ইতিহাসের পাতা থেকে
এই যে তুমি, এই যে আমি
ঘুটঘুটি এই অন্ধকারে যাচ্ছি হেঁটে,
জানি না তো কোন্ বিপদে।
আমাদের এই কাফেলাটি কোথায় গেলে
স্বস্তি পাবে? শান্তি পাবে কোন্ ছায়াতে?
পৌঁছলে কোথায় ফুটবে হাসি সবার মুখে?
এখানো তো মাথায়, বুকে, সবার চোখে
ভয়-জাগানো দৃশ্যাবলি কামড়ে ধরে
ঐ তো ছুরি বসছে গলায়, নারীর শাড়ি
নরপশু হ্যাঁচকা টানে ফেলছে খুলে।
আর্তনাদে যাচ্ছে ফেটে সাঁঝের ছায়া,
গাছের সবুজ চোখে ঝরে লালচে পানি।
আমরা ক’জন কোন্ সে কালে ঘুটঘুটে এক
অন্ধকারে পেরুচ্ছিলাম বুনো রাস্তা?
আমাদের সেই কাফেলাটি কোন্ পশুদের
দংশনে, হায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো?
আখের এই আমরা সবাই অস্ত্র দিয়ে
বদলা নিয়ে তাড়িয়ে দিলাম পশুর পাল্কে।
১৭-০৯-২০০৩
এই রীতি রয়ে যাবে
প্রত্যুষের আলোছায়াময় কালে চোখ খুলে
তাকালেই কখনো কখনো
চেনা পরিবেশ কেমন যে বেয়াড়া বেগানা খুব
মনে হয়, বোঝানো যাবে না কিছুতেই।
চতুর্দিকে সাজানো, গোছানো আসবাব,
পড়ার টেবিল আর শেল্ফে রক্ষিত
সারি সারি বইপত্র, দেয়ালে ঝোলানো ছবি-এই
সব কিছু কেমন বেগানা মনে হয়।
যে-নারী আমার পাশে ঘুমে অচেতন, কে সে? তাকে
বেজায় অচেনা মনে হয়। এই আমি
বয়সের ভারে বড় অপদস্থ, সে-ও নয় চেনা সুনিশ্চিত
তার কাছে, অথচ দু’জন ক্রমাগত করে যাচ্ছি বসবাস।
এই যে রঙিন পাখি বহুদিন পর এসে বারান্দায় ব’সে
তাকাচ্ছে আমার দিকে, সে-কি এই
লোকটিকে প্রকৃত নিরীহ ভেবে নিরাপদ বোধ
করে বাস্তবিক? করে সম্ভবত, নইলে সে নিশ্চিত উধাও
হয়ে যেতো পাখা
ঝাপ্টিয়ে কে জানে কতদূর কোন্ শান্ত ঠিকানায়।
পাখিটির সুকোমল উপস্থিতি, আমার বিনীত
ঘরঘেঁষা ফুলের গাছের মৃদু নাচ আংশিক ভুলিয়ে দেয়
বিষাদের অন্ধকার। ঈষৎ আলোর মৃদু চুমো
আমাকে ফিরিয়ে আনে অন্ধকূপ থেকে সুগভীর নদীতীরে।
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে মহিমায় ভরপুর
রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে এসে
আলিঙ্গন করলো আমাকে, আমি সেই
কথা আর সুরে রূপান্তরে অন্য কেউ হয়ে যেন
নিমেষে আনন্দলোকে চলে যাই, ভেসে
বেড়াই মেঘের সঙ্গীরূপে।
আমার শয্যায় এখনো যে-নারী ঘুমে অচেতন,
এখনো কি সে অচেনা আমার, এখনো
যখন আঁধার থেকে আলোয় নন্দিত খুব আমি?
জীবন সঙ্গিনী সে আমার। তবু কেন একটি সোনালি হাত
এখনো আমার দিকে প্রায়শ এগিয়ে আসে আর
কখনো কখনো করে আলিঙ্গন দিব্যি অগোচরে?
অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষণ্নতা, আনন্দের আলোচ্ছেটা-
দু’টি হেঁটে যায় পাশাপাশি যমজ বোনের মতো
সকল ঋতুতে দু’টিকেই চুম্বন না
ক’রে বুকে না জড়িয়ে পৃথিবীর খোলা পথে সত্যি এগোবার
জো নেই-এ কথা বলে গেছেন অভিজ্ঞ গুণীজন যুগে যুগে,-
এই রীতি রয়ে যাবে যতদিন আসমানে চন্দ্র, সূর্য আছে।
১৯-১১-২০০৩
একজন ঈগলের কথা
বয়সের ভারে জব্দ একজন প্রবীণ ঈগল
গাছের চূড়ায় ব’সে ঝিমোতে ঝিমোতে মাঝে মাঝে
বড় কষ্টে আকাশের নীলে আলগোছে
তাকাচ্ছিলো। কয়েকটি শঙ্খচিল পাখায় ছড়িয়ে
আনন্দ সেখানে উড়ছিলো কাছে ধারে;
মনে হলো, কোথাও অজানা দূরে পৌঁছুনোর সাধ
জন্মেনি ওদের মনে কস্মিনকালেও। এভাবেই
প্রথামতো কাটছিলো দিনরাত পাখির সমাজে।
বয়সী, অসুস্থ ঈগলের মনে অকস্মাৎ কী-যে
ঢেউ খেলে গেলো,
সে তার দুর্বল দু’টি পাখাকে ঝাঁকুনি দিয়ে নীল
আকাশের দিকে মেলে ধরে
এবং মেঘের স্তরে স্তরে ভেসে যেতে থাকে, যেন
গুণীর কণ্ঠের সুললিত তান কোনো মশগুল দরবারে।
ক্রমাগত বেলা বাড়ে, রোদ্দুরের তাপে
ঈগলের ডানা
কেমন ঝলসে যেতে থাকে যেন, তবু পাখিটির
নিজ আস্তানায় ফিরে যাওয়ার তাগিদ
কাঁটা হয়ে বিঁধছে না ওকে। ওড়ার নেশায় তার
ডানা দু’টি বেজায় চঞ্চল, বড় বেশি উড্ডয়নপ্রিয় আজ।
আচানক কী-যে হলো, বুড়ো সেই উড়ন্ত ঈগল ঘুরে ঘুরে
প্রবীণ গাছের নীচে পড়ে যায়। বেশ কিছু পরে
নিষ্প্রাণ ঈগলটিকে পশু, পাখি পিঁপড়ে
ঠুকড়ে ঠুকড়ে, খুঁটে খুঁটে কী দ্রুত সাবাড় করে ফেলে।
সন্ধ্যায় প্রাচীন গাছে শোকের কুয়াশা জমে ওঠে
ব’লে মনে হয়, পক্ষীসমাজ নিস্তব্ধ অতিশয়,
এমনকি বুড়োসুড়ো গাছটি নুয়ে
পড়েছে নিষাদে যেন। বাতাসে কান্নার ছায়া দোলে।
কেন যেন মনে হলো কোত্থেকে প্রবীণ একজন
ঈগল উৎসুক ডানা দু’টি ঝাপটাতে ঝাপটাতে
জ্যোৎস্নাময় মেঘদলে অনুপম ছন্দে ঘুরে ঘুরে
একলা উড়তে থাকে। ওকে যেন খুব চেনা মনে হয়।
৯-৯-২০০৩
একটি উপকথার খসড়া
শকুনটা ছিলো দশাসই আর ওর সাঙ্গাত
ছিল অন্য এক তাঁবেদার শকুন।
দু’টিতে এক জোট হয়ে হামলে পড়লো
দ্বীপবাসী তেজী, স্বাধীনচেতা এক ঈগলের ওপর।
অকারণ নয় এই উড়ে এসে জুড়ে বসে বিকট
হামলায় মেতে ওঠা। জেদি, অথচ
শান্তিপ্রিয় ঈগলের দখলে
বেশ ক’টি দুর্লভ মুক্তো আছে ব’লেই
শকুনদের উড়ে এসে জুড়ে বসার
বাসনা ছিল প্রবল। শকুনদ্বয় ঝাপ্টে, চঞ্চু চালিয়ে
ঈগলকে ক্ষতবিত ক’রে বনেদী,
দুর্লভ মুক্তোগুলোর দিকে লোভার্ত থাবা বাড়ায়।
দুই শেয়ানা শকুন এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের হামলা,
ক্রমাগত ঝাপ্টায় ঈগল এবং তার সহচরেরা চরম
পর্যুদস্ত হওয়ার আগে ওরা হঠাৎ
উধাও হলো ব’লে ধন্দে পড়ে অনেকে।
আক্রান্ত জেদি ঈগল জীবিত কি মৃত-সে এক গূঢ় রহস্য
হয়ে থাকে দ্বীপের বাসিন্দাদের নিকট।
১১-৪-২০০৩