শেষে যা-ই হোক
আর কত দূরে নিয়ে যাবে বলো? আর কত পথ
হেঁটে যেতে হবে? থামলেই যদি
ঝোপঝাড় থেকে জাঁহাবাজ পশু লাফিয়ে শরীর
টুঁটি চেপে ধরে, কী হবে আমার? নিরস্ত্র আমি,
এমনকি হাতে অস্ত্র দিলেও কাউকে কখনও
ভুলেও দেবো না আঘাত, এমন শিক্ষা পেয়েছি মা, বাবার কাছে।
হঠাৎ একদা কী ক’রে যে আমি খাতার পাতায়
কোন্ ঘোরে ডুবে পঙ্ক্তির পর
পঙ্ক্তি সাজিয়ে লিখে ফেললাম একটি পদ্য
নিজের কাছেই রহস্য হয়ে রইলো সত্যি। যতদূর জানি
আমার বংশে কখনও কারুর কলমের ডগা
ভুলেও করেনি পদ্য রচনা। অবশ্য ছিল শিক্ষার আলো।
কী করে যে এক গোধূলি-লগ্নে আমার সমুখে
মুখোমুখি এসে বসলো অচেনা মোহিনী নীরবে
রহস্য-জাল ছড়িয়ে আমার সত্তায়, আমি
তার ইঙ্গিতে সেই যে লেখনী হাতে নিয়ে এক
খেলায় মেতেছি, তার জের আজও
চলছে প্রায়শ বেলা-অবেলায়।
গ্রামে ও শহরে লগ্ন আমার জীবন, তাই তো
পুরনো গলির ধুলো আর ধুঁয়ো বমি-করা
কারখানা আর মোটর গাড়ির আওয়াজে মুখর দিনরাত কাটে।
অবশ্য আমি কখনও সখনও আমাদের প্রিয়
পাড়াতলী গাঁয়ে, মেঘনা নদীর নিঝুম শাখায়
নৌকো-ভ্রমণে পানকৌড়ির, মাছরাঙার
রূপ দেখে সুখে কাটাই সময়। পাড়াতলীতেই
দাদা, নানা, বাবা এবং আমার ছেলে শান্তিতে চিরনিদ্রায়
সমাহিত, তাই সেই ভূমি বড়ই পবিত্র প্রিয় এ কবির কাছে।
জানি না আমার সাফল্য কিছু প্রদীপের মতো
জ্বলবে তিমিরে না কি বিফলতা বয়ে নিয়ে সদা
বেঘোরে ঘুরবো এদিক সেদিক। কোনও কিছু আজ
মোহরূপে আর পারে না আমাকে বন্দি করতে। যতদিন বেঁচে
আছি এই ধু ধু ধুলোর জগতে, ততদিন কালি
কলমের খেলা খেলে যাবো ঠিক, শেষে যা-ই হোক।
১৮.০৩.২০০৪
সবাই বোঝে না, কেউ কেউ বোঝে
ভদ্রলোক প্রত্যহ একলা নিঝুম বসে থাকেন কোনার
ঘরে। প্রায়শ একটি দু’টি রঙিন
পাখি এসে বসে বারান্দায়, তাকায়
লাগোয়া ঘরের ভেতর। বয়সী ভদ্রলোক সাদরে
মুড়ি, মুড়কি ছিটিয়ে দেন পাখিদের উদ্দেশে।
পাখিরা নিমেষে ভোজ সেরে ফেলে উধাও।
ঘরের বাসিন্দা চেয়ারে হেলান দিয়ে কী-যে ভাবেন
তিনি-ই জানেন। অতিথি পাখিদের কথা?
