথা বলার ভঙ্গিতে
মুগ্ধ করে ফেললো, টের পাইনি। ওরা
কখন যে আমাকে ছেড়ে দিলো, বুঝিনি।

আমার কাপড়ে অনেক কাঁটা জড়িয়ে গেলো
কখন, টেরই পাইনি। হঠাৎ এক
কর্কশ আওয়াজ আমাকে কামড়ে ধরছে
বারবার। এদিক-সেদিক তাকাতেই দূরের
এক গাছের ডালে অসামান্য এক পাখিকে
দেখি, যার কণ্ঠস্বর কখনও কর্কশ আর কখনও
মধুর সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে অচেনা, নির্জন
বুনো জায়গায়। আমার যাত্রা থামে না।

সূর্যের তেজ ম্লান হতেই প্রশান্ত অদূরে
গাছতলায় একজন বুজুর্গকে দেখতে পাই। কী যেন
আমাকে তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। পক্ক কেশ আলেম
তাকান আমার দিকে অপরূপ
দৃষ্টি মেলে। হাতে তাঁর এক অজানা কেতাব।
ইচ্ছে হলো তাঁর পা ছুঁয়ে অবনত হই। পরক্ষণে
দৃশ্য মুছে যায়। আমি মেঘমালার দিকে তাকিয়ে
নতুন এক কবিতার প্রতিমা পেয়ে যাই। আড়াল ফোটে
আসমানে ভাসমান কার্পেট প্রবীণ যাত্রী
তাকান আমার দিকে হাসিস্নাত দৃষ্টিতে।
১৯.০৯.২০০৪

 দৃশ্য, অদৃশ্য

ভোরবেলাতেই আকাশ মুখ কালো করে ব’সে আছে।
প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি কান্না ঝরবে
ওর চোখ থেকে। সেই কখন থেকে তাকিয়ে রয়েছি, অথচ
আকাশে মাঝে-মাধ্যে আঁধার-চেরা একটি কি দু’টি
বিদ্যুতের আসা-যাওয়া করা ছাড়া তেমন কোনও
পরিবর্তন নেই। হাতের কাব্যগ্রন্থটি টেবিলের এক পাশে
সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করি। না, ঘুম
আসবে না। কোনও কবিতা কি উঁকিঝুঁকি দেবে এক্ষুণি?

বাইরে বৃষ্টিধারা নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই, তবু মনে হলো
আমি দিব্যি ভিজে উঠেছি কার সঙ্গে মিলনের
বাসনা আমাকে যেন পৌঁছে দিয়েছে বৃষ্টি ভেজা,
অপরূপ বাসরে, যেখানে স্বর্গীয় পুষ্পরাজির ঘ্রাণ
ছড়ানো আর কে এক সুন্দরী তার বৃষ্টি ভেজা
প্রগাঢ় মধ্যরাতের মতো কেশরাজি ছড়িয়ে বসে আছে
কদমতলায়। আমার হৃদয় ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে
মনোরম বাদ্যযন্ত্রের মতো। আমি কবিতা হয়ে যাই।

আচমকা বৃষ্টিস্নাত রূপসী প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে
তাকায় আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হলো অনেক কালের
পরিচিতা সে আমার। তার দিকে এগিয়ে যেতেই
সে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার বিস্ময় কেটে যাওয়ার আগেই
আমি ওকে স্পর্শ করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি। আমি
সমস্ত আবেগ প্রয়োগ ক’রে ওকে আলিঙ্গন করলাম।
তার মায়াবী স্পর্শ পেলাম কি পেলাম না,
উপলব্ধি করার আগেই আমরা দু’জন কোথায় যেন অদৃশ্য।
২২.০৬.২০০৪

না জানি কোন্‌ বিপদ

আমি কি হারিয়ে ফেলে পথ
এসেছি এখানে এই জনহীন প্রায় অবাস্তব জায়গায়?
চারদিকে দৃষ্টি মেলে দেখতে পাচ্ছি না
মানব-সন্তান, পশুপাখি কাউকেই,
এমনকি গাছপালা, হ্রদ তা-ও নেই।

হঠাৎ কোত্থেকে এক অর্ধনগ্ন পুরুষ নাচতে
শুরু করে এবং নিমেষে জায়গাটা অপার্থিব মনে হলো
আর আমি ডানা মেলে উড়ে যেতে-যেতে
মেঘে মিশে যেতে থাকি। পাখি হয়ে গেছি
ভেবে পক্ষী-সমাজের রীতি, নীতি মেনে নিতে থাকি।

আমাকে কে যেন বলে কানে কানে, ‘তুমি
এ কার নির্দেশে মানবের রীতি-নীতি বিসর্জন দিয়ে উড়ে
যাচ্ছো দিব্যি মনের খেয়ালে মেঘলোকে?
ডানা খসে যাচ্ছে অতি দ্রুত,
এখন আমি কি পতনের ধ্বংসকণা হয়ে যাবো?


আমি কি তোমার দোরে গিয়ে কড়া
নেড়ে নেড়ে শুধু ক্লান্ত হয়েই
নিজ বাসগৃহে ফিরে এসে, হায়,
হাতে তুলে নেবো কবিতার বই!
তার মুখ যদি দেখতে পেতাম,
যদি তার কথা শুনতে পেতাম,
যদি তার দু’টি মায়াবী নয়ন
আমার চোখের ধূসর মরুতে
দিতো ঢেলে সুধা, আমার হৃদয়
হয়ে যেতো এক পুষ্পবাগান!

গৃহিণী আমার পাশে এসে শোয়,
নানা কাজে খুব ক্লান্ত শরীরে
ঘুম এসে চুমো খায় তার চোখে।
কবিতার বই বুকে রেখে আমি
দেখতে না-পাওয়া দয়িতার কথা
ভাবতে গিয়েই কবিতার কিছু
পঙ্‌ক্তি আমার মনের রুক্ষ
বাগানে চকিতে ফুল হয়ে ফোটে।


অনেকটা পথ আমাকে হেঁটে যেতেই হবে,
এই সত্য রৌদ্রের মতো
ঝলমল করে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দৃষ্টি
দূরে প্রসারিত করে খানিক
ভাবলেই বুঝতে পারছি, আমার এ ভ্রমণ
তেমন সহজ হবে না। এই তো ইতিমধ্যেই
পায়ে ফোস্কা পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে,
একটু বসে জিরিয়ে নিলে মন্দ হতো না।
পরমুহূর্তেই মনে হলো, এই অবেলায় এখানে
থামলে কে জানে কোন্‌ বিপদ
লাফিয়ে পড়বে পথিকের ওপর। তাড়াতাড়ি এগিয়ে
যেতেই কয়েকটি পাথর
আমার দিকে ধেয়ে আসে। থমকে
দাঁড়াতেই যেন কার কান্নার রোল আমাকে
ভয়ার্ত করে তোলে। এমন ডুকরে ডুকরে
কে কাঁদছে? সে কেন আসছে না আমার দিকে নির্ভয়ে?


আমাকে কোথায় তুমি
কোন্‌ পথে নিয়ে যাবো
পারবো কি সহজে বুঝতে?
ভুল পথে চলে যাওয়া
মুশকিল নয় বটে,
তা বলে কি থাকবো অনড়?
যেতে হবে বহুদূরে
উজিয়ে সকল বাধা,
পথ চেয়ে রয়েছে অনেকে।
ডাক দিয়ে যাবো জোরে
ডানে বামে সবদিকে,
শুনুক, নাই-বা শুনুক কেউ।


এই যে আখেরে এই ঘোর অন্ধকারে এসে গেছি
জনহীনতায়, ক্রমাগত
ও রাম, রহিম, বলো ভাইসব, কোথায় তোমরা?
আমাকে আশ্বস্ত করো বজ্রধ্বনি ছড়িয়ে চৌদিকে।
সেই কবে থেকে এই ধ্বনি শোনার আশায় আছি
দিনরাত জেগে আর আঁকছি কত না
ছবি কাঠ-কয়লায় দেয়ালে দেয়ালে। আমাদের
অনেক সাথির রক্তে-লেখা ইতিহাস হচ্ছে না কি
উচ্চারিত রাজপথে, বস্তিতে বস্তিতে, ছাত্রাবাসে? দিকে দিকে
জয়ধ্বনি শোনার আশায় এ বাংলার
বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, যুবতী কান পেতে
রয়েছে সর্বদা আর কাঙ্ঘিত সেদিন দিকে দিকে
উড়বে গৌরবে আমাদের প্রাণপ্রিয়
জাতীয় পতাকা আর জনগণ গড়বে নতুন ইতিহাস।

নিঃসঙ্গ জুতো

বসেছিলাম লেখার টেবিল-ঘেষা
অনেকদিনের পুরনো চেয়ারে। হঠাৎ চোখ
পড়লো কিয়দ্দূরে রোদ পোহানো
নিঃসঙ্গ ঢের ক্ষয়ে-যাওয়া
একটি জুতোর দিকে। কেমন যেন
মায়া লাগলো। কার জন্য?

আবার দৃষ্টি ছুঁলো হাতে-রাখা আধ-পড়া
বইটির পাতায়, মন বসলো না। দৃষ্টি গেলো পুরনো,
বেখাপ্পা জুতোর দিকে। এক লহমায় কী মনে হলো
নিজের চেহারা দেখলাম আয়নায়। চমকে
উঠি রোদ-পোহানো, ক্ষয়ে-যাওয়া
জুতোর সঙ্গে আমার মুখের মিল দেখে।
০২.০৯.২০০৪

নিজের অজ্ঞাতেই

একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি
আমার জন্মশহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা শত শত গণ্ডারে
ভরে গেছে। কে জানে কোত্থেকে এসেছে এ পশুর দল।
হঠাৎ গণ্ডারের ভরাট মিছিল থেকে
উচ্চারিত হলো, “কে রে তুই বেল্লিক, বুরবক আমাদের
পশু বলে গাল দিচ্ছিস? বড় তো আস্পর্ধা তোর! এক্ষুণি
তোর টুঁটি ছিঁড়ে কাকপক্ষীকে খেতে দেবো আর উপড়ে নেবো
চোখ। সারা জীবন পথ হাতড়াতে হাতড়াতে কাটবে। বুঝলি বেয়াদব?”

