মেটামরফসিস
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতেই চোখে পড়লো
একটি জবরদস্ত হাত এগিয়ে
আসছে আমার দিকে। বেজায়
ভড়কে গিয়ে অগ্রসরমান হাতের দিকে নিজের
হাত বাড়াবো কি না ভেবে ধন্দে পড়ে গেলাম,
অথচ তেমন ভয়ের কাঁটার খোঁচা পেলাম না।
অচেনা লোকটার দিকে চেয়ার এগিয়ে দিকে
প্রাথমিক ভদ্র দৃষ্ট নিবেদন করার পর আলাপ
শুরু করলাম, আগন্তুক বেজায়
তুখোড় এবং অনেক কিছুই তিনি দিব্যি নিজের
এখতিয়ারে রেখেছেন এবং যখন যা খুশি
চটজলদি বলে যেতে পারেন
মন-জুড়ানো ভাষায়। তীক্ষ্ণধী ব্যক্তিটি রূপবানও বটে।
হঠাৎ দেখি সেই ব্যক্তি মোমবাতির মতো দ্রুত
গলতে শুরু করেছেন। আমার দৃষ্টিকে বিশ্বাস
করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। একজন জলজ্যান্ত ব্যক্তির
এই রূপান্তরে হতবাক আমি দেখি তার চেয়ারে
এক হনুমান ব’সে আমার দিকে তাকাচ্ছে বেয়াড়া
তাচ্ছিল্যে, নিজেকে আমার লাগছিলো বড় বেখাপ্পা।
যখন ঘুমিয়ে ছিলাম
ঘুমিয়ে ছিলাম ঘরে একা; আচমকা ঘুম ছিঁড়ে
গেলে পর মনে হলো কে যেন ঝাঁকুনি
দিয়ে জোরে ভাঙালো আমার শান্ত, গাঢ়
নিদ্রা; বিচলিত হয়ে খুঁজি কাকে? কোন্ সে মানব
অথবা মানবী, যার মুখ দেখার আশায় দ্রুত
শয্যা ছেড়ে উঠে দোর খুলে দৃষ্টি বুলোই চৌদিকে।
না, কোথাও নেই চিহ্ন কারও; বহুদূর থেকে কান্না
ভেসে আসে অথচ নিকটে ঘরবাড়ি
নেই কোনও। তা’হলে কি আকাশের মেঘমালা থেকে
মানবীর ক্রন্দনের মতো ধ্বনি ঝরছে আমার
শ্রুতিতে অথবা দূরে কোনও রুগ্ন, বিরহী যুবক
বাঁশিতে তুলছে কান্নারূপী সুর উন্মাতাল হয়ে।
কিছুতে আসে না ঘুম। মনে হলো, যুগ যুগ ধরে
এভাবেই নিদ্রাহীন থাকবো এখানে
বিরানায়। ভুলেও এখানে কেউ আসবে না, কারও কোনও কথা
শোনার সুযোগ হয়তো-বা কোনওকালে
মিলবে না কিছুতেই। পশু, পাখি আর কীট, পতঙ্গ ব্যতীত
আর কারও মুখ দেখতে পাবো না কোনও কালে!
কখনও রবিনসন ক্রুশোর ধরনে অবিকল
নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবার মতো দশা হলে, তবে
জানি না কী ক’রে কাটাতাম একা দ্বীপবাসী হয়ে। তা’হলে কি
উন্মাদের পরিণতি হতো না আমার?
তখন হয়তো পাতাময় গাছের আগ্রহী ডালে
নিজেকে ঝুলিয়ে চিরতরে অসীমের ধোঁয়াশায়
হতাম বিলীন।
০৩.১১.২০০৪
যখন নিঃসঙ্গ থাকি
নিঃসঙ্গ ছিলাম বসে সন্ধ্যারাতে পড়ার টেবিলে
ঝুঁকে, আচমকা
ন্যালাখ্যাপা এক লোক আমার সম্মুখে
দাঁড়ালো, যেন সে খুব অন্তরঙ্গ ইয়ার আমার।
আমার আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই পাশের
চেয়ারে ত্বরিৎ ক’রে নিলো ঠাঁই আর জুড়ে দিলো
ঘনিষ্ঠ আলাপ, যেন দীর্ঘ দিনের আপনজন।
বস্তুত সে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলো নিমেষে আমাকে।
আমি শুধু বিহ্বল দৃষ্টিতে অনাহূত অতিথির
দিকে চেয়ে থাকি আর মন দিয়ে
শুনি তার সব কথা, আমি কিছু বলতে গিয়েও
মূক হয়ে চেয়ে থাকি তার জ্বলজ্বলে দু’টি চোখে।
অনাহুত আজব অতিথি অনর্গল কথা ব’লে
সময়কে ঋদ্ধ করছেন, মনে হয়।
কিছু কথা বুঝি তার, কিছু বোধের আড়ালে
থেকে যায়। অথচ অপূর্ব বাণী তার আমাকে উন্নত করে।
রাত ক্রমে গাঢ় হতে থাকলে অচেনা অতিথির
কণ্ঠস্বর আরও বেশি অপরূপ, অপার্থিব হয়ে
ওঠে, ক্রমান্বয়ে আমি তার
ভক্ত হয়ে নিজের ভেতরে নতুনের আভাবোধ করি।
আচমকা রাত্রিশেষে নিজেকে কেমন
আলাদা, নতুন মনে হয়। অপরূপ এই
পরিবর্তনের রূপ সর্বক্ষণ জেগে থাকবে তো?
