চলবেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম
কত কিছুই তো ঘটে অজান্তে কত বিজ্ঞ
জ্ঞাতসার ব্যক্তির অজ্ঞাতে। কখনও কখনও
তিনি জানার ভান করেন বটে, অথচ
তার অন্তরে একটি কি দু’টি কীট কামড় দিতেই থাকে।
দেখেছি কোনও কোনও আড্ডায় ঘণ্টার পরেও
ঢের বেশি সময় গড়ায়, আড্ডাবাজগণ
টেবিল চাপড়ান। কেউ কেউ রঙিন কাগজে বেজায়
ঝুঁকে আস্তে সুস্থে কলম চালান প্রেমিকার উদ্দেশে।
কেউ কেউ গালভরা দাড়ি নিয়ে একেবারে নিঝুম
বসে থাকে হাতের পাশে চার পাঁচটি
ইংরেজি বই নিয়ে। চেহারায় তার বিদগ্ধ
প্রচ্ছায়া জাগরিত। তাকে ঘিরে আরও কেউ কেউ জমায় তুমুল আসর।
তরুণ, বিগত-তরুণদের সেই প্রিয় আড্ডায়,
মাঝারি দোকান নামজাদা হয়ে ওঠে চা-বিস্কুট এবং
লেখক ও শিল্পীদের আসা-যাওয়ার কারণে। সে দোকানে চোখ
পড়ে সাংস্কৃতিক ব্যক্তি এবং গুপ্তচরদের ভীষণ কুটিল দৃষ্টিতে।
নামজাদা সেই চায়ের দোকান চকিতে মরুর ধরনে
হয়ে গেলো। লেখক-শিল্পীরা কিংবা অধ্যাপক কেউ
আসেন না এই পথে ইদানিং, যদিও ভাবনা এবং লেখনী
কিছুই থামেনি তাদের; চলছেই শিল্পীর তুলি, কবির কলম।
২০.১০.২০০৪
জনৈক বিপ্লবীর কথামালা
ছুটছি, ছুটছি,
প্রাণপণে দৌড়ে যাচ্ছি জানি না কোথায়।
গন্তব্য যে খুঁজে নেবো সুস্থির মাথায়
তেমন সুযোগ নেই এবড়ো এই পথে।
আমাকে পালাতে
হবে, শুধু এইটুকু জানি। পায়ে যত
কাঁটাই বিঁধুক জাঁহাবাজ লোকদের
পাশব পাঞ্জার চাপ থেকে দ্রুত চলে যেতে হবে।
এইটুকু জানি
আমি একা নই, আরও আরও অনেকেই
আছে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আমার মতোই ওরা অন্ধকারে আলো দিতে চায়।
কেউ কেউ আজ
জালিমের কণ্টকিত জালে মৃতপ্রায়।
অনেকে আমার মতো বনবাদাড়ের
ঝোপঝাড়ে, পতিত গুহায় ফলমূল খেয়ে থাকে।
মাথাভরা দীর্ঘ
বুনো চুল, বেয়াড়া সুদীর্ঘ দাড়ি মুখে
আমাকে কিম্ভূতকিমাকার বানিয়েছে।
জ্বালাতে মুক্তির আলো এই মতো জীবন আমার।
০৫.১০.২০০৪
জীবনের নানা বাঁকে
সন্ধ্যাবেলা হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে
পৌঁছে যাই, বুঝতে পারি না। আচমকা
অচেনা একটি পাখি এই পথচারী
আমাকে আলতো ছুঁয়ে উড়ে চলে গেলো
না জানি কোথায় আর নিজেরই অজ্ঞাতে কেঁপে উঠে,
মুহূর্তে শুকিয়ে যায় তালু, পদযুগল গেঁথে যায় মৃত্তিকায়।
তবু আমি মাটি থেকে কোনওমতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন
করে ফের সামনের দিকে
হেঁটে যেতে শুরু করি। পুরনো দিনের
কোনও গীত গাইবার চেষ্টা করি আর আকাশের
মেঘের আড়ালে পূর্ণিমার
চাঁদ আবিষ্কারে খুব মনোযোগী হই।
ঘর ছেড়ে দূরে, বহু দূরে ঘুরে ঘুরে অতিশয়
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি এখন। যাত্রাকালে
মনে হয়েছিলো হীরা, মোতি পেয়ে যাবো ডানে বামে,
নক্ষত্রের সুকোমল ঝড় জানাবে অভিবাদন
কবিকে এবং আমি শক্রদের উপহাস, বক্রোক্তিকে তুচ্ছ
জ্ঞান করে হাসিমুখে বসবো কীর্তির সিংহাসনে।
না, আমি কখনও এমনকি ভুলক্রমেও কখনও
আত্মগরিমায় ডুবে থাকবো না। যারা
আমার স্খলন, ক্রটি দিয়েছেন দেখিয়ে সর্বদা, হাসিমুখে
সর্বদা মাথায় পেতে নেবো জীবনের নানা বাঁকে।
২২.০৩.২০০৪
জ্যোৎস্নারাতে পাঁচজন বুড়ো
পাঁচজন বুড়ো জ্যোৎস্নারাতে গোল হয়ে
বসে আছে একটি বিরান মাঠে বড়
চুপচাপ। কখনও চাঁদের দিকে তাকায়, যে যার
ভঙ্গিতে খানিক হাসে, চোখ বন্ধ করে, বিড়ি ফোঁকে
কখনও-বা। ফুরোলে বিড়ির আয়ু দূরে
ছুড়ে ফেলে দেয়। বহুক্ষণ আলাপবিহীন থাকে।
আচমকা একজন বুড়ো স্তব্ধতাকে ছিঁড়ে বলে, ‘তা’হলে কি
আমরা এখানে এভাবেই স্তব্ধতার
প্রতিমূর্তি হয়ে
আলাপকে বনবাস দিয়ে এই মাঠে শূন্যতাকে চুষে খাবো?’
