বুড়ো ঈগলের মতো?
সময় তো বয়ে গেলো চোখের নিমেষে,
অথচ জমার খাতা খাঁ খাঁ
রয়ে গেছে আমার, আকাঙ্ক্ষা উড়ে যায়
মেঘলা আকাশে। বসে থাকি একা ঘরে হতাশায়।
তবে কি বৃথাই আমি বহু রাত নির্ঘুম কাটিয়ে
ঝাঁঝালো দুপুরে পাহাড়ের চূড়ায় হেঁটেছি আর
সমুদ্রের ঢেউয়ে বসে কাটিয়ে দিয়েছি
বহুদিন? বেলা শেষে কী তবে পেলাম?
এতকাল যা ছিল আরাধ্য, যদি তার
কিছুই না জুটলো সঞ্চয়ে,
তাহলে জীবন ফাঁপা অতিশয়; হায়!
কেঁদেও পাবো না তাকে, প্রাপ্তি যার ছিল আকাঙ্ক্ষিত।
আমাকে দেখে কি আজ সর্বহারা মনে হয়? না কি
বুড়ো ঈগলের মতো অথর্ব, ঝিমোনো?
তাই কি উদ্ধত দাঁড় কাক, এমনকি ক্ষুদ্র পাখি
ঠুকরে আমুদে ঢঙে উড়ে চলে যায়। চুপচাপ বসে থাকি।
বেগানা এক নদী তীরে
এই তো নিজেকে দেখছি মেঘলা, নিঝুম দুপুরে
একলা হাঁটছি অচেনা পথের ধার ঘেঁষে আর
আকাশ পাতাল ভাবছি কেবল। আচানক কোনও
ধাবমান যান হানলে আঘাত হারাবো জীবন।
অথচ আমার সেদিকে মোটেও নেই তো খেয়াল,
আমার ভেতর কী যে তোলপাড়
চলছে এখন, অজানা সবার। এমনকি এই
আমারও মনের অজ্ঞাত সব।
আমি কি ব্যর্থ প্রেমিক এখন জীবনের এই
গোধূলি বেলায়? এ কথা শুনলে হেসে গুলজার
করবে সবাই জমাট আসর। সত্যি তেমন নয় তো কিছুই,
তবুও মনের দিগন্ত জুড়ে অচিন কুয়াশা!
তবে কি মৃত্যু-চিন্তা আমাকে করছে কাতর?
ঘর থেকে পথে দিয়েছে হেলায় আচমকা ছুড়ে?
এ কোথায় আমি এলাম ধূসর প্রহরে এমন বেগানা মাটিতে?
কী হবে এখন একলা এখানে সংজ্ঞা হারালে।
হঠাৎ কেমন অট্রহাসির ধাক্কা আমাকে
ধুলোয় লুটিয়ে পতিত আমার দিকে ছুড়ে দেয়
ভয়াবহ ঢেউ। ডুবে যেতে থাকি কোন্ সে পাতালে? কে জানতো এই
পরিণতি হবে আমার এমন বেয়াড়া, বেগানা এক নদী তীরে?
১৬.০২.২০০৪
বেলা অবেলার তাঁর বাণী
বড় বেশি অস্থিরতা গোধূলিতে আমাকে দখল
করে নিয়ে জনহীন ঘরে ডানে বামে
ঘোরাচ্ছে ভীষণ। এ বয়সে
এ রকম ছটফটে আচরণ খুব বেমানান
ব’লে মৃদু হাসবেন অনেকেই। এমনকি কেউ
মস্তিষ্কের বিকৃতি ভেবেই দুশ্চিন্তায় মজবেন।
ব্যাপারটি বুঝতে পেরেও দ্রুত করি পায়চারি
ঘরের ভেতর। ঘন ঘন চোখ যায়
পুরনো দেয়ালে, উড়ে-যাওয়া পাখি আর আকাশের
নীলে, অকস্মাৎ চুপচাপ
লেখার টেবিল-ঘেঁসে দাঁড়ানো চেয়ারে
বসে পড়ি। চোখ দু’টি অজান্তেই দ্রুত মুদে আসে।
আচানক কার গাঢ় কণ্ঠস্বর যেন
আমাকে প্রবল নাড়া দিয়ে চোখ খুলে সামনের
দিকে দৃষ্টি মেলে দিতে বাধ্য করে। দেখি
একজন সুকান্ত প্রবীণ নিরীক্ষণ
করছেন আমাকে প্রকৃত বিশ্লেষণী
ভঙ্গিমায়। পরক্ষণে তিনি সাবলীল উচ্চারণ
করলেন অনুপম কথামালা। দৃষ্টি থেকে তাঁর
হলো বিচ্ছুরিত কিছু হীরাপ্রতিম বাক্যের ফুলঝুরি শুধু।
কী করে যে কেটে গেলো নিমেষেই এমন সময়,
বুঝতে পারিনি কিছুতেই। শ্রদ্ধেয় প্রবীণ চেনা
দৃশ্য থেকে তাঁর অনুপম সৌন্দর্যের আভা নিয়ে
কোথায় যে হলেন বিলীন, জানবো না কোনওকালে,
শুধু তাঁর সৌম্য মূর্তি স্মৃতির উদ্যানে
মাঝে-মধ্যে হবে প্রস্ফুটিত আর তাঁর
বাণী বেলা অবেলায় গুঞ্জরিত হয়ে
এই ব্যর্থ জ্ঞানপ্রার্থী আমাকে করবে ঋদ্ধ বেলা অবেলায়।
৩০.০৩.২০০৪
বেলাশেষে কখনও হয় কি সাধ
আমি কি এভাবে বারবার
নিজের সঙ্গেই অভিনয় করে যাব?
