তিনজন যুবকের গর্জে ওঠা
(হরিপদ দত্ত প্রিয়বরেষু)
চোখের সম্মুখে আমি বড়সড় একটি বাড়িকে
অতি দ্রুত খসে যেতে দেখছি এখন। এমন তো
ভুলেও ভাবিনি কোনওকালে। বেশ কিছুকাল আগে,
যখন সৌন্দর্য নিয়ে বাড়িটিকে দাঁড়াতে দেখেছি,
করেছি কত না গল্প দিকে দিকে, জনে জনে, আজ
সেই স্মৃতি আমাকে করছে নিত্য ব্যঙ্গ।
এ বাড়ির কতিপয় বিভ্রান্ত বাসিন্দা, স্বার্থান্বেষী
যারা, তারা নিভৃত, রহস্যময় স্থানে
গভীর নিশীথে ব’সে নিজেদের মাঝে বাড়িটির
কিছু অংশ অতিশয় ধড়িবাজ ধনীদের হাতে
তুলে দিতে হয়েছে তৎপর। কিয়দ্দূরে বৃক্ষডালে
ব’সে-থাকা পাখিরা বাড়িটির কষ্ট দেখে হাহাকার ক’রে ওঠে
গাছের পাখিরা দূর থেকে দ্যাখে বাড়িটির যত
ভালো বাসিন্দার নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনধারার
ছবি, কিয়দ্দূর থেকে দ্যাখে আর ভাবে-এই
মানুষেরা এমন দুর্দিনে আচানক
কোথায় দাঁড়াবে গিয়ে? নেবে ঠাঁই? অথচ এরাই
একদিন বাড়িঅলাদের নানা কাজে বাড়িয়েছে হাত।
‘এই কি বিধান, হায়? ন্যায় নীতি?’-ব’লে
ওরা শূন্য আসমানে তাকায়, অথচ তিনজন
যুবকের কণ্ঠ গর্জে উঠে করে উচ্চারণ- ‘আর অনাচার,
অবিচার মেনে নিয়ে উঁচু মাথা নিচু
করবো না, করবো না। এই বাণী নুয়ে-পড়া সব
অধিবাসীদের সুপ্ত শোণিতে তরঙ্গ নেচে বলে, ‘হবে জয়।
১৯.১২.২০০৪
তুমি আজ অধিরাজ
(হুমায়ুন আজাদের উদ্দেশে)
গ্যয়েটের ফাউস্টের মতোই কাটছে প্রধানত
ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে জীবন তোমার। জ্ঞানার্জনে
অক্লান্ত সাধক তুমি, উপরন্তু কাব্য রচনায়
সিদ্ধিলাভ করেছো এবং
প্রতিক্রিয়াবিরোধী ব’লেই ওরা অশুভ তিমিরে
তোমার বিশুদ্ধ রক্ত বইয়ে দিয়েছে হিংস্রতায়।
বিদ্যা, যতটুকু জানা আছে, মানসের শ্রীবৃদ্ধির
বস্তুত অপরিহার্য শ্রেষ্ঠ উপাদান। তুমি তাই আভা তার
দিয়েছো ছড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসুক শিক্ষার্থীদের মনে
নিত্যদিন। সমাজের নানা বয়সের
আগ্রহী পুরুষ, নারী তোমার জ্ঞানের ছোঁয়া পেয়ে
আলোকিত হয়ে ঢের বস্তুত কৃতজ্ঞ বোধ করেছেন যখন তখন।
মূর্খেরা ভেবেছে তুমি অস্ত্রাঘাতে নিষ্প্রাণ হ’লেই
নিভে যাবে তোমার সৃষ্টির আলোমালা,
অথচ জানে না ওরা সর্বদা সজীব তুমি, অমর তোমার
প্রোজ্জ্বল রচনাবলি। তোমার শরীর
কোনওকালে মৃত্তিকায় বিলুপ্ত হলেও
যুগ যুগ জ্বলজ্বলে রয়ে যাবে বাংলার দালান,
কুটিরে, নদীর ঢেউয়ে। দেশপ্রেমী প্রতিটি প্রাণের
আসনে হে কবি হুমায়ুন তুমি আজ অধিরাজ।
০৪.০৩.২০০৪
দিগন্তের বুক চিরে
কখনও কখনও আমি একান্তে নিজেকে
বিশ্লেষণ করার ইচ্ছায় গৃহকোণে
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি,
আকাশ পাতাল ভাবি, এলোমেলো অনেক ভাবনা
আমাকে বিব্রত করে। বুকশেলফ থেকে
বই টেনে নিই দুশ্চিন্তার মাকড়সা-জাল থেকে মুক্তি পেতে।
তবুও নিস্তার নেই যেন, আচমকা ভাবনার
খোলা পথে দেশের দশের ছায়াছবি
রূপায়িত হয়ে
কোন্ সে পাতালে ঠেলে দেয়, হাবুডুবু
খেতে থাকি। কারও সাতে পাঁচে নেই, তবু
কেন ঘোর অমাবস্যা ভাবনার পূর্ণিমাকে দ্রুত গ্রাস করে?