না কি সদ্য-পড়া কবি পাবলো নেরুদার কাব্য-গ্রন্থের
মহিমা? কখন যে কার মনে খেলে যায় কোন্ সে
সরল ভাবনা অথবা জটিল, প্রায়-অবোধ্য বিষয়-
কে বলতে পারে? মন তো আফ্রিকার জঙ্গল নিছক।
কী সব ভাবনা ভদ্রলোকের মানসে দিঘির মাছের
মতো লাফিয়ে ওঠে। কেন যে
তার অতীতের প্রায় মুছে-যাওয়া এক ঘটনা দিঘির পারের
ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। মুছে যায় সে-ছবি
বহু যুগের ওপারের স্তব্ধতায়। বদলাতে থাকে অনেক
ছবি। সে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে দিঘির কিনারে।
পুনরায় কখন ঠায় জেগে ওঠে সে ঠাওর করতে
ব্যর্থ হয়। নড়বড়ে ভাবনা
তাকে ভোগায়। অকস্মাৎ তালুতে ফোটে তিনটি গোলাপ।
শকুনের ঝাঁকের দাপট ক্রমাগত বাড়লে
বন্দুক হাতে ভদ্রলোক হঠাৎ রণমূর্তি করেন ধারণ।
সবাই বোঝে না, কেউ কেউ বুঝে ‘ধন্য ধন্য’ করে নীরবে।
০৩.১০.২০০৪
সবাই সবার জন্য
নিঝুম রাতের ঘরের স্তব্ধ কড়া জেগে ওঠে
আচমকা কার জোরালো নাড়ায়। ছুটে গিয়ে খুলি
বন্ধ দুয়ার। দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা ঝুলে
থাকে আর এক টিকটিকি খোঁজে রাতের ডিনার।
খানিক পরেই ধীরে ফিরে আসি ঘরের ভেতর;
টেবিলে-জিরানো বোতলের পানি শুষে নিয়ে ফের
বিছানায় যাই। ঘুমোতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ
হয়ে আকাশের রূপ দেখে নিই। গাছের পাতার
নাচ চোখে পড়ে। বাতাসের কাছে মনে-মনে ঢের
কৃতজ্ঞবোধ করি সুকোমল সেবার জন্য।
নির্ঘুম রাতে বহুরূপী ধ্যান-ধারণা কেবল
উঁকি দেয় মনে। জানালার দিকে চোখ মেললেই
নানা সময়ের নানা মুখ আর অনেক কাহিনী
জ্বলজ্বল করে, কিছু শুধু প্রায় ধূসর, মলিন-
মিছিলের মতো আসা-যাওয়া করে। শুধু বালোবেসে
সেইসব ছবি কাছে টেনে আনি, উড়াই নিশান।
যদি কোনও দিন কেউ ক্ষেপে গিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে
তেড়ে আসে তাকে শান্তির বাণী শুনিয়ে, ভুলিয়ে
যাতনা আমার যত্নে সত্যি বুকে নেবো টেনে,-
বলবো আমরা নিয়ত সবাই সবার জন্য
১৯.০৯.২০০৪
সাম্প্রতিক এক নৈশ অভিজ্ঞতা
বেজায় ঝাঁকুনি দিয়ে আচানক কেমন
আজব ক’টি কণ্ঠস্বর আমার
নৈশ ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। ডানে বামে তাকিয়ে
দেখি ঘরের কোথাও কেউ নেই। শুধু নিস্তব্ধ
থমথমে আঁধার যেন কালো দৃষ্টি ছড়িয়ে
আমার সত্তায় হয়তো কিছু বলতে চায়।
কী কথা অন্ধকারের চোখে? তার চিন্তায়? খানিক
পরেই দেয়ালে ঝুলতে দেখি
জনৈক সুন্দরীর মুখ। বিস্ময় অস্তমিত
না হতেই রূপসীর কণ্ঠস্বর ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া আমাকে
জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করে, ‘হায় কবি, সাতটি
বসন্ত কাটতেই আমাকে বিস্মৃতির ধুলোয় ছুড়ে দিলে?
স্তম্ভিত বাক্যহারা আমি কিছু বলার চেষ্টা
করতে না করতেই সুন্দরী হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো
অজানা কোথায়। ঘরের আলো
জ্বালাবো কি জ্বালাবো না ভাবতে না ভাবতে
কতিপয় অদৃশ্য নারী পুরুষের মিলিত হাসি সুরের
সৃষ্টি করে আমার সত্তায় ঘুমের আমেজ
ছড়িয়ে দিলো। আমি অজান্তেই আলিঙ্গনে বাঁধতে
চাইলাম যেন কাকে। শূন্যতাকে? আমাকে জড়িয়ে ধরে হাওয়া।
১৩.১২.২০০৪
সুযোগই দেবো না
তোমরা কারা ভিড় জমিয়েছো
এই আগুনের ফুল্কি-ঝরানো দুপুরে? তোমাদের
চেহারা দেখে কেমন যেন ভড়কে যেতে হয়। বিশ্বাস
করো, শত চেষ্টাতেও এমন
মনোভাবকে তাড়ানো যায় না ,
বুক ধক্ ধক্ করতেই থাকে। বড় শীতল হয়ে পড়ি।
তোমরা যারা প্রকৃতই বাইরে এবং ভেতরে
সত্যি-সত্যি সুশীল, যাদের দৃষ্টিতে কোমলতা এবং
আচরণে বিচ্ছুরিত সভ্যতার আভা, তাদের
দীর্ঘায়ু এবং কল্যাণ কামনা করি সর্বদা,
তোমাদের চরিত্রের আলোয়
উদ্ভাসিত হোক বন্ধু-বান্ধবের, সমাজের আসর।
এখনও তোমাদের পায়ের সঙ্গে
পা মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চাই পুবের সূর্যোদয়ের
দিকে। শরীরে যতই ধুলোর পলেস্তারা লাগুক,
আমার এই চলা থামাবো না।
ঝড় যত তাণ্ডবই ছুড়ে দিক আমার দিকে,
এই যাত্রা অবিচল থাকবে পুরোদমে।
আমার শরীরের ক্ষতের দিকে তাকিয়ে কাউকে
করুণাময় বাক্য উচ্চারণের সুযোগই দেবো না।
১১.০৪.২০০৪