কোন্ সে ব্যাধির
কে তুমি আমাকে লাটিমের মতো
ঘুরোতে ঘুরোতে আখেরে কোথাও
দূরে ছুড়ে ফেলো? কখনও তোমার
পাই না তো খোঁজ। কত পথে হাঁটি,
কত মাঠে ছুটি, নদীর কিনারে
বসে থাকি এক ধ্যানীর ধরনে।
প্রায়শ কতো রাত কেটে যায়
নির্ঘুম আর সারাদিন কাটে
ঘরের ভেতর পায়চারি করে।
কখনও আহার মুখে তুলে নিতে
ভুলে যাই আর গাছে পাখিদের
সংসার দেখে কত যে সময়
কেটে যায় আর জরুরি চিঠির
পাতা ছিঁড়ে ফেলি বড় ভুলো মনে।
যদি ভাবে কেউ রমণীর প্রেমে
মজে এই আমি এমন হয়েছি
তা’হলে বেজায় ভুল হয়ে যাবে।
ভালোবাসবার বয়সের কোনও
সীমানা যদিও বাঁধাধরা নেই,
সে কারণে আজ হইনি এমন।
ভুলো-মন তবে? বুঝি না, জানি না।
কেউ কি আমাকে দয়াপরবশ
হয়ে বলে দেবে কেন আজকাল
এমন উতলা এ-মন আমার?
কোন্ সে ব্যাধির হয়েছি শিকার?
এই ব্যাধি থেকে আমাকে মুক্তি
দেয়ার সাধ্য হাকিমের নেই।
০৯.০৪.২০০৪
কোন্ সে মানবী
তিন শতকের প্রাচীন অথচ
নব যুবতীর অপরূপ মুখ,
জ্বলজ্বলে চোখ, উন্নত বুক
বুকের সোনালি আঁচিল চকিতে
জাগে স্মৃতিপটে চোখ বুজলেই।
কাকে মনে পড়ে? কোন্ সে মানবী?
যত দূর জানি, নয় সে সুদূর
বাগদাদ কিবা দ্বারকার কেউ।
সে আমার এই জন্ম-শহরে
থাকে তার প্রিয় সংসারে আর
আমি থাকি দূরে, মানে বহুদূরে
এই শহরেই কবিতাকে বুকে প্রবল জড়িয়ে।
গৌরী নামের সেই যুবতীকে
হৃদয় আমার দিয়েছি যখন,
ছিলাম কি আমি যুবক তখন?
নয় তা মোটেই। তখন আমার
কেশর-সুলভ কেশের চূড়ায়
ধরেছিল পাক রীতি অনুসারে।
তবুও আমাকে দিয়েছিলে তুমি
পুশিদা পুষ্প হৃদয়-তরুর।
সেই পুষ্পের সুগন্ধে আমি
স্বর্গের আভা পেয়েছি নিত্য।
অথচ এখন সেই আভা তুমি
কেন যে হঠাৎ নিয়েছো ছিনিয়ে!
২০.০২.২০০৪
খোঁপায় সাজায় লাল ফুল
বসন্ত, এখন আমি যুবা নই আর,
উচ্ছ্বাস আমাকে মানায় না,
এখন যুবক যুবতীরা সহজেই
তোমার শোভায় মেতে ওঠে দিগ্ধিদিক।
যখন গাছের ডালে জ্বলজ্বলে পুষ্পরাজি দেখা
দেয়, আর সুরে সুরে তারুণ্যের
বিজয় ঘোষিত হয়, পরিবেশ যেন
রবীন্দ্রনাথের গীতসুধা হয়ে যায় লহমায়।
জীবনে বঞ্চনা আছে, আছে অত্যাচার,
অবিচার, প্রতারণা, তবু
যখন হাওয়ায় দুলে ওঠে গাছের সবুজ পাতা,
রঙিন ফুলের শোভা হৃদয়ের গভীরে বেহেস্তি আলো আনে।
ঘরে ঘরে, হে বসন্ত, তোমার উদ্দেশে গীতিমালা,
কবিতা এখন নিবেদিত, নৃত্যশিল্পী
বিচিত্র মুদ্রায় তুলে ধরে ক্ষণে ক্ষণে তোমাকেই।
ওগো ঋতুরাজ ঘরে ঘরে তোমারই বন্দনা আজ।
সচ্ছল ঘরেই শুধু এখন নন্দিত নও তুমি,
চেয়ে দ্যাখো তোমার রঙিন চোখ মেলে,
শহরের ঘিঞ্জি এক মহল্লার দীন ঘরে
একজন কুট্রি যুবা সঙ্গিনীর খোঁপায় সাজায় লাল ফুল।
খোলা উঠোন জুড়ে
এই যে খোলা উঠোন জুড়ে
চলছে নৃত্য, গানের সুরে দুলছে সত্যি
গেরস্তদের বসতবাড়ি। নাচ জমেছে
ডানে বামে। কাছের, দূরের সবার প্রাণে।
হঠাৎ কিছু মন্দ লোকের অত্যাচারে
নৃত্য-গানের আসর ভাঙে।
লাঠির বাড়ি মাথায় পড়ে শিল্পীজনের।
নারী, পুরুষ প্রাণের ভয়ে কাঁপতে থাকে।
কিন্তু ক’জন তরুণ রুখে দাঁড়ায় এবং
তাদের রণমূর্তি দেখে গুণ্ডারা সব
লেজ গুটিয়ে পালায় দূরে। খানিক পরে
বসলো হেসে গানের আসর, নাচের পালা।
সেখানে কেউ কখনও আর
নাটক কিংবা গানের আসর পণ্ড করে
দেয়ার খায়েশ নিয়ে লাঠি হাতে আসেনি।
নৃত্য-গীতের আসর জমে, জিন্দাবাদ।
২২.০৩.২০০৪
গলে-যাওয়া দীর্ঘকায় লোক
একজন দীর্ঘকায় লোক গলি থেকে
বেরিয়ে প্রধান পথে মাথা উঁচু ক’রে
হেঁটে হেঁটে সামনে এগোতে থাকে। অকস্মাৎ এ কি!