তার বাক্যে অন্যজন নড়েচড়ে বসে, বন্ধুদের
দিকে হাসি ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘তুমিও তো পাথরের
ধরনে নিশ্চুপ বসে ছিলে এতক্ষণ। শোনো ভায়া,
তুমি কিছু শোনাও যা আমরা অতীতে
শুনিনি। তা’হলে বুঝি কতটা তোমার দৌড়, মাথা
নুয়ে মেনে নেবো ঠিক তোমার সিদ্ধির জেল্লা ভায়া।‘
এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো যে প্রবীণ, দৃষ্টি মেলে
এদিক সেদিক দ্রুত তাকিয়ে আবার
নিমেষে দৃষ্টির ঝাঁপি বন্ধ ক’রে বলে, ‘শোনা ভাইসব, যত
কথাই বলো না কেন, এই দুনিয়ায় পুরনোকে পুরোপুরি
খারিজের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ষোলো-আনা নতুন কথার
আমদানি বস্তুত সম্ভব নয়। প্রাচীনের রেশ রয়ে যায় শেষতক।‘
অকস্মাৎ বিরান মাঠের বুক থেকে পাঁচ বুড়োর আসর
মুছে যায়। সতেজ, সবুজ ঘাস আর
দূরবর্তী গাছপালা-সব কিছু গায়েব এবং
ধোঁয়াটে একটি গোলকের চঞ্চলতা পরিবেশে
শূন্যতাকে সদ্যবিধবার
বুক-চেরা মাতম বানিয়ে আবর্তিত হতে থাকে!
০৭.০৪.২০০৪
তিনজন ঘোড়সওয়ার
তিনজন ঘোড়সওয়ার সারাদিন অনেক
এবড়ো খেবড়ো পথ পেরিয়ে
ঘোর সন্ধ্যাবেলা এসে পৌঁছলো ঢের পুরনো
এক দালানের সামনে। ঘোড়াদের পিঠ থেকে
নেমে বেঁধে ওদের গাছের ডালে বেঁধে দালানে
প্রবেশ করেই গা ছমছমিয়ে ওঠে তাদের।
পরস্পর মুখের দিকে তাকিয়ে তারা খানিক
চমকে ওঠে। কোনও কথাই ঝরে না কণ্ঠস্বর থেকে।
ঘোড়সওয়ারেরা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ক’রে দালানে
বসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। বেশ পরে খানিক
চাঁদের ফিকে আলো ভাঙা জানলা
দিয়ে ঘরে ঢোকে সলজ্জ অতিথির ধরনে।
অতিশয় ক্লান্ত ঘোড়সওয়ারেরা মেঝেতে ঘুমোবার
চেষ্টা করতেই কানে ভেসে আসে কাদের
যেন পদধ্বনি। ওরা ভাঙা জানলা থেকে দৃষ্টি
মেলে দিতেই দ্যাখে ক’জন অপরূপ সুন্দরী
হেঁটে যেতে-যেতে কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। স্তম্ভিত
ঘোড়সওয়ারদের ঘোর কাটতে কাটতে কত যুগ কেটে গেলো, কে বলবে?
ঘোড়সওয়ারত্রয় জানলার কাছে মূর্তির ধরনে
রইলো দাঁড়িয়ে। বাইরে নানা গাছের ডালে সতেজ ভোরের
পাখিদের কোরাস ঝরায় অকৃপণ সুর। ঘোড়সওয়ারেরা
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো? কত শতাব্দী? ঘোড়সওয়ারেরা
কোথায়, কখন গেলে পাবে তাদের
মনের মতো জগৎ? কোথাও তেমন কিছু বাস্তবিক আছে কি?
আলোর আহ্বানে ঘোড়সওয়ারত্রয় অতিশয় পুরোনো
দালান থেকে বেখাপ্পা হাসিতে কাঁপতে
কাঁপতে ভয়ঙ্কর দৃষ্টি মেলে পরস্পর
অর্থহীন, মারমুখো ঝগড়া বাঁধিয়ে
একে অন্যকে ভয়ঙ্কর জখম করে। অদূরে
গাছের ডালে বন্দি শাদা, কালো এবং
লাল রঙের তিনটি ঘোড়া ওদের
মালিকদের কাণ্ডে ভয়ে, ঘৃণায়, ক্রোধে বন্ধন ছিঁড়ে পালায়।
১১.১২.২০০৪