কী এক আজব খেলা চলছে স্বদেশে ইদানিং,
বুঝেও বুঝি না যেন! আমরা কি
সবাই এখন উল্টো পায়ে হাঁটছি কেবল? ব্যতিক্রম কিছু
আছে বটে, তবে তারা এক কোণে বসে
থিসিসের মায়াজালে বন্দি হয়ে ক্লান্তির বিস্তীর্ণ কুয়াশায়
পথ, বিপথের ফারাক না বুঝে ঘুরছেন, শুধু ঘরছেন।
কালেভদ্রে কিছু কলরব শ্রুত হয় পাড়ায় পাড়ায় আর
জাগৃতির ঢেউ দ্রুত বুদ্বুদের মতো
মিশে যায়। এই কি নিয়তি সকলের? ‘নয়, নয়
কখনও তা নয়’ ধ্বনি জেগে ওঠে দূর দিগন্তের বুক চিরে।
দুই বন্ধুর কথা
শাহেদ বিষণ্ন স্বরে মুখোমুখি বসে-থাকা প্রিয়
সতীশকে বলে, ‘কেন তুমি আজকাল
এরকম কিছু শব্দ ব্যবহার করো যেগুলো কখনও আগে
উচ্চারণ করতে না? আমাদের ব্যবহৃত কিছু
বিশিষ্ট বিদেশী শব্দ মুসলমানেরা
ব্যবহার করে যাতে বাংলার আভাস নেই মোটে!
‘শুনতে শুনতে উর্দু শব্দ মুখে অবলীলাক্রমে
চলে আসে। কী করবো, বলো ভাই?’ সতীশ সলজ্জ
কণ্ঠস্বরে বলে ঠোঁটে মৃদু হাসি এনে। শাহেদের
কণ্ঠস্বরে বেদনার রেশ জেগে থাকে। সতীশের
হাতে হাত রেখে বলে শাহেদ, ‘শোনো হে বন্ধু, ছাড়ো
এই রীতি, নিজের বৈশিষ্ট্য থেকে হয়ো না বিচ্যুত কোনও কালে।‘
এরপর কেটে গেছে কিছুদিন। শহরে ও গ্রামে
ঘোর, হিংস্র অমাবস্যা নেমে
আসে সংখ্যালঘুদের জীবনে সহসা। কোনও কোনও পুরুষের
প্রাণ ঝরে যায়, যুবতীর মানহানি ঘটে ক্রূর
মনুষ্যরূপের অন্তরালে লুক্কায়িত লোভী পশুর ধর্ষণে।
শাহেদ দেখতে যায় সতীশকে প্রায়শই, সাহস জোগায় সবাইকে।
শাহেদের আরচণ আর আশাবাদী কথামালা
জাগায় সাহস সতীশের ভাবনায়। উপরন্তু নিজেও সে
এই দেশ যা তার আপন জন্মভূমি, এর সোঁদা
মাটি ছেড়ে যাবে না কোথাও কোনও দিন
ডেরা বেঁধে নেয়ার প্রফুল্ল বাসনায়। সতীশের
কথামালা থেকে ইদানিং উর্দু, ফার্সি শব্দাবলী ঝরে গেছে।
১২.১১.২০০৪
দুলবে তারার মালা, হবে জয়ধ্বনি
বাগানের ফুলগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে জাঁহাবাজ
পশুপ্রায় লোকগুলো ডানে বামে নিষ্ঠুর বুলেট
ছুড়তে ছুড়তে ত্রাস সৃষ্টি শুধু-যেন ওরা
কর্কশ বুটের নিচে পিষে
নিরীহ বাঙালিদের মুছে
ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে যেন ফুঁসছে চৌদিকে শুধু।
শহরে ও গ্রামে অস্ত্রধারী জল্লাদেরা
নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের
ব্রত নিয়ে পাগলা কুকুর হয়ে রাজপথে আর
অলিতে গলিতে হানা দেয়। রক্ত ভাসে
সবখানে পশ্চিমের রক্তপায়ী পশুদের অস্ত্র
থেকে প্রায় যখন তখন। লুট হতে থাকে নারীর সম্ভ্রম।
অচিরে বাংলায় নানা ঘরে মাথা তোলে
একে একে বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বদেশের
সম্ভ্রম রক্ষার জ্বলজ্বলে শপথের
পতাকা উড়িয়ে দিগ্ধিদিক। প্রাণ যায় যাক, ক্ষতি
নেই; দুর্বিনীত শক্রদের আমাদের
ধনধান্যে পুষ্পেভরা জন্মভূমি থেকে
ঝেঁটিয়ে বিদায় ক’রে নিজস্ব সত্তাকে সমুন্নত
রেখে ঢের ঝড় পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সাফল্যের বাগিচায়।
হায়, এখন তো নানা ঘাটে ছদ্মবেশী শক্রদল
কী চতুর প্রক্রিয়ায় দেশপ্রেমী বৃদ্ধিজীবী আর
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে ক্রূর ফাঁদ পেতে
আড়ালে মুচকি হাসে; আসমানে কেঁপে ওঠে চাঁদ!
তবু জানি, মুক্তিযোদ্ধাদের গলায় আখেরে ঠিক
দুলবে তারার মালা, চতুর্দিকে হবে জয়ধ্বনি।
০৮.১২.২০০৪