জানলা থেকে গণ্ডারের বিপুল মিছিল দেখে আর
ওদের ক্রুদ্ধ বক্তব্য শুনে পিলে চমকে তো গেলোই,
শিরার উষ্ণ রক্ত শীতল হয়ে গেলো এক লহমায়। আচমকা
কানে এলো এক ঘোষণা,-“হে নগরবাসী, যা বলছি মন দিয়ে
শোনো। তোমাদের শহর এখন
আমাদের দখলে। কেমন ক’রে গণ্ডার-প্রভুদের
দাসত্ব পালনের সুযোগ তোমরা পেলে তা জানার প্রয়োজন নেই।
তোমরা এমনই অথর্ব, এরকমই নিষ্কর্মা যে,
কারও না কারও প্রভুত্ব স্বীকার না করলে
তোমাদের উদরের অন্ন হজম হয় না। তাই এখন গণ্ডার-প্রভুদের
গোলাম তোমরা। হ্যাঁ, তোরা আমাদের
দাসত্ব করলেই থাকবি সুখে, মেদ জমবে তোদের শরীরে।

জানলা দিয়ে ভোরবেলার রোদ আমার ঘুমন্ত
মুখের ওপর খেলা করতেই আমি
জেগে উঠলাম। জানলা রাস্তায় দৃষ্টি দিয়ে
গণ্ডারের মিছিল খুঁজি। না, তেমন কিছু নেই কোথাও।
সত্যি কি নেই? কেন যেন মাথায়, কপালে হাত
চলে গেলো নিজের অজ্ঞাতেই একটি কি দু’টি শিঙের উদ্দেশে।
০৫.১১.২০০৪

 পক্ষীসমাজ

কত যে খণ্ডিত হই রোজ
নিজেই জানি না।
পথে যেতে যেতে কত অচেনা মুখের
সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু কথা না ব’লেই
যে যার গন্তব্য চলে যাই। এই মতো
আচরণ নিন্দনীয় নয় ব’লে বিবেচিত মানব সমাজে।

পক্ষী সমাজের কিছু আচরণ ভিন্ন,
জানা আছে। ওরা
বস্তুত একলা নয়, দল বেঁধে চলে,
একত্রে আহার করে অবসর উপভোগ করে
মিলে মিশে এক জায়গায়। নিজেদের
মধ্যে মানুষের মতো খুনোখুনি করে না কখনও।
২৫.০৩.২০০৪

পারবো নাকি পূর্ণিমার চাঁদ এনে

আমি কি প্রত্যহ ভীতসন্ত্রস্ত মানুষে হয়ে কাটাবো সময়?
আমাকে মোড়ল আর তার
স্যাঙাত এবং তল্পিবাহকেরা
দেখাবে রক্তিম চোখ যখন তখন
আর আমি মাথা হেঁট করে
দূরে চলে যাবো আর গৃহকোণে লুকাবো নিজেকে।
তাহলে আমি কি এভাবেই
কাটাবো এখানে দিনরাত?
বালিশে লুকিয়ে মুখ নিজেকে ধিক্কার
দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
ছিঁড়বো মাথার চুল? অমাবস্যা-রাতে
হবো আত্মাঘাতী?

কী আমার দান এ সমাজে?
আমি কি পেরেছি বদলাতে সমাজের
চেহারা নিজের সাধ অনুসারে? পেরেছি কি
ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে কুসংস্কার?

পারিনি এখনও আমি আমার কাছের
মানে অন্তরঙ্গ জনদের ভাবনা-চিন্তাকে ঠিক
আমার ধারায় এনে সমাজের চেহারায় আলোর ঝলক
সৃষ্টি করে নিজেরা ক্রমশ ধন্য হতে।

আসন্ন সন্ধ্যায় অন্ধকারে ছিঁড়ে আমরা কি
পারবো না পূর্ণিমার চাঁদ এনে আমাদের সব
অকল্যাণ মুছে ফেলে আগামীকে কল্যাণের আলোয় প্রদীপ্ত
করে এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে ধন্য হতে?
২৪.০৮.২০০৪

 পূর্বে না-দেখা ঝর্নার সান্নিধ্য

কোথাও কোনও যানবাহন ছিলো না। মাইল,
মাইল হেঁটে ক্লান্ত শরীরে একটি পুরানো,
ভাঙাচোরা বাড়ির কাছে হাজির
হলাম। বাড়ির দিকে তাকাতেই গা ছমছম
করে উঠলো। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে
গা’জুড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছার অকালমৃত্যু হলো।
আবার ভীষণ অনিচ্ছার মুণ্ডু মুড়িয়ে এগোই।
গলা শুকিয়ে কাঠ, অথচ পান করার
মতো পানি কাছে ধারে কোথাও নেই। হঠাৎ
মাথার ওপর দিয়ে একটি বাজপাখি উড়ে হয়তো
আমার দুর্দশা দেখে পাখা ঝাপ্টে হেসে অনেক
দূরে উধাও হয়ে গেলো। আজ এখানে, কাল সেখানে
এই যে আমি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াই,
এরকম কাটবে আর কতকাল, কে জানাবে আমাকে?

হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত আর কতটা
পথ পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত আস্তানায় পৌঁছুতে পারবো
ভেবে কখনও হতাশায় কালো হই, কখনও আবার
আশার তিনশত প্রদীপ জ্বলে ওঠে। এভাবে
প্রায়-মৃত শরীরটিকে টেনে হিঁচড়ে চলতে চলতে
আচনকা মন-মাতানো সুরধারা খুব নিকট থেকে
ভেসে এসে আমাকে সঞ্জীবিত করে, নতুন হয়ে উঠি।

প্রকৃত মুক্তির আলোকিত জনতার শ্রেয় দেশ

যখন বেরোই পথে দিন কিংবা রাতে
চোখে পড়ে নানা ধরনের কিছু লোক
ডানে বামে। আচমকা কেন যেন মনে হয় কারও
ঘাড়ে শুধু একখানা মাথা নয়, দুটো কি তিনটি
মাথা লগ্ন বলে মনে হয়। সাধ জাগে লোকটিকে
গিয়ে প্রশ্ন করি, সত্যি আপনার মাথা কি তিনটি?

মাঝে মাঝে কী-যে হয় মধ্যরাতে একলা দূরের
বাগানে হাজির। চোখে পড়ে, এক কোণে
ক’জন জুয়াড়ি দিব্যি মেতেছে খেলায়, কেউ খুব হেরে গিয়ে
গিন্নির গয়না কিছু বেঘোরে খুইয়ে বসে আর
আচানক দৃশ্যটি তিমিরে মিশে যায়। বহু দূরে বিধবার
বুকফাটা কান্নার ধরনে এক পাখি ডেকে ওঠে বারবার।

রাত আরও গাঢ় আর বয়সী হতেই
চোখে পড়ে এক মধ্যবয়সী বেখাপ্পা লোক দূরে
তিন জন যুবকের সঙ্গে, মনে হলো বড় বেশি
গুপ্ত কিছু করছেন স্থির। আসমানে অন্ধকার
ভেদ করে মিছিলের আভা জেগে ওঠে। বয়সের
দৌরাত্ম্য উপেক্ষা করে নেতা দৃপ্ত পায়ে যান হেঁটে।

স্বপ্ন নাকি বাস্তব সহজে বোঝা মুশকিল। তেজী সেই
মিছিলে জালিম লাঠি ডানে বামে
চালায় পুলিশ আর ভাড়াটে গুণ্ডারা। রক্ত ঝরে।নিরস্ত্র পুরুষ আর নারীদের। আন্দোলনরত
যারা, তারা স্বপ্ন দ্যাখে পুষ্পশোভিত আগামী আর
প্রকৃত মুক্তির আলোকিত জনতার শ্রেয় দেশ।

প্রতিদ্বন্দ্বী

এই যে প্রায়শ রাত্রির ঘুম মাটি করে বসে
কবিতা লেখার সাধনা করছি টেবিলে ঝুঁকে,
পরিণামে তার কী ফল জুটবে ভাবি মাঝে মাঝে;
তবে শেষ তক ভুলে গিয়ে সব সৃষ্টির মোহে বন্দি থাকি।

অনেক খাতার শূন্য পাতায় শব্দ-মিছিল
সাজিয়ে চলেছি বহুকাল ধরে। মাথার কালো
চুল সবগুলো শুভ্র হয়েছে অনেক আগেই। এখন ফেরার
পথ খোলা নেই, পথে যত কাঁটা থাকুক, তবুও এগোতে হবে।

আমার শরীরে দগদগে ক্ষত হয়েছে অনেক,
হঠাৎ কখনও হিংস্র ঈগল হামলা করে।
শরীরের তিন টুকরো মাংস ঈগলের ঠোঁটে
ঝুলতে ঝুলতে কখন কোথায় পড়ে যায় দূরে, পাই না টের।
ঈগল আমাকে নিয়েছে কি ভেবে আসমানচারী
জাঁহাবাজ আর হিংসুটে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী?
নইলে কেন সে ডানা ঝাপ্টিয়ে আসছে আমার
দিকে পুনরায়? জানে নাকি পাখি সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ আমি?
২০.০৩.২০০৪

ফের উঠে সোজাই দাঁড়াই

আমি কি তোমাকে মেয়ে
ভালোবেসে অবশেষে
অপবাদ বয়েই বেড়াবো?
পড়ে আছি এক কোণে,
বয়সের ভারে আজ
তা’ বলে কি হেলাই প্রাপ্য?

আজও পূর্ণিমা-চাঁদ জেগে থাকে আসমানে,
জাগে না কি হৃদয় তোমার?
হয়তো তুষার কিছু জমেছে সেখানে,
নইলে কেন দেখা দাও না আর?

