কবরের পাশে
গোধূলি বেলায়
একটি অচেনা কবরের পাশ দিয়ে
হেঁটে যেতে-যেতে কেন জানি
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশে পাশে
কোনও ঘরবাড়ি নেই, শূন্যতা বিলাপ করে শুধু
আর কিছু গাছপালা শোনাতে চাইছে কোনও কথা।
বিরান স্থানের
এই প্রায় নিশ্চিহ্ন, অচেনা কবরের
প্রয়াত বাসিন্দা কে ছিলেন?
তিনি কি পুরুষ না কি নারী? হাওয়ায় স্পন্দিত এই
গাছের সবুজ পাতাগুলি পারবে কি সত্যি জানাতে এখন?
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকি আরো কিছুক্ষণ।
কবরের পাশে
না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হেঁটে
যেতে শুরু করি আর কখনো সুনীল আকাশের
দিকে, কখনো-বা চারদিকে দৃষ্টি মেলে দিই কিছুই না ভেবে।
কিছুতেই ফুরায় না যেন পথ; ভাবি, আমার কি
কেবলি সম্মুখে হেঁটে চলাই নিয়তি?
বেলা পড়ে আসে,
ক্লান্তি ভর করে দু’পায়ে আমার এবং আচমকা
আমার প্রয়াত জননীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে মেঘমালা থেকে-
‘বাচ্চু, বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো তুমি দাঁড়াওনি
আমার নিঝুম এই কবরের পাশে। আমাকে কি ভুলে গেলে?
হায়, অপরাধী আমি মাথা নীচু ক’রে থাকি বেশ কিছুক্ষণ।
১৩-১২-২০০৩
কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার পথ
(তুষার কর প্রীতিভাজনেষু)
আমাদের জীবনে কি কৃষ্ণপক্ষ শাসন করেই
যাবে বহুকাল? পূর্ণিমার
মুখে দেখে যেতে বুঝি পারবো না আর। চতুর্দিকে
নৈয়াশা-পীড়িত, নুয়ে-পড়া মানুষের আসা-যাওয়া।
এই আমি একদা ছিলাম জ্বল জ্বলে আশাবাদী;
হতাশার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে জয়ী হয়ে
কাটিয়ে দিয়েছি বহুকাল। দুর্দশার মুখে থুতু
ছিটিয়ে এনেছি উৎসবের দিনগুলি, রাতগুলি।
কোন সে অশুভ ঝড় চকিতে গুঁড়িয়ে দিলো এই
ঈর্ষণীয় শান্তির মোহন নীড়? কার
অসুস্থ চেতনা সত্য, সুন্দরের বিলয় সাধনে
নিয়ত সৃষ্টির নয় ধ্বংসের সপক্ষে ক্রিয়াশালী সর্বক্ষণ।
ষড়যন্ত্র যতই তুখোড় হোক, অন্ধকারে অস্ত্র
যতই শানাক কিংবা অশুভের সঙ্গে সন্ধি করে
বুনুক ধ্বংসের বীজ যত্রতত্র, আখেরে নিশ্চিত শুভ জয়ী
হয়ে চতুর্দিকে কৃষ্ণপক্ষে পূর্ণিমার পথ খুলে দেবে ঠিক।
২
দিন, মাস, বছর, শতাব্দী,
শতাব্দীর পর শতাব্দীও
কেটে যাবে; অসংখ্য শতাব্দী
লুপ্ত হলে প্রিয় বাংলাদেশ,
দুনিয়াদারি কি রয়ে যাবে?
যাবে না কি সব লুপ্ত হয়ে?
শূন্যতাই পরিণতি নিশ্চিত আখেরে।
১১-১২-২০০৩
কোনওমতে টিকে আছি
কী করি? কী করি, বলো কিছুই তো লাগছে না ভালো,-
সভা সমিতিতে গিয়ে কয়েক মিনিট
কক্তৃতায় গা ভাসিয়ে দেয়া, তর্কে মাতা আর আড্ডায় নরক
গুলজার করা কিংবা কী ক’রে চলবে
সংসার মসৃণ রূপে, আমার মৃত্যুর পর গোটা পরিবার
কোন্ সে বিপাকে প’ড়ে কাটাবে কঠিন দিনগুলি,
রাতগুলি, আমার কবিতা কেউ ছুঁয়ে দেখবে কি দেখবে না,-
এ সব কিছুই আর এখন পাচ্ছে না আশকারা দুশ্চিন্তার।
অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এক ঝাঁক ঝিঁঝিঁ পোকা
মাথার ভেতর একটানা একঘেয়ে আওয়াজ করতে থাকে আর
চোখে ঘুম নামার পরেই থামে ওদের কোরাস। জাগলেই
নিশ্চিত বাজাবে ব্যান্ড আমি জেগে থাকা অব্দি; এমনকি কোনও
কবিতা লেখার দীপ্র মুহূর্তেও করে না রেয়াত; এ যন্ত্রণা
কোনও দিন শেষ হবে কি না, কে আমাকে ব’লে দেবে?
