আকাশে অনেক মুখ
এ কেমন সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমার
প্রিয় এই শহরকে আজ। চতুর্দিকে
গুঁড়িয়ে পড়ছে ঘরবাড়ি। নরনারী, শিশুদের
বুকফাটা কান্নায় কাঁপছে পথঘাট, গাছপালা।
এই তো নিজেকে আমি হট, পাথরের
স্তূপ থেকে আহত শরীর তুলে দেখে আশেপাশে,
সবদিকে অগণিত লাশ, কোনও কোনও
স্থানে ভাঙা পুতুল-জড়ানো হাতে নিষ্প্রাণ বালিকা।
আমাদের ছোট ঘরবাড়ি খুঁজে খুঁজে
আখেরে অধিকতর ক্লান্ত শরীরে অজানা
জায়গায় ভগ্নস্তূপে বসে পড়ি। হঠাৎ সমুখে
একটি ধূসর খাতা দেখে দ্রুত হাতে তুলে দিই।
আবিষ্কৃত খাতার প্রথম দু’টি পাতা
গায়েব হ’লেও অবশিষ্ট বেশ ক’টি পাতা জুড়ে
রয়েছে কবিতা সত্যি বলতে কী, কতিপয় পদ্য
পড়তেই উদ্ভাসিত প্রকৃত কবির পরিচয়।
কখন যে রাত ওর কোমল শরীর
নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, অদূরে গাছের
পাতাময় ডাল থেকে পাখির নিঝুম গান ঝরে
জ্যোৎস্নার ধরনে। ভেসে ওঠে আকাশে অনেক মুখ।
১৪.০১.২০০৫
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, তোমাকে
এই যে এখন বসে পুরনো চেয়ারে
এবং ঈষৎ ঝুঁকে টেবিলে লিখতে শুরু ক’রে
মনে গাছপালা, নদী, জ্যোৎস্নাস্নাত ক্ষেত
জেগে ওঠে বয়েসী আমার কিয়দ্দূরে। মাঝে মাঝে
পাখি গান গেয়ে ওঠে, জ্যোৎস্না নৃত্যপরায়ণ হয়।
এমন সময়ে মনে পড়লো তোমার কথা হে বন্ধু, যে-তুমি
সুদূর বিদেশে একা শীতার্ত রাত্তিরে
পড়ছো জরুরি বই অথবা লিখছো স্বদেশের
পত্রিকার প্রয়োজনে নিয়মিত তুখোড় কলাম,
যেগুলোর সাড়া দ্রুত পড়ছে পাঠক-পাঠিকার মজলিশে।
হে বন্ধু, তোমার কখনও কি মধ্যরাতে অনুতাপ
জেগে ওঠে সাহিত্য-রচনা অবহেলিত হয়েছে
বড় বেশি ব’লে? না কি নিজেকে প্রবোধ দাও কাগজে কলম
ছোঁয়াবার কালে দেশবাসীদের জাগাবার কাজ
অবহেলা করা অনুচিত ভেবে লিখছো নিয়ত?
শোনো বন্ধু, যে যাই বলুক, রাশি রাশি
লেখক বিস্মৃত হবে ভাবী কালে, অথচ তোমার নাম নিশ্চিত ঘুরবে
গুণীজন আর জনতার মুখে যুগে যুগে। এই সত্য
উজ্জ্বল তোমার কাছে, বুঝি তাই তুমি প্রায়শই
চালাও কলম সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে।
জানি বন্ধু, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মৃতিপটে
রাখবে সাজিয়ে ভালোবেসে, শ্রদ্ধাভরে
তোমার অক্ষয় নাম, গাইবে তোমার গান যুগ-যুগান্তর-
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি?’ বন্ধু, তোমাকেও
ভুলবে না প্রকৃত বাঙালি কোনও কালে।
আমি আর আমি নই
মধ্যরাতে আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখি-
আমার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
এগোচ্ছে দেয়ালের দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত আমি
চোখ বুজে থাকি কিছুক্ষণ। আবার
চোখ মেলতেই বিচ্ছিন্ন হাতকে দেখি দেয়াল আর
ছাদ ভ্রমণের তোফা জায়গা ঠাউরে নিয়েছে।
বেহাত আমি কাকে ডাকবো গহন রাতে?
চেঁচাতে গিয়ে বেজায় নির্বাক হয়ে শুধু
পড়ে থাকি বিছানায়। হঠাৎ মনে হয়, এ কি!