আমার এ কাতরতা দেখে দূরে আকাশের
তারাও কাঁপতে থাকে খুব!
তুমি এতটুকু আর
বিচলিত নও তো কিছুতে।

তা’হলে আমি কি আজ সবকিছু থেকে দূরে
সরে কোনও ভাগাড়ে থাকবো?
তবু কেন জানি আমি
মাথা নেড়ে আচমকা
ফের উঠে সোজাই দাঁড়াই।
১৯.০২.২০০৪

ফোটে বুনো ফুল

ছিলাম নিশ্চুপ ব’সে বিকেলে ঘরের এককোণে,
হাতে ছিল আধ-পড়া বই।
হঠাৎ পাশের পুরো খোলা দরজার
নগ্নতাকে যেন চুমো খেয়ে অন্দরে প্রবেশ করে
তিনটি শকুন। কখন যে হাত থেকে
আধ-পড়া বইটি মেঝেতে পড়ে গেলো
জানতে পারিনি; শকুনোর, কী অবাক কাণ্ড, ছিল
বেজায় নিশ্চুপ।

অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি অযাচিত
আগত শকুনদের দিকে।
বিস্মিত আমাকে ওরা চকিতে বাংলায়
করে সম্ভাষণ,বলে কিছু ভালো কথা
যা আমি কখনও আগে শুনিনি এবং আরও বেশি
বিস্ময়ের আবর্তে ভীষণ ঘুরপাক খেতে থাকি।

আমাকে বেজায় বিহ্বল, হতবাক হ’তে দেখে
তিনটি শকুন
একে অপরের কালো শরীরে লুটিয়ে প’ড়ে দিব্যি
জোরে হেসে হেসে ঘর প্রবল কাঁপিয়ে।
আমাকে হঠাৎ ভীত দেখে ওরা তিন পাখি
নিমেষে অদৃশ্য হয়, আসমানে চাঁদ জেগে ওঠে।

কিছুক্ষণ ব’সে আরও ভাবনার মায়াজালে দূরে
কোথায় যে ভ্রমণ করতে থাকি,-বুঝি কি বুঝি না, অকস্মাৎ-
হাতে উঠে আসে প্রিয়সঙ্গী বলপেন। পাশে-রাখা
প্যাডের উন্মুক্ত বুকে ফোটে বুনো ফুল!
২৯.১০.২০০৪

 বস্তির খুব কাছে

হঠাৎ কোত্থেকে বলা নেই কওয়া নেই অসংখ্য শকুন
উড়ে এসে জুড়ে বসলো বস্তির খুব কাছে। পুরো জায়গা
কালো আসমানের বিরাট এক অংশ হয়ে প্রতিভাত সব
পথিকের দৃষ্টিতে। একজন বুড়োসুড়ো লোক টলতে টলতে
ভুলক্রমে প্রায় শকুনের ঝাঁকের গা ঘেঁসে হেঁটে যাওয়ার ক্ষণে
মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মাটিতে।
অবসন্ন, প্রায়-অচেতন বৃদ্ধটিকে ছেঁকে ধরলো শকুনের
পাল। ওদের হিংস্র, তীক্ষ্ণ ঠোকর মানুষের মাংসের ঘ্রাণ
আরও বেশি লোভাতুর এবং ক্ষুধার্ত করে তুললো। শকুনের পালের
হামলা বৃদ্ধকে বড় বেশি কাতর করে তোলে। লোকটি হিংস্র
চঞ্চুগুলোর হামলা থেকে রেহাই পাওয়ার তীব্র বাসনায়
গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চায়। শীর্ণ হাত দু’টো দিয়ে জাঁহাবাজ
শকুনদের ক্ষুধার্ত, আক্রমণাত্মক ঠোঁট বড় বেশি
তেজী, মাংসলোভী হয়ে ওঠে।

বৃদ্ধটি নিজের দু’টি হাতকেই বড় বেশি জখমি, ছেঁড়া খোঁড়া
হতে দেয় নিরুপায় হয়ে। কয়েকবার কোনও কোনও শকুনের
টুঁটি চেপে ধরে, ছিঁড়ে ফেলতে চায় হিংস্র আক্রমণকারীদের
মুণ্ডু, ছুড়ে ফেলার তীব্র বাসনায় জ্বলে ওঠে বারুদের মতো, কিন্তু
অবসন্ন শরীর তাকে মাটিতে চেপে ধরে, শকুনের পাল তার
ওপর সওয়ার হয় ভয়ঙ্কর হিংস্রতায়। কিছুক্ষণ পর
শকুনের পাল সরে আসে কিয়দ্দূরে। ওদের ছেড়ে-আসা
জায়গায় পড়ে থাকে কয়েকটি মানবিক হাড়।

জ্যোৎস্নারাতে বুড়োর হাড়গুলো সজীব, সুন্দর হয়ে
একজন অপরূপ মানব হয়ে আসমানে ভাসে।
২৬.০৬.২০০৪

 বাঁশিঅলা

বলা যেতে পারে-
সে-তো আজ নয়, বহুকাল আগে,
যখন আমার দেহ মনে
কৈশোর নিভৃতে খেলছিল অপরূপ
খেলা ভোরবেলা, রৌদ্রময় দ্বিপ্রহর,
মেঘঢাকা গাঢ় সন্ধ্যায় আর
গভীর রহস্যময় রাতে ছিলাম নিমগ্ন আর
কে এক রহস্যময়ী সঙ্গিনী ছিলেন উদ্যানের মায়াপথে

সে-রাতে, এখনও মনে পড়ে-
দিগন্তের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কানে
ভেসে এসেছিল কোন্‌ এক
বংশীবাদকের মন-জয়-করা সুর! কান পেতে
শুনি আমি খুঁজি তাকে দিগ্ধিদিক। শুধু
সুর আসে ভেসে, বাদকের দেখা পাইনে কিছুতে।

এ কেমন বাঁশি যার সুর ভাসে, অথচ বাদক
অদৃশ্য সর্বদা? তার দেখা
পাওয়ার আশায় ঘুরি প্রহরে প্রহরে, শুধু তার
সুর ভেসে আসে, ছুঁয়ে যায় এই নিবেদিত-প্রাণ
আমাকে তবুও অপরূপ শিল্পী তার সবটুকুউ
রূপ থেকে দান ক’রে ঝলসিত হতে নন রাজী।

তবে কি আমার ঝুলি অপূর্ণই রবে সর্বকাল?
যদি আমি মাথা কুটে মরি বাঁশি, তবু
তুমি দেবে না কি ঢেলে তোমার সকল
সুরের অক্ষয় ডালি আমার কম্পিত অঞ্জলিতে?
১৩.০৯.২০০৪

 বিস্মিত দৃষ্টিতে

বহুক্ষণ হেঁটে, হেঁটে, হেঁটে
কোথায় এসেছি
গায়ে-কাঁটা-দেয়া এই জন্মন্ধ সন্ধ্যায়?
মনে হচ্ছে পশ্চিম আকাশ
কালো বিস্কুটের মতো আর
চাঁদ কোনও বুড়োর ধরনে কতিপয়
ফোকলা দাঁতের আহামরি সৌন্দর্যের
বিদঘুটে বাজারু প্রচারে কী অশ্লীল!

বিদঘুটে, হিংসুটে এক বৃক্ষতলে
ক’জন জুয়াড়ি
মেতেছে খেলায় আর কখনও কখনও
তাদের হুল্লোড়ে কেঁপে ওঠে
জমি, যেন গিলে খাবে সেই
ফতুর জুয়াড়িদের। আচানক নারীর কান্নার
ধ্বনি ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে ঘোর কৃষ্ণ
দিগন্তের বুক চিরে। কে এই নিঃসঙ্গ অনামিকা?

কখন যে নিজেকে দেখতে পাই এক
হ্রদের কিনারে,
বড় বেশি অন্ধকার চারদিক থেকে
দাঁত নখ খিঁচিয়ে আসছে। মুখ ঢেকে
রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।
আমি তো ভেবেছিলাম হ্রদ থেকে উঠে
জাগবে সুন্দরী কেউ হাসি মুখ আর
বসবে আমার পাশে, শোনাবে জলজ
কাহিনী এবং ওষ্ঠ এগিয়ে চুম্বন দেবে এঁকে
আমার এ পিপাসার্ত ঠোঁটে।

এরকম কিছুই ঘটেনি, শুধু দেখি
ধু ধু বিরানায় বসে আছি এক বুক
হাহাকার নিয়ে আর ক্ষেপে-যাওয়া চাঁদ
দূর থেকে থুতু, শ্লেষ্মা ছিটিয়ে আমাকে
তুচ্ছতার ভাগাড়ের বাসিন্দা বানাতে
বড় বেশি ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আচমকা
আমার ভেতর প্রায় ক্রোধের ধরনে
কী এক আবেগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মাটি থেকে কিছু ঢেলা কুড়িয়ে ওপরে ছুড়ে দিই
বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখি পুষ্পবৃষ্টি ঝরে অবিরত!
১৪.০৫.২০০৪

বুড়ো ঈগলের মতো?

সময় তো বয়ে গেলো চোখের নিমেষে,
অথচ জমার খাতা খাঁ খাঁ
রয়ে গেছে আমার, আকাঙ্ক্ষা উড়ে যায়
মেঘলা আকাশে। বসে থাকি একা ঘরে হতাশায়।

তবে কি বৃথাই আমি বহু রাত নির্ঘুম কাটিয়ে
ঝাঁঝালো দুপুরে পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটেছি আর
সমুদ্রের ঢেউয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েছি
বহুদিন? বেলা শেষে কী তবে পেলাম?

এতকাল যা ছিল আরাধ্য, যদি তার
কিছুই না জুটলো সঞ্চয়ে,
তাহলে জীবন ফাঁপা অতিশয়; হায়!
কেঁদেও পাবো না তাকে, প্রাপ্তি যার ছিল আকাঙ্ক্ষিত।

আমাকে দেখে কি আজ সর্বহারা মনে হয়? না কি
বুড়ো ঈগলের মতো অথর্ব, ঝিমোনো?
তাই কি উদ্ধত দাঁড় কাক, এমনকি ক্ষুদ্র পাখি
ঠুকরে আমুদে ঢঙে উড়ে চলে যায়। চুপচাপ বসে থাকি।

বেগানা এক নদী তীরে

এই তো নিজেকে দেখছি মেঘলা, নিঝুম দুপুরে
একলা হাঁটছি অচেনা পথের ধার ঘেঁষে আর
আকাশ পাতাল ভাবছি কেবল। আচানক কোনও
ধাবমান যান হানলে আঘাত হারাবো জীবন।

অথচ আমার সেদিকে মোটেও নেই তো খেয়াল,
আমার ভেতর কী যে তোলপাড়
চলছে এখন, অজানা সবার। এমনকি এই
আমারও মনের অজ্ঞাত সব।

আমি কি ব্যর্থ প্রেমিক এখন জীবনের এই
গোধূলি বেলায়? এ কথা শুনলে হেসে গুলজার
করবে সবাই জমাট আসর। সত্যি তেমন নয় তো কিছুই,
তবুও মনের দিগন্ত জুড়ে অচিন কুয়াশা!

