ভিন্ন জীবন উঠলো নেচে
একটি দ্বীপের অধিবাসী অষ্টপ্রহর
অন্ধকারে ডুবে থাকে। যায় না দেখা কোনও কালে
তাদের কিংবা অন্য কারও দেহের ছায়া।
ভুলেও কেউ আসে না সেই দ্বীপের তীরে।
মাঝে-মধ্যে দ্বীপবাসীরা
হাওয়ার ছন্দে নেচে ওঠে, ওদের গানের তালে তালে
ফুলের, ফলের গাছেরা সব দুলতে থাকে-
যেন ভীষণ মাতাল ওরা, লুটবে ধুলোয়।
দ্বীপবাসীদের মধ্যে ক’জন ছিলো বটে
খুব আলাদা। অন্যেরা সব নেশায় ডুবে থাকলে ওরা
থাকতো দ্বীপের বাইরে কোনও আলোকিত দ্বীপের খোঁজে
যাবার জন্যে নৌকো তৈরি ক’রে কোথাও পৌঁছে যেতে।
ভাবলো ওরা তারা যদি আলসেমিকে
আঁকড়ে থাকে, তাহ’লে আর মুক্তি ওদের হবে নাকো
কোনও কালে। ক’দিন পরে নৌকো বাগে পেয়ে গেলে
আলাদা সেই দ্বীপবাসীরা ডিঙি ভাসায় সমুদ্দুরে।
চলন্ত সেই নৌকো থেকে
ভিন্ন ধাতের ক’জন দ্যাখে, অবাক, একি! ওই তো দূরের
আকাশ থেকে ঝরছে আলো একটি দ্বীপে!
আঁধার-ভরা দ্বীপের ক’জন হাসলো শেষে।
আলোকিত দ্বীপে সবাই
নাও ভিড়ালো, নামলো তীরে, বাঁধলো ডেরা
নতুন ছাঁদে। আলোর চুমোয় ওরা সবাই
হলো বিভোর। ভিন্ন জীবন উঠলো নেচে।
২৫.০১.২০০৪
মগের মুল্লুক না কি?
যাচ্ছিলাম একা সুনসান অচেনা রাস্তায় । হঠাৎ
কোত্থেকে ক’জন ডাকাবুকো লোক আমার
ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ
টুঁটি চেপে ধরে আমার, কারও মুঠোয়
বন্দি আমার মাথার উস্কো-খুসকো চুল
আর অন্য একজন ক্রমাগত মারছে লাথি।
মগের মুল্লুক না কি? কেউ কি নিজের উন্মশহরে
নিরাপদে পথে হেঁটে চলতে
পারবে না? তাকে কি গুণ্ডাদের খঞ্জরের আঘাতে
মুখ থুবড়ে পড়তে হবে খোলা রাস্তায়? জ্যোৎস্নাস্নাত
পথ কি রঞ্জিত হবে নিরপরাধ, কারও সাতে, পাঁচে
না-থাকা, নিরামিষ ধরনের ব্যক্তির রক্তধারায়?
কখনও কখনও মনে হয়, আমার প্রিয় শহর
এই ঢাকা রত্নপুরী, এখানে
নগরবাসী সবাই উত্তম চরিত্রের অধিকারী,
প্রত্যেকেই ধীমান, শিল্পকলা-চর্চায় মনোযোগী। কখনও
কখনও কবিমেলা অনুষ্ঠিত হয় অপরূপ উৎসবের
ধরনে, সংবাদ যার রটে যায় দেশ-দেশান্তরে।
এই স্বপ্ন, এই অভিলাষ অর্ধসত্য হয়ে রয়
কারও কারও চেতনায়, কেউ কেউ
খেলাঘর ভেঙে গেলে বেদনার্ত চিত্তে কবিতা রচনায়
মাতাল হয়ে খাতার পাতা কখনও নিরাশায়, কখনও-বা-আশায়
বাংলা বর্ণমালার রূপ নানা সাজে সাজিয়ে
আসমানের মেঘে, বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে ভাসায়।
০১.১১.২০০৪
মন্দ ভাগ্য নিয়ে কাটাই
যখন রোদে ভোরের চুমোয় জেগে উঠি
আশেপাশের সব কিছুকেই কেমন যেন
অচিন দেশের দৃশ্য ভেবে
নিজেকে খুব খাপছাড়া আর একলা লাগে।
এলোমেলো কত কিছুই ভাবতে থাকি
এই আমি কি সত্যি কোনও বিশেষ ব্যক্তি নাকি ঘরের
আসবাবেরই অংশ কিছু? না কি বনের
প্রাণীর মতোই জীবিত এক পশু কিংবা পাখি?
ভোরের আলো একটু তেজী হলে পরেই
আমার ভেতর ক্রমান্বয়ে
ভাবনা যেন বদলে যেতে থাকে এবং বুঝতে পারি-
সত্যি আমি আদমেরই বংশ থেকে জন্মেছি ঠিক।
তবে কেন সাতসকালে এমনতরো
ভাবনা এসে দখল করে আমার মতো শাদাসিধে
মানুষটিকে? দুনিয়া খুবই হিংস্র হয়ে উঠেছে আজ;
তবু নানা পাড়ায় কিছু মধুর সুরে কোকিল ডাকে।
হায়রে আমি মন্দভাগ্য নিয়ে কাটাই
বৃক্ষহারা গলির কোণে! এই গলিতে গায়ক পাখি
কিংবা কোকিল কোনও কালেই ঝরায় না সুর,
মাঝে মাঝে ফিল্মি গানের ধাক্কা লাগে কানে জোরে!