আমার নিজের ভাষা, অন্য যে-ভাষা
জানা আছে-সবই বিস্মৃতির তিমিরে
নিমজ্জিত। কিছু বলতে গেলে জাগছে
অবোধ্য শব্দের বেখাপ্পা কিছু ধ্বনি। আমাকে
নিয়ে এ কেমন খেলা চলছে? চৌদিকে আজব
সব ছবি ভাসছে, ডুবছে বারবার। দেয়াল
ভেঙে পড়ছে এদিক সেদিক। আমি আর আমি নই।
আমাকে ঠুকরে খাচ্ছে কয়েকটি আজব
মিশকালো কাক। কখন থেকে পড়ে আছি
এঁদো কাদায়, বলা দায়। আমাকে এখানে এনেছে
কারা-কেউ কি বলে দেবে? অস্থিরতা চেপে ধরেছে!
বীভৎস শব্দ সব ধেয়ে আসছে
চতুর্দিক থেকে। কারা যেন আমার শরীর থেকে
খসিয়ে নিচ্ছে মাংস, কতিপয় ক্ষধার্ত শকুন
সোৎসাহে ধেয়ে আসছে নেমে আমার দিকে।
এ কি! আমার শরীর থেকে মাথা
বিচ্ছিন্ন হয়ে কিয়দ্দূরে বিষণ্ন এক
বটগাছের প্রায় শরীর ছুঁয়ে নাচতে
শুরু করে। অথচ আমার শ্বাসপ্রশ্বাস
বইছে রীতিমতো। উপরন্তু আমার মনে
অসমাপ্ত কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি
গজিয়ে উঠলো গাছের সতেজ পাতার মতো
স্বচ্ছন্দ, অনাবিল। পাশেই ধ্বনিত পাখির গান।
০৪.০৯.২০০৪
আমি কোথায় এসে পড়েছি
আমার জীবন কখন যে আচমকা
মুছে যাবে, জানা নেই। হোক না যখনই,
দৈবক্রমে যদি দুনিয়ায় ফিরে আসি
হাজার বছর পর শ্যামলীতে, তখন কি খুঁজে
পাবো এই আমার নিজের বাড়িটিকে? কিছুতেই
পড়বে না দৃষ্টিতে বিনীত সেই বাড়ি। বহুতল
শৌখিন মহল কোনও করবে বিরাজ সেই স্থানে। হয়তো-বা
আগেকার চেনা জায়গাটা, মাথা কুটে মরলেও, চিনবো না।
আমার নিজের বংশধর কেউ চিনে নিয়ে এই
আমাকে স্বাগত
জানিয়ে শ্রদ্ধাত আভা ছড়িয়ে সানন্দে বসাবে না
অপরূপ আসনে এবং
আমার দু’চোখ ভিজে যাবে কি তখন ঠিক মানুষের
মতো নয়, অথচ মানব-সন্তানের
বিকৃত ধরনের গড়ে-ওঠা জীব যেন নিয়মিত
ওঠে বসে, হাঁটে আর দরজা, জানালা বন্ধ করে, খুলে দেয়
সম্ভবত বিলুপ্ত আমার বংশধর। বৃথা আমি
উঠবো সন্ধানে মেতে তাদের কাউকে
এবং হাঁটবো ডানে বামে। প্রশ কি করবো
কখনও সখনও পথচারীদের? নিরুত্তর চলে যাবে ওরা
যে যার গন্তব্যে। প্রকৃতই আছে কি গন্তব্য কোনও?
‘নেই, নেই’ ধ্বনি শুধু কানে এসে ঝরে যায় নির্বাক ধুলায়।
এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে দেখি শুধু পাথরের
ঘরবাড়ি, পরিচ্ছন্ন পথঘাট, হায়,
নেই কোনও গাছ-গাছালির
এতটুকু চিহ্ন কোনওখানে। মাঝে মাঝে
চোখে পড়ে পাথরের মূর্তি কিছু সাজানো, গোছানো;
দোকানে পসরা ঢের, অথচ কোথাও এক রত্তি ফুল নেই।
এ আমি কোথায় এসে পড়েছি হঠাৎ? বৃষ্টিধারা
কস্মিনকালেও স্নান করিয়ে দেয় না
এই শহরকে, শুধু ধু ধু তাপে বেঁচে আছে এই
নগরের বাসিন্দারা সব, পুতুলের মতো ওরা
পারে না ওঠাতে মাথা কিছুতেই মহীয়ান
লৌহমানবের প্রিয় হুকুমবরদারদের ত্রাসে
দিনরাত। বেহেস্তে করছে বসবাস, সদা মেনে নিতে হয়।
মধ্যরাতে ঘুম ভাঙতেই দেখি সারাটা শরীর
ঘামে ভেজা, রাতের স্বপ্নের দানে ভীষণ কাতর হয়ে পড়ি।
১৪.০৩.২০০৪