দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর
কী ক’রে যে এত দ্রুত কণ্টকিত আঁধারে
ঢুকে পড়েছি, টের পাইনি।
পথে ক’জন অন্ধ পথিক আমাকে
স্বেচ্ছায় দিব্যি কথা বলার ভঙ্গিতে
মুগ্ধ করে ফেললো, টের পাইনি। ওরা
কখন যে আমাকে ছেড়ে দিলো, বুঝিনি।
আমার কাপড়ে অনেক কাঁটা জড়িয়ে গেলো
কখন, টেরই পাইনি। হঠাৎ এক
কর্কশ আওয়াজ আমাকে কামড়ে ধরছে
বারবার। এদিক-সেদিক তাকাতেই দূরের
এক গাছের ডালে অসামান্য এক পাখিকে
দেখি, যার কণ্ঠস্বর কখনও কর্কশ আর কখনও
মধুর সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে অচেনা, নির্জন
বুনো জায়গায়। আমার যাত্রা থামে না।
সূর্যের তেজ ম্লান হতেই প্রশান্ত অদূরে
গাছতলায় একজন বুজুর্গকে দেখতে পাই। কী যেন
আমাকে তার দিকে টেনে নিয়ে যায়। পক্ক কেশ আলেম
তাকান আমার দিকে অপরূপ
দৃষ্টি মেলে। হাতে তাঁর এক অজানা কেতাব।
ইচ্ছে হলো তাঁর পা ছুঁয়ে অবনত হই। পরক্ষণে
দৃশ্য মুছে যায়। আমি মেঘমালার দিকে তাকিয়ে
নতুন এক কবিতার প্রতিমা পেয়ে যাই। আড়াল ফোটে
আসমানে ভাসমান কার্পেট প্রবীণ যাত্রী
তাকান আমার দিকে হাসিস্নাত দৃষ্টিতে।
১৯.০৯.২০০৪
দৃশ্য, অদৃশ্য
ভোরবেলাতেই আকাশ মুখ কালো করে ব’সে আছে।
প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বুঝি কান্না ঝরবে
ওর চোখ থেকে। সেই কখন থেকে তাকিয়ে রয়েছি, অথচ
আকাশে মাঝে-মাধ্যে আঁধার-চেরা একটি কি দু’টি
বিদ্যুতের আসা-যাওয়া করা ছাড়া তেমন কোনও
পরিবর্তন নেই। হাতের কাব্যগ্রন্থটি টেবিলের এক পাশে
সরিয়ে রেখে চোখ বন্ধ করি। না, ঘুম
আসবে না। কোনও কবিতা কি উঁকিঝুঁকি দেবে এক্ষুণি?
বাইরে বৃষ্টিধারা নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই, তবু মনে হলো
আমি দিব্যি ভিজে উঠেছি কার সঙ্গে মিলনের
বাসনা আমাকে যেন পৌঁছে দিয়েছে বৃষ্টি ভেজা,
অপরূপ বাসরে, যেখানে স্বর্গীয় পুষ্পরাজির ঘ্রাণ
ছড়ানো আর কে এক সুন্দরী তার বৃষ্টি ভেজা
প্রগাঢ় মধ্যরাতের মতো কেশরাজি ছড়িয়ে বসে আছে
কদমতলায়। আমার হৃদয় ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে
মনোরম বাদ্যযন্ত্রের মতো। আমি কবিতা হয়ে যাই।
আচমকা বৃষ্টিস্নাত রূপসী প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে
তাকায় আমার দিকে। তাকে দেখে মনে হলো অনেক কালের
পরিচিতা সে আমার। তার দিকে এগিয়ে যেতেই
সে হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার বিস্ময় কেটে যাওয়ার আগেই
আমি ওকে স্পর্শ করার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠি। আমি
সমস্ত আবেগ প্রয়োগ ক’রে ওকে আলিঙ্গন করলাম।
তার মায়াবী স্পর্শ পেলাম কি পেলাম না,
উপলব্ধি করার আগেই আমরা দু’জন কোথায় যেন অদৃশ্য।
২২.০৬.২০০৪
না জানি কোন্ বিপদ
আমি কি হারিয়ে ফেলে পথ
এসেছি এখানে এই জনহীন প্রায় অবাস্তব জায়গায়?
