এরা চেনা কেউ নয়?
সন্ধ্যারাতে বিছানায় শুয়ে আকাশ কুসুম ভেবে
ভেবে দিব্যি সময় কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। যে-শহরে
আমার নিবাস তার অস্তিত্বে প্রকৃতি
বড়ই কৃপণ ভেবে আক্ষেপ হচ্ছিলো খুব। ডান দিকে ফিরে
তাকালাম আকাশের দিকে,
যেমন প্রেমিক তার দৃষ্টি প্রেমিকার
বুকে করে স্থাপন প্রগাঢ় আবেগের সুষমায়।
অকস্মাৎ প্রেমের কবিতা রচনার
ভাবনা আমাকে দিব্যি করলো দখল। বিছানার
কোমল আশ্রয় ছেড়ে গৃহকোণে স্থাপিত টেবিলে
রাখা প্যাড এবং কলম টেনে নিয়ে
প্রেমিকার চোখ, মুখ স্মৃতিপটে রেখে কাগজের
বুকে শব্দাবলি সাজাবার উদ্যোগ নিতেই কী-যে
হলো, প্রিয় মুখ স্মৃতি থেকে গেলো মুছে
নিমেষেই আর কী প্রবল ভেসে ওঠে কতিপয় শীর্ণ মুখ।
কারা এরা? চেনা কেউ নয়, তবু বড় পরিচিত
মনে হয়, আমার আত্মীয় খুব নিকটের
সুনিশ্চিত। তবে কেন এ রকম বিষণ্ন, ক্ষুধার্ত
মুখ, যেন মৃতপ্রায়? তাহ’লে আমি কি
নির্দয় ভীষণ? অমানুষ একজন। হায় মঙ্গা
ওদের কামড়ে খেতে-খেতে প্রায় লাশ দ্রুত বানিয়ে ফেলেছে!
১০-১১-২০০৩
কখনো কখনো
কোনো কোনো ভোরবেলা একটি কি দুটি পাখি এসে
বারান্দায় বসে আর তাকায় আমার দিকে, যেন
অতিশয় পরিচিত আমি
ওদের, তাই তো খুব কাছে এসে বসে,
আমার ছিটানো বিস্কুটের গুঁড়ো খেয়ে
পাখা মেলে চলে যায় কত দূরে জানি না কোথায়।
কখনো কোকিল খাঁখাঁ দুপুরের কানে
ব্যাকুল, নিভৃত সুর ঢেলে দেয় বারবার, ভারি
ইচ্ছে হয় ছুটে যাই ঝোপঝাড়ে, টেনে নিই বুকে
পাখিটিকে। সে কি ধরা দেবে? এ কবিকে
পছন্দ হ’লেও ওরে দেবে না তো ধরা। ব্যর্থ আমি
মাঝে মাঝে কল্পনায় শুনি তার গান।
যখন ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা, কাছের গাছের
একটি উৎসুক ডাল বাড়ায় সবুজ গলা তার
আমার নিভৃত ঘরে, যেন
আদর কুড়াতে চায় নিরালায় নিঃসঙ্গ কবির।
ওকে ছুঁতে গেলে আচমকা হাওয়া এসে
এক ঝটকায় ওকে দূরে নিলে শুনি হাহাকার।
নিশীথের প্রথম প্রহরে আকাশের ক’টি তারা
নেমে এসে বসে হেসে প্রসারিত দু’হাতে আমার;
অপরূপ কণ্ঠস্বরে কী যেন বলতে
চেয়ে থেমে যায়, নাচে হাতের তালুতে
প্রাক্তন ঘনিষ্ঠ পরিচয় স্মৃতিপটে ঝলসিত ব’লে বুঝি।
হঠাৎ হাতের পাতা গাঢ় অমাবস্যা হয়ে যায়!
কোন কোনো গহন রাত্রিরে মনে হয়
কখনো না-দেখা এক জলাশয় ডাকছে আমাকে
মায়াবী জলজ সুরে। জ্যোৎস্না
ওকে বড় বেশি বিচলিত
করছে বুঝি-বা তাই ওর তট ছিঁড়ে
চাইছে আসতে ছুটে এ শহরে আমার নিকট।
২৪-০৪-২০০৩
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
সূর্য জাগবার আগে, দুপুরে, গোধূলিবেলা কিংবা
সন্ধ্যা, এমনকি মধ্যরাতে
কণিকা, তোমার গান প্রাণের উপত্যকায় কখনও ঝরায়
কত অপরূপ ফুল, কখনওবা স্বর্গীয় শিশির।
আনন্দের প্রহরে অথবা বেদনার মেঘময়
মুহূর্তে তোমার সুর আমাকে অনন্য এক ভ্রমণে করেছে
সঙ্গী বারবার সেই দেশে
যেখানে মানব তার কল্পনার উজ্জ্বল উড়াল
পেয়ে যায় অনন্তের সীমাহীনতায়। তুমি নেই
প্রকৃতি-শোভিত প্রিয় শান্তিনিকেতনে,-
এ নির্দয় সত্য মেনে নিতে আমার চৈতন্য আজও
হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তুমি আছো, থাকবে নিয়ত
তানে, লয়ে প্রস্ফুটিত রবীন্দ্রনাথের চিরঞ্জীব গীতিমাল্যে
এবং তোমার কণ্ঠসুধা সুখী, দুঃখী
কালে জানি জাগাবে পূর্ণিমা।
১৫-০৮-২০০২
কণ্ঠস্বর অন্ধকারে বটায় প্রেম
জ্বলজ্বলে, ঝলমলে এই শহরের অনেক
আলিশান দালানে
কত না আনন্দধ্বনি সাহেব, বিবিকে তন্ময়
করে রাখে, শৌখিন প্লেটের উচ্ছিষ্ট
খাবার ভেসে যায় নর্দমায়, কে তার
হিশেব রাখে ক্ষুধার্ত বনি আদম ছাড়া এখন?