তবে কি মৃত্যু-চিন্তা আমাকে করছে কাতর?
ঘর থেকে পথে দিয়েছে হেলায় আচমকা ছুড়ে?
এ কোথায় আমি এলাম ধূসর প্রহরে এমন বেগানা মাটিতে?
কী হবে এখন একলা এখানে সংজ্ঞা হারালে।

হঠাৎ কেমন অট্রহাসির ধাক্কা আমাকে
ধুলোয় লুটিয়ে পতিত আমার দিকে ছুড়ে দেয়
ভয়াবহ ঢেউ। ডুবে যেতে থাকি কোন্‌ সে পাতালে? কে জানতো এই
পরিণতি হবে আমার এমন বেয়াড়া, বেগানা এক নদী তীরে?
১৬.০২.২০০৪

বেলা অবেলার তাঁর বাণী

বড় বেশি অস্থিরতা গোধূলিতে আমাকে দখল
করে নিয়ে জনহীন ঘরে ডানে বামে
ঘোরাচ্ছে ভীষণ। এ বয়সে
এ রকম ছটফটে আচরণ খুব বেমানান
ব’লে মৃদু হাসবেন অনেকেই। এমনকি কেউ
মস্তিষ্কের বিকৃতি ভেবেই দুশ্চিন্তায় মজবেন।

ব্যাপারটি বুঝতে পেরেও দ্রুত করি পায়চারি
ঘরের ভেতর। ঘন ঘন চোখ যায়
পুরনো দেয়ালে, উড়ে-যাওয়া পাখি আর আকাশের
নীলে, অকস্মাৎ চুপচাপ
লেখার টেবিল-ঘেঁসে দাঁড়ানো চেয়ারে
বসে পড়ি। চোখ দু’টি অজান্তেই দ্রুত মুদে আসে।

আচানক কার গাঢ় কণ্ঠস্বর যেন
আমাকে প্রবল নাড়া দিয়ে চোখ খুলে সামনের
দিকে দৃষ্টি মেলে দিতে বাধ্য করে। দেখি
একজন সুকান্ত প্রবীণ নিরীক্ষণ
করছেন আমাকে প্রকৃত বিশ্লেষণী
ভঙ্গিমায়। পরক্ষণে তিনি সাবলীল উচ্চারণ
করলেন অনুপম কথামালা। দৃষ্টি থেকে তাঁর
হলো বিচ্ছুরিত কিছু হীরাপ্রতিম বাক্যের ফুলঝুরি শুধু।

কী করে যে কেটে গেলো নিমেষেই এমন সময়,
বুঝতে পারিনি কিছুতেই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ চেনা
দৃশ্য থেকে তাঁর অনুপম সৌন্দর্যের আভা নিয়ে
কোথায় যে হলেন বিলীন, জানবো না কোনওকালে,
শুধু তাঁর সৌম্য মূর্তি স্মৃতির উদ্যানে
মাঝে-মধ্যে হবে প্রস্ফুটিত আর তাঁর
বাণী বেলা অবেলায় গুঞ্জরিত হয়ে
এই ব্যর্থ জ্ঞানপ্রার্থী আমাকে করবে ঋদ্ধ বেলা অবেলায়।
৩০.০৩.২০০৪

বেলাশেষে কখনও হয় কি সাধ

আমি কি এভাবে বারবার
নিজের সঙ্গেই অভিনয় করে যাব?
এই যে এখন কালো পাখিটা আমার
মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, ওর
উড়াল আমার সর্বনাশ ডেকে আনবে কি আজ?

দেখছি আমার হাত কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে,
খাতার পাতায় লেখা নয়া শব্দগুলো
কোন্‌ দুঃস্বপ্নের স্পর্শে কুষ্ঠরোগীর ক্ষতের মতো
হয়ে গেল? উড়ন্ত পাখির
চাঞ্চল্য কোথায় থেমে গেল?

তাহ’লে আমি কি ক্রমান্বয়ে জবুথবু
মাংসপিণ্ড হয়ে এককোণে
প্রত্যহ থাকব প’ড়ে? যদি তাই হয়,
তা’হলে আমার বেঁচে থেকে
কী লাভ? কেবল জড়পিণ্ড হয়ে শুধু
ডান বাঁয়ে কিংবা সম্মুখে তাকিয়ে
দিনরাত কাটানো মাসের পর মাস,
বছরের পর ফের বছর কাটানো
নরক বাসের চেয়ে বেশি ছাড়া কিছু কম নয়।
কখনও চকিতে ভোরবেলা আমার ঘরের ঠিক
কাঁধ ঘেঁষে একটি সবুজ পাখি সৌন্দর্য বিলিয়ে
বসে থাকে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক
উৎসুক দৃষ্টির আভা ছড়িয়ে হঠাৎ পাখা মেলে
উড়ে চলে যায় দূরে অজানা কোথায়।

বেলাশেষে জ্যোৎস্নাময় রাতে ওর কখনও হয় কি
সাধ উড়ে যেতে নক্ষত্রের
প্রোজ্জ্বল মেলায়? হয় না কি সাধ তার
চাঁদে গিয়ে বসতে কখনও? হয় না কি
সাধ তার ফোটাতে সুরের পুষ্পরাজি মায়ালোকে?

বেশ কিছুদূর এসে

হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে আজ মনে হয়-
এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম কত আলো,
কত অন্ধকার খেলা করেছে আমার সঙ্গে। ভালো,
মন্দ এসে ঘিরেছে আমাকে আর ক্রূর দ্বন্দ্বময়
অন্তরের ইতিহাস রয়ে যাবে অজানা নিশ্চয়।
যদি নগ্নতায় উদ্ভাসিত হতো অন্তর্লোক, তবে
অনেকে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো নীরবে,
কেউ কেউ দিতো টিটকিরি দিব্যি রাজপথময়।

আমরা এমন যুগে বাস করছি, যখন কেউ
পাশে এসে বসলে ভীষণ উসখুস বোধ করি।
মনে হয়, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির শার্টের খুব ফিকে
আড়ালে রিভলবার কিংবা ছোরা ঘান্টি মারা ফেউ
হয়ে আছে। এক্ষুণি লোকটাই হাসিমুখে তড়িঘড়ি
হিম লাশ ক’রে দেবে জলজ্যান্ত ভদ্রলোকটিকে!
১৬.১১.২০০৪

 ব্যর্থ অভিশাপ

হে বান্ধব, এই যে এখানে তুমি এক কোণে ব’সে
প্রত্যহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা দেয়ালের
কিংবা বাইরের কোনও গাছ
অথবা প্রশান্ত আকাশের দিকে দৃষ্টি
মেলে দিয়ে কাটাও সময়
তাতে তোমার কী লাভ হয়, বলবে কি?

প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি, তবু আজ অব্দি
পাইনি উত্তর, শুধু তুমি ঠোঁটে হাসি
খেলিয়ে তাকাও এই উৎসুক ব্যক্তির দিকে আর
এলেবেলে কী-যে বলো, শত চেষ্টাতেও
অর্থের সন্ধান মেলা ভার। ডুবন্ত সূর্যের দিকে
কিছুক্ষণ তাকালেই সম্ভবত মিলবে হদিস বক্তব্যের।

হে বান্ধব, দেখছি তোমাকে ভ্রাম্যমাণ মেঘলোকে।
বুঝি না কী ক’রে ফের ফিরে আসবে এখানে
এই মৃত্তিকায় আর স্বাভাবিক ভাষা
উচ্চারণ করবে আবার সাধারণ মজলিশে।
এই তো জাগলো চাঁদ ঘুমের সাগর ভেদ ক’রে ;
হে বান্ধব, দেখছি তোমার হাতে অপরূপ চলিষ্ণু কলম।

খাতার পাতার পর পাতা অক্ষরের চুমোয় লাল
হয়ে ওঠে পুনরায় কিছুদিন পর। জানি অনেকেই ভেবে
নেচে উঠেছিলো সুখে-এবার তোমার
কলমের গতি চিরতরে থেমে গেলো সুনিশ্চিত!
অথচ বেজায় একগুঁয়ে কলম তোমার বন্ধু,
কোনও অভিশাপ পুড়ে ছাই করতে পারে না কলমকে।
০৮.১১.২০০৪

ভিন্ন জীবন উঠলো নেচে

একটি দ্বীপের অধিবাসী অষ্টপ্রহর
অন্ধকারে ডুবে থাকে। যায় না দেখা কোনও কালে
তাদের কিংবা অন্য কারও দেহের ছায়া।
ভুলেও কেউ আসে না সেই দ্বীপের তীরে।

মাঝে-মধ্যে দ্বীপবাসীরা
হাওয়ার ছন্দে নেচে ওঠে, ওদের গানের তালে তালে
ফুলের, ফলের গাছেরা সব দুলতে থাকে-
যেন ভীষণ মাতাল ওরা, লুটবে ধুলোয়।

দ্বীপবাসীদের মধ্যে ক’জন ছিলো বটে
খুব আলাদা। অন্যেরা সব নেশায় ডুবে থাকলে ওরা
থাকতো দ্বীপের বাইরে কোনও আলোকিত দ্বীপের খোঁজে
যাবার জন্যে নৌকো তৈরি ক’রে কোথাও পৌঁছে যেতে।

ভাবলো ওরা তারা যদি আলসেমিকে
আঁকড়ে থাকে, তাহ’লে আর মুক্তি ওদের হবে নাকো
কোনও কালে। ক’দিন পরে নৌকো বাগে পেয়ে গেলে
আলাদা সেই দ্বীপবাসীরা ডিঙি ভাসায় সমুদ্দুরে।

চলন্ত সেই নৌকো থেকে
ভিন্ন ধাতের ক’জন দ্যাখে, অবাক, একি! ওই তো দূরের
আকাশ থেকে ঝরছে আলো একটি দ্বীপে!
আঁধার-ভরা দ্বীপের ক’জন হাসলো শেষে।

আলোকিত দ্বীপে সবাই
নাও ভিড়ালো, নামলো তীরে, বাঁধলো ডেরা
নতুন ছাঁদে। আলোর চুমোয় ওরা সবাই
হলো বিভোর। ভিন্ন জীবন উঠলো নেচে।
২৫.০১.২০০৪

মগের মুল্লুক না কি?

যাচ্ছিলাম একা সুনসান অচেনা রাস্তায় । হঠাৎ
কোত্থেকে ক’জন ডাকাবুকো লোক আমার
ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ
টুঁটি চেপে ধরে আমার, কারও মুঠোয়
বন্দি আমার মাথার উস্‌কো-খুসকো চুল
আর অন্য একজন ক্রমাগত মারছে লাথি।

মগের মুল্লুক না কি? কেউ কি নিজের উন্মশহরে
নিরাপদে পথে হেঁটে চলতে
পারবে না? তাকে কি গুণ্ডাদের খঞ্জরের আঘাতে
মুখ থুবড়ে পড়তে হবে খোলা রাস্তায়? জ্যোৎস্নাস্নাত
পথ কি রঞ্জিত হবে নিরপরাধ, কারও সাতে, পাঁচে
না-থাকা, নিরামিষ ধরনের ব্যক্তির রক্তধারায়?

