যেখানে পূর্ণিমা-চাঁদ চুমো খাবে
এই যে সর্বত্র ভয়ঙ্কর কাঁটাময়
জায়গায় বহু দূর থেকে
হাঁটতে হাঁটতে একা পৌঁছে গেছি
অনিচ্ছা সত্ত্বেই-একি ভবিতব্য শুধু?
এগোতে গেলেই চারদিক থেকে সব হিংস্র কাঁটা
বিঁধবে শরীরে আর বৃষ্টির ফোঁটার মতো রক্ত
ঝরবে এবং আমি রক্তহীনতায়
জনহীন ভয়ঙ্কর পথে পড়ে থাকবো নিশ্চিত।
হয়তো খানিক পরে মানুষের শোণিতের ঘ্রাণে
ক্ষুধার্ত পশুর ঝাঁক এসে
জুটবে আমাকে ঘিরে। পাশব হামলা অতিশয়
দ্রুত ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে গিলে ফেলে দিব্যি তৃপ্তি পাবে।
তবে কি বেগানা এই জনহীন এলাকায় আমার জীবন
অন্তিম নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে
নিভে যাবে ঝড়-ক্ষুব্ধ দিনে কিংবা রাতে?
কাঁটাবন থেকে দ্রুত বেরিয়ে পৌঁছুতে হবে শান্ত আস্তানায়।
যাক ছিঁড়ে যাক ক্লান্ত শরীর আমার, তবু যেতে
হবে সেই এলাকায় যেখানে পূর্ণিমা-চাঁদ চুমো
খাবে আসমান, নদী, মাটি আর মানুষকে। চৌদিক কেমন
নিমেষে বদলে ফেলে রূপ। গীতসুধা পান করে নানা প্রাণী।
১৯.০২.২০০৪
রক্তগোলাপের মতো প্রস্ফুটিত
কী-যে হলো, কিছুদিন থেকে
আমার পড়ার ঘরে আজগুবি সব দৃশ্য জন্ম
নেয় চারদেয়ালে এবং
বইয়ের শেল্ফে, এলোমেলো, প্রিয় লেখার টেবিলে।
কতবার গোছাই টেবিল
সযত্নে, অথচ ফের কেন যেন হিজিবিজি অক্ষরের মতো
কেমন বেঢপ রূপ হয়ে
আমাকে সোৎসাহে ভ্যাঙচায় লেখার সময়।
ওরা কি আমার রচনার
পরিণাম বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কলম থামাতে চায় এই
অধমের? লুকাবো না, আমি
ভীত চিত্তে কলম থামিয়ে দূরে দৃষ্টি মেলে দিই।
আচমকা কতিপয় দীর্ঘদেহী প্রেত
লেখার টেবিল ঘিরে ধেই ধেই নেচে আমাকেই
বিদ্রূপের কাদায় সজোরে ঠেলে দিয়ে
দন্তহীন ভয়ঙ্কর মুখে ক্রূর হাসি হাসে!
২
কোত্থেকে ঘরে ভুতুড়ে আঁধার ঢুকেছে হঠাৎ,
ভেবেই পাই না। আঁধার এমন দংশনপ্রিয়
হতে পারে, আগে জানতে পারিনি। নিজ হাতকেই
কেমন অচেনা বলে মনে হয়। ভয়ে কেঁপে উঠি।
ভয় তাড়ানোর চেষ্টায় দ্রুত চড়িয়ে গলার
ধ্বনি এলোমেলো কীসব আউড়ে গেলাম কেবল।
আকাশে এখন চাঁদ আর তারা দেবে না কি উঁকি?
কেউ কি আমার গলা চেপে ধ’রে করবে হনন?
কারা যেন ছুটে আসছে এদিকে। ওরা কি দস্যু?
নাকি আগামীর ঘটনাবলির বেঢপ আভাস?
হঠাৎ আমাকে ভগ্ন বাড়ির স্তূপের ভেতর
কাতরাতে দেখি। কিছু ধেড়ে পোকা চাটছে জখম।
আমার দেশের চারদিক জুড়ে ক্রূদ্ধ পানির
দংশনে আজ পাড়া গাঁ এবং শহর কাতর।
ভয় হয় যদি হঠাৎ প্লাবন বাড়িঘর সব
মানুষ সমেত ঘোর বিরানায় মুছে ফেলে দেয়।
৩
এখন কোথায় আমি? কে আমাকে এই
নিঝুম বেলায় বলে দেবে? এখানে তো ডানে-বামে
জনমানুষের চিহ্ন নেই। বড় বেশি শূন্যতার
হাহাকার অস্তিত্বকে নেউলের মতো
কামড়াচ্ছে সারাক্ষণ। ভাবছি, এখন যদি কোনও
কুশ্রী মানবেরও পদধ্বনি শুনি বড় ভালো হয়।
কখনও হতাশা যেন সমাজকে, দেশকে বিপথে
টেনে নিয়ে অন্ধের আসরে
আরও বেশি অন্ধ, বোবা জমা ক’রে ঘন ঘন জোরে
করতালি দিয়ে আরও বেশি জম্পেশ আসর না বসায়।
আজকের এই বোবা অন্ধকার লুটপাট আর
অস্ত্রবাজি, আমার বিশ্বাস, আগামীর
