কঙ্কালের সঙ্গে
আজকাল কী-যে হয়, বড়
ভুল করে ফেলি বারবার। চিঠি লিখে
খামে ভরবার পর ঠিকানা লিখতে গিয়ে কিছু
বাদ পড়ে যায়
অনিচ্ছাবশত আর সেই ভ্রম ভ্রমরের মতো
হুল ফোটাতেই থাকে। চিঠিখানি ডাকঘরে বেঘোরে ঘুমায়।
বয়সকে দোষী ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা
দিই বটে, তবু এই বেয়াড়া মনের হঠকারি আচরণে
ক্রদ্ধ হয়ে আমারই মাথার চুল ছিঁড়ি
আর কষে চড় দিই টেবিলের গালে। অকস্মাৎ
নিকটে ঝিমিয়ে-থাকা অসমাপ্ত কবিতা আমার
হায়, ভীতত্রস্ত হয়ে দৃষ্টিপাত করে ডানে, বামে।
তা হ’লে আমি কি খাতা বন্ধ করে রাখবো সর্বদা ?
কলমের মুখে এঁকে দেবো
খিল যতদিন বেঁচে থাকি ? ‘কেন তুমি এই মতো
ভাবনাকে আজকাল চলেছো প্রশ্রয় দিয়ে ?’- নিজেকে সওয়াল
করি; ‘মন থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু স্বাভাবিক জীবনের পথে
হেঁটে ফের তুখোড় আড্ডায় ঝেড়ে ফেলো ক্লান্তির কুয়াশা।‘
অথচ আমাকে নানা উদ্ভট দৃশ্যের ছায়াছবি
কেবলই দেখায় ভয়। ঘুমোতে গেলেই
কঙ্কালেরা আমার শয্যার পাশে এসে
দাঁড়ায় অথবা বসে। নিঃশব্দ হাসির তোড়ে ভাসায় আমাকে!
কাদের ভগ্নাংশ এরা? কোন্ দশক অথবা শতকের ধুলো
ঝেড়েঝুড়ে এসেছে এখানে? দাঁতহারা, শব্দহারা
হাসি যাচ্ছে দেখা মুখমণ্ডলে ওদের। কঙ্কালের
হাসি কি আমাকে কোনও পরমার্থ বোঝাবার চেষ্টা
করছে নির্জন ঘরে? পরমুহূর্তেই ওরা ঘরের রেলিং-এ
ঝুলে পড়ে, যেন কোনও ঘৃণ্য অপরাধের আসামি।
আচমকা নিজেকেই সেই কঙ্কালের মতো
মনে হয় আর আমি শুয়ে আছি যেন কোনও
পুরনো কবরে; নানা কীট শরীরের মাংসহীন,
ক্ষয়া হাড়ে হেঁটে হেঁটে ভীষণ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ খুব! সেই দৃশ্য
থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে করে ভারী
ক্লান্ত হয়ে পড়ি, নখ দিয়ে স্যাঁতসেঁতে মাটি আঁচড়াতে থাকি।
১৪.০২.২০০৪
কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার বাসনায়
কখন যে আমাকে ভীষণ এক পশু এ পাড়ায়
তাড়িয়ে এনেছে, টের পাইনি। তা’হলে এতক্ষণ
দুঃস্বপ্ন দেখেছি ঘুমে? মনে
হলো সারা শরীরে রয়েছে
গাঁথা সারি সারি কাঁটা। কেন
এই শাস্তি ভোগ করে চলেছি, বুঝি না কিছুতেই।
কখনও কখনও ক্ষণকাল অপরূপ গাছঘেরা
হ্রদের কিনারে দেখি নিজেকে শায়িত। কানে আসে
পাখিদের সুরেলা আওয়াজ। অপক্ষণে মনে হয়, কারা যেন
চুপিসারে চলে গেলো অজানায়। আমি ঘাসময়
মাটি থেকে উঠে আস্তে গা ঝেড়ে এগোই
অন্যদিকে ভিন্ন দৃশ্য দেখার আশায়। আসমানে জাগে চাঁদ।
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় যে চলে যাই, ঠিক বুঝে
ওঠা ঢের মুশকিল। কানামাছি খেলার ধরনে
প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছে স্বস্তি বোধ করা হয় না সহজ আর।
ঝরিয়ে প্রচুর ঘাম ডানে বামে শেষে
বস্তুত নিজের নির্বুদ্ধিতা ভীষণ অসহ্য লাগে। ঘরে ফিরে
ক্লান্তির অসহ্য চাপ দু’ চোখে ঘুমের ছায়া মাখে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে সমস্ত শরীরে যেন কেউ শত
তীক্ষ্ণ সুচ বিঁধিয়েছে শাস্তিরূপে। আখেরে ক্লান্তির
কালিমা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে
যেন জাদুবলে দিব্যি আলাদা মানুষ হয়ে ফের
কাছের টেবিলে ঝুঁকে অসমাপ্ত এক
কবিতাকে পূর্ণতা দেয়ার বাসনায় উদ্দীপিত হয়ে উঠি।
১৭.১০.২০০৪
কবির আভায় প্রজ্বলিত
ইদানিং কখনও কখনও হঠাৎ কী-যে হয়,
আমার চোখের সামনে কিছু
ছবি ঝলসে ওঠে, যেগুলো বড় বেখাপ্পা, বেগানা।
সেসব ছবি আমাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে
বেশ কিছুক্ষণ। তখন আমার বেহুঁশ হওয়ার
উপক্রম। নিজেকে সামলে রাখি কোনও মতে।
ক্ষণিক পরে নিজেকে দেখতে পাই একটি বাগানে।
বাগানের সৌন্দর্য এমনই, যা’
বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত, শুধুউ অসামান্য
কোনও শিল্পী তার চিত্রে ফোটাতে সক্ষম
সেই সৃষ্টি। আমার বিস্ময় মুছে যাওয়ার
আগেই দেখি আমি পড়ে আছি এক হতশ্রী ভাগাড়ে।
কে আমাকে মুক্তি দেবে এই ভয়ঙ্কর
পরিবেশ থেকে? আমি কি এখানে পচতে থাকবো?