কখনও কখনও মনে হয়, আমার প্রিয় শহর
এই ঢাকা রত্নপুরী, এখানে
নগরবাসী সবাই উত্তম চরিত্রের অধিকারী,
প্রত্যেকেই ধীমান, শিল্পকলা-চর্চায় মনোযোগী। কখনও
কখনও কবিমেলা অনুষ্ঠিত হয় অপরূপ উৎসবের
ধরনে, সংবাদ যার রটে যায় দেশ-দেশান্তরে।

এই স্বপ্ন, এই অভিলাষ অর্ধসত্য হয়ে রয়
কারও কারও চেতনায়, কেউ কেউ
খেলাঘর ভেঙে গেলে বেদনার্ত চিত্তে কবিতা রচনায়
মাতাল হয়ে খাতার পাতা কখনও নিরাশায়, কখনও-বা-আশায়
বাংলা বর্ণমালার রূপ নানা সাজে সাজিয়ে
আসমানের মেঘে, বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে ভাসায়।
০১.১১.২০০৪

মন্দ ভাগ্য নিয়ে কাটাই

যখন রোদে ভোরের চুমোয় জেগে উঠি
আশেপাশের সব কিছুকেই কেমন যেন
অচিন দেশের দৃশ্য ভেবে
নিজেকে খুব খাপছাড়া আর একলা লাগে।

এলোমেলো কত কিছুই ভাবতে থাকি
এই আমি কি সত্যি কোনও বিশেষ ব্যক্তি নাকি ঘরের
আসবাবেরই অংশ কিছু? না কি বনের
প্রাণীর মতোই জীবিত এক পশু কিংবা পাখি?

ভোরের আলো একটু তেজী হলে পরেই
আমার ভেতর ক্রমান্বয়ে
ভাবনা যেন বদলে যেতে থাকে এবং বুঝতে পারি-
সত্যি আমি আদমেরই বংশ থেকে জন্মেছি ঠিক।

তবে কেন সাতসকালে এমনতরো
ভাবনা এসে দখল করে আমার মতো শাদাসিধে
মানুষটিকে? দুনিয়া খুবই হিংস্র হয়ে উঠেছে আজ;
তবু নানা পাড়ায় কিছু মধুর সুরে কোকিল ডাকে।

হায়রে আমি মন্দভাগ্য নিয়ে কাটাই
বৃক্ষহারা গলির কোণে! এই গলিতে গায়ক পাখি
কিংবা কোকিল কোনও কালেই ঝরায় না সুর,
মাঝে মাঝে ফিল্মি গানের ধাক্কা লাগে কানে জোরে!
১৮.০২.২০০৪

মাটির ঘ্রাণের ছোঁয়া

প্রায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিকেলের ঠাণ্ডা রোদে
ঘরের বাইরে রাখা চৌকিতে একটি
লাশ দেখে থমকে দাঁড়াই। এই লাশ
অন্য কারও নয়, এতো স্বয়ং আমার।

বাড়ির সবাই শোকাহত বড়, কারও কারও চোখ
অশ্রুময়। ঘরের ভেতর থেকে ক্রন্দনের রোল
ভেসে এসে লাশটিকে ছুঁয়ে যায়,
লাশ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ভীষণ।

আমাকে দেখেও কেউ বলে না কিছুই। যেন আমি
অবয়বহীন কেউ চলাফেরা করছে এখানে
সারাক্ষণ আমি ডাকাডাকি করলেও
কারও কিছু এসে যায় না। তবে কি মৃত আমি?

গোসলের শেষে লাশটিকে কাফন পরিয়ে খাটে
শুইয়ে সবাই নিয়ে যায় গোরস্তানে। দেখি আমি
যাচ্ছি ঢুকে কবরের ভেতরে এবং
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই
দোয়া দরুদের আভা দেয় মেখে লাশের অস্তিত্বে,
সবাই বিদায়্য নেয় আমি রয়ে যাই অন্ধকারে।

বাসগৃহে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি পাশে
ঘুমিয়ে আছেন সুখে জীবন-সঙ্গিনী;তবু আমি
একা, বড় একা বোধ করি আর যেন
নাকে লাগে ভেজা মাটির ঘ্রাণের নগ্ন ছোঁয়া!

মানবিক আর্তনাদ

ঘুটঘুটে এক গলির মোড়ে
এলাম যেন কিসের ঘোরে।
ডানে বামে বন্ধ দোরে
পড়ছে ধাক্কা বেজায় জোরে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।

একলা আমি আঁধার ঘরে
বসছি বটে নড়ে চড়ে।
হঠাৎ এ কি ভীষণ ঝড়ে
বসত বাড়ি বেজায় নড়ে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।

জানলা ধরে দাঁড়াই একা,
কারও সঙ্গে হবেই দেখা।
পছন্দ যার আমার লেখা,
তার জন্যেই আঁকছি রেখা-
আঁকছি শুধু, মগ্ন হয়ে আঁকছি।


কখন যে ঘরে ঢুকে বিছানায় ঘুমে
ঢুলে পড়েছিলাম ক্লান্তির কুয়াশায়,
মনেই পড়ে না। জানালার বাইরে চাঁদের
ক্ষয়া মুখ চোখে পড়তেই মনে পড়ে
অসমাপ্ত একটি কবিতা তিন দিন ধরে মাথা
চাপড়াচ্ছে, অথচ এখনও আমি খাচ্ছি, দাচ্ছি,
দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি, চায়ের
দোকানে নির্দিষ্ট কোণে ব’সে আড্ডা দিচ্ছি;
ঝাঁ ঝাঁ তর্কে নিয়ত উঠছি মেতে রাজনীতি আর
মিছিল, উত্তর-আধুনিক কবিতা ইত্যাদি নিয়ে।
‘নেই, তোমার মুক্তি নেই কিছুতেই’,
কে যেন প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে গেলো।
মুখচ্ছবি তার শত চেষ্টাতেও পড়লো না ধরা।
দৃষ্টিতে আমার পড়ে তিনজন রূপবতী দূরে
একটি হ্রদের তীরে এসে বসে, তাদের পেলব
গানের সুষমা হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্বর্গীয় করে।


অবশেষে বৃক্ষতলে এসে বসি, এখন আমার
পাশে বসে নেই কোনও পুরুষ কি নারী।
অকস্মাৎ প্রায় মাথা ঘেঁসে কালো এক পাখি
উড়ে যায়। অগণিত বুটের আওয়াজে
শান্তিপ্রিয় জনসাধারণদের মগজ ভীষণ
আলোড়িত, কেমন কুঞ্চিত হতে থাকে। রাইফেল
গর্জন করেনি, তবু লেফ্‌ট রাইট,
লেফ্‌ট রাইট ধ্বনি এক ঝাঁক পায়রা এবং
অজস্র রঙিন হাঁস দূরবর্তী মেঘমালা ছুঁয়ে
দূরে, বহুদূরে উড়ে চলে যায়। বারুদের গন্ধে
কী ভীষণ ভারী হতে থাকে
চতুর্দিক। মানবিক আর্তনাদ ক্রমাগত প্রসারিত হয়।
১৮.০৫.২০০৪

 মেটামরফসিস

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতেই চোখে পড়লো
একটি জবরদস্ত হাত এগিয়ে
আসছে আমার দিকে। বেজায়
ভড়কে গিয়ে অগ্রসরমান হাতের দিকে নিজের
হাত বাড়াবো কি না ভেবে ধন্দে পড়ে গেলাম,
অথচ তেমন ভয়ের কাঁটার খোঁচা পেলাম না।

অচেনা লোকটার দিকে চেয়ার এগিয়ে দিকে
প্রাথমিক ভদ্র দৃষ্ট নিবেদন করার পর আলাপ
শুরু করলাম, আগন্তুক বেজায়
তুখোড় এবং অনেক কিছুই তিনি দিব্যি নিজের
এখতিয়ারে রেখেছেন এবং যখন যা খুশি
চটজলদি বলে যেতে পারেন
মন-জুড়ানো ভাষায়। তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিটি রূপবানও বটে।
হঠাৎ দেখি সেই ব্যক্তি মোমবাতির মতো দ্রুত
গলতে শুরু করেছেন। আমার দৃষ্টিকে বিশ্বাস
করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। একজন জলজ্যান্ত ব্যক্তির
এই রূপান্তরে হতবাক আমি দেখি তার চেয়ারে
এক হনুমান ব’সে আমার দিকে তাকাচ্ছে বেয়াড়া
তাচ্ছিল্যে, নিজেকে আমার লাগছিলো বড় বেখাপ্পা।

যখন ঘুমিয়ে ছিলাম

ঘুমিয়ে ছিলাম ঘরে একা; আচমকা ঘুম ছিঁড়ে
গেলে পর মনে হলো কে যেন ঝাঁকুনি
দিয়ে জোরে ভাঙালো আমার শান্ত, গাঢ়
নিদ্রা; বিচলিত হয়ে খুঁজি কাকে? কোন্‌ সে মানব
অথবা মানবী, যার মুখ দেখার আশায় দ্রুত
শয্যা ছেড়ে উঠে দোর খুলে দৃষ্টি বুলোই চৌদিকে।

না, কোথাও নেই চিহ্ন কারও; বহুদূর থেকে কান্না
ভেসে আসে অথচ নিকটে ঘরবাড়ি
নেই কোনও। তা’হলে কি আকাশের মেঘমালা থেকে
মানবীর ক্রন্দনের মতো ধ্বনি ঝরছে আমার
শ্রুতিতে অথবা দূরে কোনও রুগ্ন, বিরহী যুবক
বাঁশিতে তুলছে কান্নারূপী সুর উন্মাতাল হয়ে।

কিছুতে আসে না ঘুম। মনে হলো, যুগ যুগ ধরে
এভাবেই নিদ্রাহীন থাকবো এখানে
বিরানায়। ভুলেও এখানে কেউ আসবে না, কারও কোনও কথা
শোনার সুযোগ হয়তো-বা কোনওকালে
মিলবে না কিছুতেই। পশু, পাখি আর কীট, পতঙ্গ ব্যতীত
আর কারও মুখ দেখতে পাবো না কোনও কালে!

