প্রতিদ্বন্দ্বী
এই যে প্রায়শ রাত্রির ঘুম মাটি করে বসে
কবিতা লেখার সাধনা করছি টেবিলে ঝুঁকে,
পরিণামে তার কী ফল জুটবে ভাবি মাঝে মাঝে;
তবে শেষ তক ভুলে গিয়ে সব সৃষ্টির মোহে বন্দি থাকি।
অনেক খাতার শূন্য পাতায় শব্দ-মিছিল
সাজিয়ে চলেছি বহুকাল ধরে। মাথার কালো
চুল সবগুলো শুভ্র হয়েছে অনেক আগেই। এখন ফেরার
পথ খোলা নেই, পথে যত কাঁটা থাকুক, তবুও এগোতে হবে।
আমার শরীরে দগদগে ক্ষত হয়েছে অনেক,
হঠাৎ কখনও হিংস্র ঈগল হামলা করে।
শরীরের তিন টুকরো মাংস ঈগলের ঠোঁটে
ঝুলতে ঝুলতে কখন কোথায় পড়ে যায় দূরে, পাই না টের।
ঈগল আমাকে নিয়েছে কি ভেবে আসমানচারী
জাঁহাবাজ আর হিংসুটে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী?
নইলে কেন সে ডানা ঝাপ্টিয়ে আসছে আমার
দিকে পুনরায়? জানে নাকি পাখি সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থ আমি?
২০.০৩.২০০৪
ফের উঠে সোজাই দাঁড়াই
আমি কি তোমাকে মেয়ে
ভালোবেসে অবশেষে
অপবাদ বয়েই বেড়াবো?
পড়ে আছি এক কোণে,
বয়সের ভারে আজ
তা’ বলে কি হেলাই প্রাপ্য?
আজও পূর্ণিমা-চাঁদ জেগে থাকে আসমানে,
জাগে না কি হৃদয় তোমার?
হয়তো তুষার কিছু জমেছে সেখানে,
নইলে কেন দেখা দাও না আর?
আমার এ কাতরতা দেখে দূরে আকাশের
তারাও কাঁপতে থাকে খুব!
তুমি এতটুকু আর
বিচলিত নও তো কিছুতে।
তা’হলে আমি কি আজ সবকিছু থেকে দূরে
সরে কোনও ভাগাড়ে থাকবো?
তবু কেন জানি আমি
মাথা নেড়ে আচমকা
ফের উঠে সোজাই দাঁড়াই।
১৯.০২.২০০৪
ফোটে বুনো ফুল
ছিলাম নিশ্চুপ ব’সে বিকেলে ঘরের এককোণে,
হাতে ছিল আধ-পড়া বই।
হঠাৎ পাশের পুরো খোলা দরজার
নগ্নতাকে যেন চুমো খেয়ে অন্দরে প্রবেশ করে
তিনটি শকুন। কখন যে হাত থেকে
আধ-পড়া বইটি মেঝেতে পড়ে গেলো
জানতে পারিনি; শকুনোর, কী অবাক কাণ্ড, ছিল
বেজায় নিশ্চুপ।
অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি অযাচিত
আগত শকুনদের দিকে।
বিস্মিত আমাকে ওরা চকিতে বাংলায়
করে সম্ভাষণ,বলে কিছু ভালো কথা
যা আমি কখনও আগে শুনিনি এবং আরও বেশি
বিস্ময়ের আবর্তে ভীষণ ঘুরপাক খেতে থাকি।
আমাকে বেজায় বিহ্বল, হতবাক হ’তে দেখে
তিনটি শকুন
একে অপরের কালো শরীরে লুটিয়ে প’ড়ে দিব্যি
জোরে হেসে হেসে ঘর প্রবল কাঁপিয়ে।
আমাকে হঠাৎ ভীত দেখে ওরা তিন পাখি
নিমেষে অদৃশ্য হয়, আসমানে চাঁদ জেগে ওঠে।
কিছুক্ষণ ব’সে আরও ভাবনার মায়াজালে দূরে
কোথায় যে ভ্রমণ করতে থাকি,-বুঝি কি বুঝি না, অকস্মাৎ-
হাতে উঠে আসে প্রিয়সঙ্গী বলপেন। পাশে-রাখা
প্যাডের উন্মুক্ত বুকে ফোটে বুনো ফুল!