অবিরাম বমি কি আমাকে বেহুঁশ করে ফেলবে?
দুশ্চিন্তায় অবসন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই
একটি প্রফুল্ল সারস আমাকে তার ডানায়
আশ্রয় দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলো মেঘলোকে।
কখন যে মেঘলোক থেকে অপরূপ এক উদ্যানে
এসে গাছতলায় ঠাঁই পেলাম,
টের পাইনি। নিজেকে কেমন পরিবর্তিত মনে হলো।
একি! আমার ভেতর এক পরিবর্তিত ব্যক্তিকে
অনুভব করি। অজানা কে যেন আড়াল থেকে
আমাকে কবির আভায় জ্বলজ্বল্ব করে!
১৯.০৯.২০০৪
কী তবে আমার কাজ
কী তবে আমার কাজ? কেউ বলে, ময়দানে গিয়ে
স্টেজে উঠে আগুন-ঝরানো,
জনতা-জাগানো বক্তৃতায় মেতে ওঠো। কেউ
বলে, যত পারো লিফলেট লিখে সর্বত্র ছড়াও।
এইসব পরামর্শ শুনে শুনে দু’বেলা কানের
পর্দা ফেটে যেতে চায়! উত্তেজক মিছিলে প্রায়শ
সোৎসাহে সামিল হয়ে স্লোগান ছড়ালে
হবে কি সার্থক এই মানব জীবন শান্তশিষ্ট এ বান্দার?
বস্তুত এসব কাজে দক্ষতা দেখানো,
বাহবা কুড়ানো ক্ষণে ক্ষণে সাধ্যাতীত
আমার, বরং এর চেয়ে ঢের ভালো নিজ ঘরে বসে কোনও
কবিতার ধ্যানে কিছু সময় কাটিয়ে লিখে ওঠা।
সে-কবিতা যদি মানুষকে দিন বদলের কাজে
প্রেরণা জোগায় বহুবার,
তাহ’লে জীবন এই নগণ্য আমার
সার্থকতা পেয়ে যাবে, অন্তরালে ধন্য হবে কবি।
১৭.০২.২০০৪
কোকিলের গানে
আমি তো এখন দূরে, বহুদূরে চলে
যেতে চাই। যদি হেঁটে যেতে হয়, তবু
দ্বিধাহীন চলে যাবো। যদি ঘামে নেয়ে উঠি, তবু
থামাবো না গতি, বেপরোয়া যাত্রী আমি।
এই যে হেঁটেছি ইতিমধ্যে ঢের পথ, বাধা পেয়ে
যাইনি ভড়কে কিছুতেই। প্রধানত
আলোয়, অথচ ঘোর অমাবস্যা হলেও যাত্রার
বেগ না থামিয়ে চালিয়েছি পদযুগল
সামনের দিকে আর যখন হঠাৎ হিংস্র কোনও
পাখি এসে হামলা করেছে, ওকে দিয়েছি তাড়িয়ে।
ছিল না সহজ কিছু, পদে পদে কত যে বিভ্রম
নানা ছদ্মবেশে এসে মধুর আলাপে
আমাকে ভুলিয়ে সর্বনাশ সাধনের
চোখ-ঝলসানো প্রক্রিয়াকে প্রায়-সফল করেছে
ভেবে চারদিক তীক্ষ্ম হাসি-ঝড়ে ভীষণ কাঁপায়।
অকস্মাৎ চোখ খুলে গেলে দেখি এক
নিঝুম কবরস্থানে শুয়ে আছি। নানা ধরনের
কবরের ভেতর কত যে
কাহিনী ঘুমিয়ে আছে, কোন্ গল্পকার
রূপায়িত করতে পারবে সেই অজানাকে? কোকিলের গানে
গুঞ্জরিত হয়ে গোরস্তান আরও বেশি স্তব্ধতায় মগ্ন হয়।
১০.০৪.২০০৪