কখনও রবিনসন ক্রুশোর ধরনে অবিকল
নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার মতো দশা হলে, তবে
জানি না কী ক’রে কাটাতাম একা দ্বীপবাসী হয়ে। তা’হলে কি
উন্মাদের পরিণতি হতো না আমার?
তখন হয়তো পাতাময় গাছের আগ্রহী ডালে
নিজেকে ঝুলিয়ে চিরতরে অসীমের ধোঁয়াশায়
হতাম বিলীন।
০৩.১১.২০০৪

যখন নিঃসঙ্গ থাকি

নিঃসঙ্গ ছিলাম বসে সন্ধ্যারাতে পড়ার টেবিলে
ঝুঁকে, আচমকা
ন্যালাখ্যাপা এক লোক আমার সম্মুখে
দাঁড়ালো, যেন সে খুব অন্তরঙ্গ ইয়ার আমার।

আমার আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই পাশের
চেয়ারে ত্বরিৎ ক’রে নিলো ঠাঁই আর জুড়ে দিলো
ঘনিষ্ঠ আলাপ, যেন দীর্ঘ দিনের আপনজন।
বস্তুত সে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলো নিমেষে আমাকে।

আমি শুধু বিহ্বল দৃষ্টিতে অনাহূত অতিথির
দিকে চেয়ে থাকি আর মন দিয়ে
শুনি তার সব কথা, আমি কিছু বলতে গিয়েও
মূক হয়ে চেয়ে থাকি তার জ্বলজ্বলে দু’টি চোখে।

অনাহুত আজব অতিথি অনর্গল কথা ব’লে
সময়কে ঋদ্ধ করছেন, মনে হয়।
কিছু কথা বুঝি তার, কিছু বোধের আড়ালে
থেকে যায়। অথচ অপূর্ব বাণী তার আমাকে উন্নত করে।

রাত ক্রমে গাঢ় হতে থাকলে অচেনা অতিথির
কণ্ঠস্বর আরও বেশি অপরূপ, অপার্থিব হয়ে
ওঠে, ক্রমান্বয়ে আমি তার
ভক্ত হয়ে নিজের ভেতরে নতুনের আভাবোধ করি।
আচমকা রাত্রিশেষে নিজেকে কেমন
আলাদা, নতুন মনে হয়। অপরূপ এই
পরিবর্তনের রূপ সর্বক্ষণ জেগে থাকবে তো?
অধিক সৃষ্টির আভা জ্বলজ্বলে হয়ে উঠবে তো?
২৩.০৯.২০০৪

 যদি পঙ্‌ক্তিমালা করে আলিঙ্গন

এই যে কখনও আমি বিচলিত হয়ে পড়ি সন্ধ্যা
নামলেই, অন্তর্লোক গাঢ় অন্ধকার
দ্রুত ছেয়ে এলেই কে যেন বোধাতীত
ভাষার আবৃত্তি করে বেশ কিছুক্ষণ। মনে হয়, কোনও পাখি
বস্তুত আপন মনে সুরেলা ছন্দের এক অর্থহীন গান
দিচ্ছে উপহার প্রকৃতিকে প্রত্যাশার পরপারে বাস ক’রে।

নিঃসঙ্গ পাখির সুর থেমে গেলে দূরের চাঁদের
ভগ্নাংশ চকিতে কোন্‌ বিরানায় মুখ
থুবড়ে মিলিয়ে যায়, বলতে পারে না
কেউ কোনও কালে, শুধু অরণ্যের গাছপালা, হ্রদ
জানে সেই রহস্যের ইতিহাস। একজন চন্দ্রাহত লোক
কিছু পঙ্‌ক্তি উচ্চারণ করে বারবার, দেয় চন্দ্রিমার ভগ্নাংশের খোঁজ।

এখন যেদিকে যাই পথ কী ভীষণ ক্ষেপে ওঠে,
ডাকাবুকো পশুর ধরনে
তিন হাত ওপরে লাফিয়ে উঠে চকিতে কামড়ে দেয়, আমি
চীৎকারে বিদীর্ণ করে দিতে চাই চতুর্দিক, অথচ গলায়
হায়, এতটুকু শব্দ কিছুতেই পরিস্ফুট হয় না তখন।
ব্যর্থতায় হাতের আঙুলগুলো খুব জোরে কামড়াতে থাকি।

কখনও আমার চারদিকে সুন্দরীরা নাচ, গান
জুড়ে দেয় বেশ কিছুক্ষণ বিনা কোনও প্রত্যাশায়। খাতা খুলে
বসে থাকি লেখার টেবিল ঘেঁসে, যদি পঙ্‌ক্তিমালা
পদ্যরূপে করে আলিঙ্গন নিত্য এই শব্দমালা সন্ধানীকে।
২১.০৩.২০০৪

যাত্রা থামাবো না

এগিয়ে যেতেই চাই। স্থবির আমার চতুর্দিকে
গজিয়ে উঠুক নিত্য দীর্ঘকায় ঘাস
আর আমি পোকামাকড়ের
স্পর্শেও অনড় থাকি, আমাকে করে না
দখল এমন সাধ কস্মিনকালেও। আমি দূর
তারাময় আকাশে সাঁতার কেটে চাঞ্চল্যের স্বাদ পেতে চাই।

অথচ আমাকে আজকাল বারবার
ভীষণ ঝিমুনি ঘিরে ধরে; হাঁটতে দাঁড়ালে যেন
কেউ চেপে চেয়ারে বসিয়ে দেয় অথবা শয্যায়
হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি নিদ্রা নেশায়
ডুবিয়ে কোন্‌ সে অবাস্তব মজলিশে নিয়ে যায়, বলা দায়।
কাটলে আজব নেশা, ক্লান্তির ছায়ায় মিশে যাই।

মধ্যরাতে বাঁশের বাঁশির সুর না জানি কোত্থেকে
ভেসে আসে, মনকেমনের আলোড়ন
আমাকে চঞ্চল ক’রে তোলে; শয্যা ছেড়ে
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ
যুবতী চাঁদের বাহু প্রণয়ের আভা ছড়িয়ে আমার
সত্তায় কী গান গেয়ে চলে গেল যোজন শূন্যতায়!

এগিয়ে চলার সাধ মিটে গেছে কি আমার?
কখনও তা’ নয়। আজও জীবনের এই
ধূসর গোধূলি বেলাতেও কাঁটাময় পথে হেঁটে
ক্লান্তির কুয়াশা মেখে সত্তায় এগোতেই চাই! পথে
আমাকে ফেলুক গিলে, দাঁতাল কাঁটারা সব ছিঁড়ে
খুঁড়ে নিক আমার শরীর, যাত্রা তবু থামাবো না।
০২.০৯.২০০৪

যেখানে পূর্ণিমা-চাঁদ চুমো খাবে

এই যে সর্বত্র ভয়ঙ্কর কাঁটাময়
জায়গায় বহু দূর থেকে
হাঁটতে হাঁটতে একা পৌঁছে গেছি
অনিচ্ছা সত্ত্বেই-একি ভবিতব্য শুধু?

এগোতে গেলেই চারদিক থেকে সব হিংস্র কাঁটা
বিঁধবে শরীরে আর বৃষ্টির ফোঁটার মতো রক্ত
ঝরবে এবং আমি রক্তহীনতায়
জনহীন ভয়ঙ্কর পথে পড়ে থাকবো নিশ্চিত।

হয়তো খানিক পরে মানুষের শোণিতের ঘ্রাণে
ক্ষুধার্ত পশুর ঝাঁক এসে
জুটবে আমাকে ঘিরে। পাশব হামলা অতিশয়
দ্রুত ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গিলে ফেলে দিব্যি তৃপ্তি পাবে।

তবে কি বেগানা এই জনহীন এলাকায় আমার জীবন
অন্তিম নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে
নিভে যাবে ঝড়-ক্ষুব্ধ দিনে কিংবা রাতে?
কাঁটাবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে পৌঁছুতে হবে শান্ত আস্তানায়।

যাক ছিঁড়ে যাক ক্লান্ত শরীর আমার, তবু যেতে
হবে সেই এলাকায় যেখানে পূর্ণিমা-চাঁদ চুমো
খাবে আসমান, নদী, মাটি আর মানুষকে। চৌদিক কেমন
নিমেষে বদলে ফেলে রূপ। গীতসুধা পান করে নানা প্রাণী।
১৯.০২.২০০৪

 রক্তগোলাপের মতো প্রস্ফুটিত

কী-যে হলো, কিছুদিন থেকে
আমার পড়ার ঘরে আজগুবি সব দৃশ্য জন্ম
নেয় চারদেয়ালে এবং
বইয়ের শেল্‌ফে, এলোমেলো, প্রিয় লেখার টেবিলে।

কতবার গোছাই টেবিল
সযত্নে, অথচ ফের কেন যেন হিজিবিজি অক্ষরের মতো
কেমন বেঢপ রূপ হয়ে
আমাকে সোৎসাহে ভ্যাঙচায় লেখার সময়।

ওরা কি আমার রচনার
পরিণাম বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কলম থামাতে চায় এই
অধমের? লুকাবো না, আমি
ভীত চিত্তে কলম থামিয়ে দূরে দৃষ্টি মেলে দিই।

আচমকা কতিপয় দীর্ঘদেহী প্রেত
লেখার টেবিল ঘিরে ধেই ধেই নেচে আমাকেই
বিদ্রূপের কাদায় সজোরে ঠেলে দিয়ে
দন্তহীন ভয়ঙ্কর মুখে ক্রূর হাসি হাসে!


কোত্থেকে ঘরে ভুতুড়ে আঁধার ঢুকেছে হঠাৎ,
ভেবেই পাই না। আঁধার এমন দংশনপ্রিয়
হতে পারে, আগে জানতে পারিনি। নিজ হাতকেই
কেমন অচেনা বলে মনে হয়। ভয়ে কেঁপে উঠি।

ভয় তাড়ানোর চেষ্টায় দ্রুত চড়িয়ে গলার
ধ্বনি এলোমেলো কীসব আউড়ে গেলাম কেবল।
আকাশে এখন চাঁদ আর তারা দেবে না কি উঁকি?
কেউ কি আমার গলা চেপে ধ’রে করবে হনন?

