নিঃসঙ্গ জুতো
বসেছিলাম লেখার টেবিল-ঘেষা
অনেকদিনের পুরনো চেয়ারে। হঠাৎ চোখ
পড়লো কিয়দ্দূরে রোদ পোহানো
নিঃসঙ্গ ঢের ক্ষয়ে-যাওয়া
একটি জুতোর দিকে। কেমন যেন
মায়া লাগলো। কার জন্য?
আবার দৃষ্টি ছুঁলো হাতে-রাখা আধ-পড়া
বইটির পাতায়, মন বসলো না। দৃষ্টি গেলো পুরনো,
বেখাপ্পা জুতোর দিকে। এক লহমায় কী মনে হলো
নিজের চেহারা দেখলাম আয়নায়। চমকে
উঠি রোদ-পোহানো, ক্ষয়ে-যাওয়া
জুতোর সঙ্গে আমার মুখের মিল দেখে।
০২.০৯.২০০৪
নিজের অজ্ঞাতেই
একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি
আমার জন্মশহরের প্রায় প্রতিটি রাস্তা শত শত গণ্ডারে
ভরে গেছে। কে জানে কোত্থেকে এসেছে এ পশুর দল।
হঠাৎ গণ্ডারের ভরাট মিছিল থেকে
উচ্চারিত হলো, “কে রে তুই বেল্লিক, বুরবক আমাদের
পশু বলে গাল দিচ্ছিস? বড় তো আস্পর্ধা তোর! এক্ষুণি
তোর টুঁটি ছিঁড়ে কাকপক্ষীকে খেতে দেবো আর উপড়ে নেবো
চোখ। সারা জীবন পথ হাতড়াতে হাতড়াতে কাটবে। বুঝলি বেয়াদব?”
জানলা থেকে গণ্ডারের বিপুল মিছিল দেখে আর
ওদের ক্রুদ্ধ বক্তব্য শুনে পিলে চমকে তো গেলোই,
শিরার উষ্ণ রক্ত শীতল হয়ে গেলো এক লহমায়। আচমকা
কানে এলো এক ঘোষণা,-“হে নগরবাসী, যা বলছি মন দিয়ে
শোনো। তোমাদের শহর এখন
আমাদের দখলে। কেমন ক’রে গণ্ডার-প্রভুদের
দাসত্ব পালনের সুযোগ তোমরা পেলে তা জানার প্রয়োজন নেই।
তোমরা এমনই অথর্ব, এরকমই নিষ্কর্মা যে,
কারও না কারও প্রভুত্ব স্বীকার না করলে
তোমাদের উদরের অন্ন হজম হয় না। তাই এখন গণ্ডার-প্রভুদের
গোলাম তোমরা। হ্যাঁ, তোরা আমাদের
দাসত্ব করলেই থাকবি সুখে, মেদ জমবে তোদের শরীরে।
জানলা দিয়ে ভোরবেলার রোদ আমার ঘুমন্ত
মুখের ওপর খেলা করতেই আমি
জেগে উঠলাম। জানলা রাস্তায় দৃষ্টি দিয়ে
গণ্ডারের মিছিল খুঁজি। না, তেমন কিছু নেই কোথাও।
সত্যি কি নেই? কেন যেন মাথায়, কপালে হাত
চলে গেলো নিজের অজ্ঞাতেই একটি কি দু’টি শিঙের উদ্দেশে।
০৫.১১.২০০৪
পক্ষীসমাজ
কত যে খণ্ডিত হই রোজ
নিজেই জানি না।
পথে যেতে যেতে কত অচেনা মুখের
সঙ্গে দেখা হয়, কিন্তু কথা না ব’লেই
যে যার গন্তব্য চলে যাই। এই মতো
আচরণ নিন্দনীয় নয় ব’লে বিবেচিত মানব সমাজে।
পক্ষী সমাজের কিছু আচরণ ভিন্ন,
জানা আছে। ওরা
বস্তুত একলা নয়, দল বেঁধে চলে,
একত্রে আহার করে অবসর উপভোগ করে
মিলে মিশে এক জায়গায়। নিজেদের
মধ্যে মানুষের মতো খুনোখুনি করে না কখনও।
২৫.০৩.২০০৪
পারবো নাকি পূর্ণিমার চাঁদ এনে
আমি কি প্রত্যহ ভীতসন্ত্রস্ত মানুষে হয়ে কাটাবো সময়?
আমাকে মোড়ল আর তার
স্যাঙাত এবং তল্পিবাহকেরা
দেখাবে রক্তিম চোখ যখন তখন
আর আমি মাথা হেঁট করে
দূরে চলে যাবো আর গৃহকোণে লুকাবো নিজেকে।
তাহলে আমি কি এভাবেই
কাটাবো এখানে দিনরাত?
