আলাদা এক রাজ্য
এই যে কবি ভর দুপুরে
হন্তদন্ত হয়ে এখন যাচ্ছো কোথায়
কোন্ ঠিকানা লক্ষ্য ক’রে? উশকো খুশকো
ঢেউ-খেলানো লম্বা চুলের নিচে আছে
মস্ত দামি মগজ বটে, সেখানে এক ফুল-বাগানে
গানের পাখি সৃষ্টি করে সুরের আলো।
হায়রে কবি, ধুলোয় তোমার
পাঞ্জাবি আর পায়জামাটা ধূসর হলো, তবু হাঁটা
থামছে না যে। আর কতটা পথ তোমাকে হাঁটতে হবে?
দুপুরটি কি বিকেল হবে? নাকি কালো
সন্ধ্যা হয়ে ভেঙচি কেটে ভয় দেখাবে ক্লান্ত এই
পথচারীকে! কবি তুমি পথ হারালে বেলা শেষে?
পথ হারালে যাবে কোথায় এ শহরে
আলোবিহীন কোন্ অজানা আস্তানেতে?
কেউ কি তোমার হাতটি ধ’রে নিয়ে যাবে
শান্তিময়ী কারও কাছে, যার মোহিনী ছোঁয়ায় তুমি
ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাবে ? কবি তোমার
মনে তখন ফুলের মতো পদ্য কোনও উঠবে ফুটে।
এইতো দ্যাখো কবি, তোমার কল্পনাকে ধনী ক’রে
চতুর্দিকে আঁধার ছিঁড়ে জ্বলে ওঠে হাজার বাতি,
এখন তুমি এই শহরে রাজা বটে। হাতে একটি
কলম পেলে আলাদা এক রাজ্য জানি উঠবে গড়ে।
২৯.০১.২০০৪
ঈর্ষা-বিছা
তোমার সঙ্গে দেখা হলো কোন্ দশকে ?
নাকি সুদূর ধূসর কোনও ভিন শতকে ?
তখন তুমি এই আমাকে চিনতে পেরেছিলে কি ?
আমি তোমায় চিনতে পেরে হ্রদের দিএক গিয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি অচেনা এক যুবার সাথে
গল্পে মেতে ছিল বটে। আমি তোমার
দৃষ্টিপথে পড়িনি যে, বুঝতে আমার
হয়নি কষ্ট। হয়তো খানিক চিন্তে পেরে
ইচ্ছে করেই অবহেলা করেছিলে। এখন কিছু
পুষ্প জানি ঝরেছিলো মাটির বুকে।
আচ্ছা তুমি এই আমাকে এমন ঝাঁ ঝাঁ
অবহেলা করলে কেন ? না হয় আমি
ক্ষয়ে গেছি কালের চড়ে, কিন্তু আমার
মন এখনও সজীব কোনও ফুলের মতোই
রয়ে গেছে। এই তো আমি তোমায় দেখে
অনেক পরে হয়ে গেছি আবার যুবা সন্ধ্যা রাতে!
কিন্তু তুমি এই আমাকে রাখলে দূরে
হেলায় ঠেলে। মেতে আছো যুবার সঙ্গে
হ্রদের ধারে। জানি না কোন্ সুখের টানে
যাচ্ছো ভেসে! ঈর্ষা-বিছা আমায় জ্বালায় ক্ষণে ক্ষণে!
০৭.০২.২০০৪
উৎফুল্ল পূর্ণিমা যখন প্রখর অমাবস্যা
এই যে দেখছি আকাশ, পায়ের তলার
সোঁদা মাটি, বাতাসের গাছের
সবুজ পাতার কম্পন ক্ষণে ক্ষণে, পাখির
উড়ে এসে বসা পাশের বাড়ির উন্মোচিত ছাদে,
কিয়দ্দূরে একজন পথিকের হেঁটে-যাওয়া সবই
নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে, সত্যি বলতে কি,
বিশিষ্ট করে তুলেছে, যদিও এই গলিতে
তেমন কোনও আয়োজন নেই উৎসবের।
তা’হলে কেন মনে এই বুড়ো সুড়ো আমার অন্তরে
এই অবেলায় ফুটেছে নানা সুগন্ধি ফুল,
কেন সত্তা-নাচানো গানের সুর প্রস্ফুটিত?