অধিক সৃষ্টির আভা জ্বলজ্বলে হয়ে উঠবে তো?
২৩.০৯.২০০৪
যদি পঙ্ক্তিমালা করে আলিঙ্গন
এই যে কখনও আমি বিচলিত হয়ে পড়ি সন্ধ্যা
নামলেই, অন্তর্লোক গাঢ় অন্ধকার
দ্রুত ছেয়ে এলেই কে যেন বোধাতীত
ভাষার আবৃত্তি করে বেশ কিছুক্ষণ। মনে হয়, কোনও পাখি
বস্তুত আপন মনে সুরেলা ছন্দের এক অর্থহীন গান
দিচ্ছে উপহার প্রকৃতিকে প্রত্যাশার পরপারে বাস ক’রে।
নিঃসঙ্গ পাখির সুর থেমে গেলে দূরের চাঁদের
ভগ্নাংশ চকিতে কোন্ বিরানায় মুখ
থুবড়ে মিলিয়ে যায়, বলতে পারে না
কেউ কোনও কালে, শুধু অরণ্যের গাছপালা, হ্রদ
জানে সেই রহস্যের ইতিহাস। একজন চন্দ্রাহত লোক
কিছু পঙ্ক্তি উচ্চারণ করে বারবার, দেয় চন্দ্রিমার ভগ্নাংশের খোঁজ।
এখন যেদিকে যাই পথ কী ভীষণ ক্ষেপে ওঠে,
ডাকাবুকো পশুর ধরনে
তিন হাত ওপরে লাফিয়ে উঠে চকিতে কামড়ে দেয়, আমি
চীৎকারে বিদীর্ণ করে দিতে চাই চতুর্দিক, অথচ গলায়
হায়, এতটুকু শব্দ কিছুতেই পরিস্ফুট হয় না তখন।
ব্যর্থতায় হাতের আঙুলগুলো খুব জোরে কামড়াতে থাকি।
কখনও আমার চারদিকে সুন্দরীরা নাচ, গান
জুড়ে দেয় বেশ কিছুক্ষণ বিনা কোনও প্রত্যাশায়। খাতা খুলে
বসে থাকি লেখার টেবিল ঘেঁসে, যদি পঙ্ক্তিমালা
পদ্যরূপে করে আলিঙ্গন নিত্য এই শব্দমালা সন্ধানীকে।
২১.০৩.২০০৪
যাত্রা থামাবো না
এগিয়ে যেতেই চাই। স্থবির আমার চতুর্দিকে
গজিয়ে উঠুক নিত্য দীর্ঘকায় ঘাস
আর আমি পোকামাকড়ের
স্পর্শেও অনড় থাকি, আমাকে করে না
দখল এমন সাধ কস্মিনকালেও। আমি দূর
তারাময় আকাশে সাঁতার কেটে চাঞ্চল্যের স্বাদ পেতে চাই।
অথচ আমাকে আজকাল বারবার
ভীষণ ঝিমুনি ঘিরে ধরে; হাঁটতে দাঁড়ালে যেন
কেউ চেপে চেয়ারে বসিয়ে দেয় অথবা শয্যায়
হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি নিদ্রা নেশায়
ডুবিয়ে কোন্ সে অবাস্তব মজলিশে নিয়ে যায়, বলা দায়।
কাটলে আজব নেশা, ক্লান্তির ছায়ায় মিশে যাই।
মধ্যরাতে বাঁশের বাঁশির সুর না জানি কোত্থেকে
ভেসে আসে, মনকেমনের আলোড়ন
আমাকে চঞ্চল ক’রে তোলে; শয্যা ছেড়ে
জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। হঠাৎ
যুবতী চাঁদের বাহু প্রণয়ের আভা ছড়িয়ে আমার
সত্তায় কী গান গেয়ে চলে গেল যোজন শূন্যতায়!
এগিয়ে চলার সাধ মিটে গেছে কি আমার?
কখনও তা’ নয়। আজও জীবনের এই
ধূসর গোধূলি বেলাতেও কাঁটাময় পথে হেঁটে
ক্লান্তির কুয়াশা মেখে সত্তায় এগোতেই চাই! পথে
আমাকে ফেলুক গিলে, দাঁতাল কাঁটারা সব ছিঁড়ে
খুঁড়ে নিক আমার শরীর, যাত্রা তবু থামাবো না।
০২.০৯.২০০৪