যন্ত্রণা হয় না শেষ এক লহমায় কোনও দিন;
মানুষ অথবা পশু, বস্তুত জীবের
কিছুতে রেহাই নেই যন্ত্রণার নির্দয়তা থেকে
এই দুনিয়ায়, অন্য কোনও পৃথিবীর অস্তিত্বের কথা আজও
অজানা আমার। বড় বেশি ঝামেলায়
সত্তায় অনিশ্চয়তা ব’য়ে কোনওমতে টিকে আছি।
০৭-১১-২০০২
ক্যালেন্ডার পালটে গেলে
ক্যালেন্ডার পাল্টে গেলে নতুন বছর প্রকৃতই
পরিবর্তনের রঙ এনে দেয়, যদি
স্বস্তি আর শান্তি গলাগলি করে পরস্পর খুব
সুখে বসবাস করবার স্বাদ পায় সুনিশ্চিত।
অন্ধকার আকাশের বুকে প্রত্যাশার পূর্ণচাঁদ
জেগে উঠলেই জানি ভোগান্তি-বিদীর্ণ জনগণ
হাত ধরাধরি করে যাবে
মিলনমেলায় আর স্বাগত জানাবে শুভ আর কল্যাণকে।
আমরা সকল হতভাগ্য, প্রতারিত জনসাধারণ সত্যি
পাবো তো আবার ফিরে আনন্দের রঙধুন আর
প্রগতির পদধ্বনি হবে তো সুস্পষ্ট আরও নিকট তারিখে?
হয়তো দুলবে সাফল্যের মালা অচিরেই, মন বলে।
অথচ মনের কত প্রত্যাশার আলো মালা হতাশার ঝড়ে
নিভে গিয়ে লুটোপুটি খেয়েছে ভাগাড়ে,
এ-ও তো দেখেছি কত আহত দৃষ্টিকে
ধূম্রজালে বিদ্ধ হয়ে হত্যাযজ্ঞে সত্তাহীন হতে!
কী-যে হলো, এখন নতুন ক্যালেন্ডারে
চোখ পড়লেও বনবাদাড়ের ভীষণ দৃশ্যের
ছবি ফুটে ওঠে, কল্যাণের পলায়নে
হতাশায় ডুবে যেতে-যেতে রজ্জু ভেবে সর্পকেই তুলি হাতে।
আবার খুঁড়িয়ে হাঁটবো কি দীর্ঘ ভাঙাচোরা পথে,
যেখানে অনেক মোড়ে আচমকা অতি
ভয়ানক গহ্বর নিষ্ঠুর হাসি ছড়িয়ে তিমিরে
তুমুল লাফিয়ে ওঠে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুদের হিংস্রতায়।
২৬-১২-২০০২
ক্রিসমাস ট্রি যার স্মৃতির প্রতীক
কেন যে অনেকদিন থেকে মাঝে-মধ্যে আচমকা
গোধূলি বেলায় চোখে ভেসে ওঠে অতিদূরে
কালের বিচারদৃশ্য আর
আলখাল্লা-পরা এক বিবাগী পুরুষ।
কী এমন অপরাধ ছিল তার? বস্তুত কিছুই
নয়, শুধু তিনি তার বিশ্বাসের কথামালা পথের কিনারে
দাঁড়িয়ে আগ্রহী কিছু শ্রোতাকে কখনো
কখনো প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে শোনাতেন। উপস্থিত
শ্রোতারা শুনতো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। আলখাল্লা-পরা
সেই বক্তা ধীর, স্থির অনন্য যেশাস।
ঈর্ষান্বিত, ভীষণ চক্রান্তকারী পুরোহিতদের
দু’চোখের বালি তিনি। ওরা তাকে পৃথিবীর রৌদ্র-ছায়া থেকে
চিরতরে সরিয়ে দেয়ার ক্রূর বাসনায় পাইলেট নামে
খ্যাত এক রোমান কর্তার দোরে ধর্না দেয়। ওদের নালিশে
প্রথমে দেয় না কান পাইলেট । পরে বন্দী যেশাসকে
হঠাৎ জিগ্যেস করে, “বলো দেখি সত্য বলে কাকে?”
হই হল্লা তীব্র হ’লে যেশাস জবাব না দিতেই তাকে ক্রুশবিদ্ধ
করার হুকুম দিয়ে পাইলেট মৃদু হেসে সাত তাড়াতাড়ি
চলে গেলো অন্যত্র কোথাও। যেশাসকে
ক্রুশে ওরা বিদ্ধ করে জালিম পেরেকে। পৈশাচিক হৈ-হল্লায়
মত্ত, হীন পুরোহিতদের সাধ মেটে। যন্ত্রণায়, যন্ত্রণায়
ভুগে শেষে প্রাণ ত্যাগ করলেন যীশুখৃষ্ট। এখনতো তার স্মৃতি ঘিরে
ক্রিসমাস ট্রির জ্বলজ্বলে দীপ জ্বলে সারা রাত
নিবেদিত ভক্তদের ঘর। মহান সে পুরুষের মৃত্যু নেই!
১৯-১২-২০০৩