চারদিকে দৃষ্টি মেলে দেখতে পাচ্ছি না
মানব-সন্তান, পশুপাখি কাউকেই,
এমনকি গাছপালা, হ্রদ তা-ও নেই।
হঠাৎ কোত্থেকে এক অর্ধনগ্ন পুরুষ নাচতে
শুরু করে এবং নিমেষে জায়গাটা অপার্থিব মনে হলো
আর আমি ডানা মেলে উড়ে যেতে-যেতে
মেঘে মিশে যেতে থাকি। পাখি হয়ে গেছি
ভেবে পক্ষী-সমাজের রীতি, নীতি মেনে নিতে থাকি।
আমাকে কে যেন বলে কানে কানে, ‘তুমি
এ কার নির্দেশে মানবের রীতি-নীতি বিসর্জন দিয়ে উড়ে
যাচ্ছো দিব্যি মনের খেয়ালে মেঘলোকে?
ডানা খসে যাচ্ছে অতি দ্রুত,
এখন আমি কি পতনের ধ্বংসকণা হয়ে যাবো?
২
আমি কি তোমার দোরে গিয়ে কড়া
নেড়ে নেড়ে শুধু ক্লান্ত হয়েই
নিজ বাসগৃহে ফিরে এসে, হায়,
হাতে তুলে নেবো কবিতার বই!
তার মুখ যদি দেখতে পেতাম,
যদি তার কথা শুনতে পেতাম,
যদি তার দু’টি মায়াবী নয়ন
আমার চোখের ধূসর মরুতে
দিতো ঢেলে সুধা, আমার হৃদয়
হয়ে যেতো এক পুষ্পবাগান!
গৃহিণী আমার পাশে এসে শোয়,
নানা কাজে খুব ক্লান্ত শরীরে
ঘুম এসে চুমো খায় তার চোখে।
কবিতার বই বুকে রেখে আমি
দেখতে না-পাওয়া দয়িতার কথা
ভাবতে গিয়েই কবিতার কিছু
পঙ্ক্তি আমার মনের রুক্ষ
বাগানে চকিতে ফুল হয়ে ফোটে।
৩
অনেকটা পথ আমাকে হেঁটে যেতেই হবে,
এই সত্য রৌদ্রের মতো
ঝলমল করে বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দৃষ্টি
দূরে প্রসারিত করে খানিক
ভাবলেই বুঝতে পারছি, আমার এ ভ্রমণ
তেমন সহজ হবে না। এই তো ইতিমধ্যেই
পায়ে ফোস্কা পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে,
একটু বসে জিরিয়ে নিলে মন্দ হতো না।
পরমুহূর্তেই মনে হলো, এই অবেলায় এখানে
থামলে কে জানে কোন্ বিপদ
লাফিয়ে পড়বে পথিকের ওপর। তাড়াতাড়ি এগিয়ে
যেতেই কয়েকটি পাথর
আমার দিকে ধেয়ে আসে। থমকে
দাঁড়াতেই যেন কার কান্নার রোল আমাকে
ভয়ার্ত করে তোলে। এমন ডুকরে ডুকরে
কে কাঁদছে? সে কেন আসছে না আমার দিকে নির্ভয়ে?
৪
আমাকে কোথায় তুমি
কোন্ পথে নিয়ে যাবো
পারবো কি সহজে বুঝতে?
ভুল পথে চলে যাওয়া
মুশকিল নয় বটে,
তা বলে কি থাকবো অনড়?
যেতে হবে বহুদূরে
উজিয়ে সকল বাধা,
পথ চেয়ে রয়েছে অনেকে।
ডাক দিয়ে যাবো জোরে
ডানে বামে সবদিকে,
শুনুক, নাই-বা শুনুক কেউ।
৫
এই যে আখেরে এই ঘোর অন্ধকারে এসে গেছি
জনহীনতায়, ক্রমাগত
ও রাম, রহিম, বলো ভাইসব, কোথায় তোমরা?
আমাকে আশ্বস্ত করো বজ্রধ্বনি ছড়িয়ে চৌদিকে।
সেই কবে থেকে এই ধ্বনি শোনার আশায় আছি
দিনরাত জেগে আর আঁকছি কত না
ছবি কাঠ-কয়লায় দেয়ালে দেয়ালে। আমাদের
অনেক সাথির রক্তে-লেখা ইতিহাস হচ্ছে না কি
উচ্চারিত রাজপথে, বস্তিতে বস্তিতে, ছাত্রাবাসে? দিকে দিকে
জয়ধ্বনি শোনার আশায় এ বাংলার
বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক, যুবতী কান পেতে
রয়েছে সর্বদা আর কাঙ্ঘিত সেদিন দিকে দিকে
উড়বে গৌরবে আমাদের প্রাণপ্রিয়
জাতীয় পতাকা আর জনগণ গড়বে নতুন ইতিহাস।