এ কেমন রাত এলো?
সারাদিন কাজ করে সন্ধেবেলা রহমত আলী
গৃহিণীর জন্যে কিছু ফুল নিয়ে বস্তিতে ফেরার
পথে দ্যাখে আসমানে রূপালি টাকার মতো চাঁদ
হাসছে। হঠাৎ এ কী! মিশমিশে অন্ধকার থাবা
দিয়ে ঢেকে ফেলে চতুর্দিক। এ কেমন
তুফান কাঁপিয়ে দিচ্ছে সব কিছু? কেমন ধ্বংসের আলামত?
‘এ কেমন রাত এলো’? রহমত আলী নিজেকেই
প্রশ্ন করে। নড়বড়ে ঘর তার জ্বরতপ্ত রোগীর লাহান
ভীষণ কাঁপছে, যেন এক্ষুণি পানিতে
ভেসে যাবে। তার গৃহিণী রহিমা
বেজায় ভয়ার্ত চোখে তাকায় স্বামীর দিকে আর
কোলের সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরে।
আসমান বেজায় গর্জনে চতুর্দিক
কাঁপিয়ে তুলছে; রহমত আলী কেঁপে-ওঠা ঘরে
বসে দ্যাখে, বড় জোরে পানি
ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে
দিয়েছে হাঙ্গাম জুড়ে। বুঝি নিমেষেই
সব কিছু ডুবে যাবে, ভেসে যাবে, বুঝিবা নিশ্চিহ্ন
হবে সব কিছু, যাবে মুছে, হায়, সাধের সংসার।
এ কেমন মশারি ধরেছে ঘিরে চতুর্দিক থেকে?
কখন যে ডুবেছে কুটির তার, রহমত বুঝতে পারেনি।
ডুবতে ডুবতে
ঘুমের সজল মায়াজাল থেকে জেগে
রহমত নিজেকে দেখতে পায় কাঠের তক্তায়।
কোথায় সংসার তার? কোথায় রহিমা?
হা কপাল! কোথায় সন্তান? ধোঁয়া, সব কিছু ধোঁয়া।
২৯.০৬.২০০৪
এই পরিণতি জেনেও এখনও
গভীর নিশীথে যখন বাড়ির সবাই ঘুমের
চুমোয় অচিন বাগানে মুগ্ধ, আমি জাগ্রত
একাকী লেখার টেবিলে কলম হাতে নিয়ে আর
দূরের আকাশে তারাগুলো হাসে কবির কাণ্ডে।
এই যে নিজেকে কবি বলে মেনে নিয়েছি কিছুটা-
ব্যাপারটি ঠিক হয়নি শোভন। মাঝে মাঝে ভাবি,
সত্যি কি আমি পেরেছি দাঁড়াতে এখনও প্রকৃত
সৃজন-মুখর কবির সারিতে? কে দেবে ভরসা?
ভীষণ আঁধার আমাকে চকিতে মুছে ফেলে দিলে,
আমার সৃষ্টি শব্দমালা কি ঝুলবে তখনও
পাঠক-সমাজে? জানবো না, হায়, কিছুতেই আর।
তবুও সফেদ কাগজ সাজাই কালো অক্ষরে।
হয়তো আড়ালে জাঁদরেল কোনও ক্রিটিক অধরে
বাঁকা হাসি টেনে আমার বেচারা কবিতার বই
ছুড়ে ফেলে দেন বাজে কাগজের ঘৃণ্য পাহাড়ে।
এই পরিণতি জেনেও এখনও বেহায়া মাথায়
এক রাশ শাদা কাশফুল নিয়ে কখনও সকালে
দুপুরে অথবা গভীর নিশীথে কলম চালাই।
২১.০৯.২০০৪
একটি এলিজি
(খন্দকার মজহারুল করিম স্বরণে)
কেন তুমি হুট করে এত প্রিয় এই আসরের
আকর্ষণ ছেড়ে চলে গেলে? কেন গেলে?