১৮.০২.২০০৪
মাটির ঘ্রাণের ছোঁয়া
প্রায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিকেলের ঠাণ্ডা রোদে
ঘরের বাইরে রাখা চৌকিতে একটি
লাশ দেখে থমকে দাঁড়াই। এই লাশ
অন্য কারও নয়, এতো স্বয়ং আমার।
বাড়ির সবাই শোকাহত বড়, কারও কারও চোখ
অশ্রুময়। ঘরের ভেতর থেকে ক্রন্দনের রোল
ভেসে এসে লাশটিকে ছুঁয়ে যায়,
লাশ সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ভীষণ।
আমাকে দেখেও কেউ বলে না কিছুই। যেন আমি
অবয়বহীন কেউ চলাফেরা করছে এখানে
সারাক্ষণ আমি ডাকাডাকি করলেও
কারও কিছু এসে যায় না। তবে কি মৃত আমি?
গোসলের শেষে লাশটিকে কাফন পরিয়ে খাটে
শুইয়ে সবাই নিয়ে যায় গোরস্তানে। দেখি আমি
যাচ্ছি ঢুকে কবরের ভেতরে এবং
আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই
দোয়া দরুদের আভা দেয় মেখে লাশের অস্তিত্বে,
সবাই বিদায়্য নেয় আমি রয়ে যাই অন্ধকারে।
বাসগৃহে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি পাশে
ঘুমিয়ে আছেন সুখে জীবন-সঙ্গিনী;তবু আমি
একা, বড় একা বোধ করি আর যেন
নাকে লাগে ভেজা মাটির ঘ্রাণের নগ্ন ছোঁয়া!
মানবিক আর্তনাদ
ঘুটঘুটে এক গলির মোড়ে
এলাম যেন কিসের ঘোরে।
ডানে বামে বন্ধ দোরে
পড়ছে ধাক্কা বেজায় জোরে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।
একলা আমি আঁধার ঘরে
বসছি বটে নড়ে চড়ে।
হঠাৎ এ কি ভীষণ ঝড়ে
বসত বাড়ি বেজায় নড়ে-
শুনছি শুধু অবাক হয়ে শুনছি।
জানলা ধরে দাঁড়াই একা,
কারও সঙ্গে হবেই দেখা।
পছন্দ যার আমার লেখা,
তার জন্যেই আঁকছি রেখা-
আঁকছি শুধু, মগ্ন হয়ে আঁকছি।
২
কখন যে ঘরে ঢুকে বিছানায় ঘুমে
ঢুলে পড়েছিলাম ক্লান্তির কুয়াশায়,
মনেই পড়ে না। জানালার বাইরে চাঁদের
ক্ষয়া মুখ চোখে পড়তেই মনে পড়ে
অসমাপ্ত একটি কবিতা তিন দিন ধরে মাথা
চাপড়াচ্ছে, অথচ এখনও আমি খাচ্ছি, দাচ্ছি,
দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি, চায়ের
দোকানে নির্দিষ্ট কোণে ব’সে আড্ডা দিচ্ছি;
ঝাঁ ঝাঁ তর্কে নিয়ত উঠছি মেতে রাজনীতি আর
মিছিল, উত্তর-আধুনিক কবিতা ইত্যাদি নিয়ে।
‘নেই, তোমার মুক্তি নেই কিছুতেই’,
কে যেন প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে গেলো।
মুখচ্ছবি তার শত চেষ্টাতেও পড়লো না ধরা।
দৃষ্টিতে আমার পড়ে তিনজন রূপবতী দূরে
একটি হ্রদের তীরে এসে বসে, তাদের পেলব
গানের সুষমা হৃদয়ের তন্ত্রীকে স্বর্গীয় করে।
৩
অবশেষে বৃক্ষতলে এসে বসি, এখন আমার
পাশে বসে নেই কোনও পুরুষ কি নারী।
অকস্মাৎ প্রায় মাথা ঘেঁসে কালো এক পাখি
উড়ে যায়। অগণিত বুটের আওয়াজে
শান্তিপ্রিয় জনসাধারণদের মগজ ভীষণ
আলোড়িত, কেমন কুঞ্চিত হতে থাকে। রাইফেল
গর্জন করেনি, তবু লেফ্ট রাইট,
লেফ্ট রাইট ধ্বনি এক ঝাঁক পায়রা এবং
অজস্র রঙিন হাঁস দূরবর্তী মেঘমালা ছুঁয়ে
দূরে, বহুদূরে উড়ে চলে যায়। বারুদের গন্ধে
কী ভীষণ ভারী হতে থাকে
চতুর্দিক। মানবিক আর্তনাদ ক্রমাগত প্রসারিত হয়।
১৮.০৫.২০০৪