কারা যেন ছুটে আসছে এদিকে। ওরা কি দস্যু?
নাকি আগামীর ঘটনাবলির বেঢপ আভাস?
হঠাৎ আমাকে ভগ্ন বাড়ির স্তূপের ভেতর
কাতরাতে দেখি। কিছু ধেড়ে পোকা চাটছে জখম।

আমার দেশের চারদিক জুড়ে ক্রূদ্ধ পানির
দংশনে আজ পাড়া গাঁ এবং শহর কাতর।
ভয় হয় যদি হঠাৎ প্লাবন বাড়িঘর সব
মানুষ সমেত ঘোর বিরানায় মুছে ফেলে দেয়।


এখন কোথায় আমি? কে আমাকে এই
নিঝুম বেলায় বলে দেবে? এখানে তো ডানে-বামে
জনমানুষের চিহ্ন নেই। বড় বেশি শূন্যতার
হাহাকার অস্তিত্বকে নেউলের মতো
কামড়াচ্ছে সারাক্ষণ। ভাবছি, এখন যদি কোনও
কুশ্রী মানবেরও পদধ্বনি শুনি বড় ভালো হয়।

কখনও হতাশা যেন সমাজকে, দেশকে বিপথে
টেনে নিয়ে অন্ধের আসরে
আরও বেশি অন্ধ, বোবা জমা ক’রে ঘন ঘন জোরে
করতালি দিয়ে আরও বেশি জম্পেশ আসর না বসায়।

আজকের এই বোবা অন্ধকার লুটপাট আর
অস্ত্রবাজি, আমার বিশ্বাস, আগামীর
সকালে, দুপুরে, রাতে পারবে না মাথা তুলে দাঁড়াতে নিশ্চিত,
যখন স্বদেশ রক্তগোলাপের মতো প্রস্ফুটিত।
২০.০৭.২০০৪

 লড়ছি সবাই

মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে
কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে,
রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে,
কেউবা দেখি চুপিসারে
অন্য কারুর জায়গা কাড়ে
পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে।
লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।

জল খেয়েছি সাতটি ঘাটে,
ফল পেয়েছি বাবুর হাটে,
কিন্তু সে-ফল পোকায় কাটে,
ঘুণ ধরেছে নক্‌শি খাটে,
কানাকড়ি নেইকো গাঁটে,
চলছি তবু ঠাটে বাটে,
রোজানা ধার করছি শুধুই করছি।

পক্ষিরাজের ভাঙা ডানা,
রাজার কুমার হলো কানা।
দিনদুপুরে দৈত্যপানা
মানুষগুলো দিচ্ছে হানা,
নিত্য চলে ঘানি টানা,
জগৎ-জোড়া খন্দখানা-
হোঁচট খেয়ে পড়ছি কেবল পড়ছি।


ফসল ক্ষেতে পোকা পড়ে,
ঘর উড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে,
মাতম ওঠে ঘরে ঘরে।
কত ভিটায় ঘুঘু চরে,
কঙ্কালেরা এই শহরে
বাঁচার জন্যে ধুঁকছে ম’রে।
বাঁচার লড়াই লড়ছি, সবাই লড়ছি।

 শকুন ও কোকিলের কাহিনী

প্রবহমান নদীতীরে একটি নয়নাভিরাম
বৃক্ষ নানাজনের হিংসার পাত্র হয়ে
মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। গাছটিতে
এক ঝাঁক কোকিল মহানন্দে করতো বাস।

ওদের গানের সুরে পার্শ্ববর্তী নদীর ঢেউ
উঠতো নেচে প্রায়শই। সহসা
একদিন কোত্থেকে ক’টি শকুন উড়ে এসে
জুড়ে বসে উৎপাতে উঠলো মেতে। কোকিলেরা ভড়কে যায়।

মারমুখো শকুনদের হামলায় সবুজ গাছের নিচে
বয়ে যায় রক্তিম স্রোত, অনেক
কোকিলের লাশে ছেয়ে যায় ভেজা মাটি। তবে কি
বৃক্ষচূড়ায় কায়েম হলো শকুনের কর্তৃত্ব?

তিন-চারবার সূর্য আকাশ থেকে উধাও
হওয়ার পর কোকিলের ঝাঁক গান গাইতে
শুরু করে নতুন প্রেরণায়। ওদের ডানা আর ঠোঁটের
ঝাপটায় শকুনেরা জখম-কলঙ্কিত
পাখা আর মাথা নিয়ে পড়ি মরি করে পালালো
দূরে অন্য কোনওখানে। কোকিলের গানে নাচে প্রফুল্ল নদী।
১৪.১২.২০০৪

শুধু চাই স্পর্শ সাধনার

আজকাল মাঝে মাঝে কেন যে চকিতে
বুদ্ধমূর্তি জেগে ওঠে দৃষ্টিতে এবং আমি সুদূর দিগন্তে
হেঁটে যেতে থাকি ব’লে মনে হয় শুধু। উদাস দৃষ্টিতে
তাকাই সম্মুখে, দেখি বুদ্ধদেব বোধিদ্রুতলে
ধ্যানমগ্ন আছেন একাকী বসে। ধ্যানকে বাতাস
ঘন ঘন সশ্রদ্ধ প্রণাম করে বিনম্র ভঙ্গিতে।

অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয়ের ঝাঁঝালো মেজাজ অকস্মাৎ
গর্জে ওঠে যদি কোনও অসহায় বুড়ো
ভিখারিকে দেখে, তখনও কি আমি মূক
হয়ে এককোণে ঠিক থাকবো দাঁড়িয়ে? সাতে পাঁচে
নাক গলাবো না বলে চুপ করে কোমল বালিশে
চোখ মুখ গুঁজে থাকা যায় কি সর্বদা? মনুষ্যত্ব থাকবে কি?

কোনও কোনও পুস্তকের পাতায় আমরা দেখি এক
ক্রুশবিদ্ধ মানবের ছবি যিনি
মানুষের কল্যাণের জন্যে ক্রমাগত ভেসেছেন বিপরীত
স্রোতে আর হয়েছেন নির্বোধ পেরেকে বিদ্ধ আপাদমস্তক।
করেননিকো ক্ষমা প্রার্থনা, রক্তধারার তীক্ষ্ণ কষ্ট
তুচ্ছ করে জালিম বিপথগামীদের কল্যাণ কামনা করেছেন।

মহত্ত্বের রূপে ঘোর অমাবস্যা পূর্ণ চন্দ্রালোকে
পরিণত হয় আর মহামানবের
সংস্পর্শে ডাকাত হয়ে যায় অসামান্য দরবেশ। বুঝি তাই
মানবের সম্ভাবনা সুপ্রচুর সর্বকালে, শুধু চাই স্পর্শ সাধনার।
এই তো নীরব, কালো, কাঁটাময় জঙ্গল কেমন
বাগানে রূপান্তরিত, নতুন গানের সুর ভাসে।

 শেষে যা-ই হোক

আর কত দূরে নিয়ে যাবে বলো? আর কত পথ
হেঁটে যেতে হবে? থামলেই যদি
ঝোপঝাড় থেকে জাঁহাবাজ পশু লাফিয়ে শরীর
টুঁটি চেপে ধরে, কী হবে আমার? নিরস্ত্র আমি,
এমনকি হাতে অস্ত্র দিলেও কাউকে কখনও
ভুলেও দেবো না আঘাত, এমন শিক্ষা পেয়েছি মা, বাবার কাছে।

হঠাৎ একদা কী ক’রে যে আমি খাতার পাতায়
কোন্‌ ঘোরে ডুবে পঙ্‌ক্তির পর
পঙ্‌ক্তি সাজিয়ে লিখে ফেললাম একটি পদ্য
নিজের কাছেই রহস্য হয়ে রইলো সত্যি। যতদূর জানি
আমার বংশে কখনও কারুর কলমের ডগা
ভুলেও করেনি পদ্য রচনা। অবশ্য ছিল শিক্ষার আলো।

কী করে যে এক গোধূলি-লগ্নে আমার সমুখে
মুখোমুখি এসে বসলো অচেনা মোহিনী নীরবে
রহস্য-জাল ছড়িয়ে আমার সত্তায়, আমি
তার ইঙ্গিতে সেই যে লেখনী হাতে নিয়ে এক
খেলায় মেতেছি, তার জের আজও
চলছে প্রায়শ বেলা-অবেলায়।

গ্রামে ও শহরে লগ্ন আমার জীবন, তাই তো
পুরনো গলির ধুলো আর ধুঁয়ো বমি-করা
কারখানা আর মোটর গাড়ির আওয়াজে মুখর দিনরাত কাটে।
অবশ্য আমি কখনও সখনও আমাদের প্রিয়
পাড়াতলী গাঁয়ে, মেঘনা নদীর নিঝুম শাখায়
নৌকো-ভ্রমণে পানকৌড়ির, মাছরাঙার
রূপ দেখে সুখে কাটাই সময়। পাড়াতলীতেই
দাদা, নানা, বাবা এবং আমার ছেলে শান্তিতে চিরনিদ্রায়
সমাহিত, তাই সেই ভূমি বড়ই পবিত্র প্রিয় এ কবির কাছে।
জানি না আমার সাফল্য কিছু প্রদীপের মতো
জ্বলবে তিমিরে না কি বিফলতা বয়ে নিয়ে সদা
বেঘোরে ঘুরবো এদিক সেদিক। কোনও কিছু আজ
মোহরূপে আর পারে না আমাকে বন্দি করতে। যতদিন বেঁচে
আছি এই ধু ধু ধুলোর জগতে, ততদিন কালি
কলমের খেলা খেলে যাবো ঠিক, শেষে যা-ই হোক।
১৮.০৩.২০০৪

 সবাই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে

ভদ্রলোক প্রত্যহ একলা নিঝুম বসে থাকেন কোনার
ঘরে। প্রায়শ একটি দু’টি রঙিন
পাখি এসে বসে বারান্দায়, তাকায়
লাগোয়া ঘরের ভেতর। বয়সী ভদ্রলোক সাদরে
মুড়ি, মুড়কি ছিটিয়ে দেন পাখিদের উদ্দেশে।
পাখিরা নিমেষে ভোজ সেরে ফেলে উধাও।

ঘরের বাসিন্দা চেয়ারে হেলান দিয়ে কী-যে ভাবেন
তিনি-ই জানেন। অতিথি পাখিদের কথা?
না কি সদ্য-পড়া কবি পাবলো নেরুদার কাব্য-গ্রন্থের
মহিমা? কখন যে কার মনে খেলে যায় কোন্‌ সে
সরল ভাবনা অথবা জটিল, প্রায়-অবোধ্য বিষয়-
কে বলতে পারে? মন তো আফ্রিকার জঙ্গল নিছক।

কী সব ভাবনা ভদ্রলোকের মানসে দিঘির মাছের
মতো লাফিয়ে ওঠে। কেন যে
তার অতীতের প্রায় মুছে-যাওয়া এক ঘটনা দিঘির পারের
ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। মুছে যায় সে-ছবি
বহু যুগের ওপারের স্তব্ধতায়। বদলাতে থাকে অনেক
ছবি। সে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে দিঘির কিনারে।

পুনরায় কখন ঠায় জেগে ওঠে সে ঠাওর করতে
ব্যর্থ হয়। নড়বড়ে ভাবনা
তাকে ভোগায়। অকস্মাৎ তালুতে ফোটে তিনটি গোলাপ।
শকুনের ঝাঁকের দাপট ক্রমাগত বাড়লে
বন্দুক হাতে ভদ্রলোক হঠাৎ রণমূর্তি করেন ধারণ।
সবাই বোঝে না, কেউ কেউ বুঝে ‘ধন্য ধন্য’ করে নীরবে।
০৩.১০.২০০৪

সবাই সবার জন্য

নিঝুম রাতের ঘরের স্তব্ধ কড়া জেগে ওঠে
আচমকা কার জোরালো নাড়ায়। ছুটে গিয়ে খুলি
বন্ধ দুয়ার। দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা ঝুলে
থাকে আর এক টিকটিকি খোঁজে রাতের ডিনার।