বালিশে লুকিয়ে মুখ নিজেকে ধিক্কার
দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে
ছিঁড়বো মাথার চুল? অমাবস্যা-রাতে
হবো আত্মাঘাতী?
কী আমার দান এ সমাজে?
আমি কি পেরেছি বদলাতে সমাজের
চেহারা নিজের সাধ অনুসারে? পেরেছি কি
ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিতে কুসংস্কার?
পারিনি এখনও আমি আমার কাছের
মানে অন্তরঙ্গ জনদের ভাবনা-চিন্তাকে ঠিক
আমার ধারায় এনে সমাজের চেহারায় আলোর ঝলক
সৃষ্টি করে নিজেরা ক্রমশ ধন্য হতে।
আসন্ন সন্ধ্যায় অন্ধকারে ছিঁড়ে আমরা কি
পারবো না পূর্ণিমার চাঁদ এনে আমাদের সব
অকল্যাণ মুছে ফেলে আগামীকে কল্যাণের আলোয় প্রদীপ্ত
করে এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে ধন্য হতে?
২৪.০৮.২০০৪
পূর্বে না-দেখা ঝর্নার সান্নিধ্য
কোথাও কোনও যানবাহন ছিলো না। মাইল,
মাইল হেঁটে ক্লান্ত শরীরে একটি পুরানো,
ভাঙাচোরা বাড়ির কাছে হাজির
হলাম। বাড়ির দিকে তাকাতেই গা ছমছম
করে উঠলো। এখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে
গা’জুড়িয়ে নেয়ার ইচ্ছার অকালমৃত্যু হলো।
আবার ভীষণ অনিচ্ছার মুণ্ডু মুড়িয়ে এগোই।
গলা শুকিয়ে কাঠ, অথচ পান করার
মতো পানি কাছে ধারে কোথাও নেই। হঠাৎ
মাথার ওপর দিয়ে একটি বাজপাখি উড়ে হয়তো
আমার দুর্দশা দেখে পাখা ঝাপ্টে হেসে অনেক
দূরে উধাও হয়ে গেলো। আজ এখানে, কাল সেখানে
এই যে আমি যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াই,
এরকম কাটবে আর কতকাল, কে জানাবে আমাকে?
হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত আর কতটা
পথ পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত আস্তানায় পৌঁছুতে পারবো
ভেবে কখনও হতাশায় কালো হই, কখনও আবার
আশার তিনশত প্রদীপ জ্বলে ওঠে। এভাবে
প্রায়-মৃত শরীরটিকে টেনে হিঁচড়ে চলতে চলতে
আচনকা মন-মাতানো সুরধারা খুব নিকট থেকে
ভেসে এসে আমাকে সঞ্জীবিত করে, নতুন হয়ে উঠি।
প্রকৃত মুক্তির আলোকিত জনতার শ্রেয় দেশ
যখন বেরোই পথে দিন কিংবা রাতে
চোখে পড়ে নানা ধরনের কিছু লোক
ডানে বামে। আচমকা কেন যেন মনে হয় কারও
ঘাড়ে শুধু একখানা মাথা নয়, দুটো কি তিনটি
মাথা লগ্ন বলে মনে হয়। সাধ জাগে লোকটিকে
গিয়ে প্রশ্ন করি, সত্যি আপনার মাথা কি তিনটি?
মাঝে মাঝে কী-যে হয় মধ্যরাতে একলা দূরের
বাগানে হাজির। চোখে পড়ে, এক কোণে
ক’জন জুয়াড়ি দিব্যি মেতেছে খেলায়, কেউ খুব হেরে গিয়ে
গিন্নির গয়না কিছু বেঘোরে খুইয়ে বসে আর
আচানক দৃশ্যটি তিমিরে মিশে যায়। বহু দূরে বিধবার
বুকফাটা কান্নার ধরনে এক পাখি ডেকে ওঠে বারবার।
রাত আরও গাঢ় আর বয়সী হতেই
চোখে পড়ে এক মধ্যবয়সী বেখাপ্পা লোক দূরে
তিন জন যুবকের সঙ্গে, মনে হলো বড় বেশি
গুপ্ত কিছু করছেন স্থির। আসমানে অন্ধকার
ভেদ করে মিছিলের আভা জেগে ওঠে। বয়সের
দৌরাত্ম্য উপেক্ষা করে নেতা দৃপ্ত পায়ে যান হেঁটে।
স্বপ্ন নাকি বাস্তব সহজে বোঝা মুশকিল। তেজী সেই
মিছিলে জালিম লাঠি ডানে বামে
চালায় পুলিশ আর ভাড়াটে গুণ্ডারা। রক্ত ঝরে।নিরস্ত্র পুরুষ আর নারীদের। আন্দোলনরত
যারা, তারা স্বপ্ন দ্যাখে পুষ্পশোভিত আগামী আর
প্রকৃত মুক্তির আলোকিত জনতার শ্রেয় দেশ।