এই যে এখন কালো পাখিটা আমার
মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল, ওর
উড়াল আমার সর্বনাশ ডেকে আনবে কি আজ?
দেখছি আমার হাত কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে,
খাতার পাতায় লেখা নয়া শব্দগুলো
কোন্ দুঃস্বপ্নের স্পর্শে কুষ্ঠরোগীর ক্ষতের মতো
হয়ে গেল? উড়ন্ত পাখির
চাঞ্চল্য কোথায় থেমে গেল?
তাহ’লে আমি কি ক্রমান্বয়ে জবুথবু
মাংসপিণ্ড হয়ে এককোণে
প্রত্যহ থাকব প’ড়ে? যদি তাই হয়,
তা’হলে আমার বেঁচে থেকে
কী লাভ? কেবল জড়পিণ্ড হয়ে শুধু
ডান বাঁয়ে কিংবা সম্মুখে তাকিয়ে
দিনরাত কাটানো মাসের পর মাস,
বছরের পর ফের বছর কাটানো
নরক বাসের চেয়ে বেশি ছাড়া কিছু কম নয়।
কখনও চকিতে ভোরবেলা আমার ঘরের ঠিক
কাঁধ ঘেঁষে একটি সবুজ পাখি সৌন্দর্য বিলিয়ে
বসে থাকে। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক
উৎসুক দৃষ্টির আভা ছড়িয়ে হঠাৎ পাখা মেলে
উড়ে চলে যায় দূরে অজানা কোথায়।
বেলাশেষে জ্যোৎস্নাময় রাতে ওর কখনও হয় কি
সাধ উড়ে যেতে নক্ষত্রের
প্রোজ্জ্বল মেলায়? হয় না কি সাধ তার
চাঁদে গিয়ে বসতে কখনও? হয় না কি
সাধ তার ফোটাতে সুরের পুষ্পরাজি মায়ালোকে?
বেশ কিছুদূর এসে
হেঁটে হেঁটে বেশ কিছুদূর এসে আজ মনে হয়-
এই যে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম কত আলো,
কত অন্ধকার খেলা করেছে আমার সঙ্গে। ভালো,
মন্দ এসে ঘিরেছে আমাকে আর ক্রূর দ্বন্দ্বময়
অন্তরের ইতিহাস রয়ে যাবে অজানা নিশ্চয়।
যদি নগ্নতায় উদ্ভাসিত হতো অন্তর্লোক, তবে
অনেকে আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতো নীরবে,
কেউ কেউ দিতো টিটকিরি দিব্যি রাজপথময়।
আমরা এমন যুগে বাস করছি, যখন কেউ
পাশে এসে বসলে ভীষণ উসখুস বোধ করি।
মনে হয়, পার্শ্ববর্তী ব্যক্তির শার্টের খুব ফিকে
আড়ালে রিভলবার কিংবা ছোরা ঘান্টি মারা ফেউ
হয়ে আছে। এক্ষুণি লোকটাই হাসিমুখে তড়িঘড়ি
হিম লাশ ক’রে দেবে জলজ্যান্ত ভদ্রলোকটিকে!
১৬.১১.২০০৪
ব্যর্থ অভিশাপ
হে বান্ধব, এই যে এখানে তুমি এক কোণে ব’সে
প্রত্যহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা একা দেয়ালের
কিংবা বাইরের কোনও গাছ
অথবা প্রশান্ত আকাশের দিকে দৃষ্টি
মেলে দিয়ে কাটাও সময়
তাতে তোমার কী লাভ হয়, বলবে কি?
প্রশ্ন করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি, তবু আজ অব্দি
পাইনি উত্তর, শুধু তুমি ঠোঁটে হাসি
খেলিয়ে তাকাও এই উৎসুক ব্যক্তির দিকে আর
এলেবেলে কী-যে বলো, শত চেষ্টাতেও
অর্থের সন্ধান মেলা ভার। ডুবন্ত সূর্যের দিকে
কিছুক্ষণ তাকালেই সম্ভবত মিলবে হদিস বক্তব্যের।
হে বান্ধব, দেখছি তোমাকে ভ্রাম্যমাণ মেঘলোকে।
বুঝি না কী ক’রে ফের ফিরে আসবে এখানে
এই মৃত্তিকায় আর স্বাভাবিক ভাষা
উচ্চারণ করবে আবার সাধারণ মজলিশে।
এই তো জাগলো চাঁদ ঘুমের সাগর ভেদ ক’রে ;
হে বান্ধব, দেখছি তোমার হাতে অপরূপ চলিষ্ণু কলম।
খাতার পাতার পর পাতা অক্ষরের চুমোয় লাল
হয়ে ওঠে পুনরায় কিছুদিন পর। জানি অনেকেই ভেবে
নেচে উঠেছিলো সুখে-এবার তোমার
কলমের গতি চিরতরে থেমে গেলো সুনিশ্চিত!
অথচ বেজায় একগুঁয়ে কলম তোমার বন্ধু,
কোনও অভিশাপ পুড়ে ছাই করতে পারে না কলমকে।
০৮.১১.২০০৪