সকালে, দুপুরে, রাতে পারবে না মাথা তুলে দাঁড়াতে নিশ্চিত,
যখন স্বদেশ রক্তগোলাপের মতো প্রস্ফুটিত।
২০.০৭.২০০৪
লড়ছি সবাই
মিশমিশে ঘোর অন্ধকারে
কনুই দিয়ে ধাক্কা মারে,
রহিম পড়ে রামের ঘাড়ে,
কেউবা দেখি চুপিসারে
অন্য কারুর জায়গা কাড়ে
পাচ্ছি তা টের হাড়ে হাড়ে।
লাইন থেকে সরছি ক্রমে সরছি।
জল খেয়েছি সাতটি ঘাটে,
ফল পেয়েছি বাবুর হাটে,
কিন্তু সে-ফল পোকায় কাটে,
ঘুণ ধরেছে নক্শি খাটে,
কানাকড়ি নেইকো গাঁটে,
চলছি তবু ঠাটে বাটে,
রোজানা ধার করছি শুধুই করছি।
পক্ষিরাজের ভাঙা ডানা,
রাজার কুমার হলো কানা।
দিনদুপুরে দৈত্যপানা
মানুষগুলো দিচ্ছে হানা,
নিত্য চলে ঘানি টানা,
জগৎ-জোড়া খন্দখানা-
হোঁচট খেয়ে পড়ছি কেবল পড়ছি।
২
ফসল ক্ষেতে পোকা পড়ে,
ঘর উড়ে যায় ঘূর্ণিঝড়ে,
মাতম ওঠে ঘরে ঘরে।
কত ভিটায় ঘুঘু চরে,
কঙ্কালেরা এই শহরে
বাঁচার জন্যে ধুঁকছে ম’রে।
বাঁচার লড়াই লড়ছি, সবাই লড়ছি।
শকুন ও কোকিলের কাহিনী
প্রবহমান নদীতীরে একটি নয়নাভিরাম
বৃক্ষ নানাজনের হিংসার পাত্র হয়ে
মেরুদণ্ড সোজা রেখে দাঁড়িয়ে ছিলো। গাছটিতে
এক ঝাঁক কোকিল মহানন্দে করতো বাস।
ওদের গানের সুরে পার্শ্ববর্তী নদীর ঢেউ
উঠতো নেচে প্রায়শই। সহসা
একদিন কোত্থেকে ক’টি শকুন উড়ে এসে
জুড়ে বসে উৎপাতে উঠলো মেতে। কোকিলেরা ভড়কে যায়।
মারমুখো শকুনদের হামলায় সবুজ গাছের নিচে
বয়ে যায় রক্তিম স্রোত, অনেক
কোকিলের লাশে ছেয়ে যায় ভেজা মাটি। তবে কি
বৃক্ষচূড়ায় কায়েম হলো শকুনের কর্তৃত্ব?
তিন-চারবার সূর্য আকাশ থেকে উধাও
হওয়ার পর কোকিলের ঝাঁক গান গাইতে
শুরু করে নতুন প্রেরণায়। ওদের ডানা আর ঠোঁটের
ঝাপটায় শকুনেরা জখম-কলঙ্কিত
পাখা আর মাথা নিয়ে পড়ি মরি করে পালালো
দূরে অন্য কোনওখানে। কোকিলের গানে নাচে প্রফুল্ল নদী।
১৪.১২.২০০৪
শুধু চাই স্পর্শ সাধনার
আজকাল মাঝে মাঝে কেন যে চকিতে
বুদ্ধমূর্তি জেগে ওঠে দৃষ্টিতে এবং আমি সুদূর দিগন্তে
হেঁটে যেতে থাকি ব’লে মনে হয় শুধু। উদাস দৃষ্টিতে
তাকাই সম্মুখে, দেখি বুদ্ধদেব বোধিদ্রুতলে
ধ্যানমগ্ন আছেন একাকী বসে। ধ্যানকে বাতাস
ঘন ঘন সশ্রদ্ধ প্রণাম করে বিনম্র ভঙ্গিতে।
অস্ত্রধারী ক্ষত্রিয়ের ঝাঁঝালো মেজাজ অকস্মাৎ
গর্জে ওঠে যদি কোনও অসহায় বুড়ো
ভিখারিকে দেখে, তখনও কি আমি মূক
হয়ে এককোণে ঠিক থাকবো দাঁড়িয়ে? সাতে পাঁচে
নাক গলাবো না বলে চুপ করে কোমল বালিশে
চোখ মুখ গুঁজে থাকা যায় কি সর্বদা? মনুষ্যত্ব থাকবে কি?
কোনও কোনও পুস্তকের পাতায় আমরা দেখি এক
ক্রুশবিদ্ধ মানবের ছবি যিনি
মানুষের কল্যাণের জন্যে ক্রমাগত ভেসেছেন বিপরীত
স্রোতে আর হয়েছেন নির্বোধ পেরেকে বিদ্ধ আপাদমস্তক।
করেননিকো ক্ষমা প্রার্থনা, রক্তধারার তীক্ষ্ণ কষ্ট
তুচ্ছ করে জালিম বিপথগামীদের কল্যাণ কামনা করেছেন।
মহত্ত্বের রূপে ঘোর অমাবস্যা পূর্ণ চন্দ্রালোকে
পরিণত হয় আর মহামানবের
সংস্পর্শে ডাকাত হয়ে যায় অসামান্য দরবেশ। বুঝি তাই
মানবের সম্ভাবনা সুপ্রচুর সর্বকালে, শুধু চাই স্পর্শ সাধনার।
এই তো নীরব, কালো, কাঁটাময় জঙ্গল কেমন
বাগানে রূপান্তরিত, নতুন গানের সুর ভাসে।