২৯.১০.২০০৪
বস্তির খুব কাছে
হঠাৎ কোত্থেকে বলা নেই কওয়া নেই অসংখ্য শকুন
উড়ে এসে জুড়ে বসলো বস্তির খুব কাছে। পুরো জায়গা
কালো আসমানের বিরাট এক অংশ হয়ে প্রতিভাত সব
পথিকের দৃষ্টিতে। একজন বুড়োসুড়ো লোক টলতে টলতে
ভুলক্রমে প্রায় শকুনের ঝাঁকের গা ঘেঁসে হেঁটে যাওয়ার ক্ষণে
মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো মাটিতে।
অবসন্ন, প্রায়-অচেতন বৃদ্ধটিকে ছেঁকে ধরলো শকুনের
পাল। ওদের হিংস্র, তীক্ষ্ণ ঠোকর মানুষের মাংসের ঘ্রাণ
আরও বেশি লোভাতুর এবং ক্ষুধার্ত করে তুললো। শকুনের পালের
হামলা বৃদ্ধকে বড় বেশি কাতর করে তোলে। লোকটি হিংস্র
চঞ্চুগুলোর হামলা থেকে রেহাই পাওয়ার তীব্র বাসনায়
গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চায়। শীর্ণ হাত দু’টো দিয়ে জাঁহাবাজ
শকুনদের ক্ষুধার্ত, আক্রমণাত্মক ঠোঁট বড় বেশি
তেজী, মাংসলোভী হয়ে ওঠে।
বৃদ্ধটি নিজের দু’টি হাতকেই বড় বেশি জখমি, ছেঁড়া খোঁড়া
হতে দেয় নিরুপায় হয়ে। কয়েকবার কোনও কোনও শকুনের
টুঁটি চেপে ধরে, ছিঁড়ে ফেলতে চায় হিংস্র আক্রমণকারীদের
মুণ্ডু, ছুড়ে ফেলার তীব্র বাসনায় জ্বলে ওঠে বারুদের মতো, কিন্তু
অবসন্ন শরীর তাকে মাটিতে চেপে ধরে, শকুনের পাল তার
ওপর সওয়ার হয় ভয়ঙ্কর হিংস্রতায়। কিছুক্ষণ পর
শকুনের পাল সরে আসে কিয়দ্দূরে। ওদের ছেড়ে-আসা
জায়গায় পড়ে থাকে কয়েকটি মানবিক হাড়।
জ্যোৎস্নারাতে বুড়োর হাড়গুলো সজীব, সুন্দর হয়ে
একজন অপরূপ মানব হয়ে আসমানে ভাসে।
২৬.০৬.২০০৪
বাঁশিঅলা
বলা যেতে পারে-
সে-তো আজ নয়, বহুকাল আগে,
যখন আমার দেহ মনে
কৈশোর নিভৃতে খেলছিল অপরূপ
খেলা ভোরবেলা, রৌদ্রময় দ্বিপ্রহর,
মেঘঢাকা গাঢ় সন্ধ্যায় আর
গভীর রহস্যময় রাতে ছিলাম নিমগ্ন আর
কে এক রহস্যময়ী সঙ্গিনী ছিলেন উদ্যানের মায়াপথে
সে-রাতে, এখনও মনে পড়ে-
দিগন্তের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কানে
ভেসে এসেছিল কোন্ এক
বংশীবাদকের মন-জয়-করা সুর! কান পেতে
শুনি আমি খুঁজি তাকে দিগ্ধিদিক। শুধু
সুর আসে ভেসে, বাদকের দেখা পাইনে কিছুতে।
এ কেমন বাঁশি যার সুর ভাসে, অথচ বাদক
অদৃশ্য সর্বদা? তার দেখা
পাওয়ার আশায় ঘুরি প্রহরে প্রহরে, শুধু তার
সুর ভেসে আসে, ছুঁয়ে যায় এই নিবেদিত-প্রাণ
আমাকে তবুও অপরূপ শিল্পী তার সবটুকুউ
রূপ থেকে দান ক’রে ঝলসিত হতে নন রাজী।
তবে কি আমার ঝুলি অপূর্ণই রবে সর্বকাল?
যদি আমি মাথা কুটে মরি বাঁশি, তবু
তুমি দেবে না কি ঢেলে তোমার সকল
সুরের অক্ষয় ডালি আমার কম্পিত অঞ্জলিতে?
১৩.০৯.২০০৪
বিস্মিত দৃষ্টিতে
বহুক্ষণ হেঁটে, হেঁটে, হেঁটে
কোথায় এসেছি
গায়ে-কাঁটা-দেয়া এই জন্মন্ধ সন্ধ্যায়?
মনে হচ্ছে পশ্চিম আকাশ
কালো বিস্কুটের মতো আর
চাঁদ কোনও বুড়োর ধরনে কতিপয়
ফোকলা দাঁতের আহামরি সৌন্দর্যের
বিদঘুটে বাজারু প্রচারে কী অশ্লীল!
বিদঘুটে, হিংসুটে এক বৃক্ষতলে
ক’জন জুয়াড়ি
মেতেছে খেলায় আর কখনও কখনও
তাদের হুল্লোড়ে কেঁপে ওঠে
জমি, যেন গিলে খাবে সেই
ফতুর জুয়াড়িদের। আচানক নারীর কান্নার
ধ্বনি ভেসে আসে ক্ষণে ক্ষণে ঘোর কৃষ্ণ
দিগন্তের বুক চিরে। কে এই নিঃসঙ্গ অনামিকা?
কখন যে নিজেকে দেখতে পাই এক
হ্রদের কিনারে,
বড় বেশি অন্ধকার চারদিক থেকে
দাঁত নখ খিঁচিয়ে আসছে। মুখ ঢেকে
রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই।
আমি তো ভেবেছিলাম হ্রদ থেকে উঠে
জাগবে সুন্দরী কেউ হাসি মুখ আর
বসবে আমার পাশে, শোনাবে জলজ
কাহিনী এবং ওষ্ঠ এগিয়ে চুম্বন দেবে এঁকে
আমার এ পিপাসার্ত ঠোঁটে।
এরকম কিছুই ঘটেনি, শুধু দেখি
ধু ধু বিরানায় বসে আছি এক বুক
হাহাকার নিয়ে আর ক্ষেপে-যাওয়া চাঁদ
দূর থেকে থুতু, শ্লেষ্মা ছিটিয়ে আমাকে
তুচ্ছতার ভাগাড়ের বাসিন্দা বানাতে
বড় বেশি ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আচমকা
আমার ভেতর প্রায় ক্রোধের ধরনে
কী এক আবেগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মাটি থেকে কিছু ঢেলা কুড়িয়ে ওপরে ছুড়ে দিই
বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখি পুষ্পবৃষ্টি ঝরে অবিরত!
১৪.০৫.২০০৪