লোকটা মোমের মতো ধীরে
গলে যেতে থাকে আর পথচারী অনেকেই তার
দিকে অতিশয় বিচলিত দৃষ্টি গেঁথে দেয় যেন।
কারও দিকে দৃষ্টি নেই চলন্ত, গলন্ত লোকটার। পথে জমে
ক্রমাগত পথচারীদের ভিড়। কোন্
কে যে তীক্ষ্ণ খঞ্জর বসিয়ে দেয় বুকে,
এমন দুশ্চিন্তা নড়ে চড়ে মাঝে মাঝে,
যেমন ইঁদুর কোনও ক্রিয়াপ্রিয় বিড়ালের মতো।
আসমানে কৃষ্ণ মেঘমালা চন্দ্রমাকে গ্রাস করে!
শহরে পড়েছে ঢুকে জাঁহাবাজ ডাকাতের দল
চারদিক থেকে, ভীত-সন্ত্রস্ত শহরবাসীদের
চোখ থেকে গায়েব হয়েছে ঘুম। নারীদের সম্ভ্রম হানির
আশঙ্কা এবং পুরুষের শোণিতের বন্যা বয়ে
যাওয়ার শিউরে-ওঠা রক্তিম প্রহর কাটাবার
চেতনা, সাহস আর বিজয়ের ধ্বনি কখন তুলবে কারা?
যখন শহরবাসী হতাশার হিম-অন্ধকারে
হাবুডুবু খাচ্ছিল, হঠাৎ চৌদিক থেকে আলো
জেগে ওঠে আর কিয়দ্দূর থেকে অপরূপ গীত
ভেসে আসে। কী আশ্চর্য! গলিত মোমের
স্তূপ থেকে দীর্ঘদেহী রূপবান পুরুষেরা জেগে
উঠে শক্র-তাড়ানোর যুদ্ধে জয়ী হতে ছুটে যায়।
০৬.০১.২০০৫
গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান
এই যে আমি কে জানে কতদিন, কতকাল পর
সোঁদা মাটির ভেতর থেকে আচানক বেরিয়ে এসে
তাকাচ্ছি এদিক সেদিক, কে এই আমি?
এমন সুনসান এলাকায় কোন্ মানব বলে দেবে কে আমি?
থমথমে নৈশ প্রহরে মাটির বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে
কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হলো
নিজেকে। আত্মপরিচয় কোথায় কখন যে হঠাৎ
লুপ্ত হয়েছে! নামহীন, ঠিকানাবিহীন, কে
বলবে?
মাংসহারা, হাড়সর্বস্ব আমার শরীর কবর থেকে
বেরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিকেলের মৃত রোদ
আমার প্রবীণ কঙ্কালের সঙ্গে
ইয়ার্কি মারার মতলবে ঘন ঘন
চুমো খায়, সুড়সুড়ি দেয় মাংসবিহীন
বগলে। আমার কঙ্কাল হাঁটতে থাকে দিশাহীন।
আমার করুণ কঙ্কাল বিরান গোরস্তানে
অদৃশ্য মহিমায় পথ চলে, দেহলগ্ন মাটি
খসে না কোথাও। হঠাৎ দু’টি কাক কোত্থেকে
উড়ে এসে সওয়ার হয় আমার কাঁধে। চেঁচাতে
চেষ্টা করে প্রাণপণে, অথচ নীরবতা! ভর করে
ওদের ওপর। হঠাৎ তিনটি কোকিল কিয়দ্দূরে
মহানন্দে সুরের ঝরনা সৃষ্টি করে। আমার
কঙ্কাল কারও চোখে পড়ুক না পড়ুক,
কোকিলের সুর সজীব।
গলায় বজ্রপ্রায় আওয়াজ এনে
নিজের উপস্থিতি প্রচারে শত চেষ্টা
সত্ত্বেও ব্যর্থ হই বারবার। শরীরের ভীষণ
শুষ্ক, ভঙ্গুর হাড়গুলো শীতার্ত গাছের
পাতার মতো ঝরতে থাকে। আকাশে
নক্ষত্রের ঝাঁক মেতে ওঠে উপহাসে। বিরান
গোরস্তানের স্তব্ধতাকে মাঝে-মধ্যে সঙ্গীতের
আভা দিয়ে
সাজিয়ে তোলে কোকিলের করুণ আহ্বান।