খানিক পরেই ধীরে ফিরে আসি ঘরের ভেতর;
টেবিলে-জিরানো বোতলের পানি শুষে নিয়ে ফের
বিছানায় যাই। ঘুমোতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ
হয়ে আকাশের রূপ দেখে নিই। গাছের পাতার
নাচ চোখে পড়ে। বাতাসের কাছে মনে-মনে ঢের
কৃতজ্ঞবোধ করি সুকোমল সেবার জন্য।

নির্ঘুম রাতে বহুরূপী ধ্যান-ধারণা কেবল
উঁকি দেয় মনে। জানালার দিকে চোখ মেললেই
নানা সময়ের নানা মুখ আর অনেক কাহিনী
জ্বলজ্বল করে, কিছু শুধু প্রায় ধূসর, মলিন-
মিছিলের মতো আসা-যাওয়া করে। শুধু বালোবেসে
সেইসব ছবি কাছে টেনে আনি, উড়াই নিশান।

যদি কোনও দিন কেউ ক্ষেপে গিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে
তেড়ে আসে তাকে শান্তির বাণী শুনিয়ে, ভুলিয়ে
যাতনা আমার যত্নে সত্যি বুকে নেবো টেনে,-
বলবো আমরা নিয়ত সবাই সবার জন্য
১৯.০৯.২০০৪

 সাম্প্রতিক এক নৈশ অভিজ্ঞতা

বেজায় ঝাঁকুনি দিয়ে আচানক কেমন
আজব ক’টি কণ্ঠস্বর আমার
নৈশ ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। ডানে বামে তাকিয়ে
দেখি ঘরের কোথাও কেউ নেই। শুধু নিস্তব্ধ
থমথমে আঁধার যেন কালো দৃষ্টি ছড়িয়ে
আমার সত্তায় হয়তো কিছু বলতে চায়।
কী কথা অন্ধকারের চোখে? তার চিন্তায়? খানিক
পরেই দেয়ালে ঝুলতে দেখি
জনৈক সুন্দরীর মুখ। বিস্ময় অস্তমিত
না হতেই রূপসীর কণ্ঠস্বর ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া আমাকে
জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করে, ‘হায় কবি, সাতটি
বসন্ত কাটতেই আমাকে বিস্মৃতির ধুলোয় ছুড়ে দিলে?

স্তম্ভিত বাক্যহারা আমি কিছু বলার চেষ্টা
করতে না করতেই সুন্দরী হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো
অজানা কোথায়। ঘরের আলো
জ্বালাবো কি জ্বালাবো না ভাবতে না ভাবতে
কতিপয় অদৃশ্য নারী পুরুষের মিলিত হাসি সুরের
সৃষ্টি করে আমার সত্তায় ঘুমের আমেজ
ছড়িয়ে দিলো। আমি অজান্তেই আলিঙ্গনে বাঁধতে
চাইলাম যেন কাকে। শূন্যতাকে? আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওয়া।
১৩.১২.২০০৪

 সুযোগই দেবো না

তোমরা কারা ভিড় জমিয়েছো
এই আগুনের ফুল্‌কি-ঝরানো দুপুরে? তোমাদের
চেহারা দেখে কেমন যেন ভড়কে যেতে হয়। বিশ্বাস
করো, শত চেষ্টাতেও এমন
মনোভাবকে তাড়ানো যায় না ,
বুক ধক্‌ ধক্‌ করতেই থাকে। বড় শীতল হয়ে পড়ি।

তোমরা যারা প্রকৃতই বাইরে এবং ভেতরে
সত্যি-সত্যি সুশীল, যাদের দৃষ্টিতে কোমলতা এবং
আচরণে বিচ্ছুরিত সভ্যতার আভা, তাদের
দীর্ঘায়ু এবং কল্যাণ কামনা করি সর্বদা,
তোমাদের চরিত্রের আলোয়
উদ্ভাসিত হোক বন্ধু-বান্ধবের, সমাজের আসর।

এখনও তোমাদের পায়ের সঙ্গে
পা মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চাই পুবের সূর্যোদয়ের
দিকে। শরীরে যতই ধুলোর পলেস্তারা লাগুক,
আমার এই চলা থামাবো না।
ঝড় যত তাণ্ডবই ছুড়ে দিক আমার দিকে,
এই যাত্রা অবিচল থাকবে পুরোদমে।

আমার শরীরের ক্ষতের দিকে তাকিয়ে কাউকে
করুণাময় বাক্য উচ্চারণের সুযোগই দেবো না।
১১.০৪.২০০৪

সেই যে কখন থেকে

সেই যে কখন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছি বড় একা
তোমার নিস্তব্ধ দোরে, তুমি
খেয়ালই করোনি। হায়, কিছুতেই তুমি
ভুলেও একটিবার তাকাচ্ছো না এই গরিবের দিকে!

না হয় আমার গায়ে চোখ-জুড়ানো পোশাক নেই,
না হয় আমার কথা জাঁদুরেল কোনও
শরিফের মতো কেতাদুরস্ত হওয়ার
তেমন সুযোগ কিছুতেই পাইনি কস্মিনকালে।

তা’বলে অশেষ ঘেন্না পেয়ে দিগ্ধিদিক
লুকিয়ে নিতান্ত সাধারণ মুখ লুকিয়ে বেড়াবো,
এমনও তো মেনে নেয়া যায় না সহজে।
অজান্তেই এই সত্তা বিদ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠে।

আমার জৌলুশ নেই বটে, কিন্তু বিদ্যার বৈভব
আমার অন্তরে আছে, তুমি তার পরিচয় পেয়েছো নিশ্চিত,
তবু কেন তোমার নিস্তব্ধ দোরে এভাবে দাঁড়িয়ে
থেকে প্রায়। ভিখারির ধরনে নিশ্চুপ সময়ের দাস হবো?

তোমার তো জানা আছে আমাদের শহীদ, উন্নত শির নেতা
কখনও জালিম আর অন্যায় বিলাসী
কারও সঙ্গে করেননি সন্ধি। তিনি নেই, তাঁর
আদর্শের ওজ্জ্বল্য, মহিমা রয়ে গেছে অবিচল।
০৯.০৪.২০০৪

হাঁটছি হাঁটছি

ভোর নেই, দ্বিপ্রহর নেই,
নেই সন্ধ্যা; হাঁটছি, হাঁটছি।
কখন যে বেলা শেষ হয়ে এলো
বস্তুত পাইনি টের। রাত্রি দাঁত, নখ বের করে
আমাকে খাবলে ধরে। কী ভীষণ যন্ত্রণার ফাঁদে
পড়ে কাতরাতে গিয়ে অসহায়, বোবা হয়ে থাকি।

পথের ধূসর ধুলো, কালো
কাঁটা ক্ষিপ্ত, বেয়াড়া গাছের,
আমাকে খোঁচাতে থাকে আর
বেধড়ক রক্ত ঝরে অতিশয় ক্লান্ত শরীরের
নানা শিরা ছিঁড়ে-খাঁড়ে। গাছে-বসা কয়েকটি পাখি
ভীত স্বরে কেঁদে ওঠে, হায়, মানবের দুর্দুশায়।

এই যে যাত্রায় আমি আজ
পদে পদে বিপর্যস্ত হয়ে
কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি
রেখে ফের হাঁটছি, হাঁটছি, সে কি শুধু অবিরত
ব্যর্থতার ভস্মরাশি সত্তাময় গ্রহণের জন্যে?
যতই ক্লান্তির চাপ থাক, তবু এগোতেই হবে।

ঐ তো দূরে যাচ্ছে দেখা চূড়া
অপরূপ আস্তানার, যার
প্রদীপের আভা মুছে ফেলে
দেবে অতীতের ভ্রান্তি, দুর্গন্ধ এবং হাহাকার।
সম্মুখে উঠছে ভেসে অগ্রসর তরুণ, তরুণী,
যারা হাতে আগামীর প্রদীপ, নিশান তুলে নেয়।

হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে

হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে আজ মনে হয়-
এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম কত আলো,
কত অন্ধকার খেলা করেছে আমার সঙ্গে। ভালো,
মন্দ এসে ঘিরেছে আমাকে আর ক্রুর দ্বন্দ্বময়
অন্তরের ইতিহাস রয়ে যাবে অজানা নিশ্চয়।
যদি নগ্নতায় উদ্ভসিত হতো অন্তর্লোক, তবে
অনেকে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো নীরবে,
কেউ কেউ দিতো টিটকিরি দিব্যি রাজপথময়।

আমরা এমন যুগে বাস করছি, যখন কেউ
পাশে এসে বসলে ভীষণ উসখুস বোধ করি।
মনে হয়, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির শার্টের খুব ফিকে
আড়ালে রিভলবার কিংবা ছোরা ঘাপ্টিমারা ফেউ
হয়ে আছে। এক্ষুণি লোকটা হাসিমুখে তড়িঘটি
হিম লাশ করে দেবে জলজ্যান্ত ভদ্রলোকটিকে!

হয়তো ভালোবাসা

কখন যে কী ক’রে তারার মতো জ্বলজ্বল করে
শব্দমালা খাতার পাতায়, যায় না
ঠিক বোঝে। সেই শব্দগুচ্ছ আখেরে
পরিণত হয় পুরো কবিতায়। কখনও কখনও দেয়ালে
মাথা কুটে মরলেও হায় কবিতার ছায়া
বিন্দুমাত্র হয় না দৃষ্টিগোচর। কপাল-চাপড়ানোই সার।

কখনও কখনও তুমুল আড্ডায় ব’সে থাকি
যখন, হঠাৎ কবিতা ঝলসে ওঠে চিত্তে
দু’তিনটি শব্দ নিয়ে। আড্ডার দৃশ্য দৃষ্টি থেকে
মুছে যায়। চতুর্দিকে কতিপয় শব্দ নর্তকীরূপে
প্রস্ফুটিত হয় খাতায়। হে কল্পনা, হে সাধনা
আমাকে ভীষণ পথে নিয়ে যাও ক্ষতি নেই। সব দিক দেখে নিতে চাই।
ইচ্ছে করলেই দেখা যায় কি সকল আকাঙ্ক্ষিত
দ্রষ্টব্য কখনও? সম্ভবত নয়, মৃত্যু মুছে ফেলে
ঢের সুন্দরের চিত্রমালা দৃষ্টি থেকে, শুধু কিছু
হাহাকার থেকে যায় বাগানে, গলিতে,
বারান্দায়। কখনও কখনও তোমাদের মাঝে যারা
কাব্য ভালোবাসো তারা হয়তো আমাকে ভালোবাসো।
১৯.১০.২০০৪

Exit mobile version