শীতের পাতার মতো
আমি যে যুবক নই আর, পদে পদে বিলক্ষণ
টের পেয়ে যাই, তাই আয়নার মুখোমুখি হ’লে
নিজের চেহারা দেখে ভীষণ চমকে
উঠি, প্রশ্ন করি-
কে এই লোকটা? আজ এই ভোরবেলা
আমার শোবার ঘরে কী ভাবে প্রবেশ করেছে সে
কারো অনুমতি ছাড়া? যতদূর জানি, এ বাড়ির
কেউ তাকে এই ঘরে ঢোকার দেয়নি অনুমতি।
বুড়োসুড়ো এই লোক শীতের প্রতাপে
বড়ই কাতর, মনে হয়। মুখের চামড়া তার
ভীষণ কুঁকড়ে গেছে, মাথার ক্ষয়িষ্ণু চুল যেন এক রাশ
কাশফুল, চোখ দু’টি ঈষৎ নিষ্প্রভ। এই মাঘে
লোকটাকে, বাড়ির বাইরে তাড়ানো কি
মানবিক আচরণ? এই ঘর থেকে
বাড়ির আলাদা কোনও ঘরে বসানো উচিত হবে,
গরম চা আর এক বাটি মুড়ি দেয়া যেতে পারে।
এসব কী বলছি দাঁড়িয়ে আয়নার
সম্মুখে এমন হাড়-কাঁপানো শীতের ভোরবেলা? হায়, আমি
নিজেকেই অন্য কোনও লোক ভেবে নিয়ে এতক্ষণ
আবোল তাবোল বকে গেছি বাঘ-তাড়ানো মাঘের
হিমায়িত প্রভাতী প্রহরে। কম্পমান আমি শীতের দংশনে
এবং চকিতে চিন্তা ধাবমান দুঃখিনী বাংলার
দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এলাকায় যেখানে মানব, মানবীর প্রাণ
শীতের পাতার মতো ঝরে যায় বনি আদমের অগোচরে!
সহস্র ক্ষুধার্ত চোখ-মুখ
এমন একটা সময় ছিল, যখন
প্রায়শই সকালে অথবা বিকেলে
নদীতীরে হেঁটে বেড়াতাম কিংবা আয়েশে
বসতাম একা। বহুদিন থেকে হঠাৎ
সেই প্রিয় অভ্যাস কেন যে আমাকে
ত্যাগ করেছে, বুঝতেই পারিনি।
এখন আমি ছোট ঘরের এক কোণে একলা
বসে থাকি। আলসেমির এভাবে
কত যে বেলা আমাকে ছুঁয়ে কোথায়
মিলিয়ে যায়, বুঝতে পারি না কিছুতে।
বিকেলে দেখি, আমার ঘরের কিনারে
এক নিঝুম জলাশয়ে কতিপয় হরিণ
মুখ ডুবিয়ে জলপানে মগ্ন এবং খানিক
পরে এদিক সেদিক গোয়েন্দার মতো তাকায়।
আচমকা সেই দৃশ্য মুছে গিয়ে দৃষ্টিতে
ফুটে ওঠে কজন বাউলের আসর
এবং লালনের গান চৌদিকে, উৎসুক আকাশে
ছেয়ে যায় এবং একতারা সুর ঝরায়-
সেই সুরে বাউল নর্তক হয়, জ্যোৎস্না নর্তকী। দিগন্তে হঠাৎ
মঙ্গা সহস্র চোখ-মুখ হয়ে বানবতাকে শাসায়!
১০-১২-২০০৩
সানন্দে সাঁতার কাটে কয়েকটি হাঁস
আমাকে পেছনে টেনে নিতে
চায় কারো? রাতে না ঘুমিয়ে ভোরবেলা
সামনে এগিয়ে যেতে না যেতেই, এ কি!
হঠাৎ পেছন থেকে কারা যেন টেনে
ধরে খুব জোড়ে মুখ থুবড়ে পড়ার
নির্ঘাৎ আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়া ভার।
পেছনের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই দ্রুত
হেঁটে যেতে থাকি সামনের দিকে। বিদঘুটে কিছু
শব্দ কানে আসে ক্রমাগত, যেন সেই
আওয়াজ ভীষণ হিংস্র কুকুরের মতো
কামড়াতে বেজায় মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি চোখে
রোদমাখা শূন্যে শত তারা দেখে ফেলি!
