বিরানায় হঠাৎ
কখনো কখনো অকস্মাৎ মনে হয়,
এখন কোথাও কেউ নেই। চার পাশে ভয়ঙ্কর
শূন্যতা আহলাদে আটখানা হয়ে ধেই
ধেই নেচে বেড়াচ্ছে সর্বত্র বিলুপ্তিতে!
আমিওতো প্রাণী এক, মানবই নিশ্চিত,
তবে এই আমি কেন দিব্যি রয়ে গেছি
এমন নিষ্প্রাণ শূন্যতায়? এ কি পুরস্কার? না কি
ভয়ঙ্কর শাস্তি কোনও? নারকীয় শাস্তি সুনিশ্চিত।
আমিতো আমার চার পাশে জীবনের কলরব
শোনার ব্যাকুল প্রতীক্ষায় থাকি, এই
পাথরপ্রতিম নীরবতা বুকে চেপে থাকে, দূর
দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে কিসের অপেক্ষা করি?
গায়ে কাঁটা দেয়া নীরবতা আমাকে উন্মাদ করে
দেবে ভেবে পাথরের বুকে মাথা ঠুকে ঠুকে ব্যর্থ
জীবন বিলিয়ে দেবো হন্তারক বিরানায়। হঠাৎ দিগন্তে
মিছিলের মতো কিছু পরিস্ফুট, জীবনের মেলা আসছে এগিয়ে।
১৫-১২-২০০৩
বিষাদের ছায়া
এ ভাবে কি নিষ্প্রাণ, নিস্পৃহ থাকা যায়
বেশি দিন নিজের ছায়ার মতো? থাকা কি উচিত
আপনজনের মাঝে? তাহলে তো নানা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হবে
আমার দিকেই বারবার। বস্তুত হলোও ঠিক তাই। অনেকেই
আমাকে প্রশ্নের জালে আটকে মেটাতে চাইলেন
কৌতূহল। কী বলবো? পাইনি উত্তর খুঁজে কোনও।
তারপর থেকে নিজ বাসগৃহের বাসিন্দা কাছে এলে হাসি
এঁকে মুখে নানা কথা বলি,
কিন্তু, হায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছন্দ পতনের ফলে
হাসি উবে যায় আর নিজেকেই খুব বোকা-বোকা মনে হয়।
কখনও কখনও ভাবি, অপূর্ব আনন্দনিকেতনে
আছি হেসে খেলে, সত্যি-সত্যি
কোথাও নিকট থেকে দুঃখ ভোলানো গানের সুর
কী মধুর ভেসে এসে আমাকে দখল করে নিচ্ছে ক্রমাগত।
আমি তো নিজেই জানি নকল আনন্দ বেশিক্ষণ
যায় না টিকিয়ে রাখা, যেমন অপটু অভিনেতা
খানিক পরেই ঠিক নিজের ব্যর্থতা তুলে ধরে
দর্শকের কাছে। তবু আমি মাঝে মাঝে
নিজ বাসগৃহের বাসিন্দাদের সন্দেহ ঘোচাতে চটপট
হাস্যরস জড়ানো গল্পের অবতারণা ক’রেই
হাসির ফোয়ারা খুলে দিই সাড়ম্বরে কখনও বা
ভূতুড়ে গল্পের শিহরন সৃষ্টিতে উদ্যোগী হই রাতিবেলা।
অথচ আমার বিষণ্নতা ভেসে ওঠে বারবার চেহারায়,
মধ্যরাতে গাঢ়তর হয়ে পড়ে বিষাদের ছায়া।
১৮-১২-২০০২
বিড়াল-শূন্য বারান্দা
আমি কি এভাবে নিজেকেই কুরে কুরে খেয়ে ফেলে
বাহবা কুড়িয়ে যাবো দশদিকে? দ্যাখো,
এই ক্ষয়া আমাকে খুঁটিয়ে দ্যাখো। না, না,
অমন কষ্টের ভার স’য়ে যাওয়া আমার নিয়তি সুনিশ্চিত।
আসবে কি তোমরা আমার আস্তানায়? না, তেমন
বিড়ম্বনা হবে না পোয়াতে। দেখে যাও,
এখানে তেমন ভিড় নেই আসবাবপত্রের, কেবই কিছু
পছন্দের বইপত্র আছে। মাঝে মাঝে
চাইলে অথবা না চাইলে
কিয়দ্দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মধুর সুর।
আমার বিনীত বারান্দার প্রায়ঃশই একটি বিড়াল এসে
বসে থাকে খাদ্যের আশায়। আমি ওকে
হামেশা আমার পাত্র থেকে মাছ, মাংস
কিংবা অন্য কোনও খাদ্য দিই ভালবেসে।
বেশ কিছুদিন পর লক্ষ্য করি, সেই
অতিথি আমার মানে বিড়ালটি আসে না আর; প্রশ্ন জাগে-
কোথায় হারিয়ে গেলো কোন্ ঝোপঝাড়ে? সে কি তবে
হয়েছে শিকার দ্রুত ধাবমান কোনও মোটর কারের?