কেন তিনজন বয়েসী ব্যক্তি
হাত ধরাধরি করে গাইছেন পুরনো দিনের বিস্মৃত
এক গান। আকাশের বঙ্কিম চাঁদ ডেকে আনে নক্ষত্রদের।
এই আমি কিছুক্ষণ আগেও নববর্ষের আহ্বান,
সত্যি বলতে কি, শুনতে পাইনি। তিনজন বুড়োর
মিলিত নৃত্য আমাকে
চকিতে উৎসবে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে
ভুলিয়ে দিলো বাস্তবের নির্দয় প্রহার এবং
সমাজের কাণ্ডারিদের প্রতারণা, ভ্রূকুটি,
হঠাৎ মনে হলো, আকাশের উৎফুল্ল পূর্ণিমা
প্রখর অমাবস্যা হয়ে আমাদের ভীষণ কামড়াতে থাকে।
১৩.০৪.২০০৪
এ কার স্মরণসভা
সত্যি বলতে কী বেশ কিছুদিন থেকে
রাতে ঠিক মতো
ঘুমোতে পারিনে। বালিশে
মাথা রাখলেই কী সব আজব
ছবি ভেসে ওঠে চোখের সম্মুখে,
বিভিন্ন হাতিয়ার নাচতে থাকে
আমার চারদিকে, জল্লাদের চিৎকারে
কান ফেটে যেতে চায়, চোখ বুজে ফেলি
জল্লাদ কি কাউকে হুকুম দিচ্ছে আমাকে
ধরে আনার জন্য? হয়তো;
আমার বুক ধুকধুক করতে থাকে এবং
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি বাঁচা মরার দোটানায়
অতীত, বর্তমান এবং ভবিষৎ গুলিয়ে ফেলি।
বিশ বছর আগেকার এক বিকেলবেলার
দৃশ্য ভেসে ওঠে স্মৃতিতে, একজন বিষণ্ন তরুণীকে
দেখতে পাই আমার বেষ্টনীতে।
অকস্মাৎ এক জনসভায় দেখি আমাকে
বক্তৃতাপ্রবণ, আমার বক্তব্য হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে
নাকি শ্রোতাদের উদ্বুদ্ধ করছে বুঝতে
পারার আগেই শুরু হয় বেজায় হট্রগোল
পুলিশের লাঠির সারি হামলায় মাতে বেধড়ক
আমি কি আহত হয়ে ধুলোয় লুটিয়ে কাতরাচ্ছি বেজায়।
বহুদিন পর নিজেকে দেখতে পাই এক স্মরণসভায়
এ কার স্মরণসভা, অন্য কারও নাকি ভাঙাচোরা আমার?
০৬.০৯.২০০৪
এ কেমন কালবেলা
অন্ধকার, বড় বেশি অন্ধকার আস্তানা গেড়েছে
চারদিকে। খুব কাছের বস্তুও
এখন যাচ্ছে না দেখা। সম্মুখে এগিয়ে
যেতে গেলে কী যেন কিসের
হোঁচট পেছনে ঠেলে দেয় এই বিব্রত আমাকে
কিয়দ্দূরে। নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক পথ খুঁজে নিতে চাই।
‘কে তুমি এমন বিরানায় আমাদের
আস্তানায় তস্করের মতো
গোপনে পড়েছো ঢুকে?’ ভীষণ ভড়কে গিয়ে কথা
বলবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলি আর
অদৃশ্য ব্যক্তির অবয়ব খুঁজে খুঁজে ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে
পাথুরে মূর্তির মতো হয়ে থাকি।
কে আমাকে বলে দেবে কতদূর গেলে খাঁটি কোনও
মানুষের দেখা পাবো? এখন আমার
আশেপাশে খল, ভণ্ড আর ষোলোআনা স্বার্থপর
লোক আসা-যাওয়া করে। যে গাছকে ছায়াময় ভেবে
ঠাঁই নিই ওর নিচে, নিমেষেই সেটি উবে গিয়ে
এক রাশ কাঁটা হয়ে আমাকেই কামড়াতে থাকে।
ছুটতে ছুটতে শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে এ কোথায়
এসে পড়লাম সন্ধ্যাবেলা? আশ্রয়ের
এক রত্তি চিহ্ন নেই, শুধু খাঁ খাঁ শূন্যতা আমাকে
ত্বরিত গ্রাসের বাসনায় ক্রমাগত জিহ্বা চাটে।
তাহ’লে আখেরে, হায়, এই কালবেলায় কোথায়
বিশ্বাস্ত আশ্রয় পাবো খুঁজে? কে আমাকে
বুকে টেনে নিয়ে সুমধুর কণ্ঠস্বরে
বলবে, ‘বান্ধব, ভয় পেও না, এখানে ঠাঁই নেই ঘাতকের।