‘জয়তু বিলাসিতা, জয়তু ধনসম্পদ’
স্লোগান দিতে-দিতে ঢের আয়েশি মোটরকার ছোটে মসৃণ।
কখনো ভাঙাচোরা পথে হেঁটে যেতে-যেতে দৃষ্টিতে
দুর্দশাগ্রস্ত মহল্লায় আমার
চোখে চোখ রেখে ওরা দারিদ্র্যের কথা বেজায়
তিক্ত স্বরে ঘোষণা করে। কোনো দ্বিধা অথবা
লজ্জা নেই ওদের। সেইসব কণ্ঠস্বরে কখনো
কৌতুক, কখনো-বা ঝগড়া-প্রসূত
অগ্নিকণা ঝলসে ওঠে কোনো-কোনো কুটিরে,
কখনো-বা উলঙ্গ, বেয়াড়া উঠোনে।
বস্তির চেহারা কেবল নয়তো এমন। এখানে,
হ্যাঁ, এখানেও সূর্যোদয়ের আভা ছড়ায়
আনন্দধারা। সুনসান রাত্তিরে
যুবতীর স্তনের মতো চাঁদ জেগে থাকে আকাশে,
কখনো, কখনো দারিদ্র্যঘেরা কুটিরে
মধ্যরাতে মোটা মিহি কণ্ঠস্বর আন্ধারে প্রেম বটায়।
১০-১২-২০০৩
কতিপয় কঙ্কালের মুখোমুখি
জ্বলজ্বলে মধ্য-দুপুরে নদীর বুকে ইলিশের আচমকা
লাফিয়ে ওঠার মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি
হয়ে যায় কোনো কোনো স্মৃতি। সেই কাঙ্ক্ষিত আলো
আদর বুলোয় অস্তিত্বে, সুর হয়ে ঝরে, ভুলিয়ে দেয় হঠাৎ
নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে-পড়া মৃত্যুচিন্তা। বস্তুত
সুন্দরের বন্দনা-গীত রচনায় কাটে নানা প্রহর।
এই যে কখনো কখনো কোনো দুপুর, গোধূলিবেলা,
নিস্তব্ধ মধ্যরাতে খাতার পাতায় ঝুঁকে-থাকা নিষ্ক্রিয়
কলম হাতে, অথচ একটি পঙ্ক্তিও প্রস্ফুটিত নয়, তখন
তুমি কি দেখতে পাও কয়েকটি কঙ্কাল এসে দাঁড়িয়েছে
তোমার নির্ঘুম ঘরে? তোমার অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই
ওরা গরহাজির, অদৃশ্য চেয়ারে বসে পড়ে। ওদের বিকট,
নিঃশব্দ হাসি আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করে যেন ঘেন্না-ছড়ানো
অবহেলায়। আমাকে বিপন্ন দেখে অধিকতর কৌতুকপ্রবণ,
নিষ্ঠুর, করাত সরবরাহ করে অদৃশ্য অপশক্তি!
আতঙ্কিত নিরুপায় আমি প্রাণপণ চিৎকার করতে গিয়ে
মূক হয়ে থাকি, এদিক ওদিক তাকাই। উদ্ধারের বাণী নয়, কতিপয়
কঙ্কালের অট্রহাসি আমার ছোট ঘরটিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার
অভিলাষে আরো বেশি কট্রর, তুমুল হয়ে ওঠে। বেপরোয়া আমি
কঙ্কালদের তাণ্ডব থেকে মুক্তির আশা মহান কবিদের নানা
কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে ওদের ক্ষান্ত করতে গিয়ে আরো বেশি উপহাস্য,
বিড়ম্বিত হই। কঙ্কালেরা সেই সব কালজয়ী সৃষ্টিকে দূরে ছুড়ে
ফেলে মেদমাংসচর্মহীন পদতলে চটকাতে চটকাতে মাটিতে
মিশিয়ে দেয়। দু হাতে মুখ ঢেকে গোরস্তানের নৈশ স্তব্ধতায়
স্তম্ভিত, ভীত, সন্ত্রস্ত আমি নির্জ্ঞান হয়ে যাই।
১০-১০-২০০২