জানতে পারিনি আজও কে বাজায় বাঁশি। সে কি সুখী?
নাকি কোনও গুপ্ত বেদনার ছায়া তাকে
রয়েছে দখল করে বহুদিন থেকে। ব্যক্তিগত
দুঃখের আঁচড়ে আমি যতদূর পারি
আড়ালেই রাখি। তবু বারান্দার সেই বিড়ালের
খাঁ খাঁ অনুপস্থিতির ছায়া শূন্যতাকে আরও গাঢ় ক’রে তোলে।
বেশ কিছুকাল পর ভুলে যাই চেনা বিড়ালের উপস্থিতি-
চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ি, কখনও টেবিলে
ঝুঁকে কোনও অসমাপ্ত কবিতার শেষ পঙ্ক্তিমালা
রচনায় ফের দরবেশ তুল্য ধ্যানী হয়ে যাই।
১১-১২-২০০৩
মরণ-বিরোধী পঙ্ক্তিমালা
আমি গোলাকার চাঁদ এবং জ্যোস্নাধারার কথা
চিন্তা করি, অথচ ঘোর অমাবস্যা
ধেয়ে আসে আমার দিকে। মনে হয়, একটা
কুচকুকে কালো কাফন আমাকে ঢেকে ফেলেছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। তাহলে
আমার দিন কি ফুরিয়ে এলো? চিরকালের জন্যে
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এই শরীর আমার,
যাকে কত যত্নেই না ধুলোবালি, নোংরা
আবর্জনা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছি? শরীর একটু
বিগড়ে গেলেই তো ধর্না দিই চিকিৎসকের দুয়ারে।
এই যে আমি বন্ধুদের মজলিশে দিলখোশ গল্পে
মেতে থাকি কখনও সখনও, এই যে চার বছরের
পৌত্রী দীপিতার কষ্ট ভোলানো
হাসির ঝলক আমাকে কোনও পবিত্র এলাকায়
নিয়ে যায় অথবা কোনও বিগত কবির পঙ্ক্তিমালা
আমার চেতনায় অপরূপ পাখি হয়ে
ভাসতে থাকে, তখন আমার নামের আড়ালে
যে সত্তার বসবাস, তার জন্যে মন কেমন উদাস হয়ে যায়।
যদি বলি, মৃত্যুকে আমি ঘৃণা করি, মৃত্যুর মুখ দেখার
কোনও সাধ নেই আমার,
তবে কি এ কথা শুনে সবাই হেসে উঠবে
ঘরদোর কাঁপিয়ে? মরণের ভয়ানক চোখমুখবিহীন
মুখ দেখার, জীবনের শপথ, সত্যি বলছি
এক কণা সাধ নেই এই বান্দার।
৩-৪-২০০৩
মরমী কবি এবং পথচারী
জনৈক মরমী কবি বড় একা যাচ্ছিলেন হেঁটে
ফুটপাতে হলুদ বিকেলে। পথচারীদের তিনি
লক্ষ করেছিলেন অথবা না করেই অন্য মনে
ভাসমান মেঘ কিংবা উড়ন্ত পাখি
রূপ দেখে নাকি কবিতার পঙ্ক্তিমালা
ভাবতে ভাবতে, কেউ বলতে পারে না।
কিছু পথ তিনি অতিক্রম করতেই তিন চারজন লোক,
পরম উৎসাহী, ঘিরে ধরে আলাভোলা
কবিকে এবং বোকা-সোকা কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে
ভীষণ বিব্রত করে তাকে। নিরুত্তর তিনি মৃদু
হেসে শুধু তাকান ওদের দিকে সপ্রেম প্রশয়ে। আকাশের
সূর্য বুঝি লজ্জায় লুকোয় মুখ মেঘের বোরকায়।
কিয়দ্দূরে জনৈক যুবক, কবিতার গভীর পাঠক, স্মিত
হেসে যাত্রা থামিয়ে কবির
বিবতির, তার মতে, হেনস্থার দৃশ্য তাকে প্রায়
রুষ্ট করে তোলে এক লহমায়, কিন্তু কোনও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া
প্রদর্শনে ব্যর্থতার অন্ধকার বয়ে নিয়ে বুকে
ফুটপাতে দ্রুত, অতি দ্রুত হেঁটে যেতে শুরু করে।
১৯-১১-২০০২