হাঁপাতে হাঁপাতে এক জলাশয়ের নিকটে এসে
যেন স্বস্তি পাই আর এসে পড়ি ঢের পাতাময়
একটি গাছের নিচে। প্রায়
ঘুমের নিঝুম আলিঙ্গনে আত্মসমর্পণ করে
অতিদূর মেঘে ভেসে যেতে থাকি আর
অপরূপ ক’টি পাখি কী মধুর গান গেয়ে যায়।
কিন্তু এ কী? আমিতো দাঁড়িয়ে আছি ঠিক
আগের জায়গাতেই। নড়িনি, চড়িনি
এক চুলও, ছুটে আমি যাইনি কোথাও।
ভোরবেলাকার সেই একই দৃশ্যাবলি
প্রস্ফুটিত, ছলছলমান হ্রদের রুপালি জলে
সানন্দে সাঁতার কাটে কয়েকটি হাঁস উপদ্রবহীনতায়।
সেই কাঙ্ক্ষিত সংবাদ
দিন, মাস, বছরের পর বছর লোকটা
মন দিয়ে পড়ছে খবরের কাগজ। প্রতিটি খবর
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছে এক বিশেষ
সংবাদের জন্যে। তন্নতন্ন ক’রে খুঁজেও
তার আশা পূর্ণ হচ্ছে না
কিছুতেই। খুঁজছে, তবু খুঁজছে।
আকাঙ্ক্ষিত খবরটি খুঁজতে খুঁজতে সন্ধানী
লোকটির সব কালো চুল শাদা হয়ে গেছে এবং
চশমার কাচ পুরু থেকে পুরুতর হচ্ছে, অথচ
কিছুতে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না
যা দেখার, পড়ার জন্যে তন্নতন্ন ক’রে খুঁজছে
প্রতিটি পাতা, ঘোর অমাবস্যায় সে খুঁজছে পূর্ণিমা।
খবরের কাগজের স্তূপে লোকটা
প্রায় ডুবে যাচ্ছে, তবু নিভে-আসা চোখের
মৃদু আলোয় ভেসে উঠছে না কাঙ্ক্ষিত সংবাদ,
তবু সে খুঁজছে, খুঁজতে থাকবে সর্বদা।
কয়েক অমাবস্যার পর এক পূর্ণিমায় প্রতিটি
শহর ও গ্রাম ঝলসে উঠলো অপরূপ মুক্তির
আলোয়। প্রতিটি সংবাদপত্রে ইয়া বড় হরফে মুদ্রিত
হলো সেই সংবাদ সেই অনুসন্ধানী লোকটি অনুপস্থিত এখন।
১২-১১-২০০৩
হেঁটে যেতে যেতে
বাঁকাচোরা পথে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো যেন
আকস্মাৎ আকাশ চৌচির
হয়ে গেলে নক্ষত্রেরা মাটিতে লুটোয়,-
সেগুলো কুড়িয়ে নিতে শিশু,
বুড়ো, যুবা যুবতী সবারই
বড় সাধ হয়। এমনকি
ভিখিরীরা নিজ নিজ কোচর ভরার
প্রতিযোগিতায় খুব দড় হয়ে ওঠে-
এই চিত্র ভাসমান দৃষ্টিতে আমার। পথ যেন
হঠাৎ সরিয়ে নিলো কেউ।
সেই দৃশ্য মুছে গেলে বাড়ির দিকেই যেতে চাই
এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে ক্লান্ত হই;
বাড়ির পথ কি তবে স্মরণের আলো থেকে দূরে,
বহুদূরে অজানায় নিশ্চিহ্ন এখন?
তাহলে কী হবে এই বড় ছন্নছাড়া,
বিপন্ন আমার? পথ, করুণায় প্রস্ফুটিত হও।
ক্রমাগত হেঁটে চলি, খুঁজে ফিরি নিজের অভীষ্ট
নিকেতন, ব্যর্থতা ভীষণ পীড়া দেয়। পথে পাই
কেবল বধির, মূক পথচারী। তারা
নয় কোনও সহায় আমার। হাঁটি, হাটি,
শুধু হাঁটি, ক্লান্তির কুয়াশা গিলে খায়, চক্ষুদ্বয়
বন্ধ হয়ে আসে, তবু ঝুঁকে, কেঁপে কেঁপে পথ চলি।
১৮-৪-২০০৩