তোমার তো ছিলো না বিতৃষ্ণা,
যতদূর জানি, স্বদেশের নদী, মাঠ, গ্রামগঞ্জ,
শহরের ঘরবাড়ি, রাজপথ, অলিগলি আর
দীপ্ত জনসভা আর জনতা-শোভিত দীর্ঘ মিছিলের প্রতি।
সংসার সুখেরই ছিলো; ছিলো না কি? জীবনসঙ্গিনী
আর প্রিয় দু’টি সন্তানের সঙ্গ তুমি উপভোগ
করেছো সর্বদা। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে
মেতেছো আড্ডায়। দেশ, দেশবাসী, কখনও হতাশা,
কখনও-বা ভোরের সূর্যের মতো আশা
উঠেছে ঝলসে প্রাণে। দেশের দশের কল্যাণের,
প্রগতির পথ কী ক’রে যে প্রসারিত হবে, তার
ভাবনায় কেটেছে বিনিদ্র রাত বহুবার। স্বাস্থ্য গেছে ক্ষয়ে।
প্রায়শই মধ্যরাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, একা
কোনার টেবিলে ঝুঁকে প্রবন্ধ লিখেছো ঢের চাহিদা মেটাতে
পত্রিকার। তোমার জীবনে ছিলো নক্ষত্রের আলো
এবং সূর্যের হাসি; প্রগতির পথে
হেঁটেছো, তবুও কেন এই অবেলায়
চলে গেলে প্রিয় কাজ অসমাপ্ত রেখে?
২২.০১.২০০৪
একটি প্রাচীন সংলাপ
বয়স কম তো নয়, উড়ছে মাথায়
এখনও সফেদ চুল, কোনও
কোনও দাঁত নড়বড়ে। তদুপরি কফের ধমকে হামেশাই
বুক ফেটে যেতে চায়। তবুও কলম তার প্রায়শ চঞ্চল।
আজকাল কখনও কখনও বটগাছ থেকে নেমে
একজন অতিশয় বেঁকে-যাওয়া বুড়ো,
অনন্ত কালের মতো বুড়ো,
কবির বিনীত দোরে কড়া নেড়ে অপেক্ষা করেন।
খানিক পরেই কবি দোর খুলে দাঁড়ান, তাকান
অতিশয় নুয়ে-পড়া প্রবীণের দিকে। অনন্ত কালের মতো
যিনি তাঁর কণ্ঠ ধীরে করে উচ্চারণ-
‘তোমার লেখার ধার অস্তগামী, অবিলম্বে থামাও লেখনী।
নয়তো বুকের রক্ত ঝরিয়ে হলেও
খাতার পাতায় ফের সাজাও সতেজ প্রাণ বেগ, সৃষ্টি করো
পুষ্পদল। নয়তো কী লাভ বলো নিজেকেই
নিজেরই ডোবায় নিত্য নাকানি চুবানি খেতে দেয়া?
ক্ষণকাল পরে সেই অতিশয় প্রবীণ মানব
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলে বয়স্ক কবির
মনে ভাবনার ঢেউ খেলে যায় বারবার; আখেরে চকিতে
কবিতার খাতা খুলে তিনি
রচনা করেন এক নতুন কবিতা, রূপ যার
আকাশের তারার মতোই জ্বলজ্বলে,-হাসি ফোটে
কবিতার খাতায়, এমন হাসি আর
ঝরায়নি ঝর্নাধারা কোনও কবিতার পঙ্ক্তিমালা।
০১.১১.২০০৪
কখন পাবো মুক্তি?
এই তো আমি
অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে সন্ধেবেলা
পৌঁছে গেছি তিন শো বছর পুরনো এক
গাছের নিচে। কিন্তু আমি এমন স্থানে এলাম কেন?
নিজেকে এই
প্রশ্ন ক’রে জবাব খুঁজে পাই না কোনও।
আমার ভেতর মুষড়ে-পড়া সঙ্গীবিহীন পথিকটিকে
কী ক’রে যে বটের তলায় এই অবেলায় করি সুখী!
নই তো সাধু,
কিংবা তস্বি-হাতে কোনও শুদ্ধ ফকির নষ্ট কালে।
এই তো চোখে আসছে নেমে ঘুমের পর্দা; এই বিরানায়
আয়েশ-ছড়ানো শয্যা আমি পাবো কোথায়?
হঠাৎ একি!
আমার সামনে দাঁড়ায় এসে হরিণ-ছানা
কিন্তু কিছু পরেই এক হিংস্র পশু এসে আমায়
শাসায় বেজায়, নখরগুলো রোদে ভীষণ ঝলসে ওঠে!
দেখছি যা’ যা’
সব কিছু কি সত্যি না কি ক্লান্তি-কালো
দুঃস্বপ্ন এক? চোখে নানা বিশ্রী ছবি উঠছে ভেসে;
কখন পাবো মুক্তি আমি বটতলার এই জুলুম থেকে?
১৭.০১.২০০৪